বছর বারোর অঙ্কন তাকিয়ে ছিলো আকাশের দিকে। দূরের ওই বস্তির নিতাই তার খুব প্রিয় বন্ধু। নিতাই এর বাবা রতন সাইকেলে করে মাছ বিক্রি করেন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে। আর অঙ্কনের বাবা খুব বড় ব্যাবসায়ী। গতকাল নিতাই এর সাথে তাদের পুকুরে মাছ ধরতে ছিপ ফেলে বসেছিল অঙ্কন। বাবা জানতে পেরে কি যাচ্ছেতাই কান্ড। কড়া ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন আর যেন নিতাইএর সাথে বন্ধুত্ব না রাখা হয়৷ ওসব ছোটলোকদের সাথে তার স্ট্যাটাস মেলেনা।
অথচ রাত পোহালেই স্বাধীনতা দিবস। কত প্ল্যান ছিল তাদের দুই বন্ধুর। ইট সাজিয়ে রঙ করে তার উপর পতাকা উত্তোলন। শেষে বাচ্চাদের হাতে লজেন্স বিস্কুট তুলে দেওয়া।
কিন্তু আজ মনে হচ্ছে-
এ কেমন ছেলেবেলা?
এ কেমন স্বাধীনতা?
--
শাহেদা খুব সুন্দর নাচে। বাবা মার আদরে আদরে এই বছর আটে পা দেবে। হঠাৎ একদিন গ্রাম থেকে দাদু ঠাকুমা হাজির। মেয়েকে নাচতে দেখে অবাক। বউমার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন - এটা কি ভদ্রলোকের বাড়ি নাকি বাইজি বাড়ি? ঘুঙুর বেঁধে মেয়েকে ধিরিং ধিরিং নাচাচ্ছ?
মেয়ের নুপুর খুলে ফেলে মা।
চোখের কোনের জল নীরবে প্রশ্ন করে-
এ কেমন মেয়েবেলা?
এ কেমন স্বাধীনতা?
---
সঙ্গীতা খুব ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে পারে। প্রতিদিন ভোরে যখন হারমোনিয়াম খুলে রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়, আশেপাশের বাড়ির লোকেরা স্তব্ধ হয়ে শোনে। তার কণ্ঠের মিষ্টি সুরে ভোরের পরিবেশ যেন স্বর্গীয় হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গীতা আজ বিয়ের পরে ভোর ভোর উঠে স্বামীর টিফিন, শ্বশুর শাশুড়ীর চা বানায়। প্রতিদিনের অভ্যাস মতো হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেই শাশুড়ি বলে উঠলেন-" ওসব ছেলেমানুষী ছেড়ে এবার সংসারে মন দাও। সকাল সকাল এসব না করে বাবুর টিফিন আর শ্বশুরকে চা দাও। ওনার আবার ভোরে না চা খেলে দিন ভালো যায়না।
সেই থেকে আজ দুবছর ভোরে রেওয়াজ বন্ধ সঙ্গীতার। সঙ্গীত হারিয়ে গেছে মনের গহীনে।
কখনো কখনো মনে হয় -চিতকার করে বলে-
এ কেমন স্বাধীনতা?
এ কিসের স্বাধীনতা?
---
তানিয়া রিজুকে খুব সন্দেহ করে। হ্যান্ডসাম বর তার, কেউ যদি টোপ দিয়ে বসে। অহেতুক ফোন চেক, ফেসবুক ওয়াটস আপের লক খুলিয়ে নিয়েছে। তানিয়ার সাথে ঝগড়া অশান্তির ভয়ে ছোট বেলার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। আগামীকাল স্বাধীনতা দিবস। তাই বন্ধুদের ফোন- "রিজু কাল আমরা পিকনিক করছি। একবছর হতে চললো বিয়ে করেছিস, এখনো এতো বউ বউ কিসের ভাই? কাল রাতে চলে আসিস।"
কড়া চোখে তাকিয়ে তানিয়া। লাউডস্পিকারে শোনা কথাগুলো কানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে তার। অশান্তির মেঘ ঘনিয়ে আছে দেখে রিজু বলল- "আরে আমি যাচ্ছিনা। এ নিয়ে আর কোন কথা বোলো না প্লিজ।"
রাতের অন্ধকারে চোখের কোনে জল আসে রিজুর।
ভাবে- এ কেমন স্বাধীনতা?
এ কিসের স্বাধীনতা?
আমারও প্রশ্ন- এটা কি সত্যিই স্বাধীনতা নাকি রঙিন ফানুস?
রচনাকাল : ১৪/৮/২০২০
© কিশলয় এবং মুসকান ডালিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।