স্বপ্ন
মোঃ তোফায়েল হোসেন
গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে আমার উপর। আমাকে নাকি গভীর রাতে মুমিনার ঘর থেকে বেরুতে দেখেছেন তাদের বাড়িওয়ালা। কিন্তু মুমিনা বিষয়টা অস্বীকার গেলেও তার বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক আমার কাছে এসে অভিযোগটা পেশ করে গেলেন- মনে রাখবেন, মেয়েটা পেয়িং গেস্ট হিসেবে এখানে থাকলেও সে আমার স্ত্রীর দূর সম্পর্কের আত্নীয়। এখানে আমাদের ইজ্জত সম্মানের প্রশ্ন আছে।
কিন্তু আমার তো ওখানে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে এটা সত্যি যে ইদানিং আমি বিক্ষিপ্ত মূল্যহীন স্বপ্ন দেখছি, যেমন গত রাতে দেখেছিলাম- আমি মুমিনার সাথে তার রুমে বসে আছি। কিন্তু সেটা তো নিচক একটা স্বপ্ন ছিল।
নিঃসঙ্গ মানুষ আমি। একটা কোম্পানীতে চাকুরী করি বিধায় এ শহরে ভাড়া থাকতে হয়। মুমিনা যে বাসায় থাকে তার পাশের বাসার চিলেকোঠা ভাড়া নিয়ে সেখানে বাস করছি প্রায় দু’বছর যাবত। সেরকম অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু তো এ পর্যন্ত হয়নি। অর্থের প্রাচুর্যে ডুবে থাকা মানুষদের মধ্যে আমার মত অর্থহীন ছন্নছাড়া মানুষ তো এমনিতেই মূল্যহীন। তবে আমি মুগ্ধ হতাম রূপসীদের দেখলে। স্বপ্নের জগতে যে সেই রূপসীদের সাথে প্রেম প্রেম খেলা খেলতাম না সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে।
স্বপ্নরা জ্বালাতন করছে অনেক আগে থেকেই। প্রায় প্রতি রাতেই ভিত্তিহীন স্বপ্নরা এসে ভিড় করতো চোখের পাতায়। স্বপ্নের জ্বালায় কিছু রাত তো নির্ঘুম থাকতে হতো। কিন্তু এ পর্যায়ে এসে যা হচ্ছে তা তো হেলায় ফেলে রাখা যায় না।
সন্ধ্যায় একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করলাম। ভদ্রলোককে পুরো বিষয়টা বিস্তারিতভাবে বললাম। তিনি খুব আন্তরিকতার সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিছু ঔষধ লিখে দিয়ে তারপর বললেন- কোন সমস্যা নেই। আপনি পুরোপুরি স্বাভাবিক আছেন। শুধু টেনশন একটু কম করবেন। আর এটা মনে রাখবেন, আবেগের বয়স আপনার আর নেই। তাই আবেগময় ভালোবাসা থেকে যতটা পারেন নিজেকে দূরে রাখবেন।
কিন্তু রাত এলেই আমার মাঝে কি যেন একটা ভর করে। অশান্তিতে ভোগী। শরীরের মাঝে আলাদা একটা অনুভূতির জন্ম হয়। আর তাকে উস্কে দেয় এলোমেলো কিছু রোমান্টিক স্বপ্ন।
ছয় দিন পর ভয়ংকর একটা জিনিস আবিস্কার করলাম। শরীরটা খুব ক্লান্ত ছিল বিধায় নির্ধারিত সময়ের একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সে রাতে। ঘুমটা আসতেই স্বপ্ন এলো। দেখলাম- একটা গহীন অরণ্যের মাঝে আমি আর মুমিনা হাতে হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ করেই একটা বিশাল মাকড়সার জালে আমি জড়িয়ে গেলাম। আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম জাল ছিড়ে বেরুতে। কিন্তু কিছুতেই পারছিলাম না। মুমিনা চেয়ে চেয়ে দেখল শুধু। তারপর ছুটে পালাল দ্রুতগতিতে। ভেঙ্গে গেল ঘুম। বিশ্রী অবস্থা। ঘামে ভিজে গেছে সারাটা শরীর, এমনকি বিছানাও।
ফ্যানটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। এবার ঘুমটা এলো অনেক পরে। কিন্তু স্বপ্ন আসতে একটুও দেরী করলো না। দ্বিতীয় অংশের মত আগের স্বপ্নটার সমাপ্তি থেকেই এ স্বপ্নটার সূচনা হলো। দেখলাম- মুমিনা ফিরে এসেছে হাতে একটা পিস্তল নিয়ে। ততক্ষণে মাকড়সাটা আমার গলায় দাত বসাতে প্রস্তুত। এমন সময় মুমিনা গুলি করলো মাকড়সাটাকে। ছিটকে পড়ে গেল মাকড়সাটা। সাথে সাথে একটা জ্বালা অনুভব করলাম গলার যেখানটায় মাকড়সাটা বসেছিল সেখানটায়। হাত দিতেই দেখলাম হাত রক্তে লাল। সম্ভবত গুলিটা আমার গলার চামড়া ছুঁয়ে দিয়ে গেছে। মুমিনা এসে আমাকে মাকড়সার জাল থেকে বেরুতে সাহয্য করলো। কিন্তু কিছুতেই জালটা ছেড়া সম্ভব হচ্ছে না। এমন সময় আবারও ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানায় বসে থেকেই জিরো পাওয়ারের বাল্বের হালকা আলোয় আকস্মিকভাবে আবিস্কার করলাম আমার হাতের তালুতে লাল রক্ত। গলায় হাত চলে গেল দ্রুত- চমকে উঠলাম; আঠা আঠা কি যেন লাগছে হাতে। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝলাম- ওটা একটা মশা ছিল।
রাত দ্বি-প্রহর পেরিয়ে গেছে। ঘরময় কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর আবার শুয়ে পড়লাম। ভোরের ক্ষণিক আগে আবার ঘুম আসলো চোখের পাতা ভারি করে। আর কিছুক্ষণ পরেই স্বপ্নে ভর করে নিজেকে আবিস্কার করলাম মুমিনার সাথে তার রুমে। যখন তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম তখন ভোরের আলো ফোটতে শুরু করেছে। ফাকা রাস্তায় একা একাই ফিরছি নিজের বাসার দিকে। এমন সময় হঠাৎ করেই ম্যানহুলের ঢাকনায় পা বেঁধে হোচট খেয়ে পড়ে গেলাম।
যেন আমি হাওয়ায় ভেসে চলছিলাম এতক্ষণ। যেন আমার মাঝে আমি ছিলাম না, ছিল অন্য কেউ। চিমটি কাটলাম ডান হাত দিয়ে বাম হাতে। ব্যথা পেয়ে বুঝলাম সব ঠিক আছে। আবিস্কার করলাম, ভয়ংকর অনুভূতি নিয়ে স্পষ্ট সত্যি এই আমি- জাগ্রত, পিচ ঢালা রাস্তায় দাড়িয়ে আছি ভোরের মায়াবী আলোয়।
বিকেল হতেই দৌড়ালাম সেই ডাক্তারের চেম্বারে। উনি মুছকি হেসে বললেন- মেয়েটাকে কি আপনি খুব ভালোবাসেন? আমি সত্যি কথাটাই বললাম- হ্যাঁ। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন- তাকে নিয়ে কি খুব বেশি ভাবেন? বললাম- হ্যাঁ, ভাবি তো; তাই বলে কি আমি স্বপ্নের মাঝে হেটে চলে যাব তার রুমে- এ কি করে সম্ভব?
তিনি কিছু ঔষধ পরিবর্তন করে দিয়ে বললেন- এ ব্যাপারে একটুও টেনশন না করে ছুটি নিয়ে একটু ঘুরে আসুন কোথাও। দেখবেন ফিরে আসলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আর বয়স তো কম হলো না, এবার যদি সম্ভব হয় একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে ফেলুন।
উনি টেনশন করতে বারণ করলেও নিজেকে টেনশন মুক্ত করতে পারলাম না। কি হচ্ছে এসব আমার সাথে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কি করা উচিত তাও বুঝে আসছে না। শেষে ডাক্তারের প্রথম পরামর্শটা মানার সিদ্ধান্তই নিলাম। কিন্তু তা আর হলো না। সে রাতেই আমি আবার স্বপ্নের কাছে পরাজিত হলাম। রাত দ্বি-প্রহরে আমাকে আবিস্কার করা হলো মুমিনার ঘরে। কিভাবে গিয়েছিলাম ওখানে জানি না তবে যখন ধরা পড়লাম তখনি হুশ ফিরে এলো। মুমিনার বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক মাথা গরম মানুষ। চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দিলেন। মুমিনাকেও ছাড়লেন না। শেষে হঠাৎ করেই থেমে গিয়ে মুচকি হেসে উঠলেন কি যেন একটা ভেবে। আমার নাকের ডগায় মুখ নিয়ে বললেন- তুমি কি মুমিনাকে ভালোবাস? আমার অজান্তেই সাহসী মনটা উত্তর দিল- হ্যাঁ। কথাটা শুনে তিনি কিছুক্ষণ ভাবলেন। অতঃপর বললেন- তুমি কি জানো তার আপনজন বলে কেউ নেই। আমি না সূচক মাথা নাড়লাম। সত্যি বিষয়টা আমি জানতাম না।
এবার বলো তো তোমাকে যে যুবতী মুমিনার ঘর থেকে আবিস্কার করা হলো- তার কি বলবে? যা হয়েছে তা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না তাই আমি ভাষাহীন রইলাম। ভদ্রলোক বললেন- কোন উত্তর নেই তোমার কাছে; তাই না! তো এবার কাজী ডাকি আর নিজেকে উদ্ধার করি। এ ব্যাপারে কিছু বলার আছে তোমার?
আমার বলার কিছুই নেই তবে মুমিনার চোখের ভাষায়- তারা ঝিলমিল। ডাক্তার ভদ্রলোকের বলা- “বয়স তো কম হলো না, এবার যদি সম্ভব হয় একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে ফেলুন।” কথাটা মনে উকি দিল। হউক না- যা হয়। হয়তো ছুটি নিয়ে ঘুরে আসার সিদ্ধান্তটা মুমিনা আর আমি দু’জন মিলেই পূরণ করবো সাগরপাড়ের নির্জন কোন অরণ্য ঘেরা বাংলোয় আর সৈকতের বালিতে মুমিনার চোখে চোখ রেখে- দু’জন দু’জনকে ভালোবেসে।
***
রচনাকাল : ৪/৯/২০২০
© কিশলয় এবং মোঃ তোফায়েল হোসেন কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।