তখন বিপ্লবের কাল। ছাত্ররা স্কুল, কলেজ ছেড়ে পথে বেরিয়ে আসছে আর তাদের সঙ্গ, উৎসাহ দিচ্ছে তাঁদেরই শিক্ষকরা। ফরাসী আধিপত্যের চন্দননগরের তেমনই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন কানাইলাল দত্ত। ক্ষুদিরাম বসুর পরই প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামী শহীদ যিনি ভুবনভোলানো হাসি দিয়ে হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর দিকে চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন ,
" No No, Don't blacken my face, please !"
এবং ফাঁসুড়ে যখন তার হাতের দড়িটা মুখ না ঢাকা কানাইলালের দিকে এগিয়ে দিতে আসে, তখন, চন্দননগরের অহঙ্কার বলেন,
"It doesn't feel right ! "
হুগলী মহসিন কলেজ থেকে বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও বিপ্লব ও রাজদ্রোহীতার অভিযোগে বন্দি হলে ইংরেজ সরকার তাঁকে ডিগ্রী প্রদানে বাধা দেয়, কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সেই বাধাকে উপেক্ষা করে তাঁকে প্রদান করে তাঁর ডিগ্রী। কলেজে পড়ার সময় প্রবাদ পুরুষ প্রখ্যাত বিপ্লবী চারুচন্দ্র রায়ের সান্নিধ্যে আসেন কানাইলাল ও পেয়েছিলেন বিপ্লববাদে দীক্ষিত অধ্যাপক জ্যোতিষ চন্দ্র ঘোষকে। স্বাধীনতার যুদ্ধে শামিল হতে চলে আসেন কলকাতায় ও যোগ দেন অনুশীলন সমিতিতে। এই সময় কিংসফোর্ড হত্যা মামলায় বন্দি করা হয় বহু বিপ্লবীকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। সারাদেশ তখন উত্তাল। সংবাদের শিরোনামে আলিপুর বোমা মামলা, বন্দি স্বয়ং অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ, শ্রীশ চন্দ্র ঘোষ, চারুচন্দ্র রায় সহ আরও অনেকে। মামলায় রাজসাক্ষী ছিলেন নরেন গোঁসাই, জমিদার বাড়ির ছেলে যে পারেনি সহ্য করতে পুলিশি নির্যাতন। কিন্তু তিনি সাক্ষ্য দিলে তো সমূহ বিপদ তাই তাঁকে সরানোর ভার পড়লো কানাইলাল দত্ত এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ওপর। কিছুদিন আগেই শহীদ ক্ষুদিরামের ফাঁসি ভারতবাসীর মধ্যে এক দেশপ্রেমের জোয়ার এনেছিলো ,ইংরেজদের সাক্ষ্য দিতে রাজি কেউই নয় তাই আদালতের কাজকর্ম বন্ধ ছিলো প্রায় মাসখানেক।নরেন গোঁসাই গুনছিলো শুধুমাত্র দিন আদালত খোলার যাতে সাক্ষী দিয়ে সুখের জীবন বিলেতের পথে পাড়ি দিয়ে কাটাতে পারে। যখন বিশ্বাসঘাতক ডুবেছিলেন নিজের সুখের স্বপ্নে সেই সময় কানাইলাল দত্তের একটি চিরকুট পড়ে এসে তার হাতে। লেখা ছিলো তাতে যে,তিনি এবং সত্যেন বসুও তার সঙ্গে রাজসাক্ষী হতে চান। অবাক হলেন নরেন গোঁসাই অগ্নিশ্বর কানাইলালের কথায়। ছুটতে ছুটতে তক্ষুনি গেলেন দেখা করতে অসুস্থ সেজে থাকা কানাইলাল এবং সত্যেন বসুর সঙ্গে। বিশ্বাসঘাতককে হত্যার জন্য জেলের ভিতর গোপনে পিস্তল পৌঁছে দিয়ে গেছিলেন বিপ্লবী শ্রীশ চন্দ্র ঘোষ বিপ্লবী মতিলাল রায়ের সাহায্যে।ঘড়ির কাঁটায় পৌনে সাতটা। কোমরে গোঁজা রিভলভার থেকে রাজসাক্ষী হতে চাওয়া নরেন গোঁসাইকে লক্ষ্য করে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে গুলি চালিয়ে দিলেন কানাইলাল এবং সত্যেন বসু। রক্তাক্ত নরেন ছুটতে লাগলেন এবং কানাই আবার গুলি চালালো। গুলি চলে গেল শিরদাঁড়া ভেদ করে।গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পালাতে গিয়ে বিশ্বাসঘাতক পড়লো নর্দমায় আর ব্রিটিশ পুলিশ ঘটনার আকস্মিকতায় লুকিয়ে পড়লো টেবিলের নীচে। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা নরেনের মাথায় শেষ গুলিটা করলেন কানাই। সেদিন নরেনের শরীরে ঢুকেছিলো ঠিক ন'টি বুলেট। লুকোলেন না বা পালানোর কোনো চেষ্টাও করলেন না কানাইলাল দত্ত এবং সত্যেন বসু কিন্তু গর্জে উঠলো তাঁদের গলায় :
"বন্দেমাতরম্... বন্দেমাতরম্..."
স্বপ্ন অবশেষে তাদের পূরণ হলো খুশির ফাঁসি গলায় পরার। কিংসফোর্ডকে মারার জন্য দায়িত্ব পড়েছিলো কানাইলালের ওপর কিন্তু তার বি.এ পরীক্ষার জন্য দলের নেতারাই তাঁকে বাদ দিয়ে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু এবং বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকীকে পাঠিয়ে দেন,তাতে কানাইলাল খুবই হতাশ হয়েছিলেন। বিচার পর্বে যখন নিরুত্তাপ কানাইলালকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো,
"Why did you shoot the last bullet on the head of Naren Ghosai, when you know that he is already dead ?"
উত্তরে কানাইলাল বলেছিলেন,
"--So far all our attempts had been foiled and the enemy did narrowly escape.I wanted to be sure of the result. I am simply disgusted with attempts attempts and attempts !"
বিচারে ফাঁসির আদেশ হয়েছিল কানাইলালের এবং মৃত্যুদণ্ড রদের জন্য আবেদন করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন,
"There shall be no Appeal !"
আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এই কথা শুনে বলেছিলেন ,
" Shall আর Will ব্যবহারের পার্থক্য কোথায় কি ভাবে করতে হয় তা বাঙালি জাতিকে কানাই শিখিয়ে দিয়ে গেলো।"
সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন ব্রাহ্ম,তাই তাঁর ইচ্ছা ছিলো মৃত্যুর আগে ব্রাহ্ম সমাজের কর্ণধার পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় যেনো একবার তাঁকে আশীর্বাদ করে যান।পরে কানাইলালের পরিচিত একজন যখন শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়কে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তিনি কানাইকে দেখেছেন কি না, উত্তরে তিনি বলেছিলেন,
"কানাইকে দেখলাম।সে পায়চারী করছে--যেনো পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহ! বহুযুগ তপস্যা করলে তবে যদি কেউ ওকে আশীর্বাদ করার যোগ্যতা লাভ করে।"
মাস্টারমশাই চারুচন্দ্র রায় তাঁর প্রিয় ছাত্র কানাইলাল সম্বন্ধে শুনেছিলেন কানাইলালের ফাঁসির কাজে যুক্ত থাকা ওয়ার্ডরের থেকে,
"I am the sinner who has executed Kanailal.If you have a hundred men like him , your aim will be fulfilled."
মাস্টারমশাই অবাক হয়ে যান এই কথা ভেবে যে একদিন তিনিই বলেছিলেন তাঁর প্রিয় ছাত্রকে ,
"You are a bit too shy !"
কানাইলালের মৃত্যুর প্রায় পনেরো বছর পরে তাঁর শেষযাত্রা নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন মতিলাল রায়,ফরাসি শাসনের চন্দননগর থেকে কিন্তু পরবর্তী সময়ে বইটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেয় ফরাসি সরকার।
চন্দননগরের বিপ্লব প্রেরণার অন্যতম প্রাণ পুরুষ ছিলেন মতিলাল রায়।যিনি সেই সময় মিছিলে গাইতেন
"মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে ..."
মতিলাল রায়ের বাড়ি ছিলো আসলে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থল। ফরাসি অধিকৃত চন্দননগরে ব্রিটিশ পুলিশের বাধা নিষেধ থাকায়,বহু বিপ্লবী সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মতিলাল রায়ের গৃহে আশ্রয় নিতেন। ঋষি অরবিন্দ ঘোষ তাঁর কাছেই সেই সময় আত্মগোপন করে সেখান থেকেই পন্ডিচেরির পথে যাত্রা করেন।
এই সময় ফরাসি অধিকৃত চন্দননগরে,বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ডে ব্রিটিশরা যেমন আতঙ্কিত ছিলেন,ঠিক তেমনি ফরাসি সরকারও প্রচণ্ড ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন।নানা ঘটনায় ফরাসি সরকার বিপ্লবীদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং ব্রিটিশ সরকারের সাথে মিলে বিপ্লবীদের গতিবিধি ও কর্মকাণ্ডের ওপর নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করে।উচিৎ শিক্ষা দিতে চন্দননগরের বিপ্লবীরা বাংলার গভর্নর ফেজারের গাড়ি উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন কিন্তু সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়।বিপ্লবীরা এবারে করেন আরও বড়ো পরিকল্পনা। চন্দননগরের মেয়র তার্দিভাল এই সময় চূড়ান্ত অত্যাচার করছিলেন বিপ্লবীদের ওপর।তাই তাঁকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাঁর বাড়িতে যা এখন INSTITUT DE CHANDERNAGOR নামে পরিচিত সেখানে ফেলা হয় বোমা। তার্দিভাল বেঁচে যান কিন্তু বিপ্লবীদের ভয়ে ভীত হয়ে পালিয়ে যান ফ্রান্সে। এই পরিকল্পনার মাথা ছিলেন চারুচন্দ্র রায়,বারীন ঘোষ, শ্রীশ ঘোষ আরও অনেকে।
অধ্যক্ষ চারুচন্দ্র রায়ের সান্নিধ্যে আসা চন্দননগরের আর এক অনুচ্চারিত বিপ্লবী ছিলেন শ্রীশ চন্দ্র ঘোষ।রডা কোম্পানির লুণ্ঠিত মাউজার পিস্তল ও কার্তুজ গোপনে বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া, বিভিন্ন বিপ্লবীদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখা,শ্রী অরবিন্দ ঘোষ থেকে শুরু করে বহু ফেরারি বিপ্লবীদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করাএমন অসংখ্য দুঃসাহসিক কর্মের হোতা ছিলেন তিনি। বহু চেষ্টা করেও ব্রিটিশ পুলিশ যখন তাঁকে ধরতে ব্যর্থ হলো তখন, ফরাসি সরকারের অনুমতি নিয়ে তাঁর বাড়ির সামনে বসালো পুলিশ ফাঁড়ি। গোয়েন্দা দপ্তরের কাছে নির্দেশ ছিলো তিনি চন্দননগর ছেড়ে বেরোলেই তাঁকে যেনো গ্রেফতার করা হয়,তবুও পুলিশের চোখে বহুবার ফাঁকি দিয়ে তিনি বেনারস, লক্ষ্ণৌ,দিল্লি, সাহারানপুর, লাহোর গেছেন এবং ফিরে এসেছেন নিরাপদে আস্তানায়। শ্রীশ চন্দ্র ঘোষের দুঃসাহসিক কাণ্ড কারখানায় রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে সব সময় পাশে থেকেছেন বিপ্লবী মণীন্দ্রনাথ নায়েক।
সে সময় বাংলার বিপ্লবীদের বোমা তৈরির পীঠস্থান ছিলো চন্দননগর। ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া আরও এক গর্বের সন্তান ছিলেন বিপ্লবী মণীন্দ্রনাথ নায়েক। তখন যতো বোমা তৈরি হয়েছে তা এই বিপ্লবীর হাতেই। মতিলাল রায়ের প্রবর্তক সংঘের ভেতর প্রথম পরীক্ষা করা হয় বিপ্লবীর নিজের হাতে তৈরি করা বোমাটি যা পরে নিক্ষেপ করা হয় বড়োলাট হার্ডিঞ্জ র ওপর। কিন্তু এই স্বাধীনতা সংগ্রামী অকীর্তিতই থেকে গেছেন। সময়টা ছিল ১৯৬৮ সাল। দিল্লিতে তখন বিপ্লবীদের এক সম্মেলন চলছে।বাংলা থেকে গেছেন প্রখ্যাত বিপ্লবী অরুণ চন্দ্র দত্ত এবং বিপ্লবী মণীন্দ্রনাথ নায়েক। একটি কাঁচের বাক্স দেখিয়ে প্রদর্শক বলেন, '১৯১২ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ যে বোমায় আহত হন এইগুলো তার টুকরো এবং বোমাটির ওজন ছিলো দু পাউন্ড।' ভিড়ের মধ্যে এক বৃদ্ধ বলে ওঠেন,"না ,এক পাউন্ড এগারো আউন্স।" বৃদ্ধের বয়েসের মর্যাদা দিয়ে প্রদর্শক বললেন,'সে যাই হোক,বোমাটি ছিলো ৫ ইঞ্চি খাড়াই, ৩ ইঞ্চি ব্যাসের।' বৃদ্ধ আবার বলে ওঠেন,"৩ ইঞ্চি নয়, ৩-৩ /১৬ ইঞ্চি।" প্রদর্শক খানিক চমকে ঘুরে তাকিয়ে বলেন, 'Sir, আপনি কে আমি জানিনা কিন্তু আমি যা বলছি তা record book দেখে। ৮ই জানুয়ারি ১৯১৪,Major,J.W.Turner, Inspector of Explosives, Intelligence Branch তাঁর রিপোর্টে লেখেন---' বাধা দিয়ে বৃদ্ধ বলে ওঠেন ,"ও সাহেব কচু জানে।" স্তব্ধ প্রদর্শকের দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বিপ্লবী অরুণ চন্দ্র দত্ত বলেন,"ছাপান্ন বছর আগে এই মানুষটি এই বোমাটি তৈরি করেছিলেন। ইনিই হলেন সেই বিপ্লবী মণীন্দ্রনাথ নায়েক। আপনি এনার কথামতো তথ্যগুলো ঠিক করে নিতে পারেন।" কবে যে এই মানুষটি হারিয়ে গেলেন আমরা তা জানতেও পারলাম না।
ঠিক তেমনই ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে চন্দননগরের আরও এক বীর সন্তান বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর নাম। ব্রিটিশ শাসন কালে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করবেন বলে রাসবিহারী বসু আজীবন ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন দেশে। 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' র প্রতিষ্ঠতা ছিলেন এই মহান বিপ্লবী।তাঁর জীবন ও সংগ্রামকে লক্ষ্য করেই কথাশিল্পী শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন তাঁর কালজয়ী উপন্যাস 'পথের দাবী',যা নিষিদ্ধ করেছিলো তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক কারণ বহু বিপ্লবীর কাছে তা অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। সারাদেশে পুলিশের মারাত্মক পরিকল্পনার মাঝেও তিনি দিল্লিতে লর্ড হার্ডিঞ্জকে বোমা নিক্ষেপ, লাহোরে লরেন্স গার্ডেনে পুলিশ ক্লাবে কমিশনার গার্ডেনকে হত্যা ,বিনায়ক রাও কাপলে নিয়ে লাহোরে ঘাঁটি তৈরি করা ও তারপর একসঙ্গে সারাদেশে সিভিল মিলিটারি বিদ্রোহ আনা,ফিরোজপুর ,আম্বালা হয়ে সুদূর সিঙ্গাপুর নৌঘাঁটি পর্যন্ত অবরুদ্ধ করা এই দুঃসাহসী মানুষটিই পেরেছিলেন। ছদ্মবেশ ধারনে এই মানুষটি অসামান্য ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। কখনো রান্নার ঠাকুর গামছা কাঁধে, কখনো পুরোহিত নামাবলী গায়ে, কখনো মফস্বল শহরের মিউনিসিপ্যালিটির খাটা পায়খানা সাফ করার মেথর সেজে সকলের সামনে দিয়ে ময়লার বালতি হাতে এবং গায়ে মানুষের মল মেখে, যা আমরা কল্পনাও করতে পারিনা বেরিয়ে গেলেন রূপধারণে দক্ষ মহানায়ক পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে পুলিশের সাথে কথা বলে। একাধিক দেশি বিদেশি ভাষা বলতে পারা এই মানুষটিকে ব্রিটিশ পুলিশ ধরতেই পারিনি কোনোদিন। এই সময় ভারতের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এশিয়ার প্রথম নোবেল জয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান ভ্রমণ যাচ্ছেন এমন সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরই তিনি জাপানে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং বিশ্বকবির সচিব হিসেবে (মতান্তরে আত্মীয়) পি.এন.ঠাকুর(প্রিয়নাথ ঠাকুর ) হিসেবে জাপানে বসবাস শুরু করেন। ফেরারি জীবন কIাটলো তাঁর কিন্তু স্বদেশে ব্রাত্যই থাকলেন উপেক্ষিত নায়ক স্মৃতির অন্তরালে। মৃত্যুর আগে রাসবিহারী বসুর ইচ্ছা ছিল তাঁর চিতাভস্ম যেন গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয় কিন্তু তাঁর চিতাভস্ম তো অনেক দূর তাঁর সমাধিস্থলের মাটি আনতেই তো কেটে গেল যুগ।
বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়,বিপ্লবী বসন্তকুমার বন্দোপাধ্যায়, বিপ্লবী জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ,বিপ্লবী কালীচরণ ঘোষ,বিপ্লবী দুর্গাদাস শেঠ, বিপ্লবী মাখনলাল ঘোষালের মুক্তিসংগ্রামে ফুটে উঠেছে বিপ্লবতীর্থ চন্দননগর।
চন্দননগর কেবল চন্দননগরের জন্যই ভাবেনি,ভেবেছে সমগ্র বাংলার জন্য ,ভেবেছে সমগ্র ভারতের জন্য।আসলে চন্দননগর ভেবেছে আরও বড়ো পরিসরে স্বাধীনতা আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে দিতে। তাই হয়তো ইতিহাসে চন্দননগরের স্থান ফরাসী উপনিবেশ হিসাবে পরিচিত হওয়ার থেকে বিপ্লবের পীঠস্থান হিসাবে গণ্য হলে বোধ হয় অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হ'ত। আপাদমস্তক ফরাসী ধাঁচের তৈরি শহরে আজও কান পাতলেই শোনা যায়, সরিষাপাড়া, গোন্দোলপাড়া, প্রবর্তক সংঘ, ফটকগোড়া থেকে ফিসফিস করে ইতিহাসের কণ্ঠস্বর। বিপ্লবের আঁতুড়ঘর বাংলার চির গর্বের চন্দননগর নিয়ে লিখতে বসে এই লেখা শেষই হবে না কোনোদিন; কিন্তু শেষ যে করতেই হবে। আমার ঠাকুরের ভাষাতেই তাঁরা মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিলেন।তাঁদের কথা দিয়েই তবে শেষ করি সেই সব মহানায়কদের প্রণাম জানিয়ে :
"ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর,তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা..."
আমার 'নিদ্রিত ভারত' জাগুক,তোমাদের চরণে মাথা নত করে...
তথ্যসূত্র : বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
রচনাকাল : ৮/৮/২০২০
© কিশলয় এবং সুমি ভট্টাচার্য্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।