ছবির ওই প্রাসাদোপম অট্টালিকার মালিক ছিলেন আমার দাদু মিস্টার ব্রিটিশ রাজ। প্রকান্ড সিংহ দরজায় সোনায় মোড়া অক্ষরে INDIA লেখাটি যেনো আভিজাত্যের প্রতীক। মগধ - মৌর্য - গুপ্ত - পাল - খিলজী - তুঘলক - লোদি - মুঘল সাত পুরুষের পোট্রেট অট্টালিকার দেওয়ালে সসম্মানে বিরাজমান। স্বাভাবিক ভাবেই আদ্যিকালের বিপুল এই সম্পত্তির বাজারদরও ছিল গগনচুম্বী। যদিও আজ বলতে বাঁধা নেই, আমার দাদু নবাবী অট্টালিকাটি গাটের কড়ি না ফেলেই ছলেবলে হাতিয়ে নিয়েছিলেন।
নিঃসন্তান দাদু পরবর্তীতে এক মেয়ে ও দুই ছেলেকে দত্তক নিলেন। আদরে বাঁদরের ভয়ে দোর্দন্ড প্রতাপ দাদু ছেলেদেরকে কড়া শাসনে মানুষ করলেন। চকলেট নেবে বললেই পিঠের ছাল তুলে নিতেন। ভয়ে ভয়ে দিন কাটলেও বাচ্চাদের মন থেকে 'স্বাধীনতা' চকলেটের নেশা ছাড়ানো সম্ভব হইনি।
কারোদিন সবসময় এক যাইনা। আমার দিদা শ্রীমতী ভারত মাতা গত হলেন। দাদুও বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ছেলেপুলেদের বহুদিনের দাবী সমানাধিকার - সাম্য - স্বাধীনতা নামক চকলেটের বাক্স দিয়ে দাদু সৎসঙ্গে যেতে চাইলেন। দাদু যাবার আগে একটু বেশী উদারমনস্ক হয়ে সকলকে চকলেট ফ্যাক্টরি দিতে অট্টালিকাটি ভাগ করে বসলেন। উনি যুক্তি বেধেছিলেন ছেলেপুলেরা এতে নিজের গণ্ডিতেই বসে শান্তিতে চকলেটের মজা নেবে। বাকিদের সাথে ঝগড়াঝাঁটি করবেনা। বিচক্ষণ দাদু আদরের মেয়েকে দিলেন মাঝের অংশ। ওদিকে পুঁচকে ভাইটির দায়িত্ব চাপিয়ে বড় ছেলেকে দিলেন পূর্ব-পশ্চিমের ঘরগুলো। আজ সকলেই খুব খুশি। হোক না বিভাজন তবুও তো পাওয়া গেলো সেই আকাঙ্খিত 'স্বাধীনতা' চকলেট।
অট্টালিকার বেঢপ গড়নের জন্য ন্যায্য ভাগে অসুবিধে সৃষ্টি হলো। মুস্কিল আসানের জন্য এগিয়ে এলেন দেশ নির্মানের কারিগর প্রমোটারেরা। 'অ্যাট দি স্ট্রোক ... ' মনমুগ্ধকর ভাষনে সকলকে সম্মোহিত করে পেশ করলেন বিনা সয়েল টেস্টে বহুতলের প্ল্যান। বুলডোজারে প্রাচীন অট্টালিকা গুড়িয়ে গড়ে উঠলো আধুনিক সুবিধে যুক্ত ফার্নিশড ফ্ল্যাট। সুইমিং পুল, জাক্কুজি, জগিং ট্রাক, ব্যানকোয়েট, অডিটোরিয়ামে সেজে উঠলো নতুন 'ভারত'। কোল্যাটারাল ড্যামেজ হিসেবে বাগানের অবলা প্রাণেরা মরলো বটে কিন্তু ঐ যে কথায় আছে 'জন্মিলে মরিতে হবে।'
৩ বি.এইচ.কে ওনারশিপ ফ্ল্যাটে মেয়ের নেমপ্লেট
ভারত
১৫.০৮.১৯৪৭
দুই ভায়ের (২+১) বি.এইচ.কের দরজায় ঝুললো
পাকিস্থান
১৪.০৮.১৯৪৭
পুঁচকেটা বড় হতেই নিজের ১ বি.এইচ.কে ছিনিয়ে স্বাধীনতা চকোলেটের স্বাদ নিলো। চাইতেই অনায়াসে কিছু পেলে ঠিক মন ভরেনা। বরং ছিনিয়ে খেলে সেই চকলেটের স্বাদ জীভে লেগে থাকে। সেই পুঁচকেটা 'অল্পতে স্বাদ মেটেনা, এ স্বাদের ভাগ হবেনা' করতে করতে দরজায় টাঙালো
