ভালোবাসি
আনুমানিক পঠন সময় : ৬ মিনিট

লেখিকা : অস্মিতা ভাদুরী
দেশ : India , শহর : Konnagar

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ১৪ টি লেখনী ৩২ টি দেশ ব্যাপী ৮০৮২ জন পড়েছেন।
Asmita Bhadury
প্রায় চার বছর হতে চলল মেঘলা ও বিভোরের বিবাহিত জীবন। কিন্তু আজ ও ওরা একে অন্যকে ঠিক করে চিনে উঠতে পারেনি। না, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা নয়, ব্যস্ততা কাটিয়ে বিভোর ও সময় দিতে পারেনা, আর  লজ্জা কাটিয়ে মেঘলাও এগোতে পারেনা। বিভোরের মা মণিমালা দেবী বোঝেন সব টাই, কিন্তু বড়ো ছেলে বৌমার মধ্যে কি আর উনি কথা বলতে পারেন ! তাই নিজের যতটা সম্ভব উনি মেঘলা কে খুশি রাখার চেষ্টা করেন।  বিকেল বেলা ছাদে বসে চুল বেঁধে দেওয়া, মাঝে মাঝে পাড়ার মোড়ে ফুচকা খেতে নিয়ে যাওয়া, পুজোর সময় কেনা কাটা সবেতেই মেঘলা তার শাশুড়ি মা কে পাশে পায়। কিন্তু যাকে চায় তাকে পাওয়া হয় না। কেমন যেন মনে হয় মেঘলার যে বিভোর হয়তো তাকে নিয়ে ঠিক খুশি নয়।

উল্টো দিকে বিভোরের মনেও এক ই দোলাচল। যতই মনে করে আজ মেঘলা কে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসবে, বাইরে খেতে যাবে ,ঠিক হয়ে ওঠেনা। দু একবার চেষ্টা করেছিল, ফল অন্যরকম। মেঘলা কে যখন ই বলে কোথাও যাওয়ার জন্য ও ঠিক শাশুড়ি কে সঙ্গে নেবেই।
বিভোরের এতে খারাপ লাগে না, আবার ঠিক ভালো ও লাগে না। এই তো সেবার শীতের এক মিঠে দুপুরে বিভোর বললো মেঘলা কে " কাল কিন্ত দুপুরে ফাঁকা থেকো, নন্দনে একটা খুব সুন্দর মুভি এসেছে, তোমার ভালো লাগবে মনে হয়, আমি টিকিট করছি কিন্তু।"

মেঘলা একবার উজ্জ্বল চোখে তাকালো বিভোরের দিকে, তারপরেই ওর মনে পড়লো ওর শাশুড়ি মা একদিন পুরানো গল্প করতে করতে বলেছিলেন AC হলে তে সিনেমা দেখার তার খুব ইচ্ছে, নন্দন এ যাওয়ার ইচ্ছেও তাঁর।

সেই কথা ভেবে কখনোই বরের সাথে ড্যাং ড্যাং করে ওর যাওয়ার ইচ্ছে হলো না, ও বললো বিভোর যেন তিনটে টিকিট কাটে। বাবা কেও নিয়ে যেত, কিন্তু বয়স্ক মানুষ টাকে এতটা ধকল দেয়া উচিৎ হবেনা ভেবে সেকথা বললনা।মেঘলার কথায় আবার গম্ভীর হয়ে গেল বিভোর।

পরের দিন তাড়াতাড়ি সব কাজ সেরে তিনজনে বেরিয়ে পড়ল। সত্যি খুব সুন্দর সিনেমা টা। বিভোর যে কিকরে বুঝলো মেঘলার পছন্দের কথা সেটাই ভাবলো মেঘলা।

এই ভাবেই চলছিল। 

সেবার একটা বিশেষ কাজে মেঘলার মামাবাড়িতে এলো মেঘলা, গ্রামের বাড়ি এখন আর কেউ থাকেনা। দোতলা বাড়ি, উপরের তলায় তালা দেওয়া, নিচের তলায় কেয়ারটেকার আর তার পরিবার থাকেন। মেঘলার কাজ একদিনে মিটল না, রাতে শুতে খুব ভয় করলো তার, তাই সে পরের দিন বিভোর কে বলল সে যেন রাতে ওই বাড়িতে ফিরে আসে, তারপর কাজ মিটলে দুজনে চলে যাবে। বিভোর ও তাই করল। পরের দিন রবিবার। জনতা কারফিউ সেদিন। দুপুরে খেতে বসে মেঘলার মায়ের ফোনে তারা জানতে পারে পরদিন বিকেল পাঁচটা থেকে লকডাউন শুরু। শুনেই চমকে গেল দুজন, তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে বাড়ির জন্য বেড়িয়ে পড়ল তারা। কিন্তু, বিধি বাম, নাকি এটাই ভবিতব্য কে জানে ! দেখলো গ্রামের লোকেরা এতো কিছু না বুঝেই, এলাকা টি কে বন্ধের চেহারা দিয়েছে। সেখান থেকে রেল স্টেশন কমপক্ষে তিন কিলোমিটার। ওই সন্ধের মুখে হেঁটে যাওয়া সম্ভব না। অনেক চেষ্টা করেও ওরা বেরোতে পারলোনা মুক্তাপুর গ্রাম থেকে। ফিরে এলো মামাবাড়িতে।

অজ পাড়া গাঁ, ঝড় উঠলে কারেন্ট চলে যায়, বেশিরভাগ সময় ফোনের নেটওয়ার্ক থাকেনা, প্রয়োজনীয় জিনিস প্রায় পাওয়াই যায়না। সেরকম জিনিস নেই ঘরে। আলো , জল , পানীয় জলের বেশ অসুবিধা। এরকম জায়গায় দু' চার দিন ঘুরতে ভালোলাগে, কিন্তু দিনের পর দিন থাকা …
তারওপর যদিও বা টিভি আছে , কোনো কেবল সংযোগ নেই। 

প্রথম দু এক দিন মুষড়ে পড়লেও আস্তে আস্তে সব মানিয়ে নিলো ওরা। বাড়ি টা কে আসতে আসতে পরিষ্কার করলো মেঘলা। অবাক হয়ে দেখলো, যে বিভোর বাড়িতে এক গ্লাস জল ও নিজে নিয়ে খায়না, সে নিজে থেকেই মেঘলার কাজে হাত লাগাচ্ছে। রান্না ঘর টা একটু পিছন দিকে, রাতে রুটি করতে ভয় পায় মেঘলা একা একা, তাই বিভোর এসে বাইরের দাওয়া তে বসে থাকে যাতে মেঘলা ভয় না পায়।  

এরকম ই একদিন সকালের জলখাবার খাবার পর মেঘলা সবজি নিয়ে বসেছে কোটাকুটি করতে। পাশ থেকে বিভোর হঠাৎ বললো " একি ! আমাদের এখানে, মানে এই মুক্তাপুরেও এসে গেছে ভাইরাস ! এই যে খবরে দেখিয়েছে, দ্যাখো ! " আচমকা কথা শুনে বিভোরের দিকে তাকাতে গিয়ে, ছুরি-চপবোর্ড এ অভ্যস্ত মেঘলা বঁটিতে ডান হাতের বুড়ো আঙুল এ গভীর করে কেটে ফেললো। যন্ত্রনায় আঁৎকে উঠলো মেঘলা। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এলো রক্ত। নিজের বাম হাত দিয়ে চেপে ধরে রইলো কাটা জায়গাটা। ব্যাপার টা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত লাগলো বিভোরের ! তারপরেই দৌড়ে একমগ জল এনে বললো " শিগগিরি হাত টা ডোবাও এতে, আরাম পাবে ! " 
মেঘলা একবার ডুবিয়ে আবার তুলে নিলো হাত টা, বললো " আরে জলে ডোবালে সব রক্ত বেরিয়ে আসবে তো ! " 
বিভোরের তখন মাথা কাজ করছে না, কি করলে রক্ত কমবে ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেলো কদিন আগে নন্দনে দেখা সিনেমার একটা অংশকে। মেঘলার রক্তমাখা আঙ্গুল টা নিয়ে নিজের মুখে পুরে চুসে দিলো ভালো করে। সত্যি ই তো, রক্ত বেরোনো বেশ কমে গেল। মেঘলা অবাক আর বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলো বিভোরের দিকে।
একটু পরে নিজের ব্যাগ হাতড়ে একটা এন্টিসেপটিক ক্রিম পেলো সে, সেটা লাগিয়ে , নিজের রুমালটার একটা অংশ ছিঁড়ে, যত্ন করে বেঁধে দিলো  মেঘলার আঙ্গুল এ।

সেসব মেটার পর মেঘলা বলল " কিছুই তো রান্না হয়নি, আজ খাবো কি ? এখানে তো কিছু কিনে খাবার ও যো নেই ?"
বিভোরের সাহায্যে , সেদিন যাইহোক একটু রান্না সেরে স্নানে গেল মেঘলা। কিন্তু হায় চুল মুছতে পারছেনা , লাগছে হাতে। বিভোর আলতো করে মুছে দিলো মেঘলার ভেজা চুল। আঁচড়ে দিলো নরম করে।
খেতে বসে মহা বিপদ, কাটা জায়গায় লঙ্কা নুন লাগতেই অসহ্য যন্ত্রনা শুরু।
বিভোর একটু ইতস্ততঃ করে নিজের থালা থেকেই খাইয়ে দিতে গেল মেঘলা কে, কিন্তু লজ্জায় মেঘলা মুখ খুলতে পারলোনা। একটা চামচ এনে বিভোরের মেখে দেওয়া ভাত , মুখে তুলে আস্তে আস্তে খেতে শুরু করল। 
বিভোর বারবার বলেছিল রাতেও ভাত করতে, কিন্তু মেঘলা জানে রাতে বিভোর ভাত মোটেই পছন্দ করেনা। তাই , রাতে অনেক কষ্টে কয়েকটা রুটি করলো মেঘলা। বিভোর যথারীতি সাহায্য ও করলো তাকে।
কিন্তু , রাতে রুটি খেতে বসে মেঘলার আর উপায় রইলো না। রুটি তো আর চামচে করে খাওয়া যায়না ! বাধ্য হয়ে, বিভোরের খাইয়ে দেয়া রুটি খেতেই হলো মেঘলা কে।

পরপর দু তিন দিন এভাবেই খাইয়ে দেওয়া চললো। হাতের ব্যাথা কমে যাওয়ার পর মেঘলা খেতে বসে নিজেই খেতে শুরু করতে গেল, বিভোর হাত টা ধরে বলল " ভাগ্গিস লকডাউন এ এই গ্রামের বাড়িতে তুমি আমি আটকে পড়লাম, ভাগ্গিস তোমার হাত টা কেটে গেল, না হলে তো বুঝতেই পারতাম না কথা টা ! "

মেঘলা অবাক হয়ে বিভোরের দিকে তাকিয়ে বলল " কি কথা গো ?"

"ভালোবাসি তোমাকে" , বলল বিভোর !

ওরা খেয়াল করেনি হয়তো সেদিন ছিল পঁচিশে বৈশাখ, পাশের বাড়ির রেডিও তে বাজছিল …

" ভালোবাসি, ভালোবাসি, এই সুরে কাছে দূরে, জলে স্থলে বাজাই,
বাজাই বাঁশী, ভালোবাসি, ভালোবাসি। "


রচনাকাল : ১৭/৮/২০২০
© কিশলয় এবং অস্মিতা ভাদুরী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 1  China : 22  Denmark : 1  France : 11  Germany : 59  India : 552  Ireland : 4  Lithuania : 1  Netherlands : 1  
Norway : 23  Romania : 2  Russian Federat : 3  Saudi Arabia : 4  Sweden : 13  Switzerland : 2  Ukraine : 24  United Kingdom : 7  United States : 153  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 1  China : 22  Denmark : 1  
France : 11  Germany : 59  India : 552  Ireland : 4  
Lithuania : 1  Netherlands : 1  Norway : 23  Romania : 2  
Russian Federat : 3  Saudi Arabia : 4  Sweden : 13  Switzerland : 2  
Ukraine : 24  United Kingdom : 7  United States : 153  
লেখিকা পরিচিতি -
                          ১৯৯১ সালের ১১ই জানুয়ারি হাওড়া জেলার অখ্যাত গ্রাম হিরাপুরে জন্মগ্রহণ করেন অস্মিতা। বর্তমানে কোন্নগরবাসী এই লেখিকার, ছোট থেকেই লেখা লিখির প্রতি ঝোঁক ছিল। মূলত মা কে দেখেই অনুপ্রেরণা পান লেখিকা। পেশায় শিক্ষিকা হলেও শখ বলতে নিজের ছোট্ট বাগানের ও পোষ্যদের পরিচর্যার পাশাপাশি গান শুনতে ভীষন ভালোবাসেন। বেড়ানো, ছবিতোলা, নাচের কোরিওগ্রাফ করা শখের মধ্যেই পড়ে। কলম যেহেতু তলোয়ারের চেয়েও  শক্তিশালী, তাই নিজের বলতে না পারা সব কিছুর প্রতিবাদ লেখা দিয়েই করেন। 

ভালো থাকায় ও ভালো রাখায় বিশ্বাসী হয়ে, পরিচিত অক্ষর ও শব্দ দিয়েই , নতুন গল্পমালার সৃষ্টি করেন ! 
                          
© কিশলয় এবং অস্মিতা ভাদুরী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
ভালোবাসি by Asmita Bhadury is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪০৭৩২
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী