শরতের শিশিরভেজা ঘাসে কমলা রঙের নলাকার বোঁটায় সাদা পাপড়ির অজস্র ফুল পড়ে থাকার দৃশ্য লোভনীয়। শিশিরভেজা ঘাসে খালি পা মাড়িয়ে শিউলি ফুল কুড়ানোর একটা আলাদা সুখ আছে। রাতে ফুটে সকাল না হতেই ঝরে পড়ে বলে এই ফুলকে বলে ‘নাইট জেসমিন’। শিউলি ছাড়াও এর আরো অনেক নাম আছে। যেমন - শিউলি, শেফালি, শেফালিকা (বাংলা), শেওয়ালি (মণিপুরী), পারিজাত (মারাঠি), পারিজাতম (তেলেগু), গঙ্গা শিউলি (উড়িষ্যা), হরসিংগার, রাগাপুষ্পী, মালিকা ইত্যাদি।
পারিজাত শিউলির আরেকটি বিশেষ নাম। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীতে অনেকবার এসেছে শিউলি ফুল বা পারিজাতের কথা। পূজোয় শিউলিই এমন ফুল যেটি মাটিতে ঝরে পড়লেও তাকে দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করা যায়। প্রাচীনকালে এ ফুলের বোঁটার রঙ পায়েস ও বিভিন্ন মিষ্টান্নে ব্যবহার করা হতো। তাছাড়া শিউলির মালা খোঁপার সৌন্দর্য বাড়াতেও অনন্য। ফুল চ্যাপ্টা ধরনের। শিউলির পাতা ও বাকল বিভিন্ন রোগের মহৌষধ। ঔষধি হিসেবে ব্যবহার হয় শিউলির বীজ, পাতা ও ফুল। এই ফুল বোঁটা শুকিয়ে গুঁড়ো করে পাউডার বানিয়ে হালকা গরম পানিতে মেশালে চমৎকার রঙ হয়।
শিউলি ফুলের আরেক নাম শেফালি। দিনের আলোর স্পর্শে এই কমলা-সাদা ফুলটি তার নিজস্বতা হারায়। সূর্য ওঠার আগেই গাছ থেকে খসে পড়ে মাটিতে। টুপটাপ, গালিচার মতো বিছিয়ে থাকে শিশির-ভেজা কমলা-সাদা বৈভব। শিউলি ফুলের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে কিছু পৌরাণিক কাহিনি।
নাগরাজের অপরূপা লাবণ্যময়ী কন্যা পারিজাতিকা সূর্যের প্রেমে পড়েন। কিন্তু দিনমণির-র কাছে সে পবিত্র প্রেম নজরে পরে না। শেষে দিনমণি সূর্যকে না পেয়ে পারিজাতিকা আত্মহনন করেন। তার দেহের ভস্ম পারিজাত ফুল রূপে স্বর্গে ফুটে ওঠে। সূর্যের স্পর্শমাত্রাই সে নীরব ব্যর্থ প্রেমিকার মতো ধরে পড়ে মাটিতে। এই পারিজাত হল স্বর্গের শ্রেষ্ঠ কুসুম। পারিজাত শিউলিরই নামান্তর। পুষ্পপুরাণে রয়েছে অন্য গল্প। পারিজাত স্বর্গের ফুল।
শরৎ-হেমন্তের সকালে শিউলির সৌরভ বাঙালির প্রাণে আনে উৎসবের মেজাজ। শ্রীকৃষ্ণের দুই পত্নী সত্যভামা ও রুক্মিনীর মনে খুব দ্বন্দ্ব যে কৃষ্ণ কাকে বেশি ভালোবাসেন। সত্যভামা না রুক্মিনী কাকে। কৃষ্ণ উদাসীন থাকেন এ প্রশ্নে। শেষে একদিন তাঁরা আবদার করলে পারিজাত ফুল যদি কৃষ্ণ এনে দিতে পারেন স্বর্গ থেকে, তাহলেই বোঝা যাবে কৃষ্ণের পত্নী প্রেমের গাঢ়তা।
কৃষ্ণ স্বর্গ থেকে চুপিচুপি পারিজাত বৃক্ষ চুরি করে আনেন। সত্যভামা সকালে ঘুম ভেঙে দেখেন তার প্রাসাদে একটি অপূর্ব পারিজাত বৃক্ষ এহং সেই ফুলের গুচ্ছ বিছিয়ে রয়েছে রুক্মিনীর প্রাসাদকোণে। এ দিকে স্বর্গের ফুল পারিজাত চুরির অপরাধে দেবরাজ ইন্দ্র আভিশাপ দেন, পারিজাত কেবল ফুল ফুটেই ঝরে যাবে। ফল হবে না কখনও সে ফুলের। তা না হোক, আমরা তো শিউলি-শেফালিকা-পারিজাত যে মানেই ডাকা হোক, তার ফুলটাই ভালোবাসি। শরৎ ঋতুর শ্রেষ্ঠ সে ফুল।
শিউলিই এমন এক ফুল যেটি মাটিতে ঝড়ে পড়লেও পূজোয় দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা যায় এই ঝরা ফুল।এই ফুল শরৎকালে ফোটে। এর ফুলগুলি রাতে ফোটে এবং সকালে ঝরে যায়। শরৎকালের শিশির ভেজা সকালে ঝরে থাকা শিউলি এক সুন্দর মনোরম দৃশ্য তৈরি করে।
রচনাকাল : ৩০/৮/২০২০
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।