বাংলাদেশ
২৬.০৩.১৯৭১
বাপ কাকাদের পাঁচিলের জন্য পুঁচকেরা মিশতে পারতাম না, খেলতে পারতাম না। এখন ফেসবুকের কল্যাণে সকলেই লক্ষণের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববাসী হয়েছি। আমরা নাতিপুতিরা নেমপ্লেটে দেখে বার্থডে উদযাপন শুরু করি। বেঁচে থাকতে আমার সহৃদয় দিদার জন্মদিন পালন করা হইনি। সে যুগে বার্থ সার্টিফিকেটের চল না থাকায়, দিদার বার্থডে সকলের অজ্ঞাত ছিল। আগস্টের ১৪,১৫ ও ২৬শে মার্চ - দিদার যুবতী, বৃদ্ধ ও কিশোরী, যার কাছে যা ছবি আছে তাই দিয়ে চলে দিদার জন্মদিন যজ্ঞ। এক বছরে তিনটে বার্থডে, যাকগে বুড়ির জীবদ্দশার দুঃখ, মরণের পরে অল্প হলেও ঘুচলো।
আগের সেই একান্নবর্তী পরিবার এখন অনেকগুলো নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি বিভক্ত হয়ে গেছে। বাড়ির বাচ্চারা হুসবোধ হতেই সেই 'স্বাধীনতা' চকলেটের জন্য কান্নাকাটি শুরু করে। চকলেট তো বাচ্চারা খাবেই, কিন্তু তাই বলে এমন অট্টালিকা ভেঙে ফ্যাক্টরি বানাতে হবে? এখন তো চাইলেও বহুতলের ফ্লোর বাড়ানো সম্ভব নয়। দাদুর মনগড়া ভাগফল স্বাধীনতার চক্করে তখন পুরো বহুতলই ধসে যাবে। জন্মদিনে দিদার ছবি তো দূর ধ্বংসস্তুপে তখন কিছুই পাওয়া যাবেনা। তাইতো যোগ, ভাগ এই সব অঙ্কের ঝামেলায় না গিয়ে কেবল পরিমিত চকলেট স্বাধীনতার স্বাদ নিলে স্বাদটাও বহুগুণ হবে তেমনি স্বজন বিয়োগের আঁচ না লাগায় অখণ্ড ভারতেই স্বর্গদ্যানের গড়ে উঠবে।
আপাতত সে সব না ভেবে আমাদের ফ্ল্যাটে বুড়ি দিদার জন্মদিন পালনের জন্য ঘর সাজাতে শুরু করলাম। শুনেছি বই পাগলী দিদা জীবনে অনেক সংগ্রাম করেছিলেন। তিনি নাকি দাদুর ইচ্ছের বিরোধিতা করে মুখের উপর অন্নদাশঙ্করের কবিতার দুকলি শুনিয়ে দিয়েছিলেন
"তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
বাঙলা ভেঙে ভাগ করো !
তার বেলা?"
দিদার মৃত্যুর পর দাদুকে আটকানোর কেউ ছিলনা। ইচ্ছানুসার সব কিছু ভাগ করে দিলেন। তবে দিদার মতন অগণিত সংগ্রামীদের জন্যই আজ দাদুর মতন বেত্রাঘাতী বাবা পেতে হইনি। যা পেয়েছি, যেমন পেয়েছি, সংগ্রামীদের রক্তের বলিদানে পেয়েছি বহুকষ্টে। এতো কষ্টে পাওয়া দিনটিকে কোনোভাবেই বিস্মৃত করা যায় না। করোনা অতিমারিতে হইতো ভাতৃ আলিঙ্গন সম্ভব হচ্ছেনা, তবুও মনের আলিঙ্গনের মাধ্যমে জাতি - ধর্ম - বর্ণের ভেদাভেদ দূর করবো।
এই প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে দিদার (ভারত মাতার) জন্মদিন পুরোদমে উৎযাপন করবো।
রচনাকাল : ১৪/৮/২০২০
© কিশলয় এবং সাগর রহমান কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।