স্বাধীনতা দিবসের সকালটা আর পাঁচটা ছুটির দিনের মতই কাটতো গত বছর অবধি বীথির। অফিসের থেকে একটা বাড়তি অবসর ।অলস সকালের হাত ধরে ঘুমের রেশ চোখেমুখে এঁকে জমিয়ে প্রাতরাশ লুচি আলুরদম বা ছোলারডাল।তারপর পাশের ক্লাবে বা টেলিভিশনে পতাকা উত্তোলনে দর্শন বা শ্রবণেন্দ্রিয়কে স্বাক্ষী রেখে পাঁঠার মাংস বা ভাপা ইলিশে মধ্যাহ্নভোজে অবগাহন।এভাবেই বিছানা জর্জরিত বিকেল তারপর টকঝালমিষ্টি সন্ধ্যে সাথে পাড়ায় মাইকের তীব্র চিৎকার উপরি পাওনা । মদ মাংসের অবাধ ফোয়ারায় গালাগালি আর উন্মত্ততায় স্বীয় স্বাধীন অস্তিত্বের প্রমান দিতে দিতে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন যেন এক বিলাসি রেওয়াজ। এসব যেন গা সওয়া হয়ে গেছে সবার। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা যে স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ করেছিলেন,তা যেন এখন কালের ফেরে অবান্তর ,গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। ঐ শৈশবের পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাসে তাদের অবদান গল্পগাঁথার আকারে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে,বাস্তব আজ আর তার গুরুত্ব নিয়ে ভাবেনা।বরং স্বাধীনতা দিবসে পতাকা তুলে ,মাইক বাজিয়ে, পিকনিক আমেজে ছুটি উপভোগ করার মধ্যেই সবার স্বাধীনতার সার্থক বহিঃপ্রকাশ পরিস্ফুট হয় ।
স্বামীর অকস্মাৎ ইহলোক ত্যাগ করা ও কর্মক্ষেত্রে অবসর এই দুটি জিনিস ক্রমান্বয়ে বীথির একাকীত্ব বাড়িয়ে দিতে লাগলো। একমাত্র ছেলে সপরিবারে আমেরিকায় । তারা আগ্রহ প্রকাশ করলেও দেশ ছেড়ে পরবাসে যেতে বীথি অস্বীকার করে। ভাবেনি চাকরির অবসরের চার মাস আগেই মিহির এভাবে একা করে চলে যাবে।গল্পগাছা হোক বা সাহচর্য, নিদেনপক্ষে ঝগড়ার জন্যও তো একটা মানুষ লাগে।রাতদিনের হেল্পিং হ্যান্ড উমা আছে বটে তবে বোবা উমা বীথিকে ভালো মন্দ রেঁধেবেড়ে খাওয়াতে পারলেও গল্প করতে অসমর্থ । আকারে ইঙ্গিতে ওর কথা বীথি এখন ভালোই বোঝে তবে শুরুতে ভেবেছিলো বাড়ি ফেরৎ পাঠিয়ে দেবে, কিন্তু মেয়েটার আচার ব্যবহারে মায়ায় পরে গেছে বীথি।
আজকাল বীথি খুব একা হয়ে গেছে। বিদেশ থেকে সমু নিয়ম করে খোঁজ খবর বিধিব্যবস্হা নিষ্ঠাভরে করলেও গল্প করার বা মাকে ভার্চুয়ালি সময় দেওয়ার অবকাশ নেই। মা হয়ে আবদার করা যায়না,জোড় খাটানোও যায়না আবার অভিমান করে সন্তানের থেকে মানসিকভাবে দূরে থাকাও যায়না ।তাই মন সত্তা বিসর্জন দিয়ে ভালো থাকার অভিনয়টা নিপূণভাবে চালিয়ে যেতে হয় ।
এবারের স্বাধীনতা দিবসটা একটু বিষাদময় ।মিহির নেই,তাই রান্না খাওয়ার তরিজুত নেই এবার।ওসব মিহিরের আবদার রাখতে করতেই হতো। আজ সকাল থেকেই ছোটবেলার স্মৃতি রোমন্থনে বিভোর বীথি। অফিসের রিটায়ারমেন্টর পর এখন স্বাধীনতাদিবসের ছুটি বলতে আলাদা কিছু প্রাপ্তি নেই,রোজই অবসর।
ছোটবেলায় কথা মনে পড়ছে । বিদ্যালয়ে স্কুল ড্রেসে পতাকা উত্তোলন, কুচকাওয়াজ ,লজেন্স বাবুজি কেক সহযোগে স্বাধীনতা দিবস পালন। দেশের মাটির ঘ্রাণ ।জাঁকজমকবিহীন আন্তরিক উদযাপন । সকাল সকাল পাড়ায় পতাকা উত্তোলন করে দেশাত্মবোধক গান গাইতে গাইতে মিছিল করে পাড়া বেপাড়া পরিক্রমা বিপ্লবীদের বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন ।সেসব এখন সুদূর অতীতে। নাতনির ফোনে বীথি যেন স্কুলজীবনের স্মৃতিপাশ থেকে এক ঝলকে বর্তমানে । ঠাম্মু হ্যাপি ইনডিপেনডেন্স ডে।আজ ফেসবুকে তোমার প্রথম লাইভ,ওয়েটিং । উমা দিদি রেডি? ওকে লেটস স্টার্ট । উমা দিদির রেসিপি পোয়েম ডায়েরির এবার গ্লোবালাইজেশন হবে ঠাম্মুর কণ্ঠস্বরে।
কে বেশি নার্ভাস উমা দি না তুমি? দিদিভাই তোর উৎসাহে সাহসে সোস্যাল মিডিয়ায় উমার এই প্রতিভার বিকাশ ঘটতে চলছে। "রেসিপি শো অনেক হয় তবে এমন কবিতার ছন্দে রন্ধনপ্রণালীর বর্ণনা সত্যিই অনবদ্য "
ফেসবুক লাইভে বন্ধুমহলের এমন অনেক কমেন্টসে ভরে গেল বীথির চোখদুটো। স্বাধীনতা শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যকে স্বাধীন করে তোলার মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার আস্বাদ পাওয়া যায় ।পিছিয়ে পরা মানুষজনদের নিয়ে এগিয়ে চলার মধ্যে স্বাধীনতার প্রকৃত রূপ প্রকাশ পায় ।আত্মনির্ভর বীথি উমাকেও স্বাধীনতার মানে বুঝতে সাহায্য করেছে, মুক্তমন মুক্তচিন্তা স্বাধীনতার দোসর। বোবা উমার চোখ দুটোতেও স্বাধীনতার ইঙ্গিত । বাবুর বাড়ির হেঁসেলের বাইরেও তার একটা নিজস্ব অস্তিত্ব আছে। "বীথির বয়ানে উমার কলমে ছন্দবদ্ধ রেসিপি শো" ।
রচনাকাল : ১৫/৮/২০২০
© কিশলয় এবং অর্পিতা চক্রবর্তী কণ্ঠ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।