নারীত্ব
আনুমানিক পঠন সময় : ২৩ মিনিট

লেখিকা : অস্মিতা ভাদুরী
দেশ : India , শহর : Konnagar

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ১৪ টি লেখনী ৩২ টি দেশ ব্যাপী ৮০৮৫ জন পড়েছেন।
Asmita Bhadury
"একটা মেয়েমানুষের জীবনে শাঁখা সিঁদুরই সব" বলছিলেন রায়গিন্নী, বিকেলবেলা পান মুখে নিয়ে বাইরের রোয়াকে বসে।
রায়বাড়ির বাইরের রোয়াকে একটা মেয়েলি মজলিশ বসে রোজ বিকেলে। কে থাকেনা সেখানে, ঘোষালবাড়ীর দুই বৌ, সেনবাড়ীর গিন্নী,দত্তবাড়ীর শাশুড়ি বৌমা, চাটুজ্জে বাড়ীর নতুন বউ সব্বাই থাকে। আর এসবের মধ্যমনি হলেন রায়গিন্নী, তাদের বাড়ির রোয়াকেই আড্ডাখানা বসে কিনা। তা কোলকাতার মেয়েকে  রায়বাড়ীর বড় বৌমা করে এনেছেন বলে তার  দম্ভ একটু বেড়েছে আপাতত। কিন্তু , ওই বড়বৌমা এই মজলিশে আসেনা। প্রায় মাস দুয়েক হলো বড়ছেলে সুনন্দর বিয়ে দিয়েছেন। একটি দিনও বৌমা কমলিনীকে এখানে আনতে পারেননি। ভিতর ভিতর গৃহযুদ্ধ যতই হোক না, বাইরে সেসবের কিছুই প্রকাশ করেন না তিনি। তা ওই বক্তব্যটি করার কারণ হলো বড়বৌমা আবার লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে এই এঁদো গোলকপুরের বউ হয়ে এসেও পড়ার প্রতি ঝোঁক হারাতে পারেনি। সঙ্গের স্যুটকেসে শাড়ি গয়নার সাথে কিছু বই আর পত্রিকাও এনেছে সে। বড়ছেলে তো কলকাতাতেই থাকে, শনিবার রাতে বাড়ি আসে, সোমবার ভোরে বেরিয়ে যায়। তা সারা সপ্তাহের খবরের কাগজ জুটিয়ে আনে সে নতুন বউএর জন্য। খবর না জানলে নাকি তার খুব অস্বস্তি হয়। তাই বাসী হলেও খবরের কাগজ তার চাইই। সাথে কোনো কোনো সপ্তাহে বই ও আনে সুনন্দ বউএর জন্য। কোনোদিন সাজগোজের জিনিস বা শাড়ি আনতে দেখেননি রায়গিন্নী। আবার বৌমাও কোনোদিন সেসব আবদার করেনি। তা আজকে ভোরে ছেলে বেরিয়ে যাবার পর খবরের কাগজের ভিতর থেকে একটা খবর পরে শোনায় তাকে বড়বৌমা। তাতে লিখেছে বড় বড় আদালতে নাকি বলেছে শাঁখা সিঁদুর পড়া মেয়েদের নিজের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। এরকম কথা কেউ কোনোদিন শুনেছে ? তা, তার বৌমাটি বেশ সাধাসিধে, কথা কম বলে, কাজ কর্ম বেশ তাড়াতাড়ি শেষ করে খালি পড়াশোনাতেই যেন মন। তা এ হেন খবর যে আজ বৈকালিক মজলিসের আসর মাতাবে তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে?
সবাই নিজের নিজের মত শোনালো। শুধু চুপ করে রইলো সেনগুপ্ত বাড়ির মেজোবউ।
সেনগুপ্ত বাড়ির বড় ছেলের এখনো বিয়ে হয়নি। সে আফ্রিকায় কি সব জন্তু মন্তু নিয়ে কাজ করে, জীবনের অনেক ঝুঁকি আছে তাই বিয়ে করে আরেকজনের জীবন বরবাদ করবে না বলেই বিয়ে করেনি। এটা যে কেবলই একটা অজুহাত, তা সবাই বেশ বোঝেও। বউ হয়ে আসা ইস্তক মেজবৌ চন্দনা মাত্র দুবার তার ভাসুরকে দেখেছে, ঘোমটার আড়াল দিয়ে।একবার তার বিয়ের সময়, আরেকবার শ্বশুরমশাইয়ের যখন বাড়াবাড়ি অসুখ করেছিল তখন। সেও গ্রামের মেয়ে, তবে এই গোলকপুরের মতো বর্ধিষ্ণু নয় সে গ্রাম, সেখানে বেশির ভাগই ভাগ চাষী, দুবেলা ভরপেট খাবার জোটাতেই হিমশিম খায়। তাই এরকম ভালো ঘরে মেয়েকে দিতে দুবার ভাবেননি তার বাবা। খোঁজ নেবার প্রয়োজনও মনে করেননি জামাইয়ের ব্যাপারে। আর সে থাকে কলকাতায়, ন'মাসে ছ'মাসে বাড়ী আসে, তার মধ্যে সে খুব রগচটা, একটু কথার এদিক ওদিক হলেই আর দেখতে হবে না। তাই নামমাত্র সোনা গয়না দিয়ে মেয়েটিকে বিদেয় করে হাঁফ ছেড়েছিলেন তিনি। গায়ের রঙ শ্যামলা বলে বিয়ে ভেঙে যাচ্ছিল বারবার, তাই এই যাত্রায় ভালোয় ভালোয় সব মিটে যেতেই তাঁর শান্তি হলো যেন।

কিন্তু , বিয়ের মাস তিনেক পরেই একদিন জামাই এসে মেয়েকে বসিয়ে দিয়ে গেলো তার ঘরে। কি না, মেয়ে নাকি প্রতিবাদ করেছিল। কিসের প্রতিবাদ , স্বামী মাসান্তে দুদিনের জন্য বাড়ি এসেও মদ গিলে দিনভর পরে থাকে কেন? একটু কথার এদিক ওদিক হলেই গায়ে হাত তোলে কেন ? শরীর খুব খারাপ হলেও বাড়ির কাজ ঠিক করে না হলেই শাশুড়ি ছেলে মিলে মারধর করবে কেন ?
এত্তোসব নাটক চলবেনা ওই বাড়িতে। তাই সে যেন ঐবাড়ির যোগ্য হয়ে তবেই যাওয়ার কথা ভাবে, নইলে যাওয়ার ইচ্ছে ত্যাগ করাই ভালো। ততদিনে তার শরীরে নতুন প্রানের উপস্থিতি টের পেয়েছে সে। কিভাবে যে বাবাকে সব বোঝাবে ভাবতে ভাবতেই শুনলো তার বাবা জামাইকে বলছেন, " আমি গরিব মানুষ, ও মেয়েকে নিয়ে একঘরে হয়ে যাবো বাবা, মালিক আর চাষ করতেও দেবেনা। তুমি ওকে নিয়ে ফেরৎ যাও, আমার কিচ্ছু করার নেই, মা মারা মেয়ে তো তাই একটু ধ্যাটা ধরণের। একটু মানিয়ে গুছিয়ে নাও বাবা। একে তুমি নিয়েই যাও !"

সেই শেষ দেখেছিল বাবাকে আর ছোট ভাইটাকে, আর কোনো খোঁজ সে নেয়নি কোনোদিন তাদের। ভাইটার চোখে সেদিন জল টলটল করছিল। কিন্তু, বছর আটেকের ছেলেটার কিচ্ছু করার ছিল না। তারপর থেকে শ্বশুরবাড়িটা আরো কস্টকর হয়ে উঠলো তার কাছে। মারধর, কালসিটের দাগ আরো বাড়লো। কারনে অকারনেই খাওয়া দাওয়া বন্ধ হতে লাগল।

ছোট দেওর কে ছোটো ভাইয়ের মতোই দেখত সে। কিন্তু , একদিন বিকেলে তার শাশুড়ি যখন বৈকালিক মজলিশে এসেছেন, আকাশ কালো করে ঝড় উঠলো। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলো। বাড়িতে সে ,তার দেওর আর কাজের মাসি মালতী আছে শুধু। মাসি ছাদে কাপড় জামা তুলতে ছুটলো, কারণ বউএর শরীর ভালো নেই আর ছাদে দৌড়ে দৌড়ে ওঠাও মানা। তাও চন্দনা উঠে জানলা দরজা গুলো লাগাচ্ছিল। দেওরের ঘরে গিয়ে দেখে সে বিছানায় উল্টে ঘুমোচ্ছে, হাতে একটা মোটা বই খোলা। সে জানলা গুলো লাগালো, পর্দা টেনে যেই বেরোতে যাবে দেখে তার দেওর কখন ঘুম থেকে উঠে একদম দরজা আগলে দাঁড়িয়ে। তার দিকে আগুন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে, ওই দৃষ্টির বিষ চিনতে পেরেই বুকটা ধড়াস করে উঠলো তার। বাইরে তখন মুহুর্মুহু বাজ পড়ছে, মাসি মনে হয় ছাদে গিয়ে ওপাশের ঠাকুর ঘরে ঢুকে গেছে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে। ঘরময় দৌড়াদৌড়ি করেও নিজেকে বাঁচাতে পারলোনা চন্দনা। ভাইয়ের মতো দেখতো যাকে, তার আদিম ইচ্ছের শিকার হতে হলো তাকে। যখন সে ছেড়ে দিয়ে বারান্দায় চলে গেল, নিজের ক্ষতিটা ভালো করে বুঝলো সে। নিজের পেটেরটাও চলে গেল নিজের সম্মানের সাথে। কয়েকপা গিয়েই নিজের ঘরের সামনের চৌকাঠের কাছে মাথা ঘুরে পরে গেল সে। 

যখন চোখ মেললো দেখলো শাশুড়ি পাশে বসে আছেন, মাসির কোলে মাথা আর দেওর পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে মাকে বোঝাচ্ছে কিভাবে বৌদিদি ঝড়ের সময় জানলা বন্ধ করতে গিয়ে তাড়াহুড়োয় চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো। মুখ দিয়ে কোনো স্বর বেরোচ্ছেনা তার। শুধু বুঝতে পারছে নিজের পরনের কাপড়টা রক্তে ভিজে যাচ্ছে। শাশুড়িমা মাথায় হাত বুলিয়ে ধরা ধরা গলায় বললেন, " কিরে বউ, একটু ভালো লাগছে শরীর ? কি হারালি বুঝেছিস ? " শাশুড়ির মুখে এরকম কথা শোনার অভ্যেস তার নেই, তাই অবাক হয়ে গেল । মাসি চোখের জল মুছে বলল, " চিন্তা কোরোনা গো বৌমা, কদিন বেশরাম নাও, আবার নতুন খবর আসবে কদিন পরে।"

সত্যিই নতুন খবর এলো কদিন পরে, তবে তা সুখের নয়। চন্দনার স্বামী সেই ঝড়ের বিকেলে নিষিদ্ধপল্লী থেকে ফিরছিল। পথে , মাথায় বাজ পরে মারা গেছে। টহলরত পুলিসের থেকে এটাই জানা গেছে। শরীর ঝলসে গেছিল তাই প্রথমে চেনা যায়নি। পরে শনাক্তকরণ করেন ওনার অফিসের একজন সহকর্মী। তারপরেই বাড়িতে খবর আসে। সাদা কাপড়ে মোড়া দেহ হয়ে যখন সে ঢুকলো বাড়ির উঠানে, তার মায়ের আকাশফাটানো কান্না ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছিলনা। চন্দনা হয়তো সব অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছিল। কারণ আটদিন আগে মারা যাওয়া স্বামীর দেহ তার সামনে যখন এলো তার আগের রাতেই তাকে আরেকবার ব্যবহার করেছে তার দেওর। ভোররাতে, বাড়ির সবার গভীর ঘুমের সুযোগ নিয়ে। অশক্ত শরীরে তেমন করে প্রতিবাদ করার আগেই মুখ চেপে ধরেছিল স্বামীর ছোটভাই।

সে জানতো না কি করা উচিৎ !
বোঝেনি কাকে বললে বাঁচবে সে!
 নিজের বাপই মুখ ঘুরিয়ে নিলে , আর কার কাছে যাওয়া যায়?

তাই শুকনো দৃষ্টি নিয়ে স্বামীর শুকনো ,আপাদমস্তক সাদা কাপড়ে মোড়া শরীরটার দিকে তাকিয়ে ছিলো সে। আচ্ছা, যদি তার স্বামী বেঁচে থাকত, তাকে বললে কি তিনি বিশ্বাস করতেন প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের কুকীর্তি? নাকি আরো বাড়তো নিজের শরীরের কালশিটের দাগ?

এসব ভাবনায় ছেদ পড়লো মাসির ডাকে। মাসি তাকে ধাক্কা দিয়ে বলছে একটু কাঁদার জন্য। তার চোখের জল না পেলে নাকি তার স্বামীর স্বর্গযাত্রায় বাধা পড়বে। এত কষ্টেও সে ভাবলো, যাক তাহলে তারও ক্ষমতা আছে স্বামীর স্বর্গযাত্রা পন্ড করার! তার এতদিনের এত চোখের জলের দাম যে দেয়নি ,আজ নাকি তারই দরকার সেই অদরকারী চোখের জল !

