দাদুর বায়না
এ যেন ঠিক রাধা কৃষ্ণের প্রেম । একজন বাহাত্তর আরেকজন এবার পঁচাত্তর হবেন ।প্রতি বৎসর ঠাকুরদার জন্ম দিন খুব ঘটা করে পালন করে নাতি নাতনি ।যৌথ পরিবার ,অনেক জন নাতি নাতনি ।সবার খুব উৎসাহ দাদুর অর্থাৎ সনাতন বাবুর জন্মদিন টি উৎসব মুখর করে তুলতে ।
এবারে সবাই আশা করেছিল অন্য বারের তুলনায় আরো অনেক বেশি জাঁক জমক করার ।
কিন্তু তা তো হবার নয়। করোনা ,লক ডাউন ,চারিদিকে আতঙ্ক কি করে কি হবে? সনাতন বাবুর নিজের উৎসাহে এত টুকু ভাটা পরেনি আনন্দে টগবগ করে ফুটছেন ।
মনোরমাকে নব বধূ রূপে দেখবেন যে! প্রেমে গদ গদ হয়ে ওই দিনটির অপেক্ষায় থাকেন ।
মনোরমা দেবী নিজের জন্ম দিন পালন করতে দেন না।সকলের উৎসাহ ,উদ্দীপনা উপেক্ষা করে একদম নীরব থাকেন ,এর কারণ কেউ জানেনা,তবে সবার একটা অনুমান আছে ।হয়তো জন্মের পরে উনি মাতৃ হারা হয়েছেন সে কারণে নিজেকে অপয়া মনে করেন ।সব সময় বলেন যে মাকে মা' বলে ডাকতে পারেনি তার আবার জন্ম দিন! সবাই নিঃশর্ত মেনে নিলেও সনাতন বাবু মানে না ।সে একটা মিষ্টি শাস্তির শর্ত দেন ।জন্ম দিনে ঠাকুমাকে নববধূর বেশে দাদুর পাশে বসে থাকতে হবে ।ঠাকুমা কিছু তেই এই বায়না থেকে দাদুকে বিরত করতে পারেনা । দাদু যা কান্ড এক একসময় করেন সবার সামনে , ঠাকুমা ভীষণ লজ্জা পায় ।আর দাদুর এতে খুব আনন্দ আর মজা ।রসিক মানুষ ,হৈ চৈ আর আনন্দে থাকতে ভালো বাসেন ।জন্ম দিনে কি কি করবেন সারা বছর তার প্লান করেন । ছেলেমেয়েরা সকলেই প্রতিষ্ঠিত ,নিজেও মোটা পেনসন পান আর দু 'হাতে খরচ করেন ।
এবার করোনার জন্য তো দাদুর বন্ধুদের আসতে বলা যাবে না ,প্রতিবেশী রাও আসবেনা তাহলে শুধু ঘরের সবাই ?প্রশ্ন করে সুহাস ।ওকে সবাই সিসি বলে ডাকে । ছোট খাটো পাতলা ফিগারে মুখের আদল অনেকটা ঠাকুমার মত । ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে পড়ে ।এখন কলেজ নেই ।খুব দুষ্টু ,এক এক টা কাজে সবাইকে বোকা বানায় । সব বদ ক্ষত বুদ্ধি , কিন্তু মন খুব ভালো ।
অদ্ভুত প্লান বের করে মাথা থেকে ।এবারের জন্য ও বিশেষ কিছু ভেবে রেখেছে । এক্ষুণি কাউকে বলবে না শুধু খুড়তুতো বোন 'টিকা' কে একটু আভাস দিয়ে রেখেছে । ও ক্লাস এইটে পড়ে ,খুব চতুর আর হাসিখুশি ।সবাই ওকে সব কাজে ডাকে ,বুদ্ধিও ধরে দারুন ।
কার্তিক মাস ,এমাসেই তো দাদুর জন্ম । দিন গোনে সবাই । তবে বাকী নাতি নাতনি অর্থাৎ
বুটা ,পটা, শলা, নিকি,রূপীরা এসবের দায়িত্ব
বিশেষ নেয় না ।ওরা সিসি ,টিকার' তুলনায় অনেকটাই বড় । নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়েই বেশি ব্যস্ত । কিন্তু এনজয় করে খুব ।
অবশেষে দিনটি এলো, ৫ই কার্তিক,সবার কাঙ্খিত দিন । সকাল থেকেই বাড়িতে সাজ সাজ রব ।ছেলেরা বৌমারা সবাই ব্যস্ত । বাজার করা , রান্না করা সব নিজেদের করতে হবে ।কাজের লোক ছুটিতে করোনার জন্য । মেনু তো নেহাত কম নয় । সব টাই দাদুর নিজের পছন্দের মেনু ।
ইলিশ, চিংড়ি,পাবদা , কৈ ,থাকবেই, তবে মাংস
বাদ ।বৌমারা যে যেটায় এক্সপার্ট সে সেটা বানায় । মনোরমা 'র দায়িত্ব চুষি পুলি বানানো ,আর কেনা মিষ্টি র মধ্যে রাজ ভোগ ,রসমালাই, জলভরা সন্দেশ,লাল দই,আরো অনেক রকম মিষ্টি। সিসি' বলেছে 'আমদই ' আনবে পাড়ার নতুন দোকান থেকে, শুনেছে ওদের দই খুব ভালো । সবাই এবার ওর বাহাদুরি দেখবে ।
দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে গেলো ।এবার সবার সাজ গোজের পালা । আমি দই আনতে যাচ্ছি,টিকা' তুই ঠাকুমাকে' সাজা নো শুরু কর।
চা খাওয়া শেষ হলে মনোরমা কে নিয়ে সাজাতে
বসে, নব বধূর সাজ বলে কথা বেশ সময় লাগবে তো ! দাদুকে নিয়ে কোনচাপ নাই, নিজে একাই একশো । দাড়ি কেটে গা 'ধুয়ে ক্রীম মেখে নেয় পরে পাউডার মাখবেন ।নতুন ধাক্কা পাড়ের ধুতি, গিলে করা সিল্কের পাঞ্জাবি পরে বারবার আয়নায় নিজেকে দেখছেন ,এমন সময় ' নিকি'এসে দাদুকে বলে দেখতো আমাকে
কেমন দেখাচ্ছে?খুব সুন্দর করে সেজেছি কিন্তু,
বাজে বলবে না! তাহলে কিন্তু তোমাকে পরচুলা
পড়িয়ে দেব না । নতুন বউ তোমার টাক দেখে নেবে ! না না দিদিভাই খুব সুন্দর লাগছে তোমায়,
তবে ঠাকুমার মতো নয় । তোমার সাথে আমার আঁড়ি এই কথা বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় নিকি ।নিকি একটু দূরে গিয়ে দাদুকে টা টা করে আবার ।
দাদুর সাজ শেষ হতেই দিব্যি 'উইগ 'পরে সোফায় বসে পরেছেন। বারবার হল' ঘরের দরজার দিকে দেখছেন ।এখনও কেউ ঢোকেনি
ঘরে। বলতে না বলতে টিকা' নব বধূকে নিয়ে হল ঘরে আসে, সনাতন গদ গদ হয়ে এগিয়ে এসে হাত ধরে নিজের বাম পাশে বসান ।এর পর একে একে বাড়ির সবাই আসে । টেবিলের উপর দাদুর নাম ও বয়স লেখা ' কেক ' সাজানো ,মোম বাতি জ্বালানো, ফুল দানিতে ফুল এসব কাজ
টিকা ,নিকি ও রূপীরা মিলে হৈ হৈ করে করে । সব রেডি ,এবার কেক কাটার পালা ।প্রতি বৎসর কেক কেটে আগে দাদু নব বধূবেশী মনরমাকে খাওয়ান। সে ছোট হাঁ করে অল্প একটু মুখে নিয়ে বাকিটা সনাতন কে খাওয়ান ।
" হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ" দাদু –------"-হ্যাপি বার্থ
ডে টু ইউ"-------। দাদু কেক কাটছেন ,যথা রীতি একটা কেকের টুকরা নব বধূর মুখে দেন,বধূ টপ করে গিলে নেয় সবাই অবাক! অন্য বার তো এমন হয়না,কি হলো? দাদু ভাবেন নীচে পরে গেছে ।আর একটা টুকরা ফের দেন এবারেও কেক গায়েব ! কিন্তু সনাতন আপসোস করেন , ইস! তোমার বেনারসী তে বুঝি লাগলো , এত ক্রীম যে হাত স্লীপ কাটছে ।খানিক বিরক্ত ও হন ,
কাজের মেয়ে পুচনি কে বলেন যা তো একটা কাঁটা চামোচ নিয়ে আয় ।টিকা" বলে আমি আনছি দাদু ।টিকা' ,চামচ আনার ছলে সোজা ঠাকুমার ঘরে গিয়ে কানের কাছে মোবাইলের এলার্ম টা জোরে বাজায় ঘুম ভেংগে যায় ঠাকুমার । চায়ের সাথে হালকা ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল বিকালে ।তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন ঠাকুমা ।–-- চলো চলো দাদু রেডি ,------এই নাও ফুলের তোড়া,হল ঘরে চলো----টিকা বলে। দ্রুত পায়ে রান্না ঘর থেকে চামচ ও আনে । এবার মনোরমা দেবীকে নিয়ে ধীর পায়ে আসে, তবে নব বধূর সাজে নয় একেবারে গিন্নিমার সাজে। দাদু প্রথমে অতটা খেয়াল করেন নি । টিকা কাঁটা চামচ হাতে দিলে একটুকরা কেক কাটেন এবং
খাওয়াতে যান। ঠিক সেই মুহূর্তে সিসি" এক লাফে ,গিয়ে ঠাকুমার গলা জড়িয়ে ধরে হি: হি: ,করে হেসে ওঠে, ঘর সুদ্ধু সবাই হতভম্ব!
।একি? ঠাকুমার বদলে কিনা সিসি"? এতক্ষণ সিসি যে ঘরে ছিলোনা সেটা কেউ খেয়াল করেনি ।আম দই আনার ছুতায় গায়েব ছিল ।এদিকে দাদু তো রেগে আগুন ।হুঙ্কার দিয়ে বলেন তুমি ওই হনু মানটার সাথে হাত মিলিয়েছো, ভাবছো তুমি পার পাবে ,একদম না!,
তোমাকে আরো কঠিন শাস্তি পেতে হবে,বলতে বলতে ঠাকুমার কাছে গিয়ে মুখে কেক দেন ,এবার এই কেক সমেত সবার সামনে আমাকে চুমু "দাও--- ,দাও? দাও? আমার গালে দাও, কপালে দাও ,চিবুকে দাও,দিতেই হবে ।আমি ছাড়বো না,!শান্ত মনো" লজ্জ্বায় মাথা নীচু করে করে থাকে
রচনাকাল : ১৬/৮/২০২০
© কিশলয় এবং ইলা কর কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।