প্রিয় বন্ধু কথা,
আমার প্রিয় বুলবুলির কথা তোমায় তো আগেই বলেছি । আজ সকাল থেকে, সেই বুলবুলির রিমঝিম শব্দ মাথার মধ্যে গুনগুন করছে । কত কত শব্দ মনের অলিতে গলিতে ভেসে উঠছে । আমি তাই আজ, প্রিয় বুলবুলিকে নিয়ে ভাবব । সেই ভাবনার আবেশকে থরে থরে সাজিয়ে, পৌঁছে দেব তোমার ঠিকানায় ।
পাখি বাসা বাঁধে । আনন্দে- আনন্দে ঘরের স্থায়িত্ব মজবুত করে । সে ঘরে রচিত হয় নতুন সম্ভাবনা । সৃষ্টি হয় নতুন প্রাণ । সদ্যোজাত প্রাণ ধীরে ধীরে স্নেহ- মমতায় বিকশিত হয় । তারপর, স্কাইলার্কের মতন ডানা মেলে উড়ে যায় আলোর পৃথিবীতে ।
পাখি আসে । পাখি উড়ে যায় । 'আসা- যাওয়া'- র এই গল্প তো, জীবনচক্রের অনিবার্য প্রতিফলন ! অনিবার্য নিয়মেই ফুল ফোটে, ফুল ঝরে পড়ে । কচি কচি পাতার হামাগুড়িতে গাছের শাখাগুলো প্রাণ ফিরে পায়; প্রজাপতির রঙিন পাখার হিল্লোলে, পলাশের উন্মাদনায় প্রকৃতি নব উচ্ছাসে প্লাবিত হয় । এরপর, শীতের উত্তুরে হাওয়ার বিদায়ী সুরে, মৃত্যুর শীতল কোলে ঢলে পড়ে 'তারা' । 'যারা' একদিন এসেছিল, বিশ্ব- ব্রহ্মাণ্ডের প্রোটিন উৎস হয়ে । আজন্মকাল ধরে, 'আসা- যাওয়া'- র এই প্রাত্যহিকতা রোজ রোজ চোখ দিয়ে চেয়ে দেখি । হৃদয়ের একতারায় উপলব্ধি হয়ে, তবুও এ 'সুর' কেন মূর্ছিত হয় না? মনকে শক্ত করে, জীবনের এই চিরন্তন 'বার্তা' কতটা মেনে নিতে পারি?
আমার প্রিয় শিক্ষক, 'মা- বুলবুলি' আর তার ছোট্ট ছানা 'রুকু- শুকু' । ডানা মেলে উড়ে যাওয়া পাখির, পাখ- পাখালি গল্পটা তাই "শেষ হয়েও যেন হইল না শেষ" ! প্রকৃতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রতিটা এলিমেন্ট বা উপকরণ, যেমন- ইঁট, কাঠ, পাথর, পাহাড়, নদী, গাছপালা, পাখি ; প্রকৃতির অবিচ্ছিন্ন অঙ্গরূপে একপ্রোতভাবে মানুষের আত্মিক বেঁচে থাকার পৌষ্টিক রসদ যোগায় । 'মা- বুলবুলি', আর 'রুকু শুকু' পাখির সাথে কাটানো সময়গুলো ইতিহাসের ধূসর পাণ্ডুলিপি হোলেও, আমার জীবনমঞ্চে কোথাও না কোথাও 'তারা' যেন সত্যিকারের পথপ্রদর্শক ! সে দিনের সেই ছোট্ট পাখি, আমায় জীবনের অনিবার্যতাকে মানতে শিখিয়েছে । কাছের জনের 'মৃত্যু', 'আকস্মিক চলে যাওয়া'- কে, স্নায়বিক দৃঢ়তার সাথে মানতে শিখিয়েছে ।
পথ চলতে চলতে হঠাৎ দেখা হয় কোনো 'একজন মানুষ' এর সাথে । চোখের আলোয় চেনা- শোনা হয় । জানা- অজানার খসড়ায় একদিন 'সে' প্রিয় হয়ে ওঠে । মনের সবুজতায় স্নিগ্ধ হয়ে কখনও বা 'সে' চিরকাল চুপটি করে রয়ে যায় । মাথার উপর ছাঁদ এঁটে, চারধারে দেওয়াল গেঁথে মনের মতন একটা ঘর বাঁধে । একের পর এক ছোটো বড় স্মৃতির সম্মেলনে গল্পগাথা হয় । ছোটো কাহিনি ঐক্যবদ্ধভাবে ক্রমশই একটা উপন্যাসে পরিণত হয় । কখনও আবার, গল্পের শুরুর মাঝেই শেষের সমাধি গোপনে প্রস্তুত হয় ।
আমার প্রিয় বুলবুলি, প্রিয় শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে, কানে কানে শিখিয়ে গিয়েছিল 'জীবন মন্ত্র' ; --- 'আসা- যাওয়া'- র খেলার মাঝে কোনো সম্পর্কই চিরস্থায়ী নয় । মন তাই জলে নামুক, কিন্তু জামা যেন না ভেজে ! মরুঝড়ের হঠাৎ আগমনে, বালির মধ্যে মুখ গুঁজে বসে থাকো । কেউ যদি বলে, "এখানে বসে বসে কি করছ?" বলবে তখন, "বসে আছি এই আশায়, জ্যোৎস্না ভেজা রাত আবার আসবে । আবার আকাশকে আলোর দীপমালায় সাজিয়ে দিয়ে যাবে"। পাখির আদর্শে শিক্ষিত মন, বালিতে মুখ থুবড়ে বসেছে অগণিত বার । সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ধীর- স্থির থেকে, গায়ের ধূলো- বালি ঝেড়ে অজস্রবার সে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে ।
আমার প্রিয় বুলবুলির 'একলব্য' আমি । আমার প্রিয় শিক্ষকের কাছে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ । আমার বৃদ্ধাঙ্গুলি, দরবারী বেশে দুঃখ- সুখের 'জীবন দোঁহা' গেয়ে যাবে । আমার বৃদ্ধাঙ্গুলি, কলমের আঁচড়ে জীবনের নকসিকাঁথাকে করে তুলবে মর্মস্পর্শী । পাখির গন্ধমাখা সে গানে জীবনের ফুরিয়ে যাওয়া কথা, বেঁচে উঠবে নতুন নতুন ভাবে । আমার সে গানে--- বুলবুলি থাকবে, 'রুকু- শুকু' থাকবে, শিউলি- বেলির গন্ধ থাকবে, কালো- সাদা মানুষ থাকবে, আমরা থাকব, আর থাকবে 'তোমরা' ।।
ইতি,
তোমার বন্ধু ঈশিতা ।
ঈশিতা রায় ব্যানার্জি ।
রামাত হাগোলান স্ট্রিট, আরিয়েল, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, ইজরায়েল ।
রচনাকাল : ৩১/৮/২০২০
© কিশলয় এবং ঈশিতা রায় ব্যানার্জি কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।