শ্মশানের কাজ সেরে, তার শাঁখা সিঁদুর ঘুচিয়ে সবাই যখন বাড়ী ঢুকলো তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। নিয়ম কানুন যন্ত্রের মতো মানছিল চন্দনা। তার আর চিন্তাশক্তি ছিলোনা। রাতে মাসিকে পাশে নিয়ে শুলো সে। ভয় লাগার অজুহাতে। আর মায়ের সঙ্গে শুলো ছোটছেলে, মায়ের আদেশে। এভাবেই সব কাজ কর্ম মিটে যাওয়া পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছিল। ঝামেলা হোল মৎসমুখের পরের দিন থেকে। মায়ের নির্দেশ, এবার সংসারের ভার ছোটোছেলেকেই নিতে হবে, তাই বাকি পড়াশুনা আর কাজের ব্যবস্থাপনা সে যেন কলকাতায় গিয়ে করে। দাদারা যেমন আলেকালে বাড়ী আসতো, তেমন এলেই হবে। রোজ রোজ আসার কোনো দরকার নেই, যাতায়াতের খরচও অনেক।
ছেলে কিছুতেই যাবেনা, আর মা পাঠাবেই। শেষে উপায় না দেখে, তল্পিতল্পা বেঁধে দুদিনপরে বেরিয়ে গেল সে।
চন্দনা হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। কিন্তু , কিছুতেই বুঝতে পারলোনা তার শাশুড়ির এরকম ব্যবহারের কারণ।এভাবেই দিনগত পাপক্ষয়ের মতো করে দিনকাটতে লাগলো শাশুড়ি-বৌমার।

 মাঝে মাঝে যখন দেওর আসে, ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে চন্দনা। তবে সব ভয় উৎপাটন করে দেন শাশুড়িমাই। ওই রাত গুলো বৌমাকে নিজের কাছে নিয়ে শোন তিনি। 

এতদিন পর এই আসরে আজ তাই মনটা অন্যরকম হয়ে গেলো  চন্দনার। পুরোনো সব কথা কেমন মনে পড়ে গেল। হুঁশ ফিরল শাশুড়ির ডাকে, আঁধার হয়ে এলো, বাড়ি ফিরতে হবে তো।

বাড়ি এসে দেখে বড়ভাসুর এসেছেন। কোনো খবর না দিয়েই এসে হাজির। তাকে দেখেই শাশুড়ীমা আবার কান্নাকাটি শুরু করলেন। বড়ছেলের ওপর চিরকালই তাঁর বেশ ভরসা। তাই মনে একটু জোর পেলেন। ওদিকে চন্দনা হেঁসেল সামলাতে ঢুকে গেল। মাসি ততক্ষনে ময়দা মেখে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি দুজনে লুচি, তরকারি, সুজি করে নিলো। বড়ছেলের সবথেকে প্রিয় খাবার। তাই ওনাকে আসতে দেখেই মাসি তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছিল। সেসব হয়ে যেতেও শাশুড়িমা হেঁসেলের দিকে এলেন না দেখে মাসির হাতেই খাবার গুলো পাঠিয়ে দিলো সে। জলের গেলাসটা দিতে ভুলে গেছিল। সেটা নিয়ে তাড়াতাড়ি ঐঘরের দিকে যেতে যেতেই শুনতে পেল চাপা গলায় শাশুড়ি আর ভাসুরের কথোপকথন থেমে গেল তাকে দেখে। একটু খটকা লাগলেও, সে আর এখন কিছুই খুব বেশি ভাবেনা। যা আছে কপালে তাই তো হবে!

রাতে মাসি শুলো তার সাথে। দাদা নাকি মায়ের সাথে শোবে। তা, মাসিকে তার সাথে শুতে দেওয়ার কারণ কিছুই বুঝলনা সে।

পরেরদিন রায়বাড়ি থেকে খবর এলো নতুন বউ এর সুখবর এসেছে। পাড়ায় মিষ্টি বিতরণ হচ্ছে। মনটা কেমন হুহু করে উঠলো চন্দনার। সেদিন বিকেলে, মজলিসের একটু আগেই বৌমাকে নিয়ে রায়বাড়ি গেলেন সেনগুপ্তগিন্নী। গিয়ে বড় বউএর সাথে তার মেজবৌমার আলাপ করিয়ে দিলেন। রায়গিন্নিও খুশি হলেন তার ভালো খবর শুনে যে ওনারা এসেছেন সেটা দেখে। তাই মিষ্টি আনতে ভাঁড়ারঘরে গেলেন। এই সুযোগে সেনগুপ্তগিন্নী কথাটা পারলেন রায়বাড়ির বড়বৌ কমলিনীর কাছে। এই জন্যই তো তিনি তাড়াতাড়ি এসেছেন আজ। তিনি কমলিনীকে বললেন তার এই গেঁয়ো , অশিক্ষিত বৌমাটিকে যদি একটু লেখাপড়া শেখায় সে, তবে সবার অগোচরে। কারণ রায়গিন্নী জানতে পারলে তুমুল অশান্তি হবে। এই সময় কমলিনির একা থাকা ঠিক নয়, তাই যদি সে চন্দনাকে কাছে কাছে রাখে সারাদিনের জন্য, একটু একটু লেখাপড়া শিখতে পারে সে । কমলিনী তো এককথায় রাজি। পড়াশোনা নিয়ে আর দুবার বলতে হয় নাকি তাকে ? কিন্তু , অবাক হয়ে গেল চন্দনা। "এসবের মানে কি মা ?", শাশুড়িকে জিগ্যেস করলো সে। তিনি কিছু উত্তর দেয়ার আগেই রায়গিন্নী মিষ্টির বাটি হাতে প্রবেশ করলেন। সাথে সাথেই বৌমা কমলিনী বলে উঠলো ," মা, আপনাদের সেই সই পাতানোর গল্প বলেছিলেন না ? আমি যদি চন্দনা কে সই পাতাই আপনার আপত্তি হবে ?"
যে বৌমা খুশির খবর শোনাতে চলেছে, তার এরকম নির্ভেজাল আবদার না মানার কিছুই নেই, তাই সানন্দে অনুমতি দিলেন তিনি।

শুরু হলো চন্দনার জীবনের এক নতুন অধ্যায় । প্রায়ই চন্দনা আসে কমলিনীর কাছে। দুজনে সই পাতিয়ে একে অপরের ফুল হয়েছে। চন্দনা হলো অতসী ফুল, আর কমলিনী হলো জুঁই ফুল। তারা গল্প করে, একে অন্যের চুল বেঁধে দেয়, কমলিনী শোনায় কলকাতার গল্প, সেখানকার মেয়েদের স্কুলের গল্প। সেসব শুনতে শুনতে কোথায় যে মন ভেসে যায় চন্দনার। প্রায় মাস ছয়েক হলো, মোটামুটি বাংলা পড়তে আর লিখতে পারে এখন চন্দনা। এবার তার সই বাপের বাড়ি যাবে। কলকাতায় ডাক্তার হাসপাতালের অনেক সুযোগ সুবিধা, তাই আগামী বেশ কিছু দিন সে ওখানেই থাকবে। যাওয়ার আগে কয়েকটা বই আঁচলের তলায় লুকিয়ে সে দিয়ে দিল চন্দনাকে। বলে গেল পড়ার অভ্যাস ধরে রাখতে। সে এসে দুজনে মিলে আবার পড়বে একসাথে।

আবার একা হয়ে গেল চন্দনা। এবার এসে ভাসুরঠাকুর অনেক দিন ছিলেন। প্রায় একমাস। এর মধ্যেই তিনি কোথায় কোথায় যেন সব কথা বলে গ্রামে ইলেকট্রিক আনার ব্যবস্থা করেছেন। সব বাড়িতেই মোটামুটি ইলেকট্রিক নেয়া হয়েছে। তাই রাতে শুয়ে শুয়ে বেশ আরামে বই পড়তে পারে চন্দনা। হাওয়া আসার জন্য আর জানলা খুলতে হয়না। পাখা ঘোরে মাথার ওপর। একদিন শহরে গিয়ে একটা ছোট যন্ত্র কিনে আনলেন তিনি। নাম মোবাইল ফোন না কি। কমলিনীর বরের কাছে আছে সে জিনিস। ও দেখেছে কয়েকবার। ওতে অনেক দূর থেকেও কথা শোনা যায়, বলা যায়। তার ভাসুরেরও যে একটা আছে সে জানত না। তার ভাসুর সেটা এনে মাকে বলল সব বুঝে নিতে কি করে ফোন করতে হয়, কিকরে ধরতে হয়। কিন্তু , এই বয়সে তাঁর মাথায় ওসব ঢোকেনা। উল্টে তিনি তো ভয়েই মরছেন এটা কি নাকি এক অদ্ভুত জিনিস। তাই ডাক পড়লো চন্দনার। সব কিছু বুঝে নিতে হবে। একগলা ঘোমটা দিয়ে সে দূরে দাঁড়িয়ে রইল। তাই দেখে শাশুড়িমা হেসেই খুন, " হাহাহা, আরে ও বউ, ওই তেপান্তরের মাঠের ওপার থেকে তোকে কিকরে বড়খোকা শেখাবে রে ! কাছে আয় ! দেখে নে কিকরে কি করে। বড়খোকা তো সেই বিদেশে চলে যাবে, তখন ও আমাদের সাথে এই জিনিসটা দিয়ে কথা বলবে। তুই শিখে নে, হঠাৎ দরকার হলেও ওকে এটা দিয়ে জানানো যাবে। তুই শিখে নে মা। যদি এটা আগে থাকত, আগে যদি এসব হত, তাহলে কি আর এত দেরিতে বাপ আমার দুঃসংবাদ পেতো !?" বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। ছুটে এসে শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলো সে। এখন আর তার কোনো ইতস্তত হয়না। সে বুঝেছে, তার শাশুড়ি তাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসে এখন , মাঝের কটাদিন সে দুঃস্বপ্নের মতো ভুলে যেতে চায়। তাই পরম যত্নে সে শাশুড়ির চোখের জল মুছিয়ে দেয় নিজের আঁচল দিয়ে। তারপর ভাসুরের থেকে শিখে নেয় কিভাবে কি করতে হবে। যেহেতু একটু আধটু পড়তে শিখেছে সে, তাই ওই মোবাইল যন্ত্রটায় বাংলায় লেখা পড়ে পড়ে , একের পর এক ধাপ সহজেই শিখে নিল সে। শুধু কয়েকবার ভাসুরের আঙুলে আঙুল লেগে গেলো তার। শেখা হয়ে যেতেই কুয়োর ধারে গিয়ে স্নান করে নিলো সে। জলের আওয়াজে শাশুড়িমা দৌড়ে এলো। বলল," কিরে বউ ? এই সন্ধেবেলা চান করলি কেন ?"  চন্দনা জানালো আগে তো তিনিই বলেছিলেন ভাসুরের গায়ে ছোঁয়া লাগলে স্নান করতে হয়, আজ মোবাইল শিখতে গিয়ে ভাসুর ঠাকুরের আঙুলে আঙুল ঠেকে গেছে তার। তাই স্নান করেছে। সব শুনে হতবাক হয়ে গেলেন তিনি। একসময় এই মেয়ের ওপর কতই না অত্যাচার করেছেন, তাও এই মেয়ে ওনার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কি ভুল যে করেছিলেন ! ভাগ্গিস ভগবান তাকে শোধরানোর সময় বা সুযোগ দিয়েছেন !  তিনি জানিয়ে দিলেন এরপর আর স্নান করতে হবেনা। উনিই বলেছিলেন, এখন উনিই বারণ করলেন। তারপর প্রায় চার পাঁচ দিন ছিলেন সেনগুপ্ত বাড়ির বড়ছেলে মল্লার সেনগুপ্ত। ঐ ক'দিনে বারবার ফোন করে চন্দনাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন সব, ভুল শুধরে দিয়েছেন। যাওয়ার দিন অন্যান্যবারের মতো মায়ের চোখে জল নেই দেখে অবাক হলো চন্দনা। তিনি বলে গেলেন, তিনি পৌঁছে তারপর ফোন করবেন।

কদিন পরে কমলিনীর লক্ষ্মী লাভের খবর এলো। রায়বাড়ি যেন দুঃখে শোকাহত। মেয়ে হয়েছে বলে কেউ খবর দিতেও এলোনা। শুধু মাসি জল আনতে গিয়ে পাড়ায় খবর শুনে এসেছে তাই। চন্দনা ভাবলো, তার বাপ যেমন তাকে ঘাড়ের বোঝা ভাবতো, এই মেয়ের বাপ ও তেমন ভাবে। তবে মনে হয়না জুঁইফুলের বর সেরকম হবে।তাদের মেয়েদের যেন কোনো মূল্যই নেই। অথচ এই মেয়েই দরকার হয় মা বলে ডাকতে, বিয়ে করার সময়, নিজের কামনা বাসনা চরিতার্থ করতে। শুধু সেই মেয়ে বাবা বলে ডাকলেই যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে পুরুষগুলোর। যদি তারাও পুরুষদের এরকম করে নিচুনজরে দেখত, কোনো পুরুষ টিকতেই পারতনা।

যাইহোক, কোনোরকমে বউ নাতনি কে ঘরে তুললেন রায়গিন্নী। চন্দনা দৌড়ে গেল জুঁইফুল আর তার মেয়েকে দেখতে। অন্দরে ঢোকার মুখেই বাধা পেলো। তার মতো কালিন্দি, কপালখাকির সাথে মিশেছে বলেই নাকি তাদের বউ ঐরকম কালো মেয়ের জন্ম দিয়েছে। আর হবে না দেখা !

অপমানিত হয়ে বাড়ি এসেই, ছাদে ঠাকুর ঘরে গিয়ে ঠাকুরের পায়ের কাছে আছড়ে পড়ল। তার কি দোষ যে ঠাকুর তাকে এত শাস্তি দিচ্ছে ? সে গরিব ঘরে জন্মালো তাকি তার দোষ? ছেলে না হয়ে মেয়ে হয়ে জন্মালো সেকি তার দোষে ? তার গায়ের রঙ বাবার মতো কালো, তাও কি তার দোষ ? তার স্বামী অকালে ছেড়ে চলে গেল , সেটাও তার দোষ ? পেটের টাও আসতে না আসতেই চলে গেল, সেটাও তার দোষ? যার দোষে পেটেরটা গেল, কৈ তারতো কোনো শাস্তি হলোনা ?

"তার শাস্তি হবে রে মা, তুই ভাবিস না।"

চমকে গিয়ে ঠাকুরের সিংহাসনের দিকে তাকালো এ কার গলা শুনল ? তাদের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত মা সিংহবাহিনীর ? তারপরেই সামনে  সিংহবাহিনীর ওপর পড়া ছায়া দেখে পিছন ফিরে দেখল দাঁড়িয়ে আছেন সেনগুপ্তগিন্নী স্বয়ং। যেন মা সিংহবাহিনীর মতোই তাকে আগলে রাখবেন বলে আশ্বাস দিচ্ছেন। অবাক চোখে জল নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় চন্দনা। সেনগুপ্তগিন্নী ঠাকুরঘরে ঢুকে এসে চন্দনার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, " আমি সব জানি মা তোর কি ক্ষতি করেছে ছোটখোকা, তুই কেন মা হতে পারলিনা সে আমি জানিরে। মেজোখোকাকে শেষ দেখা দেখেও, আগের রাতের ঘটনার জন্য কেন তোর চোখে জল আসেনি আমি জানি মা। তাই তো তাকে তোর থেকে দূরে পাঠালাম রে, রোজ রোজ আসার পথ ও বন্ধ। কারণ, বড়খোকা এবার তাকে নিয়ে বিদেশে গেছে। কালেভদ্রে আসবে হয়তো। আর তাই তো তোকে একা আর শুতে দিতাম না। বড়খোকা যেদিন এলো সেদিনও ওই ভয়েই তোকে একা শুতে দিইনি। হয়ত বড়খোকা ওরকম পশু নয়, তাও পুরুষ তো ! যার বাপ আর দুই ভাইই দুশ্চরিত্র তার আর পদস্খলন হতে কতক্ষন ? কিন্তু না, ও আমার খাঁটি সোনা। ওকে আমি রায়বাড়ির বড়ো খোকাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলাম যত তাড়াতাড়ি পারে আসতে। খুব বিপদ। বলিনি মেজখোকার কথা। ও আসতেই সেদিন আমি ছোটখোকার কুকীর্তি সব বলি, তুই জল নিয়ে আসতেই তাই আমরা চুপ করে গেছিলাম। ও শহরে উকিলের সাথে কথা বলে দেখেছে ছোটোখোকাকে শাস্তি দিতে হলে তোকে সবার সামনে সব সত্যি ঘটনা নিজে মুখে বলতে হবে, এতে তোর বদনাম করবে আমাদের অশিক্ষিত গ্রাম।তাই কোনোভাবে ওকে দূরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে বড়োখোকা। ও খুব শিগগিরই আবার ফিরে আসবে ছোটখোকাকে রেখে। তারপর ……"

বাইরে মাসির পায়ের আওয়াজে চুপ করে গেলেন সেনগুপ্তগিন্নী। 
মাসি এসে শাশুড়ি বৌমাকে এরকম ভাবে দেখে অবাক হয়ে বলল, " কিগো শাশুড়ি বৌতে কি গুজুর গুজুর করছ ?" 
গিন্নী বললেন ,"সেদিনের কথাই বলছি গো মালতী, তুমি যে আমাকে বলেছিলে তুমি বৌমার গলার নিচের দিকে দাঁতের দাগ দেখেছো, পিঠে, হাতে আঁচড়ের দাগ দেখেছো, গায়ের কাপড় ঠিকঠাক ছিলোনা দেখেছো, আমি সেগুলো নিজে যাচাই করে যখন নিশ্চিত হলাম এ আমার ছোটছেলের দুষ্কর্ম, তখনই ওকে ডেকে জিগ্যেস করলাম বৌমা কিকরে পরে গেল ও জানে কিনা, ও কি সুন্দর বলল সব সাজিয়ে সাজিয়ে। অথচ আমি বাড়ি আসতেই ও বলেছিলো ও নাকি এতক্ষন ঘুমাচ্ছিল, ঝড়জলের কথা জানেই না। তাই আমার বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি কি ঘটেছিল। আর ভাগ্যের পরিহাসে সেদিনই, সেই সময়ই আমার মেজছেলেটাও চলে গেল !"



এতক্ষন মন্ত্রমুগ্ধের মতো সব শুনছিলো চন্দনা। এবার বললো, " মা, মাসি, তোমরা সব জানতে ? তবে আগে আমায় কিছু বলনি কেন ?"

মাসি বললো," আমরা ঠিক করেছিলাম এ কথা কাউকে ঘুণাক্ষরেও জানাবো না, তবে ছোট বাবুকেও আর এবাড়িতে রাখা ঠিক হবে না, বড়বাবুকে তাড়াতাড়ি খবর দেওয়া হবে, ব্যবস্থা একটা হবেই। যদি তুমি নিজে আমাদের বলতে তাহলে আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম গো বৌমা ! কিন্তু, তুমি তো মুখে কুলুপ এঁটে রইলে, সেদিন ভোররাতেও আমি কলতলায় ডাক পড়ায় যাচ্ছিলাম, ছোটবাবুকে তোমার ঘর থেকে চাদর মুড়ি দিয়ে চোরের মতো বেরিয়ে যেতে দেখলাম। ঘরে গিয়ে দেখি তোমার চেতনা নেই, তোমার কাপড় জামা আলুথালু, বিছানার চাদর ঝুলে পড়েছে, ঠোঁটের কস দিয়ে গাঁজলা। বুঝলুম মুখ চেপে ধরে খারাপ কাজ করেছে তাই গাঁজলা বেরিয়ে তুমি জ্ঞান হারিয়েছ। আমি গিন্নীমাকে ডেকে এনে দেখালুম, আবার দাঁতের দাগ, আঁচড় দেখা গেল। আমরা ঠিকই করেছিলাম ছোটবাবুকে শহরে পাঠিয়ে দেবার, কিন্তু, মেজোখোকার খপর টা এলো সেদিনই, তাই আর কটাদিন অপেক্ষা করেই দেখতে হলো।"



চন্দনা সব শুনে শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। মালতী মাসিও চোখ মুছলেন। গিন্নীমাও বৌমাকে আঁকড়ে ধরে বললেন," নীচে চল মা, বড়ো খোকা এলেই তোকে সব বলতাম। তুই আজ ঠাকুরের কাছে উত্তর চাইছিলিস বলে আমি উত্তর দিতে এলাম। তুই আমার ঘরের লক্ষ্মী, এবার আমার ঘরের নারায়ণটাকে বেঁধে রাখবি চল। আমার কিন্তু রায়বউমার মতো ছোট্ট লক্ষ্মীই চাই একটা !"
কিচ্ছু বুঝতে পারলনা চন্দনা। তখন শাশুড়ীমা তাকে বলল," তুই আমার মেজো ছেলের বউ, যদি আমার ছোটছেলে ওই কুকর্ম না করত, আজ তুই এক সন্তানের মা হতিস, আমি তোকে নিয়ে এত ভাবতামনা। কিন্তু, আমি চোখ বুজলে তোর কে আছে বল? ছোটখোকা তোর ওপর আবার যদি চড়াও হয় ? ও তোকে খারাপ পথে নিয়ে যেতে পারে। বড়খোকা শহরে গিয়ে শুনেছে, ছোটখোকা ওর বন্ধুদের নাকি বলেছে গ্রামে একটা কৃষ্ণসুন্দরী আছে, বিধবা, তাকে নিয়ে এলে দারুন ব্যবসা হবে। ওরা তো আর জানেনা মল্লার সেনগুপ্ত ওর দাদা, তাই বলে দিয়েছে। যাইহোক, তুই আমার বৌমা ছিলিস, আছিস, থাকবি। মেজবৌমা ছিলিস, এবার বড়োবৌমা হবি। আমি তোর কন্যাদান করব। মল্লার সেনগুপ্তর বউ হবি তুই, সুখে বাঁচবি বাকি জীবন। বড়খোকাকে আমিই দিয়েছি এই প্রস্তাব, ও মেনে নিয়েছে। ও আর বিদেশ যাবে না। কলকাতায় ওইসব কাজ নিয়ে কি মাস্টারি করা হয়, সেসব কাজ পেয়েছে কি যাদবপুর নাকি কোন একটা জায়গার, কি ভার্সিটি না কোথায়। এই বসত বাড়ী বেচে দেবো, কোলকাতায় থাকবো আমরা সবাই। তোকে বড়খোকা আরও পড়াবে। রায়বাড়ির বড়ছেলেও জানে এসব কিছু। ওই সব ব্যবস্থা করেছে। তাই তোকে ওই বৌমার কাছে একটু পড়ালেখা শিখতে বলেছিলাম। আমরা মূর্খ বলে কত লড়াই হেরে গেছি, এই শেষ লড়াইটা দুইসতীন মিলে লড়ব। তুইও যাতে পরে কোনো লড়াই না হারিস তার ব্যবস্থাই করছি রে। মেয়ে বলে চিরকাল লোকের কথায় নেচেই মরেছি। আর নয়, এবার পালাবদলের দিন। তুই মানুষ হয়ে বাঁচবি রে বউ, মেয়েমানুষ হয়ে নয়।"

দুই সতীন শুনে আবার অবাক চন্দনা। এবার মুখ খুলল মাসি," আমি তোর মায়ের মানে তোর শাশুড়ী মায়ের খুড়তুতো বোন, আমাকে আগে বিয়ে করেছিলেন তোর শ্বশুরমশাই, কিন্তু ছেলেপুলে না হওয়ায় আমার এই দিদিকে বিয়ে করেন আবার, আমার জেঠামশাই মানে তোর শাশুড়ির বাবা খুব বড়লোক ছিলেন, একমাত্র মেয়ে জামাইকেই তাই সব সম্পত্তি দিলেন উনি। তার কথামতই চলতেন তোর শ্বশুরমশাই। উনিই এইগ্রামে জমি কিনে বাড়ী করে দেন।কেউ কোনো খবর জানলোনা, সবার কাছে আমি কাজের লোক মালতী আর তোর শাশুড়ী গিন্নীমা মিনতি এই প্রচার হলো। শুধু তোর শাশুড়ীমাই আমাকে একটু ভালোবাসতো, তাই বেঁচে আছি আজও।"

মাঝে ফোনে খবর নিলো মল্লার কয়েকবার। প্রতিবারই ফোন ধরেই শাশুড়িকে দিয়ে দিত চন্দনা। কিছুতেই মন থেকে মানতে পারেনি তার শাশুড়ির নতুন ইচ্ছে। কিন্তু, এছাড়া তার ভবিষ্যৎই বা কি হবে ? বাবা আছেন না নেই তাই তো জানেনা। আর সেখানে যাওয়ার ইচ্ছাও নেই তার। তাই রাত জেগে আকাশকুসুম ভাবে সে তার জীবন নিয়ে। শুধু এই দুর্দশা হয়েছে বলেই না মল্লারের মতো একটা মানুষ তাকে আপন করতে চায়, নাহলে কি এসব হতো কোনোদিন ? আবার ভাবে, যদি সে বিধবা না হতো, তবে তো তার এই উত্তরণ ঘটতো না, মল্লার তখন এসব ভাবতো ও না। সত্যিই কি সে মানুষের অধিকার বাঁচবে এবার ! নাকি সেনগুপ্তবাড়ির বউ হওয়া ছাড়া আর কোনো যোগ্যতাই তার নেই ? মল্লার কি সত্যিই তাকে মন থেকে মেনে নেবে ? নাকি মায়ের অনুরোধে তার ওপর দয়া করছে মাত্র ?


ক'দিন পরেই মল্লার বাড়ি এলো। মা আর মাসি তখন পুজো দিতে গেছিলেন শিবমন্দিরে। শিবরাত্রি সেদিন। প্রকৃতির নিয়মে সে অশুচি তাই পূজো দিতে পারেনি। সেই সময় ভাসুরঠাকুর এসে হাজির হতে খুব বিপদে পড়ল চন্দনা। কোনোমতে দরজা খুলে দিয়ে ভিতরে চলে গেল। বুঝলো গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষটা, একটু শরবত করে দিলে ভালো হয়। কিন্তু, দিতে যাবে কে ? হঠাৎ শুনলো বারান্দায় এসে মল্লার বলছে," বলছি একটু শরবত, কমসে কম একটু ঠান্ডা জল হলেও ভালো হয়, বড্ড তেষ্টা পেয়েছে, ছাতিটা ফেটে যাবে এবার …"  দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে শরবত তৈরি করতে লাগল সে। মল্লারকে দিতে গিয়ে দেখল সে বারান্দায় দাঁড়িয়েই বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে, কি বলে যে ডাকবে পিছন থেকে ভেবেই পাচ্ছেনা, আর কোনো উপায় না দেখে শুধু উচ্চারণ করল "শরবত টা …"
পিছন ফিরে চন্দনার হাত থেকে গ্লাস টা নেওয়ার সময় আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে গেলো। কোনো ভাবে গ্লাসটা দিয়েই দৌড়ে রান্নাঘরে চলে গেলো সে। কিরকম যেনো অস্থির লাগছে। উনি চন্দনার ভাসুর ঠাকুর, ওনার ছোঁয়া লাগলে স্নান করতে হয় , একথা সে এতদিন মেনেছে। কিন্তু ,মা যে নিজেই বারণ করেছেন সেই কারণটার জন্য। ওই কারণ ও মনে মনেও উচ্চারণ করেনা। কি করবে, হেঁসেলে তো ঢুকে গেলো, স্নানটা করেই ফেলবে ভেবে রান্নাঘর থেকে বেরোতে গিয়েই ধাক্কা খেলো মল্লারের সাথে। খালি গ্লাস টা সে ফেরৎ দিতে এসেছিলো।কিন্তু চন্দনা এমন হুড়মুড় করে বেরোতে যাবে বোঝেনি। ধাক্কা লেগে রান্নাঘরের দরজায় কপালটা কেটে গেলো চন্দনার। যন্ত্রনায় হাত দিয়ে কপালটা চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ল সে। এত তাড়াতাড়ি সব ঘটে গেলো মল্লার কিছুই বুঝে উঠতে পারলোনা। সম্বিৎ পেয়ে সে চন্দনার পাশে বসে, তার হাতদুটো মুখ থেকে সরিয়ে দেখলো রক্তে মাখামাখি। তাড়াতাড়ি পকেটের রুমালটা ভিজিয়ে কপালে চেপে ধরলো।একটু আরাম পেলো চন্দনা। আরাম পেতেই মন বাস্তবে ফিরলো, মনে পড়লো ভাসুর এভাবে দুহাতে আগলে, কপালে ভিজে রুমাল চেপে আছে এটা কিরকম লজ্জাকর ব্যাপার। তাড়াতাড়ি উঠে সরে যেতে গেলো সে। কিন্তু, এমনিতেই প্রাকৃতিক ভাবে অসুস্থ সে, তারওপর মাথায় লেগে রক্ত ঝরেছে বেশ কিছুটা, সব মিলিয়ে মাথা ঘুরে টলে গেল চন্দনা। মল্লার হতচকিত হয়ে ধরে ফেললো চন্দনাকে। জ্ঞানহীন চন্দনাকে কয়েকবার ঝাঁকালো, কিন্তু ফল হলোনা। তাই পাঁজাকোলা করে তুলে তার ঘরে নিয়ে গেলো। শুইয়ে দিয়ে মুখে চোখে জলের ছিটে দিল। পাখা চালিয়ে দিলো। মা আর মাসিও নেই, কি করবে ভেবে পাচ্ছে না সে, এমন সময় শুনতে পেল বাইরেও  কে যেনো তার মা কে ডাকছে। সে বেরোতে যাবে দেখলো বারান্দায় উঠে এসেছে পাশের বাড়ির ছোটছেলে মধুসূদন । মল্লারকে দেখেই বললো," তোমাকেই দরকার ছিলো গো বড়দা, তুমি যেমন বলেছিলে তেমন বাড়ী,জমির খদ্দের একজনকে পেয়েছি,শাঁসালো লোক, বেশ ভালো দাম পাবে …"
বলতে বলতে বিনা অনুমতিতে ঘরের দোরগোড়ায় চলে এলো, এসেই আলুথালু বেশে, জ্ঞানহীন, কাপড়ে রক্তের দাগ লাগা চন্দনাকে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখেই কুৎসিত হাসি ছড়িয়ে মল্লারকে বলল," অঃ , তাই বলি বাড়িতে কেউ নেই কেনো, দাদাও সাড়া দেয়না কেনো, তা অসময়ে এয়ে পড়েছি, বললেই পারতে, আমি বিকেলে আসতুম…হেঁ হেঁ, সে আমি আগেই আঁচ করেছিলুম কেনো এখানকার পাঠ চুকিয়ে একেবারে কোলকেতাবাসি হবে। এমন সোমত্ব মেয়েমানুষ যাদের ঘরে আছে, তারা কি আর পাড়াগাঁয়ে মুখ দেখাতে পারবে কদিন পরে, যাইহোক, অন্যকোনো দরকার হলেও বোলো কিন্তু দাদা আমাকে, আমার ও একজন উপপত্নী আছে, আমি ঐ সব ধাইবুড়ি,হাতুড়ে ডাক্তার চিনি বেশ, তোমার অসুবিধে হলেই আমায় তলব দিও, কেমন ? আসি আমি এখন ! তোমার বেকার সময় নষ্ট করলুম, হেঁ হেঁ…"

মল্লারকে কিছুই বলার সুযোগ না দিয়ে যেমন ঝড়ের মতো, এলো তেমন ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল মধুসূদন। মল্লার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। এমন সময় মা আর মাসির গলার আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে গেলো সে, মায়ের হাত ধরে টানতে টানতে ঘরে এনে বলল সবকিছু, সবিস্তারে। শেষে বলল, " মা, এখান থেকে চলে যাওয়ার চিন্তাটা আমার বা আমাদের ভুল ছিলো। আজ মধুর কথায় বুঝলাম সবাই এরকম ভুলই ভাববে। চন্দনার অপমান হবে। ওকে আমার স্ত্রী কেউ ভাববে না মা। আমি এখানেই থাকবো। তোমরাও এখানেই থাকবে। আমি এখানেই ধুমধাম করে বিয়ে করবো। সত্যিটাকে সানন্দে গ্রহণ করতে হবে মা। পালিয়ে তো তারা যায় যারা অপরাধী। আমরা তো অপরাধী নয়। একটা মানুষ সারাজীবন অন্য কিছু মানুষের দোষের শাস্তি মাথায় করে কেনো বাঁচবে ?হোকনা সে পিতৃহীন, হোকনা অসহায়, হোকনা সে বিধবা, হোকনা আমারই মেজোভাই এর স্ত্রী, হোকনা আমার ছোটভাইএর দ্বারা ধর্ষিতা, সে তো একটা মানুষ, যার মান ও হুঁশ খুব ভালো আছে তার মধ্যে। তবেই সে তোমাদের কাছে কিচ্ছুটি বলেনি ছোটর কুকীর্তি। তোমার ছেলের নোংরামি তোমার সামনে বললে যে তোমারই অপমান সে হুঁশ ওর ভালোই আছে মা।শাঁখা সিঁদুরই সব নয় মেয়েদের জীবনে। মেয়েরা মানুষ। আমি চন্দনার পড়ার ব্যবস্থা করবো, সব কিছুই করবো। কিন্তু , কাউকে লুকিয়ে নয়। আমার স্ত্রী হিসেবে সবার সামনে ওকে আগে স্বীকৃতি দিয়ে, তারপর। যাতে কেউ ওর চরিত্র বা অসহায়ত্বের দিকে আঙুল তুলতে না পারে।"

মল্লার খেয়াল করেনি এইসব কথার মাঝেই জ্ঞান ফিরে এসেছে চন্দনার। সে বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছে দরজার পাশে। সব শুনে আবার ঘরে ঢুকে গেলো সে। 
ছেলের কথায় চোখে জল এসে গেল গিন্নিমায়ের। তিনি সানন্দে মেনে নিলেন ছেলের বক্তব্য। বুঝলেন তার সব কটি ছেলে না হলেও একটি ছেলে হিরে তৈরি হয়েছে।

ক'দিন পরে মল্লারের ইচ্ছে অনুযায়ী সব কিছু হলো। কেউ হাসিমুখে মেনে নিল,কেউ টিপ্পনী কাটলো। চারহাত এক হতে সেসব কোনো বাধাই হলোনা। 
সুখের এই জোয়ার যে তার জন্য অপেক্ষা করছিল, তা ভাবেনি চন্দনা। সেদিন মল্লারের মুখে সব শুনে ও বুঝেছিল, তার ভাসুর তাকে দয়া বা লোভে নয়, মনুষ্যত্বের খাতিরে জীবনসঙ্গী করতে চায়, তাই সে আর না করেনি।শুধু মল্লার মাঝে মাঝে তাকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করে, " এখনো কি আমি ছুঁলে স্নান করো ? নাকি আমি এখন আর অস্পৃশ্য নেই তোমার কাছে??"

লজ্জায় মুখে আঁচল চাপা দিয়ে পালিয়ে যায় চন্দনা। কিকরে জানাবে সে, মল্লারের ছোঁয়াতেই যে সে জানতে পেরেছে আরেকজনের আগমন বার্তা। অনাগত সেই ছোট্ট প্রানের খবর দিলেই নিশ্চই মল্লার বুঝবে, তার ছোঁয়া কতটা দামি এখন চন্দনার কাছে। 

সে যেমন চমক পেয়েছে শাশুড়ি আর সৎ শাশুড়ির থেকে একের পর এক, তেমনই চমক সে পেয়েছে নিজের জীবনেই। কিকরে বোঝাবে কাউকে, বিয়ের পর প্রথম দেখার পর থেকেই তার মনে অন্য জায়গায় ছিল মল্লার। কিন্তু, কোনোদিন মুখ খোলেনি সে। আজও খুলবে না। তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ আর কেউ করবে না যে, মল্লারের কাছে যে সে বাঁচার মতো বাঁচবে এবার। তার চাওয়া যে এভাবে কোনোদিন পূরণ হবে তা,সে ভাবেও নি।

নারীত্ব কি জিনিস না বুঝলেও, তার বানান টা লেখার বা পড়ার সময় কেমন একটা স্বাধীন, চাপমুক্ত অনুভূতি আসে তার।



রচনাকাল : ১৭/৮/২০২০
© কিশলয় এবং অস্মিতা ভাদুরী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 8  Canada : 21  China : 5  Denmark : 3  France : 15  Germany : 60  Hungary : 4  India : 604  Ireland : 2  Lithuania : 1  
Malaysia : 1  Netherlands : 1  Norway : 21  Romania : 2  Russian Federat : 9  Saudi Arabia : 6  Sweden : 12  Switzerland : 3  Ukraine : 25  United Kingdom : 4  
United States : 270  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 8  Canada : 21  China : 5  Denmark : 3  
France : 15  Germany : 60  Hungary : 4  India : 604  
Ireland : 2  Lithuania : 1  Malaysia : 1  Netherlands : 1  
Norway : 21  Romania : 2  Russian Federat : 9  Saudi Arabia : 6  
Sweden : 12  Switzerland : 3  Ukraine : 25  United Kingdom : 4  
United States : 270  
লেখিকা পরিচিতি -
                          ১৯৯১ সালের ১১ই জানুয়ারি হাওড়া জেলার অখ্যাত গ্রাম হিরাপুরে জন্মগ্রহণ করেন অস্মিতা। বর্তমানে কোন্নগরবাসী এই লেখিকার, ছোট থেকেই লেখা লিখির প্রতি ঝোঁক ছিল। মূলত মা কে দেখেই অনুপ্রেরণা পান লেখিকা। পেশায় শিক্ষিকা হলেও শখ বলতে নিজের ছোট্ট বাগানের ও পোষ্যদের পরিচর্যার পাশাপাশি গান শুনতে ভীষন ভালোবাসেন। বেড়ানো, ছবিতোলা, নাচের কোরিওগ্রাফ করা শখের মধ্যেই পড়ে। কলম যেহেতু তলোয়ারের চেয়েও  শক্তিশালী, তাই নিজের বলতে না পারা সব কিছুর প্রতিবাদ লেখা দিয়েই করেন। 

ভালো থাকায় ও ভালো রাখায় বিশ্বাসী হয়ে, পরিচিত অক্ষর ও শব্দ দিয়েই , নতুন গল্পমালার সৃষ্টি করেন ! 
                          
© কিশলয় এবং অস্মিতা ভাদুরী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
নারীত্ব by Asmita Bhadury is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪১১৪৪
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী