সুজানা নাজাসু
আনুমানিক পঠন সময় : ১৪ মিনিট

লেখক : মোঃ তোফায়েল হোসেন
দেশ : Bangladesh , শহর : Moulvibazar

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , আগষ্ট
প্রকাশিত ২৮ টি লেখনী ৩০ টি দেশ ব্যাপী ১৩৭৫৯ জন পড়েছেন।
সুজানা নাজাসু
মোঃ তোফায়েল হোসেন

সুজানা নাজাসু একদিন দুপুরে চেরাগ আলীর ‘‘জমিলা মোবাইল সার্ভিসিং’’ নামক দোকাটার সামনে এসে দাঁড়ালো। বিশাল জটিলতার মধ্যেও চেরাগ আলী মেয়েটার বয়স আন্তাজ করেছিলেন তখন- দশ কি বারো বছর হবে। সুজানা নাজাসু যখন দোকানের সামনে এসেছিল তখন একটা লোক চেরাগ আলীকে খুব বকাঝকা করছিল। ঠিক করতে গিয়ে তিনি লোকটার খুব দামী একটা ফোনসেট নষ্ট করে ফেলেছেন। এই বকাঝকার বিষয়টা আজ নতুন নয়। প্রায়ই চেরাগ আলীকে এমন বকাঝকা শুনতে হয়। আবার কখনো কখনো ক্ষতিপূরণ হিসেবে কিছু টাকাও গচ্ছা দিতে হয় তাকে। 

চেরাগ আলী মেকানিক হিসেবে খুবই খারাপ। আসলে তার তেমন কোন প্রশিক্ষণ নেই, দক্ষতাও নেই। চেরাগ আলীর দুই ছেলে আর দুই মেয়ে। স্ত্রী আর ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে তার ছয়জনের সংসারটা খুবই অস্বচ্ছল। নিজের বসত ভিটে ছাড়া আর কোন জমিজামও নেই। লেখাপড়া না থাকায় দিনমজুর হিসেবেই তিনি বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতেন। 

লেখা পড়া বেশি না থাকলেও মোবাইল ফোন চালনায় তিনি খুবই পারদর্শি। বিভিন্ন ধরণের ফোন সেটের বিভিন্ন জটিল সমস্যা তিনি খুব সহজেই সমাধান করে দিতেন। এ কারণে এলাকাময় তার বেশ পরিচিতও বেড়ে যায়। চেরাগ আলী একদিন ভাবলেন তিনি মোবাইল সার্ভিসিং এর কাজ করবেন। এর জন্য তিনি একটা ছকও তৈরি করলেন। 

প্রতিদিন সন্ধ্যার পর গিয়ে হাজির হতেন বাজারের একমাত্র মোবাইল সার্ভিসিং এর দোকানে। নন্দন সিংহ বলে এক যুবক সে দোকানের মালিক এবং মেকানিক। চেরাগ আলী নন্দন সিংহের সাথে ভাব জামালেন। নন্দন সিংহ যখন কাজ করে তখন তিনি পাশে দাঁড়িয়ে তা দেখতেন। মাঝে মাঝে নন্দনের কাছে এটা ওটা জানতে চাইলে সে মুছকি হেসে বলেও দিত। পরে অবশ্য তিনি বুঝেছিলেন নন্দন খুব কম সময় সঠিকটা জানাতো। বেশির ভাগ সময় সে ভুল শিখিয়ে দিত।

কিছুদিন পর চেরাগ আলী বেশ সাহসী হয়ে উঠলেন। কিছু টাকা ধার নিয়ে জেলা শহরে এসে প্রচুর লোকের সমাগম যেখানে হয় এরকম একটা জায়গায় ছোট একটা রুম ভাড়া নিয়ে জমিলা মোবাইল সার্ভিসিং নামে একটা দোকান খুলে বসলেন। রুমটার পেছনের অংশ একটা পর্দা দিয়ে ঢেকে নিজের ঘুমানোর জায়গা বানিয়ে বাকি অংশটা যতটা সম্ভব সুন্দর করে সাজালেন। দোকানের নামটা রাখার সময় তিনি খুব চিন্তায় পড়ে গেলন। স্ত্রী সন্তান সবাই তার কাছে প্রিয়। কার নামটা বাদ দিয়ে কার নামটা ব্যবহার করবেন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেছিলেন না। অবশেষে চেরাগ আলী তার মৃত মায়ের নামেই দোকানের নামকরণ করতে পেরে খুশি হলেন।

প্রথম দিন থেকেই প্রচুর কাস্টমার তাদের ফোনসেট সারাতে তার দোকানে আসতে লাগলো। আর তখনই সমস্যা দেখা দিল। অদক্ষতার কারণে চেরাগ আলী কয়েকটা মোবাইল ঠিক করার পরিবর্তে নষ্টই করে দিলেন। তবে বেশ কয়েকটা তিনি ঠিক করে দিতেও সক্ষমও হলেন। যাদেরটা ঠিক হলো তারা চেরাগ আলীর খুব প্রশংসা করলো আর যাদেরটা নষ্ট হলো তারা তাকে গালিগালাজ করে চলে গেল।

এভাবেই দিন চলতে থাকলো। কিন্তু যখন তিনি দামী কোন ফোনসেট নষ্ট করে ফেলেন তখনই জটিল সমস্যা সৃষ্টি হয়ে যায়। কাস্টমাররা তার ওপর চড়াও হয়ে যান। তবে এ রকম জটিলতা সৃষ্টি হলে আশে পাশে ঘুরতে থাকা মুখ পরিচিত কয়েকজন মাস্তান ধরণের ছেলে এসে তাতে নাক গলায়। কৌশলে এই সেই ধামাচাপা দিয়ে জটিলতা বাঁধানোর জন্য সেই কাস্টমারকেই দায়ী করে তাকে বিদায় হতে বাধ্য করে। বিপদ বিদায় হলেই চেরাগ আলী তার ড্রয়ার থেকে দুইশত টাকা বের করে তাদের নেতার হাতে ধরিয়ে দেন। প্রয়োজনে তাদের ডাক দিতে বলে তারা চলে যায়।

চেরাগ আলীকে প্রায়ই তারা এভাবে উদ্ধার করে। কিন্তু ধীরে ধীরে বিষয়টা জানা-জানি হতে থাকলে লোকজন তার দোকনে আসা ছেড়ে দেয়। কেইবা চায় তার হ্যান্ডসেটটা জেনে শুনে নষ্ট করতে। কাস্টমার কমে যেতেই চেরাগ আলী চিন্তায় পড়ে যান। এখানে দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, খাবার হোটেলের বিল আর বাড়িতে স্ত্রী সন্তানদের জন্য খরচের টাকা কোথা থেকে আসবে সে কথা ভেবে তিনি অস্থির হয়ে উঠেন।

ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে সেদিন দুপুরে একটা গুণ্ডা টাইপের লোক এলো তার নষ্ট ফোনসেটটা মেরামত করাতে। চেরাগ আলী লোকটার হাবভাব দেখেই ভড়কে গেলেন। ভাবলেন এ লোকের ফোনসেট তিনি মেরামত করার চেষ্টাই করবেন না। কিন্তু পরক্ষণে সংসারের চিন্তা তার মাথায় এলো। যা হয় হোক- মনে মনে এ কথা ভেবে তিনি সেটটা খোললেন। কিন্তু চেরাগ আলীর ভাগ্য তখন বিরূপ ছিল- ঘষা মাজা করতে গিয়ে সেটা তিনি একেবারেই নষ্টই করে দিলেন।

লোকটা ক্ষেপে গেল চেরাগ আলীর উপর। গালি গালাজ করতে করতে সে চেরাগ আলীকে মারার জন্য উদ্দ্যোক্ত হলো। পরিচিত সেই মাস্তান যুবকেরা এগিয়ে না এসে দূরে দাঁড়িয়েই দেখতে থাকলো। ফাঁকে চেরাগ আলী তাদেরকে একটা ইশারাও দিলেন। কিন্তু কি এর অজানা কারণে সেদিন তারা আর তাকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে এলো না। আর এমন উত্তপ্ত সময়েই চেরাগ আলী এক পলকের জন্য সুজানা নাজাসুকে দেখলেন তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অপলক নয়নে চেয়ে আছে তার দিকে। যদিও তখন চেরাগ আলী মেয়েটার নাম জানতেন না। তবুও সে সময় তার দিকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো পরিস্থিতিতেও তিনি ছিলেন না।

অবশেষে গুণ্ডা লোকটা ফোনটা যেভাবে হোক ঠিক করে রাখার নির্দেশ দিয়ে, কাল সকালে এসে নিয়ে যাবে বলে দোকান ত্যাগ করলো। চেরাগ আলী এবার ভাবনায় পড়ে গেলেন। তিনি জানেন এই সেটটা তার দ্বারা মেরামত করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কিছু টাকা দিয়ে অন্য কোন দোকান থেকে এটা ঠিক করানো যায়। কিন্তু সমস্যা হলো চেরাগ আলী বিগত তিনদিনে এক টাকাও রোজগার করেননি। পকেটটাও একেবারেই শূন্য। 

ভাবনার জগতে হাবুডুবু খেয়ে তিনি ফোনসেটটা হাতে নিয়ে নিজের জায়গায় বসেই রইলেন বেশ কিছু সময়। হঠাৎ তার মনে পড়লো শহরের পশ্চিম প্রান্তের “গ্যালারী ফোন সার্ভিস” এর মেকানিক জমসেদের কথা। ছেলেটা খুবই ভালো। একটা রেস্তোরেন্টে হঠাৎ করেই একদিন চেরাগ আলীর সাথে তার পরিচয় হয়েছিল। সেদিন চেরাগ আলী জমসেদের নাস্তার বিল দিয়ে দিয়েছিলেন। তাই এখন তিনি ভাবলেন তার কাছে যাওয়া যায় ফোনটা নিয়ে। তার দ্বারা যদি সমাধান না হয়, তবে তার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার চেয়ে নিয়ে অন্য কাউকে দেখানো যাবে।

চেরাগ আলী সেদিন খুব ভালোভাবেই ফেঁসেছিলেন। জমসেদ পারেনি ফোনটা ঠিক করতে। তবে চেরাগ আলীকে চাওয়া মাত্র পাঁচশত টাকা ধার দিয়েছিল। কিন্তু সেই ধার করা টাকা নিয়ে চেরাগ আলী সারা শহর ঘুরেও ফোনটা ঠিক করাতে পারেনি। বরং এতবার খোলা লাগানো আর এটা সেটা নাড়াচাড়া করায় একেবারেই ডেড হয়ে গেল।

আকাশ ভেঙ্গে পড়লো চেরাগ আলীর মাথায়। সে জানে মার্কেটে এ ধরণের হ্যান্ডসেটের দাম বিশ হাজারের ওপরে। এখন যদি মধ্যস্তকারী কাউকে সামনে ধরে লোকটার মুখামুখিও হন, তবুও কমচে কম আট দশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে চেরাগ আলীর। অথচ তার পকেট এখন একেবারেই শূন্য। বাড়িতেও বাজার সদাই শেষ হয়ে গেছে বলে ফোনে তার স্ত্রী গতকালই জানিয়েছেন।

নষ্ট ফোনসেটের বিষয়টা চেরাগ আলীকে এলোমেলো করে দিল। অবশেষে তিনি যখন এর কোন সমাধান খুঁজে পেলেন না তখন মনটা বিদ্রোহ করে উঠলো। যা হয় হোক। তার যখন টাকা দেওয়ার ক্ষমতাই নেই তখন কি আর করা। লোকটার যা ইচ্ছে তা করে নিক।

সে রাতে দোকান বন্ধ করার আগ পর্যন্ক একজন কাস্টমারও আর এলো না। বিদ্যমান জটিলতার কারণে চেরাগ আলীর ক্ষুধাও যেন হারিয়ে গেছে। তিনি ভাবলেন এবার ঘুমিয়ে পড়া দরকার। যদিও তিনি জানেন ফোনসেটটার চিন্তায় আজ রাতে তার ঘুম আসবে না কিছুতেই। তবুও সাটার টেনে দিয়ে বোতল থেকে কিছু পানি খেয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লেন।

লাইটটা বন্ধ করলেও চেরাগ আলীর এই ঘরটা বাহিরের আলোয় প্রায় আলোকিত হয়েই থাকে। তিনি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলেন তার অভাব অনটনময় জীবনের কথা। ভাবতে লাগলেন চার সন্তানের ভবিষ্যতের কথা।

বাহিরে শহরের রাস্তা তখনো সরগরম। শহরের কোলাহল কিছুটা কমেছে বটে কিন্তু মধ্য রাতের পর ছাড়া এখানে নিস্তব্ধতা নামে না। আর যখন নিস্তব্ধতা নামে তখনো প্রহরীর হাক আর দ্রুত ছুটে যাওয়া গাড়ির শব্দ থেকেই যায়।

ভাবনার জগতে থেকেই চেরাগ আলী হঠাৎ খেয়াল করলেন ঘরের পেছন দিকের ভ্যান্টিলিটর দিয়ে কিছু একটা তার রুমে প্রবেশ করেছে। দেখতে দেখতে খাড়া দেয়াল বেয়ে সেটা তার পাশে মেঝেতে নেমে এলো। দ্রুতই আকৃতি বদলে হয়ে গেল দশ বারো বছর বয়সি একটা মেয়ে!

চেরাগ আলী প্রথমে ভয় পেলেও পরমুহূর্তে কেন জানি তার সব ভয় ভেঙ্গে গেল। দুপুরে লোকটা যখন তাকে গালিগালাজ করছিল তখন এ মেয়েটাই তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অপলক চেয়ে রয়েছিল তার দিকে। 

তিনি উঠে দাঁড়িয়ে সুইচ টিপে বাল্বটা জ্বালিয়ে দিলেন। মেয়েটার গঠন কাঠামো তার বড় মেয়ে শাবানার সমান। তবে সে দেখতে শাবানার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী। তার ঘন কালো চুলগুলোর একটা অংশ নেমে গেছে পিঠে বেয়ে আর দুইটা অংশ দুই কান ঢেকে দিয়ে দুই কাঁধের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। সে শাবানা মতোই সুস্বাস্থ্যের অধিকারীনি। দারুণ সুন্দর ধূসর রং এর একটা জামা তার গায়ে। বিচিত্র একধরণের চিহ্ন আঁকা রয়েছে জামাটায়।

হঠাৎ চেরাগ আলীর দৃষ্টিতে মেয়েটার মাঝে বিদ্যমান দু’টি ব্যতিক্রম বিষয় ধরা দিল। চুলে ঢাকা কান দুটির আকার আকৃতি তার কাছে কিছুটা অন্যরকম মনে হলো। মেয়েটা কেমন করে যেন চেরাগ আলীর দ্বিধা দ্বন্ধটা বুঝে গেল। ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে দুই দিকের চুলগুলে ঠেলে দিল পিঠের দিকে। সাথে সাথে কান দুটি উন্মুক্ত হয়ে গেল। কিন্তু এখানে কান কোথায়! তার পরিবর্তে অদ্ভুতভাব কানের আকৃতির মতো বাঁকিয়ে দেওয়া দুটি এরিয়াল বসানো রয়েছে। 

আরেকটা ব্যতিক্রম হলো- মেয়েটার চোখ দুটি মানুষের চোখের মতো নয়। তার চোখের মনিগুলো বিড়ালের মতো। এছাড়া মেয়েটার বাদ বাকি সবকিছু একটা মানব শিশুর মতোই। তবে আরেকটা ব্যতিক্রম যে চেরাগ আলীর চোখের সামনেই ঘটেছিল তা তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন। ছোট্ট একটা ভ্যান্টিলিটর দিয়ে কিভাবে মেয়েটা এ ঘরে প্রবেশ করলো; কিভাবেই বা খাড়া দেয়াল বেয়ে নেমে এলো তার পাশে- এ কথা একবারও তার ভাবনায় এলো না।

মেয়েটা তার জামার পকেট থেকে তিন ইঞ্চি লম্বা আর এক ইঞ্চি প্রস্থের একটা কার্ড বের করে চেরাগ আলীর চোখের সামনে ধরলো। জামাতে দেওয়া বিভিন্ন চিহ্নগুলোর মতো ছোট্ট ছোট্ট কিছু চিহ্ন এ কার্ডেটাতেও দেওয়া আছে। চিহ্নগুলোর ফাঁকে খুব ছোট করে ইংরেজীতে লেখা রয়েছে- সুজানা নাজাসু। লেখাটা আঙ্গুলের ডগা দিয়ে দেখিয়ে সে নিজের বুকে হাত রাখলো। বিষয়টা বুঝতে বেশ সময় লাগলেও চেরাগ আলী ঠিকই বুঝে গেল এটাই মেয়েটার নাম।

এবার চেরাগ আলী মেয়েটাকে একে একে প্রশ্ন করতে লাগলেন। কিন্তু সুজানা নাজাসু কোন কথা না বলে বিড়াল চোখের অপলক দৃষ্টিতে চেরাগ আলীর দিকে শুধু চেয়েই রইল। একটানা কথা বলে তিনি যখন থামলেন তখন সে ইশারায় বুঝালো সে কথা বলতে পারে না!

এ কথাটা জানিয়ে সুজানা নাজাসু চেরাগ আলীর দিকে আর ফিরেও থাকলো না। পর্দা সরিয়ে এগিয়ে গেল চেরাগ আলীর মেরামত টেবিলের দিকে। টেবিলটার কাছে গিয়ে চেরাগ আলীর চেয়ারে উঠে বসলো। ড্রয়ার টেনে বের করে আনলো সেই ফোনসেটটা- যেটা চেরাগ আলীকে দুপুরে বেজ্জত করেছে, অর্ধেক দিন সারা শহরময় ঘুরিয়েছে, রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। 

দ্রুতই কাজ সারলো সুজানা নাজাসু। চেরাগ আলী শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলেন। ঠিক করা শেষ হলে সে ফোনটা অন করে সেটা বাড়িয়ে দিল চেরাগ আলীর দিকে। চেরাগ আলীর পৃথিবী ততক্ষণে থমকে গেছে। কি হচ্ছে এখানে, মেয়েটা কিভাবে কি করেছে, অনেক ভেবেও তার কোন কূল কিনারা তিনি পাচ্ছেন না। শহরের বড় বড় মেকানিক যেখানে ব্যর্থ সেখানে পিচ্ছি একটা মেয়ে মুহূর্তেই ভেলকি দেখিয়ে দিল!

চেরাগ আলীকে চিন্তার জগতে রেখে সুজানা নাজাসু এবার টেবিলের ওপর ফেলে রাখা একেবারেই নষ্ট কয়েকটা ফোনসেটে তার তেলেসমাতি দেখালো। প্রথমে একটা হাতে নিয়ে তার সামনে টেবিলের ওপর রাখলো। নাটগুলো দ্রুত খুলে ফেলে প্রতিটা পাটর্স ভিন্ন করে আবার দ্রুতই সব জোড়া দিতেই একদম ঠিক হয়ে গেল ফেলে দেওয়ার উপযোগী ফোন সেটটা। এভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সুজানা নাজাসু চেরাগ আলীর পরিত্যক্ত পাঁচটা ফোনসেট ঠিক করে দিল।

তারপর চেরাগ আলীর বিস্ময়ের রেশ থাকতে থাকতে যেভাবে এসেছিল সেভাবে চলে গেল ভ্যান্টিলিটর দিয়ে। কি হলো এসব- কিছুই ঠিক মতো বোধগম্য হলো না চেরাগ আলীর। তবে সুজানা নাজাসু যে সেই গুণ্ডা লোকটার ফোনসেট ঠিক করে দিয়ে তার বিরাট উপকার করেছে তা তিনি কৃতজ্ঞচিত্তেই অনুভব করলেন।

পরদিন লোকটা এসে তার ফোন সেটটা নিয়ে গেল। সেদিন আর কোন কাস্টমার এলো না চেরাগ আলীর দোকানে। তাই তিনি সন্ধ্যার পর দোকান বন্ধ করে চলে গেলেন জমসেদের কাছে। সাথে করে নিয়ে গেলেন সুজানা নাজাসুর ঠিক করে দেওয়া দুইটা ফোন সেট। জমসেদের টাকাটা তিনি খরচ করে ফেলেছেন- এ কথাটা তাকে জানিয়ে তার হাতে একটা ফোন সেট ধরিয়ে দিলেন।

ফিরে এসে দোকানটা খোলতেই একজন রিক্সার ড্রাইভার তার দোকানের সামনে এসে রিক্সা থামিয়ে দোকানে ঢুকলেন। বিক্রি করার মতো পুরাতন কোন ফোন সেট আছে কিনা জানতে চাইলেন। চেরাগ আলী একটু কম দামেই সদ্য ঠিক হওয়া একটা সেট তার কাছে বিক্রি করে দিলেন। তিনি ভাবলেন- এ সেটগুলো তো পরিত্যক্তই হয়ে গিয়েছিল। সুজানা নাজাসুর বদৌলতে ঠিক হয়েছে। এখন এগুলো বিক্রি করে যা পাওয়া যায়- তাই লাভ।

পাঁচদিনের মধ্যে চেরাগ আলী বাকি তিনটা ফোন সেটও বিক্রি করে দিতে পারলেন। এ পাঁচদিনে বেশ কয়েকজন কাস্টমারও এলেন তাদের ফোন সেট মেরামত করাতে। কোন জটিলতা ছাড়াই চেরাগ আলী সেগুলো মেরামত করে দিতে সক্ষম হলেন।

ছয়দিনের দিন একজন কাস্টমার একটা ফোন সেট নিয়ে “জমিলা মোবাইল সার্ভিসিং” এ হাজির হলেন। চেরাগ আলী অনেক চেষ্টা করেও কোনভাবেই সেটা মেরামত করতে পারছিলেন না। এমন সময় তার অসর্ততার কারণে স্ক্রু ড্রাইভারের খোঁচায় একটা স্লট ভেঙ্গে গিয়ে মেইন সার্কিটটাও ছিদ্র হয়ে দিল। অন্তরাত্মটা কেঁপে উঠলো চেরাগ আলীর। কি করবেন, কি বলবেন কিছুই মাথায় আসলো না। পরক্ষণে তিনি দেখলেন সুজানা নাজাসু সেদিনের মতো আজও তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অপলক চেয়ে রয়েছে তার দিকে। 

সুজানা নাজাসুকে দেখে কেন জানি চেরাগ আলীর মাথায় একটা কৌশল খেলে গেল। তিনি ফোন সেটের মালিককে জানালেন- তার সেটটা ঠিক করতে অনেক সময় দরকার। তিনি যদি সেটা রেখে যান তাহলে চেরাগ আলী ধীরস্থিরভাবে সমস্যাটা সেরে রাখবেন। কাল সকালে এসে তিনি সেটটা নিয়ে যেতে পারবেন।

লোকটা বেশ কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর সম্মতি দিয়ে চলে গেলেন। চেরাগ আলী এবার সেটা ড্রয়ারে রেখে দিয়ে বাতিল জিনিসপত্র ঘেটে একেবারে বিনষ্ট হয়ে যাওয়া চারটা ফোন সেট বের করলেন। তারপর সেগুলো টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে অদ্ভুত একটা আশায় বুক বাঁধলেন।

দোকান বন্ধ করার আগে আর কেউ এলো না চেরাগ আলীর দোকানে। তাই রাত গভীর হওয়ার আগেই তিনি রেস্তোরেন্ট থেকে রাতের খাবার সেরে এসে, সেই রাতের মতো সুজানা নাজাসু আসবে এমন একটা অদ্ভুত আশা নিয়ে লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন নিজের বিছানায়।

কিন্তু রাত দ্বিপ্রহরের পরও যখন সুজানা নাজাসু এলো না তখন তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। সাথে সাথে র্দুভাবনা এসে ভর করলো তার মস্তিষ্কে। সকালে যখন লোকটা আসবে তার ফোন সেটটা নিয়ে যেতে তখনকার বিষয়টা তিনি কিভাবে সামাল দেবেন এ কথা ভেবে অস্থির হয়ে পড়লেন। উল্টে পাল্টে কতোভাবেই ভাবলেন, যুক্তি দাঁড় করালেন; কিন্তু তার যুক্তিগুলো নিজের কাছেই একটাও গ্রহণযোগ্য হলো না। শূন্য হয়ে গেল তার মস্তিষ্ক।

চেরাগ আলী ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন কিনা বুঝে উঠতে পারলেন না। কিন্তু হঠাৎ করেই ঘরের লাইটা জ্বলে উঠলে তিনি ধড়ফড় করে উঠে বসলেন বিছানায়। সুজানা নাজাসু দাঁড়িয়ে আছে সুইচ বোর্ডের কাছে। চেরাগ আলী জেগে উঠেছেন দেখে সে পর্দা সরিয়ে এগিয়ে গেল চেরাগ আলীর ফোন মেরামতের টেবিলের দিকে। এবার চেরাগ আলীর ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা দিল।

সুজানা নাজাসু প্রথমে কাস্টমারের সেই ফোনটাই ড্রয়ার থেকে বের করে আনলো। দ্রুত সেটা সেরে তারপর টেবিলে রাখা বাকি চারটাও সে রাতের মতো দ্রুতই সেরে দিয়ে আচমকা চলে গেল ভ্যান্টিলিটর দিয়ে।

চেরাগ আলী এবার চালাকি শুরু করে দিলেন। নষ্ট ফোন সেটগুলো পরের দিন দেওয়ার শর্তে রাতের জন্য রেখে দিতে লাগলেন। এতে যদি কেউ রাজি না হয় তবে তিনি সেটা মেরামত করতে অপারগতা জানাতেন। আর যারা রেখে যান তারা পরদিন সকালে ঠিকটাক মতোই তাদের সেটটা পেয়ে যান। ফোনসেটের মধ্যে যত বড় সমস্যাই থাক না কেন চেরাগ আলী রাতের জন্য রেখে দিলে তা নিশ্চিত ঠিক হয়ে যাবেই।

দ্রুতই চেরাগ আলীর সুনাম ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। তার আয় রোজগারও হু হু করে বেড়ে গেল। এখন প্রতিরাতেই সুজানা নাজাসুকে আসতে হয় তার ঘরে। একটানা কয়েক ঘন্টা কাজ করতে হয় তার টেবিলে বসে। কিন্তু চেরাগ আলী তাকে কোনদিন কোন কথা বলাতে পারেনি। এমনকি সে নিজে থেকে কোনদিন একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। চেরাগ আলী শুধু একটা ভয়েই তাকে ঘাটান না। তিনি ভাবেন যদি সুজানা নাজাসু এতে রেগে গিয়ে আর কোনদিন তার ঘরে না আসে, তাহলে তার কি হাল হবে।

চেরাগ আলীর ব্যবস্যা দ্রুতই রমরমা হয়ে উঠে। কিছু দিনের মধ্যেই বিশাল পরিসরে দোকান সম্প্রসারণ করতে বাধ্য হলেন তিনি। তবে বুদ্ধিমান চেরাগ আলী তার পুরাতন দোকানটা ছাড়লেন না। রাতে এখানে বসেই তিনি জটিল সমস্যায় জর্জরিত ফোন সেটগুলো মেরামত করেন। চেরাগ আলীর ফোনসেট মেরামতের অসাধারণ নৈপূন্যতায় কাস্টমাররা মুগ্ধ। তার বিরুদ্ধে তাদের আর কোন অভিযোগ নেই।

কাস্টমারদের নষ্ট ফোন সেটগুলো নিয়ে এখন আর তাকে ভাবতে হয় না। টেবিলের ড্রয়ারে রেখে শুয়ে পড়লেই হলো। রাতে সুজানা নাজাসু চুপিচুপি এসে চেরাগ আলীকে না জাগিয়েই তার কাজ শেষ করে যায়।

এক রাতে চেরাগ আলীর প্রচণ্ড জ্বর আসলো। তিনি জড়ো সড়ো হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন নিজের বিছানায়। গভীর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায়ই তার জ্বর ছেড়ে গেল। ঘামে ভিজে গেল সারা শরীর, গায়ের কাপড়, বিছানার চাঁদর। ভেজা ভেজা অনুভূতিতে এক সময় তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। গায়ের কম্বলটা সরিয়ে তিনি উঠে বসলেন বিছানায়।

রাত তখন প্রায় শেষ ভাগে চলে এসেছে। চেরাগ আলী বাল্বটা জ্বেলে দেখলেন সুজানা নাজাসু ততক্ষণে এসে তার কাজ সেরে চলে গেছে। তিনি নিশ্চিন্ত মনে আবারও চলে এলেন বিছানার পাশে। গায়ের টি শার্টটা চেঞ্জ করে বিছানার চাঁদরটা বদলাতে গিয়ে দেখলেন বালিশের সাদা টাওয়ালে রক্তের দাগ। ভাবলেন, রক্ত খেয়ে টুইটুম্বুর হওয়া মশাই হয়তো কোনভাবে তার সাদা টাওয়ালটায় এসে মরেছে।

কিন্তু হঠাৎ কি ভেবে যেন চেরাগ আলী ডান হাত দিয়ে কানের ওপর মাথার ডান পাশে হাত দিলেন। হাতের মধ্যে ছোট্ট ধাতব কিছু একটা বাঁধলো। নক দিয়ে ঘষে উঠাতে চাইলেন কিন্তু ব্যথা পেয়ে সরিয়ে নিলেন হাত। এবার নিজের অজান্তে মাথার বাম পাশেও বাম হাতটা উঠে গেল। এখানেও একই রকম একটা ধাতব কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করলেন তিনি। হাতটা ঘুরিয়ে মাথার পেছন দিকে নিয়ে গেলে ওখানেও একই রকম একটা ধাতব কিছুর স্পর্শ লাগলো।

সে রাতের পর থেকে সুজানা নাজাসু আর আসেনি। চেরাগ আলী আর কোনদিন থাকে কোথাও দেখেননি। কিন্তু এখন আর সুজানা নাজাসুকে তার প্রয়োজন হয় না। তিনি নিজেরই এখন ফোন সেটের মেরামত করতে পারেন। এমন কোন সমস্যাই নেই- যে চেরাগ আলীর দ্বারা মেরামত করা সম্ভব নয়।

তবে তিনি সুজানা নাজাসুকে ভুলেননি। প্রতি দুপুরে আর রাত গভীরে তিনি সুজানা নাজাসুর জন্য অপেক্ষা করেন। কিন্তু সুজানা নাজাসু আর আসে না। 

শহরের বিখ্যাত ফোনসেট মেকানিক চেরাগ আলী জানেন না, সুজানা নাজাসু আর আসতে পারবেনা কোনদিন। আর এটাও তিনি জানেন না, সুজানা নাজাসু আসতে পারবেনা জেনেই সে রাতে চির বিদায় নেওয়ার আগে চেরাগ আলীর মাথার স্লটগুলো খুলে মেরামত করে দিয়েছিল।
***
রচনাকাল : ২৭/৮/২০২০
© কিশলয় এবং মোঃ তোফায়েল হোসেন কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 1  China : 11  France : 2  Germany : 2  Hungary : 3  India : 126  Ireland : 5  Israel : 1  Mongolia : 1  
Russian Federat : 9  Saudi Arabia : 4  Singapore : 1  Sweden : 12  Ukraine : 6  United States : 100  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 1  China : 11  France : 2  
Germany : 2  Hungary : 3  India : 126  Ireland : 5  
Israel : 1  Mongolia : 1  Russian Federat : 9  Saudi Arabia : 4  
Singapore : 1  Sweden : 12  Ukraine : 6  United States : 100  
© কিশলয় এবং মোঃ তোফায়েল হোসেন কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সুজানা নাজাসু by Md. Tofayel Hossen is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৪৮৪১৩৯
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী