মনসা মঙ্গল কাব্য .... জয় জয় মা মনসা
মা মনসার গল্প (দ্বিতীয় পর্ব)
তথ্যসংগ্রহ, সম্পাদনা ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
বিষহরি পূজা’ই প্রকারান্তরে মনসা পূজা। আমাদের দেশে যেখানেই সাপের ভয় বা সাপের উৎপাত বেশি সেখানেই সাপের দেবী রয়েছে। তার পুজো হয়। নানা লোকাচার পালিত হয় সর্দপদেবীকে কেন্দ্র করে। বাংলায় বিশেষ করে দক্ষিন ও দক্ষিন পশ্চিম অঞ্চলে সাপের উৎপাত বেশি। তাই সাপের দেবীর মাহাত্ম নিয়ে লোকাচারও বেশি। এখানে সাপের দেবতা – মনসা ।
গ্রামে গ্রামে মনসার থান আছে। সেখানে নিয়মিত মনসার পুজো হয়। আবার বাড়িতেও তুলসী তলার পাশে একটা মনসার ডাল পোঁতা থাকে। সেই মনসার গাছেও মনসা দেবীর অধিষ্ঠান বলে মনে করা হয়। বাংলার বাইরেও সাপের নানা দেবতা আছে। কোথাও নাগরাজ, কোথাও নাগাম্মা। আবার বালনাগাম্মা, মুদামা ও মঞ্চাম্মা ইত্যাদি আরো কতো নাম। দেবীর মাহাত্মনিয়ে অনেক গল কথা মুখেমুখে প্রচলিত। তা নিয়ে কত গল্প , নাটক সিনেমা হয়েছে। এখনো তা মানুষের কাছে অসীম আগ্রহের বিষয়।
গ্রামের সার্বজনীন মনসা থানে সমবেত হয়ে যে সমস্ত বার ব্রত ও উপবাস গুলির পালন করা হয় তার মধ্যে জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্ল দশমীতে অনুষ্ঠিত বিষহরি মনসা পূজার ব্রত অন্যতম এক মাঙ্গলিক ব্রত রূপে বিবেচিত হয়।যদিও দক্ষিনবঙ্গে এই একই দিনে দশহরা গঙ্গা পূজারও আয়োজন হয়ে থাকে।
ব্রতগুলি গ্রামীন মহিলাদের অজস্র সংস্কারে আকীর্ণ। প্রতিটি পূজার ব্রতর ন্যা য় মনসা পূজার ব্রততেও অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। সধবা নারীরা এই পূজার ব্রতাচার পালন করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা ঠিক পূজার আগের দিন নিরামিষ খাবার রান্না করে থাকে। দশহরা পূজার দিন রান্নার কোনো বাহ্যি ক রীতি রিয়াজ বা নিয়ম নাই।
ওই দিন দশ প্রকার পুষ্পবতীপত্র, ফুল ও ফলমূলাদি সহ দুধ-কলা ও মিষ্টি মিষ্টান্ন দ্বারা পূজা দেওয়া হয় বলে এরূপ পূজার নামকরণ দশহরা পূজা রাখা হয়েছে। প্রধানত দুধ-কলা ও চিনি সন্দেশের নৈবেদ্যে পূজা দেয়া এই ব্রতের অন্যযতম প্রধান রীতি ও নিয়ম। এই ব্রততে দেবী মনসার সন্তুষ্ট হওয়ার নানান মাহাত্ম্য কথা লোক সমাজে অধিক প্রচলিত আছে। তিনি সর্প কূলের আরাধ্যধ দেবী। আষাঢ় ও শ্রাবনের পর্যাপ্ত বৃষ্টিতে আমন ধানের ফলন খুব ভালো হয়ে থাকে। কিন্তু অপর্যাপ্ত বৃষ্টিতে যেমন ধানে অপরিণত শষ্যে র (আগড়ার)পরিমাণ বাড়ে।
আবার এই অপর্যাপ্ত বৃষ্টিতে বিষধর সাপের উৎপাতে মানুষ বেশি অতিষ্ট হয়। আবার অতিরিক্ত বৃষ্টিতে যখন মাঠ ঘাটে জলে ভরপুর হয় তখনও এই একই পরিণতি ঘটে। শুধু তাই নয় অপর্যাপ্ত বৃষ্টিতে বিষধর সাপের বিষের পরিমাণ ও তার তীক্ষ্ণতা এতোটাই বাড়ে যে (কালাচ, কেউটে, চন্দ্রবোড়া) সাপের কামড়ে বেশিরভাগ মানুষ চিকিৎসার প্রাগ মূহুর্তে প্রাণ হারায়। তাই বিষধর কাল সাপের কামড়ের হাত থেকে বিরত থাকার অন্য,তম এক মানসিক শক্তি লাভের পথ হিসাবে মানুষ বিষহরা মনসা পূজার প্রচলন শুরু করেছিল এমনই কিছু অনুমান করা হয় লোক শিক্ষার অন্দর মহলে।
মনসা কালসাপ কূলের প্রধানা রূপে খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীতে উপশাস্ত্রীয় দেবীপুরাণে সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। মনসা মঙ্গলের পালাতে মনসার লীলামহিমার ভয়াবহ ঘটনায় তার সেই বাহন কালসর্পের পরিচয় অতি সহজেই মেলে। তাই সেই বাহন স্বরূপ কাল সাপের হাত থেকে জীবন রক্ষার দরুন বিষহরি ব্রত ও পূজার আয়োজন করে থাকে দক্ষিণবঙ্গ তথা অখণ্ড বাংলার নারী সমাজ।
ব্রতের মূল অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসা মূর্তি হলেও প্রকৃত পক্ষে পূজার নৈবেদ্যাদি নিবেদন সমার্পন করা হয় একটি কাটা সিজ মনসার ডালের সন্নিকটে। যেখানে লাল রঙের সিঁদুর দিয়ে রাঙায়িত করা হয়। তার সামনে দুধের বাটি ও কলা নিবেদন করেন গ্রামের মায়েরা। এই সিজ মনসার ডাল পূজার প্রচলন যে ঠিক কবে সে বিষয়ে সঠিক তথ্যের উপস্থাপন মোটেই সহজ নয়।
তবে অধিকাংশ লোক দেবদেবীদের মূর্তি পূজার পূর্বে যেমন তাদের (আটেশ্বর, পেঁচাপেচি, ধর্মঠাকুর) বৃক্ষ পূজারই অধিক প্রচলন ছিল। মনসা পূজার ক্ষেত্রেও এই তথ্যভ একেবারে অযৌক্তিক নয়। বৃক্ষের মধ্যেপ বট, অশ্বথ্ব, পাকুর, বেল, তাল, সিজ মনসার বহুল প্রচলিত ছিল বলেই অনুমান করা হয়।
মায়েদের অনেকেই এদিন উপোস রাখে। গ্রামের মন্দিরে আবার অনেকেই গন্ডিও দিয়ে থাকে পরিবারের সদ্য্ দের কল্যাদণার্থে। আবার অনেকে বাড়িতে ব্যােক্তিগত ভাবে সিজ মনসার ডাল লেপন করে সেখানেও পূজা দেয়। আবার অনেকে বলেন এই ব্রততে গঙ্গা ধরণীর বক্ষে পদার্পন করেন। তাই এ দিন গঙ্গা স্নানে দশ প্রকার পাপ খণ্ডিত হয় বলে অনেকে গঙ্গা পূজার ব্রতও পালন করে গঙ্গা স্নান সুসম্পন্নের মধ্যে দিয়ে।
বিষহরা ব্রত পালনকারী যযমান দের প্রতি প্রত্যে্কের ঘরে ঘরে পান্তা খেয়ে পূজার রীতি রক্ষা করে। উনুন জ্বালানোর রীতি নাই। লোক সমাজে পৌরাণিক গল্পের কাহিনীতে বর্নিত রয়েছে যে ওই দিন উনুন জ্বালানো হলে দেবী মনসা তাঁকে স্বপ্নে সাপের ভয় দেখান। এমনকি বাস্তবেও বিষাক্ত কালসর্প এই অপরাধের কারণে দংশনও করতে পারে। তাই সমস্ত দক্ষিণ বঙ্গ জুড়ে বেশ ঘটা করে এই পূজার নিয়ম কানুন, ব্রত ও উপাচার পালন করতে দেখা যায়।
গ্রামের মহিলাদের বেশীরভাগ মায়েরা সর্প দংশনের ভয়ে ভীত হয়ে এই দেবীকে বেশ ঘটা করে পূজা দেয়। কারণ মনসার পালা গানে এই দেবীর চন্দ্রধরের নিকট থেকে পূজা নেওয়ার কৌশল অন্যা ন্যক অঞ্চলে অজানা থাকলেও এদের অজানা নয়। তাই অন্যান্য দেবীর তুলনায় এই লোক দেবীর প্রতি অনেক বেশী ভক্তি বর্ষিত হয়। ভক্তির সঙ্গে হোক বা ভয়ে ভয়ান্বিত হয়েই হোক দীর্ঘদিন ধরে মানুষ এই নাগদেবী কে পূজা দিয়ে আসছে।
এই ব্রত ও পূজার আয়োজনে কোনো প্রকার মূর্তি পূজা করা হয় না। কিন্তু যাদের বাড়ির আরাধ্য দেবী মনসা তাদের বাড়িতে বেশ ঘটা করে পূজার আয়োজন করা হয়। মূলত ঠাকুর ঘরের এক কোণে বা তুলসী মন্ডপের পাশে একটা সিজ মনসার কান্ড কে কাদার মধ্যে পুঁতে সেখানে এই পূজার যাবতীয় উপাচার গুলির আয়োজন করা হয়।
কোনো কোনো জায়গায় গ্রামের সার্বজনীন মনসার থানে পূজার আয়োজন করা হয় পূজার উপাচার গুলি নিয়ে। সিজ মনসার কান্ড কে সিঁদুরের টিপ দিয়ে বিশেষ ভাবে সাজানো হয়। তার সামনে ধূপ, দ্বীপ, চন্দন, ফুল ও ফল মূলাদি, মিষ্টি মিষ্টান্ন দ্বারা পূজা দেওয়া হয়। যখন সমস্ত গ্রাম জুড়ে প্রচন্ড সাপের উৎপাতের স্বীকার হয় তখন গ্রামের সার্বজনীন থানে সকলে একত্রিত হয়ে গন্ডি দেয়, ছলনা করে, মানত করে, পূজা দেয়, সিন্নি -ষষ্ঠী দেয়, পুরোহিত ডেকে মঙ্গল ঘট বসিয়ে পূজার শান্তি জল দেবীর চরনামৃত স্বরূপ গ্রহণ করে।
দশহরা পূজার এই পূন্য লগ্নে বহু থানে মনসার পালা গানের আয়োজন করা হয়।অনেকে আছেন যারা আর্থিক দিক থেকে সবল তাঁরা ব্যক্তিগত মনসার গানের দল বায়না করে। সমস্ত পরিবারকে সাপের উৎপাত থেকে রক্ষার জন্য গৃহস্থরা এই পূজার আয়োজন করে। দক্ষিণ বঙ্গের বহু গ্রামাঞ্চল রয়েছে যেখানে নারী সমাজের বিশ্বাস ইচ্ছাধারী নাগদেব দেবী আজও জগতে বসবাস করে। এদের পূজার আয়োজন হয় দিন,বার ও তিথির পুন্য মূহুর্তে।ভক্তরা নাগদেবী রূপী এই সাপের সেবনের জন্য পাত্রে ভরে দুধ ও কলা দিতে দেখা যায় দু’এক জায়গায়।
মনসার মৃন্ময়ী মূর্তির পিছনে এদের গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে অনায়াসে এরা সেই দুধ সেবন করে আবার গর্তে ঢুকে যায়। গ্রামের মানুষ বলেন এরা কারো কোনো ক্ষতি বা অনিষ্ট করে না। বরং বহিরাগতশত্রু দের হাত থেকে গ্রামের মানুষ কে রক্ষা করে আসছেন বহু বছর ধরে। তাই মনসা দেবী শুধুমাত্র আর দশটা দেব দেবীদের মত ঠিক তা নয়। তিনি গ্রামের মানুষের থেকে একদিকে যেমন পূজা নেন বিনিময়ে গ্রামের মানুষের রক্ষার ভার ও তিনি বহন করেন। তাই শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামে মনসা দেবীকে কেন্দ্র করে বহু প্রকার বার, ব্রত ও উপাসনার নিয়ম রয়েছে।
রচনাকাল : ১৮/৮/২০২০
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।