গল্পটা শুরু হয় বেশ কয়েক বছর আগে। আমি, রোশনি আর সিদ্ধার্থ। আমি দেবমাল্য। আমরা ছোট থেকে একসাথে একই স্কুলে এবং একই কলেজেও পড়েছি। এখন কাজের সূত্রে ওদের থেকে আলাদা হয়েছি। ওরাও ব্যাস্ত থাকে।
স্কুল লাইফ থেকেই আমি রোশনি কে ভালোবাসতাম। তখন যদিও বুঝতাম না ওই অদ্ভুত অনুভূতিটাকেই ভালোবাসা বলে। কিন্তু যখন বুঝলাম তার পরেও কোনোদিন ওকে কিছু বলার সাহস জোগাতে পারিনি। কলেজে তখন ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা চলছে। শেষ পরীক্ষার দিন সিদ্ধার্থ আমায় বলল,
-ভাই বুঝলি এবার বলতেই হবে। নাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।
-কাকে কি বলবি?
-আরে, রোশনি কে ভালোবাসার কথাটা বলতে হবে তো নাকি।
-কাকে আমায় বললি??
-হ্যাঁরে, তোকেই বললাম।
-তু.......তু...ই....তুই বুঝে গেছিলি নাকি?
-কেনো না বোঝার কি আছে। চল আজই ওর কাছে গিয়ে সব বলতে হবে।
-সত্যি? সত্যি বলছিস তুই??
-হ্যাঁরে, সত্যি।
-তুই বলবি না আমি বলব?
-তুই পারিস নাকি এসব? আমি বলব।
ইতিমধ্যেই পরীক্ষা শেষের শেষ ঘন্টা পড়লো। রোশনি বেরোতেই সিদ্ধার্থ ওর দিকে এগিয়ে গেলো।
- রোশনি বলছিলাম কি, তোর সাথে একটু কথা আছে।
- কি কথা বল না।
- না মানে, বলছিলাম কি যে আমি আজ দেবা কে বলছিলাম........
- হ্যাঁ বল কি বলছিলি?
- মানে বলছিলাম........
দেবমাল্যর পাশে এসে,
-ভাই, বলে দেবো? কেমন যেনো লাগছে। তারপর যদি আমাদের কারোর সাথেই কথা না বলে।
- তুই বল তাড়াতাড়ি, আমার তর সইছে না।
- আচ্ছা বলছি। চোখ বন্ধ করে বলি?
- তাই বল কিন্তু বল প্লিজ।
ওদিক থেকে রোশনি চিৎকার করছে। আর মিটিমিটি হাসছে।
- তোদের কি কথা শেষ হলো? কি বলবি বল না তাড়াতাড়ি।
আমি বললাম, 'ভাই দেখ হাসছে মনে হয় সব বুঝে গেছে। আমি পালাই আমি পারব না।'
- তুই পালাবি? তাহলে আমি কেনো বলব? বলব না আমি।
- আমার খুব নার্ভাস লাগছে। আচ্ছা যা তুই এবার।
রোশনি এবার এসে আমার পাশে দাঁড়াল। আমার গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে।
-কি ব্যাপার কি তোদের? এরকম অদ্ভুত আচরণ করছিস কেনো?
সিদ্ধার্থ এবার বললো,
-বলছিলাম যে, আমি..... আমি...বলতে চাইছিলাম
যে, তোকে... তোকে....
-আমায় কি বল...
-ভালোবাসি। আমি তোকে খুব ভালোবাসি সেই স্কুল লাইফ থেকে।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। একি বলল সিদ্ধার্থ ও তো আমার কথা বলবে বলল।
- আমি দেবমাল্য কে বলছিলাম আজ তোকে বলবোই।
- তা ভালোই করেছি নাহলে আবার আমায় বলতে হতো।
- মানে.....মানে.....
- মানে মানে কি করছিস। কিছুই বুঝিস না বল। বুদ্ধুরাম। আমিও তোকে ভালোবাসি স্কুল লাইফ থেকে।
আমার বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠলো। কিন্তু সত্যি তো সিদ্ধার্থ একবারের জন্য বলেনি ও আমার ভালোবাসার কথা রোশনি কে বলবে। আমার বুঝতে ভুল হয়ে গেছে।
এরপর অনেকদিন কেটে গেলো লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম।ভিতরটা যন্ত্রণায় ফেটে যেতো। পাগল পাগল লাগতো। কিছুই ভালো লাগতো না।
তারপর একদিন ভাবলাম এভাবে চলবে না। আর কতদিন এভাবে। ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে সেখানে আমি তৃতীয় ব্যাক্তি।নিজের জীবনটা আমায় নিজেকেই গুছিয়ে নিতে হবে। একটা চাকরি জোগাড় করলাম আর সেদিকে পুরো মনোনিবেশ করলাম।
এভাবে বেশ একটা বছর কেটে গেলো। ওদের সাথে এখন ফোনেই যোগাযোগ কাজের চাপে একদম সময় দিতে পারি না ওদের। এভাবে আরও তিন বছর কেটে গেলো। ওদের সাথে বেশ কয়েক বার দেখা হয়েছে। রোশনির জন্য ভালোবাসাটা একই আছে তবে আজকাল আর ভাবি না তাই কষ্টতাও কম হয়।সিদ্ধার্থ চাকরি পেয়ে গেছে আর রোশনি তখনও পড়াশোনা করছে।
এরপর একদিন হঠাৎ দরজার কলিংবেল বেজে উঠলো। আমি সেদিন ছুটি নিয়ে বাড়িতে। দরজা খুলতেই দেখি রোশনি আর সিদ্ধার্থ।
-কি রে তোরা? what a pleasant surprise..!!! আয় আয় ভিতরে আয়।
- তোর জন্য আরও একটা সারপ্রাইজ আছে।
- তাই নাকি?? তা কি শুনি।
- পরের মাসে আমারা বিয়ে করছি।
- এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করবি??
- আসলে আমি চাইছিলাম রোশনি পড়াশোনাটা শেষ করে নিতো তারপর বিয়ে। কিন্তু দুজনের বাড়ি থেকেই বলছে চাকরি যখন পেয়ে গেছি বিয়ে করে সেটেল হয়ে নিতে। রোশনি বিয়ের পরে পড়াশুনা করবে।
- আচ্ছা তা বেশ। চা খাবি তো তোরা?? আর কি খাবি বল? এসেছিস যখন লাঞ্চ করে যাস। কতদিন পর এলি এত সহজে ছাড়ব না তোদের।
- আচ্ছা রে। খেয়েই যাব। তুই আজ বাড়ি আছিস বলেই এলাম। কাকিমাকে ফোন করেছিলাম যে তুই আজ বাড়ি থাকবি কি না। তাই তোকে সারপ্রাইজ দিতে চলে এলাম।
- তাই নাকি। তা বেশ বেশ। তোরা বস।আমি চা বানিয়ে আনছি।
হঠাৎ দরজায় কলিংবেল। মা দরজা খুলে দিতে গেলো।
- ওমা তোরা!!!!!! বিদেশ থেকে ফিরলি কবে? কেমন আছিস সব?
- এই তো ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
- আমি ভালো আছি। আয় আয় বাইরে কেনো দাঁড়িয়ে ভিতরে আয়।
মেয়েটা আমার কাছে এলো আমার দিকে তাকিয়ে বললো কেন হলো এসব কেনো? তারপর আমার সামনে অঝরে কাঁদতে লাগলো আর বলতে লাগলো কেনো বুঝতে পারলাম না আমি আগে কেনো বুঝলাম না?? কিন্তু আমি নিরুপায় যাকে ভালোবাসি তার চোখে আমারই জন্য জল আর সেই জল আমি হাত দিয়ে মুছিয়ে দিতে পারছি না।কারণ?......কারণ আমি এখন দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবি মাত্র। হ্যাঁ, এটাই সত্যি। আমি নেই, আমি আর নেই। আর ওই মেয়েটা যে এখনি আমার সামনে কান্নাকাটি করলো সেটা রোশনি।
এর আগে সেই দিনটায় ফিরে যাই যেদিন আমি ওদের জন্য চা বানাতে যাই। ওরা সেদিন দুপুরের খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরে যায়। পরদিন আমায় রোশনি ফোন করে বলে,
-শপিং করতে যাবো তুইও চল।
-বললাম ছুটি নেই রে।
-দেখ না রে ম্যানেজ করতে পারিস কিনা।
-আচ্ছা ঠিক আছে দেখছি।
সেদিন আমি, রোশনি আর সিদ্ধার্থ শপিং করতে যাই। শপিং থেকে ফেরার পথে রোশনির ধাক্কা লাগে একটা বাইকের সাথে ও ছিটকে গিয়ে মাঝ রাস্তায় পড়ে। ওই..... ওই একটা বাস আসছে।আমি দৌড়ে যাই রোশনি তুলে ঠেলে সরিয়ে দেই কিন্তু আমি.........আমায় জড়িয়ে ধরে সেদিন রোশনির সেই আর্তনাদ আর কান্নার সে শব্দ আজও আমি স্পষ্ট মনে করতে পারি।
আমার ডায়েরিটা সাথে নিয়ে রোশনি বিদেশে চলে যায় পড়াশোনা করতে। হ্যাঁ, আমি চলে যাওয়ার পর আমার ডায়রিটা রোশনি খুঁজে পায় আমার বইয়ের টেবিলের ড্রয়ার থেকে। রোশনি সবটা জানতে পেরে যায়। তারপর আর বিয়ে করেনি সিদ্ধার্থকে।
আর সিদ্ধার্থকে বিয়ের জন্য রাজি করায় রোশনি। সিদ্ধার্থ বিয়ে করে তনুশ্রীকে। তনুশ্রী আমাদের কলেজের জুনিয়র। ওদের একটা মেয়েও আছে।নাম আর্শিয়া।
রোশনি আজও আমায় রোজ জিজ্ঞেস করে.... -ভালোবাসতিস যখন বললি না কেনো, আর কেনোই বা একা করে রেখে চলে গেলি?
- ওরে পাগলি, ভালোবাসতাম নয়। আজও ভালোবাসি। আর বলার কথা বলছিস, বললাম তো। শুধু একটু দেরি হয়ে গেলো রে।
রচনাকাল : ২/৯/২০২০
© কিশলয় এবং শ্রেয়সী বিশ্বাস কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।