নীল জ্যোৎস্না
আনুমানিক পঠন সময় : ৫ মিনিট

লেখক : মোঃ তোফায়েল হোসেন
দেশ : Bangladesh , শহর : Moulvibazar

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , আগষ্ট
প্রকাশিত ২৮ টি লেখনী ৩২ টি দেশ ব্যাপী ১৪৪৮২ জন পড়েছেন।
নীল জ্যোৎস্না
মোঃ তোফায়েল হোসেন

যদিও নিজের প্রতি কনফিডেন্সের কোন অভাব নেই তবুও ট্রেনে উঠে নিজের সিটে বসতে গিয়ে শীতল একটা শিহরণ সমস্ত শরীর নাড়িয়ে দিল। কামরার মধ্যখানের মুখোমুখি চার সিটের জানালার পাশের একটা সিট আমার। সিটটা খালিই কিন্তু বাকি তিন সিটে বসে আছে তিন সুন্দরী। নিজের শিহরণ নিজের মাঝে লুকিয়ে রেখেই বসে পড়লাম। 

যদিও তাদের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী তা নির্ধারণ করা খুব কঠিন তবুও আমার পাশে বসা মেয়াটাকেই বেশি আকর্ষণিয় মনে হলো। কেমন যেন একটা চুম্বকীয় শক্তি তার মাঝে বিরাজমান। হাতে “মৌচাকে ঢিল" নামের ম্যাগাজিনের ফেব্রুয়ারী ২০১৪ সংখ্যা। গলা লম্বা করে দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম আপনমনে পড়ে যাচ্ছে আমারই লেখা “ফেরারী প্রেম” গল্পটা। আলাদা একটা অনুভূতি ছুঁয়ে গেল আমার সমস্ত অস্তিত্বকে।

ক্ষণিক পরেই তার কন্ঠের ঝঙ্কার আমাকে আরও মুগ্ধতায় ডুবালো। সামনের সিটে বসা কানে ইয়ারফোন লাগানো মেয়েটাকে বলল- তিন্নি, এই গল্পটা পড়ে দেখ; অসাধারণ। 

তিন্নি হয়তো আপন মনে গানই শুনছে। তার কর্মে ব্যঘাত ঘটায় কিছুটা বিরক্তি নিয়ে ইশারায় পাশের জনকে দেখিয়ে বলল- ইরিনা, তোর অসাধারণ গল্পটা বরং লাভলীকে পড়া। কেন আমাকে বিরক্ত করিস! তুই তো জানিস আমি তোদের এসব জগতের বাসিন্দা নই।

লাভলী অবশ্য তার হাতের বইটা রেখে গল্পটা পড়লো। পড়া শেষে লেখককে প্রশংসায় ভিজিয়ে দিল হাস্যময়ী মেয়েটা। তাদের এই বাক্য বিনিময়ে নিজের অজান্তেই আমার জ্বর আসার লক্ষণ দেখা দিল। তারপর লাভলী আপন মনে বইয়ের জগতে হারিয়ে গেল আর ইরিনা আবার গল্পটা পড়তে লাগলো।

হঠাৎ খেয়াল করলাম ইরিনা গল্পটার নিচে দেয়া মোবাইল নাম্বারটা তার ফোনে উঠাচ্ছে। ক্ষণিক পর আমার সাইলেন্ট করা মোবাইলটা পকেটে নড়ে উঠলো। আমি চুপ করে বসে রইলাম। ইরিনা দুই বার ফোন দেওয়ার পর একটা এস.এম.এস পাঠালো। তারপর পুনরায় ডুবে গেল সেই “ফেরারী প্রেম” গল্পটায়। নিজেকে ধন্য মনে হলো- আমার সৃষ্টির প্রতি এই ইরিনা নামের অপরিচিত মেয়েটার সীমাহীন অনুরাগ দেখে।

লেখনীর প্রশংসায় পরিপূর্ণ ইরিনার পাঠানো ম্যাসেজটা পড়া শেষ করলাম। মুহূর্তকাল পরে ইরিনা পুনরায় ফোন দিল। এবার প্রকাশিত হলাম। আমার ফোনটা তাকে দেখিয়ে বললাম- আপনি মনে হয় আমাকেই ফোন দিচ্ছেন! আমি যেহেতু আপনার পাশেই বসে আছি সেহেতু সরাসরিই বলতে পারেন।

বিষ্ময় আর অবিশ্বাস খেলা করে গলে তার চেহারায়। সত্যতা যাচাই করে নিল সাথে সাথে। মুহূর্তের নোটিশে ইরিনার সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেল। রক্তিম আভা রাঙিয়ে দিল তার মায়াবী মুখ। বিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপন করতে ভাষাহীন ইরিনা ছুঁয়ে দিল আমার মধ্যমার প্রান্তভাগ।

পরিচয় হলো। লাভলীও আন্তরিকতার সাথে আমাদের সাথে যোগ দিল। কিন্তু ব্যতিক্রম তিন্নি। সুন্দরী মেয়েরা অহংকারী হয় এই শুনা কথাটা এখানে শুধুমাত্র তিন্নির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলো। সে দায়সারাভাবে দু’ একটি কথা বলেই চুপ হয়ে গেল। 

লাভলী আর ইরিনা আবেগ আপ্লুত। তাদের এই মনোভাব দেখে আমি আমাকে স্পষ্ট করলাম। জানালাম- আমি সে ধরনের কোন প্রতিষ্ঠিত লেখক নই। তবুও তারা মানতে রাজি নয়। লাভলীর অনুভূতির প্রকাশভঙ্গি রহস্যময় হলেও ইরিনার ভাষায়- “ফেরারী প্রেম” গল্পটা তার জীবনের পড়া শ্রেষ্ঠ গল্প!

হঠাৎ তিন্নিও আগ্রহী হলো। গল্পটা সে পড়তে চাইল। পড়া শেষে সরাসরি বিচার বিশ্লেষণ শুরু করলেও যবনিকা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তারপর সে আবার ইয়ারফোনটা কানে গুজে মোবাইলটা বুকের সমানে ধরে আনমনা হয়ে গেল।

একসময় লাভলী ক্লান্ত হয়ে বইমুখী হয়ে গেল। কিন্তু ইরিনা ধীরে ধীরে আরও ঘনিষ্ট হলো। গল্পে গল্পে ঢলে পড়লো আমার শরীরে, আমার অস্তিত্বে, আমার গল্প সৃষ্টির দোড়গোড়ায়। পবিত্র ছোঁয়া দিল আমার হাতে, বন্ধুত্বের স্পর্শ দিয়ে ছুঁয়ে দিল আমার হাতের আঙ্গুলের প্রতিটি জোড়া, প্রতিটি লোমকোপ।

ইরিনা তার পরিবার, তার লোকালয়, তার ভালোবাসার কথা বললো। জানালো- শ্রাবণের সাথে শীঘ্রই প্রণয় ঘটবে পারিবারিকভাবে। প্রধান অতিথির আসন আমকেই গ্রহণ করতে হবে বলেও বায়না ধরলো। আমি সম্মতি দিলাম অন্তরের অন্তরস্থল থেকে। 

আমরা পরস্পরের নিয়ে যখন ব্যস্ত তখন লাভলী ডু্বে আছে বইয়ের জগতে আর তিন্নি সেই আগের মতোই কানের মাধ্যমে গানের জগতে অর্ধেক আর বুকের সমান্তরালে ফোনটা দু’ হতে ধরে ফোনের জগতে অর্ধেক। তবুও কেন যেন একটা অস্বস্তি বারবার স্পর্শ করে যাচ্ছে আমায়। কি যেন একটা ধরা দিতে গিয়েও ধরা দেয়না এমন অনুভূতি।

দীর্ঘ সময় পর ট্রেন ত্যাগ করে পৃথিবীর পথে হারাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। তবে ইরিনা ফোন দিত প্রতিদিন। একদিন শ্রাবণের সাথেও কথা হলো। তারপর থেকে মাঝে মাঝে ইরিনা শ্রাবণের সাথে আমাকে কথা বলাতো। আমি শুভ কামনা করতাম দু’জনার জন্য।

মাসখানেক পর একদিন বিকেল বেলায় ইরিনা জানালো আজ তাদের প্রণয়ের সব কথাবার্তা শেষ হলো। আমি যেহেতু ঢাকায় আছি সেহেতু সন্ধ্যায় যদি তাকে আর শ্রাবণকে একটু সময় দেই তবে তারা খুব খুশি হবে। আমি দ্বিধাহীনভাবে সম্মতি দিলাম।

ঘন্টাখানেক পর ইরিনা আবার ফোন দিল। তার অস্থিরতা কন্ঠই জানিয়ে দিল। একটা ক্লিনিকের ঠিকানা দিয়ে বললো- দ্রুত যেন সেখানে আসি। আমি তার সমস্যার কথা জানতে চাইলে কিছু যান্ত্রিক ঘড়ঘড় শব্দের পর এক মহিলা কথা বললেন অন্য প্রান্ত হতে। বললেন- শ্রাবণ মারা গেছে!

আমার পৃথিবী দোলে উঠল। ছুটলাম ক্লিনিকে। গ্লাসের ওপার থেকে দেখলাম রক্তাক্ত শ্রাবণ শুয়ে আছে অচেতন। জানলাম এখনো সে বেঁচে আছে। তবে যমে মানুষে টানাটানি চলছে। 

খুঁজলাম ইরিনাকে। সেও অচেতন। তবে লাভলী ছিল সেখানে। সে চুপ করে একটা মোবাইল ফোন আমার দৃষ্টির সামনে ধরলো। আমি বিমূর্ত হয়ে দেখলাম সেই প্রথম পরিচয় দিনের ইরিনা আর আমার কয়েকটা ছবি। কিছু ছবি ইরিনার অতি কৌতুহলের বহিপ্রকাশের আর কিছু ছবি নিপুনতার সহিত খুব নোংরাভাবে এডিট করা।

আমার প্রশ্নবোধক দৃষ্টির উত্তরে লাভলী জানালো- ইরিনা আর শ্রাবণের সম্পর্ক আছে জেনেও তিন্নি প্রচণ্ড ভালোবাসত শ্রাবণকে। এমনকি ইরিনাকে একদিন বলে দিল- সে যেন শ্রাবণের আকাশে আর না ভেসে বেড়ায়। কিন্তু যে সম্পর্ক প্রণয়ের দিকে গড়াচ্ছে সে সম্পর্ক কি আর দিকহীন হয়।

তিন্নি সেদিন ট্রেনে আমাদের অগোচরে তার মোবাইল ফোনে ছবিগুলো তুলেছিল। আজ বিকেলে যখন শ্রাবণ আর ইরিনা একসাথে পার্কে বসে গল্প করছিল তখন হঠাৎ করে তিন্নি সেখানে উপস্থিত হয়ে ছবিগুলো খুব নোংরাভাবে উপস্থাপন করে শ্রাবণের কাছে। আবেগী শ্রাবণ সাথে সাথে দৌঁড় দিয়ে রাস্তায় নামে। ঝাঁপ দেয় ট্রাকের নিচে।

আমি এলোমেলো পায়ে এগিয়ে গিয়ে শ্রাবণের নিথর দেহটা আবারও দেখি। ইচ্ছে হয় আবেগী ছেলেটাকে চুল ধরে টেনে তুলে ধমকে দেই। 

মিথ্যের ফুলঝুড়ি আর লালসার রসনা পরপারে ঠেলে দিচ্ছে একটা সম্ভাবনাকে- ভাবতেই নিজের পৃথিবী থমকে দাড়ায়। না জাগ্রত, না ঘুমন্ত এমন করে কেটে গেল অনেকটা সময়। কান্নার শব্দে বাস্তবতায় প্রত্যাবর্তন করি। 

শ্রাবণ নেই! চলে গেছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে, বড় বেশি অসময়ে, বড় বেশি অনিয়মে, পৃথিবীসম হতাশার প্লাবণে ভাসিয়ে ভালোবাসাময় একটা অচেতন মেয়েকে একা রেখে, তাকে না জানিয়ে।

চুপচাপ রাস্তায় নেমে আসি। রাত মধ্যপ্রহর। নীল জ্যোৎস্নায় ডুবে আছে রাতের শহর। বরাবরের মতো উদ্দেশ্যহীন হাটতে থাকি রাস্তায়। এমন বিরহের ক্ষণে অপ্রত্যাশিতভাবে প্রেম আসে আমাকে ছুঁয়ে পূর্ণতা পেতে। আমি নীল জ্যোৎস্নায় ডুবে তাকে ফাঁকি দিয়ে কালের অতলে হারাতে চাই। শ্রাবণ বসন্তে হলো বিলিন। আমি আর ইরিনা হলাম অসময়ের প্লাবণে চির মলিন।   
***
রচনাকাল : ২/৯/২০২০
© কিশলয় এবং মোঃ তোফায়েল হোসেন কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 4  Canada : 1  China : 9  France : 1  Germany : 2  Hungary : 1  India : 123  Ireland : 4  Russian Federat : 11  Saudi Arabia : 4  
Singapore : 1  Sweden : 12  Ukraine : 7  United States : 102  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 4  Canada : 1  China : 9  France : 1  
Germany : 2  Hungary : 1  India : 123  Ireland : 4  
Russian Federat : 11  Saudi Arabia : 4  Singapore : 1  Sweden : 12  
Ukraine : 7  United States : 102  
© কিশলয় এবং মোঃ তোফায়েল হোসেন কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
নীল জ্যোৎস্না by Md. Tofayel Hossen is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪১০৮০
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী