আমার জীবনের সেরা শিক্ষক
আনুমানিক পঠন সময় : ৬ মিনিট

লেখক : সৌম্য শুভ্র বৈষ্ণব


কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১৯ , ডিসেম্বর
প্রকাশিত ২ টি লেখনী ১৩ টি দেশ ব্যাপী ১০৮৯ জন পড়েছেন।
Soumya Subhra Baishnab
করোনা ভাইরাস, লকডাউন এইসব হঠাৎ করে উদয় না হলে এতদিনে এম. এস সি শেষ করে শিক্ষিত বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু ওই ইউ.জি.সি র খামখেয়ালিপনায় এখনো ছাত্রজীবন বহাল থাকলো, আর আমি ছাত্র জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে আমার জীবনের সেরা শিক্ষক বাছাই করতে বসলাম। ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত তিনটে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, তার পর প্রাইভেট ব্যাচ,  গান, আবৃত্তি, আঁকা, কম্পিউটার, ক্যারাটে সব মিলিয়ে  এতো স্যার, ম্যাডামের সান্নিধ্যে এসেছি যে আমার ছাত্রজীবনের শিক্ষক প্রাপ্তির ঘড়াটা প্রায় পরিপূর্ণ। কিন্তু এখন  আমার সকল শিক্ষক শিক্ষিকার মাঝে সেরা শিক্ষক কে সেটা বুঝে ওঠাই আমার কাছে সবথেকে কঠিন, অনেকটা ওই আনকোরা কারোর রাতের খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রকে খুঁজে বের করার মতো।

আমার খুব প্রিয় স্যারদের মধ্যে আছেন আমার ছোটবেলার কে. জি. স্কুলের হেড স্যার, শ্রদ্ধেয় অলোক দাস মহাশয়, যিনি অত্যন্ত রাশভারী মানুষ হলেও আমি যখন স্কুলের প্রথমদিকে লোয়ারে কেঁদে বমি করে ফেলেছিলাম, সব ভুলে নিজে এসে সব সামলেছিলেন, আমাকে ইংলিশ শিখিয়েছেন, গল্পের বইয়ের নেশা ধরিয়েছেন। আছেন লেখা ম্যাডাম, যিনি ক্লাস ফোরের বৃত্তি পরীক্ষার আগে রোজ ফোন করে নতুন নতুন রচনা, প্যারাগ্রাফ বলতেন তৈরি করতে, যিনি নাটক লিখে সেই নাটক প্রতিবছর বার্ষিক অনুষ্ঠানে করাতেন, যেখান থেকে আমার প্রথম নাটকের হাতেখড়ি। অনাথ সমিতি কে.জি স্কুল, আমার প্রথম স্কুল, সব স্যার, ম্যাডাম আমার খুব প্ৰিয়। সবার নাম করতে পারলাম না, কিন্তু সুহাস স্যার, সুব্রত স্যার, মিতা ম্যাডাম, গোপাল স্যার খুব প্রিয়।

আছেন রসুলপুর বি. এম হাই স্কুলের সেই আলম বাবু, যার বাংলা ক্লাস করে শিখেছি  কিভাবে নিজের মনের ভাষা প্রয়োগে সাহিত্য সুন্দর হয়, যিনি ক্লাসের ফাঁকে আমায় আবৃত্তি শেখাতেন।
আমার প্রিয় স্যারদের মধ্যে আছেন রসুলপুর স্কুলের সুবোধ বাবু, যিনি আমাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন, আমি স্কুলের হয়ে কোথাও গিয়ে ফার্স্ট হলে উনি  আনন্দের সাথে গোটা স্কুলে সেই খবর প্রচার করে দিতেন। আছেন স্বতী ম্যাডাম, যিনি প্রথমদিন যখন ক্লাসে এসেছিলেন, ওনার মধ্যে একজন ম্যাডামকে কম, একজন মাকে বেশি খুঁজে পেয়েছিলাম। আছেন অরুন বাবু, যিনি আমাকে বুঝিয়েছেন ডিগ্রি লাভ করাটাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়, সমাজের জন্য কিছু করে যেতেই হবে।  আছেন রিপন বাবু, যিনি আজ অব্দি প্রতিটা পদক্ষেপ নেবার আগে আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা যোগান। আছেন রমেশ বাবু, মৃনাল বাবু, সোমনাথ বাবু, যাদের ক্লাস করে আমার বায়োলজির প্রতি ভালোবাসা জন্মায়, যেটা আজ অব্দি আমার পড়াশোনার বিষয়বস্তু। আছেন বিষ্ণুপদ বাবু, মিঠু ম্যাডাম, সুপর্ণা ম্যাডাম, হিরন্ময় বাবু, অংশু বাবু, শুভাশীষ বাবু। রসুলপুর বি. এম. হাই. স্কুলের প্রত্যেক স্যার, ম্যাডামের অবদান আমার জীবনে অনস্বীকার্য, একই সাথে তাপস স্যার, বিকাশ স্যারের অবদানও।

বর্ধমানে গিয়ে হাজারো ভালো ছেলের মাঝে যখন মনে হতো হারিয়ে যাবো, ইলেভেন- টুয়েলভ এর পড়ার চাপে যখন নাভিশ্বাস উঠে যেত, তখন সুমন স্যারের বায়োলজি ক্লাসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতাম। বায়োলজিকেই জীবনের চলার পথের পাথেয় করার  পরিকল্পনা সুমন স্যারের ব্যাচ থেকেই।  প্রদীপবাবু ওনার ক্লাসে শুধু ইংলিশই শেখাননি, শিখিয়েছেন বাস্তবতা, শিখিয়েছেন জীবনের শিক্ষা। ক্লাস শেষ হতে হতে নটা, সাড়ে নটা বাজতো, তারপরও দাঁড়িয়ে থাকতাম শুধু মুগ্ধ হয়ে স্যারের থেকে জীবন দর্শন শুনবো বলে। একই ভাবে দিলীপ বাবু, রিনি ম্যাডাম, গদাধর বাবু, বিকাশ বাবু জীবনের সেরা শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম।

চন্দননগরের গঙ্গার ধারের ওই ডুপ্লেক্স সাহেবের কলেজে যখন ভর্তি হলাম, সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ, হাজারো অচেনা মুখ আমার চারপাশে। কিন্ত ওই পাঁচতলার  জুওলজি ডিপার্টমেন্টের সাতজন স্যার, ম্যাডামের ভালোবাসায়, আন্তরিকতায় দুদিনের মধ্যে মনে হয়েছিল এটা আমার পরিবার, আমার সেকেন্ড হোম। শ্রদ্ধেয় এইচ.ও.ডি, এস.বি. ম্যাম যখন ভরসা করে কোনো অনুষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্ব দিতেন, নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো। ডি. এস ম্যাম, আমার প্রজেক্ট গাইড, জীবনের অন্যতম সেরা শিক্ষিকা, যখন  'বাবা' বলে ডাকতেন, ম্যাডামকে তখন 'মা' এর মত মনে হতো। এম.সি ম্যাম আমাদের নিয়ে ছুটে গেছেন আজ বিজ্ঞান মেলায়, কাল কুইজে। জীবনে সবথেকে বেশি সময় কলেজকে দিয়েছেন, আমাদের দিয়েছেন। পি. জি স্যারের ক্লাসের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, ওনার সরল, সাবলীল ব্যাখ্যা শোনার জন্য। এস. আর. ম্যাম শুধু ক্লাস নেননি,প্রতিটা পদক্ষেপে অন্যপ্রেরণা দিয়েছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,সব দিক থেকে সার্বিক বিকাশে সাহায্য করেছেন ডি.সি স্যার, ডি. বি স্যার।
রণজিৎদা, শুধু আমার শিক্ষক নয়, আমার দাদা, আমার "ফ্রেন্ড, ফিলোসফার, গাইড"। রণজিৎদার সান্নিধ্যে কাটানো দিনগুলো এখনো জীবনের  অন্যতম সেরা মূহুর্ত। দাদার ব্যাচ থেকে যা পেয়েছি, তা জীবনের চলার পথের পাথেয়। পারভীনদিও নিজের দিদির মতো পড়িয়েছে, গল্প বলেছে, আমাদের আবদার মিটিয়েছে।

ইউনিভার্সিটিতে  সকল স্যার, ম্যাডামের ক্লাস খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম এ.এম স্যার, এন. এইচ স্যার, এ. এ স্যারের ক্লাসের জন্য।  জুওলজিক্যাল এসোসিয়েশন অফ বার্ডওয়ানের সকল দাদা, দিদি আমাদের পিছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যান, তাদের থেকে যা শিক্ষা লাভ করি, সেটা খুব দামী। তবে সকলের মধ্যে অয়নদা কে আদর্শ মনে করি।

খুব ইচ্ছা হয় শংকর স্যারের, আঁকার ক্লাসে যাই, স্যারের পাশে বসে তুলির আঁচড় দি সাদা পাতায়, কিন্তু আজ আর হয়ে ওঠে না। গোপী স্যারের সাথে নানচাকু ঘোরানো হয়না আর আজ, তবে লড়াই করার, বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়ানোর যে সাহসটা স্যার মনে এনে দিয়েছেন, সেই কারণে গোপীকান্ত স্যার, আমার জীবনে অনত্যম।

নিজের চোখে দেখিনি কোনোদিন, এমনকি উনি বেঁচে থাকতে ওনার নামও শুনি নি। কিন্তু মৃত্যুর পর বরুণ বিশ্বাসের জীবনদর্শন বা জীবন কাহিনীর যে সামান্যতম অংশ পড়ার, উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছি, তাতে মনে হয়েছে মেরুদন্ড সোজা না থাকলে, পিঠ হয়তো বাঁচানো যায়, কিন্তু বাঁচার মতো বাঁচা যায় না। ওনার এই শিক্ষার জন্য উনিও আমার জীবনের একজন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক।

ছোটবেলার কথা খুব একটা মনে নেই, কারোরই থাকে না। তবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এইটুকু বুঝি, যে মানুষ দুটো আমাকে মাতৃভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখিয়েছিলেন, আমাকে হাতে ধরে লিখতে শিখিয়েছিলেন, আমার অক্ষর পরিচিতি যে মানুষদুটোর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল, তারা আমার জীবনের সেরা শিক্ষক। আমার অবান্তর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন যারা, আমার শিশু মনের কৌতুহল মিটিয়েছেন যারা, আমার বাবা আর মা, আমার জীবনের সেরা শিক্ষক-শিক্ষিকা। মায়ের কাছেই প্রথম হারমোনিয়ামের সাথে পরিচয়, আবৃত্তিতে হাতেখড়ি আর বাবার হাত ধরে আমার বাইরের জগৎকে চিনতে শেখা। ঠাম্মার কাছ থেকে শিক্ষা লাভ সহজ, সরল জীবনযাত্রার, কঠোর পরিশ্রমের, জীবন সংগ্রামে লড়াই করে টিকে থাকার। আজকে  ঠাম্মা না থাকলেও, ঠাম্মাও আমার জীবনের সেরা শিক্ষিকা।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাকে  শিক্ষা দিয়েছেন যারা, সবাই আমার শিক্ষক। শিক্ষক কথার অর্থ বুঝিয়েছেন যারা, তারা আমার শিক্ষক, শিক্ষককে শিক্ষক বলতে শিখিয়েছেন যারা তারা সকলেই আমার শিক্ষক।  কিন্তু আমার চোখের সামনে আমার যে শিক্ষকের চোখ আমারই কোনো সহপাঠীর  শরীরের আনাচে কানাচে ঘুরতো,  আমার চোখের সামনে আমার  যে শিক্ষকের নোংরা হাত আমারই কোনো সহপাঠীর শরীর ছুঁয়ে দেখতো, প্রতিবাদ করতে গেলে চূড়ান্ত অপমানিত হতে হতো, তাদের আমি শিক্ষক বলতে পারলাম না।

আজকে জীবনের এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এটা উপলব্ধি করেছি, জীবনের সর্বকালের সেরা শিক্ষক সময় আর পরিস্থিতি। প্রতি মুহুর্তে ঠিক, ভুল, ভালো, খারাপের পার্থক্যটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ।

আজ, শিক্ষক দিবসের প্রাক্কালে আমার সকল শিক্ষক, শিক্ষিকার চরণে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।



ধন্যবাদন্তে,
- সৌম্য শুভ্র বৈষ্ণব
- স্নাতকোত্তর ছাত্র, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়।
ঠিকানা:- বৈদ্যডাঙ্গা, রসুলপুর, পূর্ব বর্ধমান, ৭১৩১৫১।
ফোন- ৯০৬৪৫২৫৭৮০ ।
রচনাকাল : ৩০/৮/২০২০
© কিশলয় এবং সৌম্য শুভ্র বৈষ্ণব কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 8  China : 24  France : 3  India : 141  Ireland : 12  Italy : 1  Russian Federat : 10  Saudi Arabia : 7  Sweden : 10  Ukraine : 5  
United States : 152  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 8  China : 24  France : 3  India : 141  
Ireland : 12  Italy : 1  Russian Federat : 10  Saudi Arabia : 7  
Sweden : 10  Ukraine : 5  United States : 152  
© কিশলয় এবং সৌম্য শুভ্র বৈষ্ণব কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
আমার জীবনের সেরা শিক্ষক by Soumya Subhra Baishnab is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৪২৭২৯৬
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী