মনসা মঙ্গল কাব্য .... জয় মা মনসা
পৌরাণিক গল্প (প্রথম পর্ব)
তথ্যসংগ্রহ, সম্পাদনা ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
ঘন জঙ্গলে সর্পবেষ্টিত মনসা দেবী। পুরাণেই প্রথম মনসার জন্ম-সংক্রান্ত উপাখ্যানটি পাওয়া যায় । পুরাণ মতে , মনসা ঋষি কশ্যপের সন্তান তথা কাশ্যপ গোত্রজ । উল্লেখ্য , মঙ্গলকাব্যে শিবকে মনসার পিতা বলা হলেও , পুরাণে সেই তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায় না । একবার সাপ ও সরীসৃপরা পৃথিবীতে উৎপাত শুরু করলে , ঋষি কশ্যপ নিজের মন থেকে মনসা দেবীর জন্ম দেন । মন থেকে জন্ম বলে তার নাম হয় ‘মনসা’ । সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তাকে সর্প ও সরীসৃপদের দেবী করে দেন । মনসা তার মন্ত্রবলে পৃথিবীতে নিজের কর্তৃত্ব বিস্তার করেন । এরপর মনসা শিবকে প্রসন্ন করেন । শিব তাকে বলেন নারায়ণ প্রসন্ন করতে । মনসার প্রতি প্রসন্ন হয়ে নারায়ণ তাকে সিদ্ধি নামক দৈবী ক্ষমতা প্রদান করেন । এর ফলে দেবী হিসেবে মনসার কর্তৃত্ব সুবিদিত হয় ।
কশ্যপ ঋষি জরৎকারুর সঙ্গে মনসার বিয়ে দেন । জরৎকারু এই শর্তে মনসাকে বিবাহ করতে রাজি হয়েছিলেন যে , যদি মনসা তার কথার অবাধ্য হন , তবে তিনি মনসাকে পরিত্যাগ করবেন । একবার মনসা জরৎকারুর নিদ্রাভঙ্গ করতে দেরি করেছিলেন । এতে সেদিন জরৎকারুর পূজা করা হয়ে ওঠেনি । এই ঘটনায় দুঃখিত হয়ে জরৎকারু মনসাকে ত্যাগ করেন । পরে দেবতাদের অনুরোধে তিনি মনসার কাছে ফিরে আসেন এবং আস্তিক নামে এক পুত্রের জন্ম দেন ।
মনসাবিজয় কাব্যে উল্লেখ আছে, বাসুকীর মাতা একটি বালিকার মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। সেই মূর্তিতে শিবের বীর্য নিক্ষিপ্ত হলে তা থেকে মনসার জন্ম হয়। বাসুকী মনসাকে নিজ ভগিনী বলে স্বীকার করে নেন। রাজা পৃথু যখন গাভীরূপী পৃথিবীকে দোহন করছিলেন, তখন তা থেকে বিষের উৎপত্তি হয়। বাসুকী মনসাকে সেই বিষের কর্তৃত্ব প্রদান করেন। শিব মনসাকে দেখে আকৃষ্ট হন। কিন্তু মনসা তাকে নিজ পিতৃপরিচয় দান করলে, শিব মনসাকে গৃহে নিয়ে আসেন। শিবের স্ত্রী চণ্ডী মনে করেন, মনসা শিবের অপর স্ত্রী বা তার জারজ সন্তান। তিনি মনসাকে অপমান করে তার একটি চোখ দগ্ধ করেন। মনসা একচক্ষু-বিশিষ্ট দেবীতে পরিণত হন। পরে সমুদ্রমন্থনের সময় হলাহল বিষের প্রভাবে শিব যখন মৃতপ্রায় হন, তখন মনসা তার প্রাণরক্ষা করেন। একদিন চণ্ডী মনসাকে লাথি মারেন। মনসা তখন বিষদৃষ্টি দিয়ে চণ্ডীকে অজ্ঞান করে দেন। শেষে চণ্ডী ও মনসার বিবাদে বীতশ্রদ্ধ হয়ে শিব মনসাকে একটি গাছের নিচে পরিত্যাগ করেন। তবে তিনি মনসার চোখের জল থেকে নেতো বা নেতা নামে মনসার এক সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেন।
পরে ঋষি জরৎকারু মনসাকে বিবাহ করেন। কিন্তু চণ্ডী মনসার ফুলশয্যার রাত্রিটি মাটি করে দেন। তিনি মনসাকে সর্পালঙ্কার পরিধান করতে বলেছিলেন। তারপর তিনি ফুলশয্যার ঘরে একটি ব্যাঙ ছেড়ে দেন। ফলে সাপগুলি ঘরময় ছুটে বেড়াতে শুরু করে। ভয় পেয়ে জরৎকারু ঘর ছেড়ে পালিয়ে যান। কয়েক দিন পর অবশ্য তিনি ফিরে আসেন। এরপর তাদের পুত্র আস্তিকের জন্ম হয়।
মনসার এক সঙ্গিনী নেতার পরামর্শে মনসা মর্ত্যে নেমে আসেন মানব ভক্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। প্রথম দিকে মানুষ তাকে উপহাস করত। কিন্তু যারা মনসার ক্ষমতা অস্বীকার করল, তাদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলে মনসা তাদের বাধ্য করলেন তার পূজা করতে। মুসলমান শাসক হাসানের মতো বিভিন্ন জাতির মানুষকে মনসা তার ভক্ত করে তুললেন। কিন্তু চাঁদ সদাগর তার পূজা করলেন না। মনসা লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মতো একজন দেবী হতে চাইছিলেন। তাতে সফল হওয়ার জন্য চাঁদ সদাগরের হাতে পূজাগ্রহণ তার কাছে বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু চাঁদ সঙ্কল্প করেছিলেন, তিনি মনসার পূজা করবেন না।
মনসা চাঁদকে ভয় দেখানোর জন্য একে একে চাঁদের ছয় পুত্রকে হত্যা করলেন। শেষে মনসা ইন্দ্রের রাজসভার দুই নর্তক-নর্তকীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলেন। এঁদের নাম ছিল অনিরুদ্ধ ও ঊষা। অনিরুদ্ধ চাঁদ ও তার স্ত্রী সনকার সপ্তম পুত্র রূপে জন্মগ্রহণ করলেন। তার নাম হল লখিন্দর। ঊষা বেহুলা নামে জন্মগ্রহণ করলেন। লখিন্দর ও বেহুলার বিবাহ হল। মনসা লখিন্দরকে হত্যা করলেন। কিন্তু বেহুলা স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে নদীতে ভেসে চললেন। শেষে তিনি চাঁদের সাত পুত্রের প্রাণ ও হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করার উপায় জেনে ফিরে এলেন। চাঁদ মনসার দিকে না তাকিয়েই বাঁ হাতে তার দিকে ফুল ছুঁড়ে দিলেন। মনসা এতেই খুশি হলেন। তিনি চাঁদের পুত্রদের জীবন ফিরিয়ে দিলেন এবং তার হারানো সম্পদও ফিরিয়ে দিলেন। মঙ্গলকাব্যে রয়েছে, এরপর মনসার জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পেল।
রচনাকাল : ১৭/৮/২০২০
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।