নিজের কলমে 'আমার জীবনের সেরা শিক্ষক'--কে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ করে দিলো 'কিশলয় পত্রিকা'। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েই আজ স্মৃতির পাতায় ভীড় করেছে ছাত্রী জীবনের সেই পড়াশোনা, শাসন,বকুনি আর মজার গল্প। এক অদ্ভুত স্নেহের স্পর্শ জুড়ে আছে এই শিক্ষক শব্দটির মধ্যে। ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রত্যেকের জীবনে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শিক্ষিকারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সব সম্মানিত শিক্ষকদের মধ্যে ভালো লাগার এমন শিক্ষক শিক্ষিকা থাকেন, যাঁদের পড়ানোর পদ্ধতি, স্নেহ ভালোবাসা আমাদের মনে আলাদা করে দাগ কেটে যায়। তাঁদেরকেই আমরা সেরার আখ্যা দি, তাই তাঁরাই হন আমাদের জীবনের পথ চলার প্রেরণা।
কারণ প্রয়োজনের তাগিদে ,আমাকে বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতে হয়েছিল। তারপরও মুঠো ফোনের দৌলতে কিছুজনের সাথে যোগাযোগে ছিলাম। কিন্তু শীতের শিশির বিন্দুর মতোই বেলা বাড়ার সাথে সাথে আমরা সবাই মিলিয়ে গেলাম। আজ বলবো,জীবনের সেরা শিক্ষক আমার মায়ের কথা। মা ছাড়া যে পৃথিবীর আলোয় দেখতাম না,তাই প্রথম শিক্ষাগুরু মা। মা শব্দটি উচ্চারণ করলেই তাই মনে হয়,
"প্রথম স্পর্শ মা,প্রথম গন্ধ মা,প্রথম শব্দ মা,
প্রথম চলা মা,প্রথম বলা মা,
প্রথম গুরু মা,সকল শুরু মা,প্রথম স্নেহ মা,
অন্তরের অন্তরাতে শব্দব্রহ্ম মা...."
কিন্তু আজ গর্ভধারিনী মায়ের কথা বলছি না। মা অর্থাৎ সেই মা যে আমার শিক্ষা গুরু। সেই মা যে আমাকে জীবনে চলার পথে সুশিক্ষিত, জীবনের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পর্কে হাতে ধরে শিখিয়েছেন।
Teacher অর্থাৎ শিক্ষক শিক্ষিকা। শিক্ষিকা শব্দের অর্থ শিষ্টাচার, ক্ষমাশীল এবং কর্তব্যপরায়ণ। শিক্ষা শব্দটি এসেছে শাস ধাতু থেকে যার অর্থ হলো শাসন করা বা উপদেশ দান করা। অন্যদিকে শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ Education এসেছে Latin শব্দ educare বা edukatum থেকে। যার অর্থ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা। প্রখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটল বলেন,
"সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হলো শিক্ষা"। আর আমার ঠাকুর বলে,
"শিক্ষা হলো তাই, যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।"
আজ আমরা যা শিখেছি যতটা শিখেছি তার অধিকাংশটাই শিখিয়েছেন আমাদের শিক্ষক শিক্ষিকারা। সফলতার পেছনে থাকে শিক্ষক শিক্ষিকার অবদান। যাঁদের ওপর ভর করে আমরা মাথা তুলে দাঁড়াই। স্কুলের গণ্ডি পার করার পর কম বেশি আমরা সকলেই বারবার ফিরে দেখি ফেলে আসা স্কুলের দিন। হ্যাঁ, ওই দিনগুলি বেশ ছিল। পরীক্ষার টেনশন, হাজার বকুনি, চোখ রাঙানির বেড়া জাল দেওয়া ঐ চনমনে অতীত কে আজ খুব ভালো সময় বলে মনে হয়। যে সময়টাকে আমাদের গড়ে তোলার কারিগর হিসাবে ছিলেন আমাদের শিক্ষক শিক্ষিকারা। আজও তাঁদের বিরামহীন জ্ঞান উজাড় করে গড়ে যাচ্ছেন একের পর এক ছাত্র-ছাত্রী।
ব্যক্তিগত কথা বলি, আমার মেয়েবেলা যে স্কুলে কেটেছে অর্থাৎ প্রভাবতী বালিকা বিদ্যালয়, ইদানীং ফেসবুকের দৌলতে স্কুলের বান্ধবীদের মুখে যখন শুনি আমাদের কয়েকজন শিক্ষিকা আর ইহ জগতে নেই, তখন গলার কাছে কষ্টটা বড্ড জোরে ধাক্কা মারে। কী কঠোর অনুশাসনে আমাদের স্কুল জীবন কেটেছিল। স্কুলের প্রধান ফটক যেন জেলখানার গরাদ। আর আমরা স্কুল ভর্তি লাল ফিতে, সাদা মোজা,সাদা জুতো, সাদা জামার কিশোরী সেই স্কুল নামক জেলখানার ছয় ঘণ্টার কয়েদি। ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘরে পৌঁছনোর খানিক আগেই স্কুলের মাঠে সবাই জড়ো হয়ে পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণী প্রার্থনা করতাম ,
"ভাইয়ের মায়ের এতো স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ, ও মা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি, আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি।"
প্রার্থনার মাঝে আমাদের দুষ্টুমি চলতো কিন্তু শিক্ষিকাদের চোখ রাঙানির ভয়ে আমরা তটস্থ থাকতাম। অথচ প্রতিটি শিক্ষিকা ছিলেন স্নেহশীলা।
আজ যাঁর কথা বলছি তাঁকে আমরা সম্পূর্ণরূপে পেয়েছি যখন আমরা নবম শ্রেণীর কিশোরী। বিজ্ঞান ভাগ হয়ে গেল। ভৌত বিজ্ঞান আর জীবন বিজ্ঞান। পদার্থ বিদ্যা এবং রসায়ন বিদ্যার জটিল নীরস রসায়নকে সরস করে জটিল অংশগুলি এমন ভাবে বুঝিয়ে দিতেন যে বিষয়টির ওপর ভয় কাটার সাথে সাথে শ্রদ্ধাও বাড়তে লাগলো। বিজ্ঞানের নানা বিষয় আলোচনায় কতো কি জানতে পারতাম। ফর্সা, সুন্দর লম্বা বিনুনি মানেই ছোটো রুমাদি। আর দিদির সেই ডাক ক্লাসে এসেই প্রথমে ছিল,
"আমার মেয়েরা।"
আজ সেই ডাকের বড়ো অভাব। প্রতিটি ছাত্রীর নাম শুধু নয়, রোল নম্বরও কন্ঠস্থ ছিলো যা তিনি অবলীলায় বলতে পারতেন। আজ এই বয়েসে এসে বুঝতে পারি ,গুরু শিষ্যার সম্পর্কই শুধুমাত্র নয় মা মেয়ের সম্পর্ক ছিলো। দিদিকে আমরা ভয় খুব পেতাম আর নিয়ম নিষ্ঠার ফাঁসে দম বন্ধ হয়ে আসতো কিন্তু আজ মা হয়ে বুঝি এই নিয়ম নিষ্ঠার প্রয়োজন কতটা। আবার দিদির অন্যরূপ পেয়েছি সরস্বতী পূজার খিচুড়ি আলুরদম খাওয়ার সময় , স্কুলের বাৎসরিক এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময়। স্কুলের অনুষ্ঠানে গ্রিন রুমে পুরুষ চরিত্রে নাচ থাকলে ধুতি পরানো, নাকের নীচে কাজল পেন্সিল দিয়ে গোঁফ এঁকে দেওয়া, চুল আঁচড়ে দেওয়া, শাড়ি পরানো ; সে যেন দিদির এক অন্য রূপ। কি সুন্দর বন্ধুর মতো মিশে যেতেন আর পড়ার সময় কি ভয়ঙ্কর পেতাম দিদিকে। যখন দিদি গম্ভীর হয়ে জিগ্যেস করতেন ,
"2Mg+O2 কি হয় ?
যদি বলতে পারতাম 2MgO.
দিদি গম্ভীর হয়ে একটু ছোট্ট খুশি হতেন কিন্তু যখন জিগ্যেস করতেন,
"নিউটনের দ্বিতীয় গতি সূত্র অথবা Fe+CuSO4 র ব্যালান্স কি হয় ?"
আর বলতে না পারলে চোখ এমন গোল গোল করে পাকিয়ে দেখতেন যে মনে হতো যেন হৃৎপিণ্ড বুঝি লাফিয়ে বেরিয়ে এসে জীবন বিজ্ঞানের প্র্যাক্টিক্যাল খাতার মতো এঁকে দিদির সামনে চলে আসবে। ফলশ্রুতি, কান ধরে বেঞ্চের ওপর দাঁড়ানো! কিন্তু এই দিনগুলিই যে ভীত তৈরি করেছে আমাদের তা বেশ বুঝতে পারি এখন।এখন বুঝতে পারি ওই রাগী রাগী ভাবই ছিলো ওনার মুখোশ মাত্র আর অন্তরে ছিলো সুনিবিড় ছায়া। ওই যে কথায় আছে, ওপরের কাঠিন্যকে জয় করতে না পারলে যে ভেতরে রসের সন্ধান পাওয়া যায় না, ঠিক তেমনি করেই দিদি আমাদের শিখিয়েছিলেন ওপরের কাঠিন্যকে জয় করে ভেতরের রসের সন্ধান কেমন করে পেতে হয়। অত্যন্ত স্নেহশীলা অথচ প্রয়োজনে ভীষণ কঠিন কঠোর ব্যক্তিত্ব ,এই হলেন আমাদের সকলের প্রিয় ছোটো রুমাদি। যাঁর অমোঘ আকর্ষণে আজ স্মৃতির পাতায় ভাসতে ভাসতে চলে এসেছি নিজের থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়রের জীবন থেকে ছোট্ট এক টুকরো ছুটি নিয়ে যাতে দুটো ঝুঁটি লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা ছটফটে প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর বালিকা থেকে কিশোরী র সোনালী স্মৃতিতে ছোটো রুমাদির আদরের হাত ধরে ফিরে যেতে পারি।
তবে, আমার জীবনের সেরা শিক্ষক শিক্ষিকা ছাড়াও এমন কয়েকজন মনীষী, বিপ্লবীর কথা না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যাঁরা নিজেদের শিক্ষা, চেতনা,আত্মপলব্ধির দ্বারা আমাদের জ্ঞানচক্ষু খুলে দিয়েছেন। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ করে তোলেন ও মেয়েদের শিক্ষার জন্য লড়াই করেছিলেন। রাজা রামমোহন রায়,প্রথম আধুনিক পুরুষ যিনি কুসংস্কার,সতীদাহ প্রথা, পণ প্রথার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন ও মেয়েদের শিক্ষার জন্য লড়াই করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ, যিনি ভারতবর্ষের নাম উঁচুতে তুলে ধরেছিলেন ও যুবসমাজের চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব, যিনি পুঁথিগত শিক্ষা না থেকেও সকল মানুষের জ্ঞানচক্ষুর পর্দা খুলে দিয়েছিলেন। গৌতম বুদ্ধ, যিনি জাগতিক সুখকে ত্যাগ করে সাধনায় ব্রতী হতে শিখিয়েছিলেন। ব্যাস দেব, যিনি বেদের সংস্করণকে ঋক,সাম, যজু, অথর্বে ভাগ করেন। মহর্ষি বাল্মীকি,যিনি সংস্কৃতের মহাপণ্ডিত রামচারিত মানস সৃষ্টি করেন। চাণক্য, যিনি অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক ও চিন্তাবিদ ছিলেন। শংকরাচার্য, যিনি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করে চেতনার জাগরণ ঘটিয়েছিলেন। আর্যভট্ট, যিনি বিখ্যাত গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ ছিলেন। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি শুধুমাত্র নিজের রচনার মধ্যে দিয়েই নয় কাজের মধ্যে দিয়েও শিক্ষার আলোক ছড়িয়েছেন। এপিজে আব্দুল কালাম, যিনি মিসাইলম্যান নামে খ্যাত তিনি বিজ্ঞানকে শুধুমাত্র ভারতে নয় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, শহীদ কানাইলাল,শহীদ ক্ষুদিরাম,শহীদ ভাগৎ সিং, শহীদ রাজগুরু,শহীদ সুখদেব, বিপ্লবী মণীন্দ্রনাথ নায়েক, বিপ্লবী শ্রীশ চন্দ্র ঘোষ,শহীদ বিনয়,বাদল,দিনেশ,বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত,বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দার, প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলী আরও কতো যে নাম আছে সেরা শিক্ষক শিক্ষিকার তালিকায় তা লিখে শেষ করতে পারবো না।
একজন সফল মানুষের পেছনে যে একজন শিক্ষক শিক্ষিকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সে শিক্ষক যে শুধুমাত্র পড়াশোনার ক্ষেত্রেই হতে হবে তা নয়, তিনি জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রেই হতে পারেন। আজ আমি যে এই প্রতিটি কথা, প্রতিটি শব্দ গুলি লিখতে পারছি তা শুধুমাত্র এক শিক্ষকের জন্যই। কারণ, আমার জীবনের ব্যর্থতার দিনে তিনি শুধুই আমার পাশে দাঁড়ান নি ,আমার সফলতার দিনেও আমার লক্ষ্য ওই মানুষটিই স্থির করে দিয়েছেন এবং দিচ্ছেনও। পড়েছিলাম যখন অন্ধকারে,তখন শিক্ষক নামক আলোর ফেরিওয়ালার হাত ধরে এলাম আলোয়। আসলে আমরা কোন পথে হাঁটবো তা অন্ধকার নির্ধারিত করেনা, তা নির্ধারিত হয় আলোর দ্বারা। আমার জীবনের সকল সফলতার জন্য তাঁর সাথে থাকার অবদান অনস্বীকার্য। জীবনে নিজের কাজের প্রতি অবিচল থাকতে শিখিয়ে চলেছেন সেই মানুষ গড়ার কারিগরটি।
গুরু--শিষ্যার সম্পর্কই হচ্ছে আসলে এক অসামান্য সম্পর্ক যা দিন ও রাতের মতোই এক নিবিড় সম্পর্ক। আসলে, সময় থামেনি আর বয়েসও বাড়েনি শুধু রয়ে গেছে টান টান পিছুটান ,তাই বড়ো করে পাওয়া গেলো আবারও ছোটবেলাকে ক্ষীর সন্দেশের নরম পাকে কিশোরী বেলার মালাইয়ে যা মিলিয়ে যায়। তবু তারা ফিরে তাকায় কারণ এই স্বাদেরও যে ভাগ হয়। আমার জীবনের সেই সকল সেরা শিক্ষক-শিক্ষিকাকে অন্তরের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, প্রণাম জানিয়ে তাদের দীর্ঘায়ু সুস্থতার কামনা করে লেখার ইতি টানলাম তবে।
রচনাকাল : ২০/৮/২০২০
© কিশলয় এবং সুমি ভট্টাচার্য্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।