"তুই আজও স্কুলে এলি না চুটকি , স্যার বলেছে তোকে খুব বকবে । আজ নিয়ে পনেরো দিন হয়ে গেলো তুই স্কুলে যাস না । কোনো চিঠি ও স্যার কে দিসনি । কি হয়েছে তোর ? স্যার বলেছে আমাকে তোর খবর নিয়ে যেতে আমাকে বল না কি হয়েছে?" - জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে জিগ্গাসা করেই যাচ্চে সাধন।
ও জানে ছুটকিদের বাড়ির ভিতরে ঢোকা যায় না । সবাই বলে ছুটকিরা খারাপ পাড়ায় থাকে । সেই জন্য ভদ্রলোকেরা কেউ ওদের পাড়া দিয়ে যায় না । কিন্তু সাধন তো ছুটকির ভালো বন্ধু । তাই ও স্কুল ছুটির পর রোজ ছুটকিদের এই জানলার ধারে এসে দাঁড়ায় ছুটকি ও অপেক্ষায় থাকে কখন সাধন আসবে। তারপর স্কুলের সব খবরাখবর দেয়ানেয়া চলে। সাধনের প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে ছুটকি বললো - "শুনতে চাস কি ব্যাপার-- মা আমার বিয়ের ঠিক করেছে । আর কোনোদিনই হয়তো আমার স্কুলে যাওয়া হবে না রে সাধন । সামনের রবিবার আমার বিয়ে"।
- "কি বলছিস ছুটকি ! কোথায় কার সাথে ? তোর তো এখনো আঠারো বছর হয় নি, তুই রাজী হোলি কেনো?"
- "আমার কথা কে শুনবে বল ! এই খারাপ পাড়ার মেযেদের কথা কে শুনবে বল।"
- "আচ্ছা ছুটকি ঐ যে সাদা শাড়ী পড়া দিদিরা স্কুলে এসেছিল তোর মনে আছে ? ওরা বলেছিল যে কোনো অসুবিধা তে ওদের ফোন করতে, তুই ওদের ফোন করে সব কথা বল না যদি ওরা কিছু করতে পারে।"
- "না রে সাধন , মা সেই ফোন নাম্বার নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে । আমাকে ঘরে আটকে রেখেছে । ঐ যে দাস পাড়ার লক্ষণ মুদি আছে যার বৌ টা গলায় দড়ি দিয়ে মরলো গতবছর ওর সাথেই তো বিয়ে দেবে বলে থোক করেছে।"
- "সে তো একেবারে ই বুড়ো রে ছুটকি, তুই ওর সাথে কি করে থাকবি?"
- "জানি না রে সাধন , মাকে কত করে বোঝাচ্ছি কিছুতেই শুনছে না । শুধু বলছে, খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকবি আর কি চাস ? সাধন ভাই তুই একবার স্যার কে গিয়ে বলবি যদি উনি কিছু করতে পারেন।"
- "ঠিক আছে চিন্তা করিস না আমি কালকেই স্যারকে গিয়ে বলছি সব কথা । উনি আজও ক্লাসে তোর কথা বলেছে।"
- "কি বলেছে বল বল"
- "ঐ বলছিল যে ছুটকি খুব ভাল রেজাল্ট করবে । ওর পড়াশুনায় খুব মাথা ও আমাদের স্কুলের এমন কি দেশের মুখও উজ্বল করবে।"
পরের দিন সাধন এসে বলে, "ছুটকিতোকে যা যা বলবো তুই সেই মত কাজ করে যাবি স্যারের সাথে আমার সব প্ল্যান হয়ে গেছে ।এই নে ওষুধ গুলো নিয়ে রাখ এখন থেকে রোজ একটু একটু করে তোর মা মাসিদের খাবারে মিশিয়ে দিবি । আর শোন স্যার ও এই স্কুল থেকে বদলি হয়ে নিজের রাজ্য বিহারের কোনো একটাস্কুলে যাচ্চে । আগামী শনিবার সন্ধেবেলা ওনার ট্রেন, যে কোনোভাবে তোকে সাথে নিয়েই উনি।এখান থেকে যাবেন । তুই শুধু মনে জোর রাখ।"
অবশেষে আসে সেই শনি বার । খুব সকালেই চুপিচুপি সাধন খবর দিয়ে যায় , "আজ সন্ধে ছ টায় স্যারের ট্রেন । স্যার স্টেশনে অপেক্ষা করবে । তুই সাহসের সাথে আসল কাজটা করবি ।দুপুরে খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধের ডোজ টা বাড়িয়ে দিবি যাতে কারো ঘুম না ভাঙে । আর তোদের বড়ো দরজার পাহারাদার দের পান এর সাথে ওষূধ মিশিয়ে দিয়ে যাবে রহিম । ঠিক পাঁচ টার সময় সবকাজ সেরে রেডি হয়ে থাকবি মিস যেন না হয় । স্টেশন যেতে চল্লিশ মিনিট মত লাগবে । তার পরেই ট্রেন ধরে একদম পগারপার । আমাদের কথা তোর মনে থাকবে মনে থাকবে তো ছুটকি ! আমি রহিম নয়না সবাই তোর সাথে আছি । একদিন খুব বড়ো হবি তুই দেখিস ! দেশের মুখ উজ্বল করবি , ভালো থাকিস । আর হ্যাঁ, নয়না বোরখা পাঠিয়েছে, ও আর ওদের অটো ড্রাইভার অটো নিয়ে বড়ো বটগাছ তলায় দাঁড়িয়ে থাকবে । আমি এখন চলি রে!"
সাধন, রহিম ,নয়না ঠিক সময় মত ছুটকি কে স্যারের হাতে তুলে দিয়েছে ওরা হাত নেড়ে বিদায় দিয়েছে প্রিয় বন্ধুকে ।নিশ্চিন্তে যে যার বাড়ি ফিরে গিয়েছে ।অনেক থানা পুলিশ করে ও ছুটকি র মা ওর কোনো খবর পায় নি । তেরো বছর পর আবার তিন বন্ধু স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন আসার অপেক্ষায় আজকের অপেক্ষা ছুটকির জন্য না আজ অপেক্ষা হাসপাতালের নতুন ডাক্তার ওদের স্যার দিগ্বিজয় জয়সওয়ালের মেয়ে রূপমতী জয়সওয়াল এর জন্যে ।
রচনাকাল : ৩১/৮/২০২০
© কিশলয় এবং মৌসুমী ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।