দ্বিতীয় বসন্ত
মোঃ তোফায়েল হোসেন
বিবর্ণ, বিক্ষিপ্ত, নিস্তব্ধ, নির্বাক, নির্জন এক সন্ধ্যায় হঠাৎ খবর এলো ‘ব’ অক্ষরে নির্মিত উদ্ভাবিত শব্দ দ্বারা কেউ একজন শীগ্রই আবদ্ধ হচ্ছেন। ভাবলাম এ বিষয়ে কিছু একটা লেখা যাক! কিন্তু কি লিখব তা বুঝে উঠতে পারছি না।
হয়তো আমি নগন্য এক অধম বলেই এমন হচ্ছে। শেষে ভাবলাম- এই মুহূর্তে বর-কনের আকাশ-বাতাস, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, বন-বনানী, নদ-নদী, সাগরগীরির মধ্যে যে অনবধ্য প্রাণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে তা থেকেই কিছু লিখার চেষ্টা করি। আশা করি তা পড়ে ভাই বেরাদরদের গালে সুখের দাড়ি গজাবে, পাকবে। আরও আশা করি দয়া-দাক্ষিণ্য, ইন্সুরেন্স, ক্ষতি পূরণের থোক বরাদ্দ, রেমিটেন্স থেকে কোর্টকাচারি, ফাটাফাটি পর্যন্ত টেনে নিতে পারব। তারপর ভোরের কুয়াশার মতো প্রতীক্ষার প্রহর মিথ্যে করে টুনাটুনির গল্প কার্গো ফ্লাইটে করে নিয়ে আসব।
বহু প্রতীক্ষিত এই বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর বোকা পুরুষটার জব্দ হওয়ার একটা প্রয়াস যে হবে না তা বললে সত্যের মহত্ত অন্তরালে রয়ে যাবে। তাই শুভ কামনার কোরাস গেয়ে গেয়ে বাউণ্ডুলে কলম চালালাম। আর শুরুটা করলাম ‘ব’ নিয়ে বকাবকি দিয়ে। ‘ব’ দিয়ে উচ্চারিত বহুল প্রত্যাশিত ‘বিবাহের’ আবহ সংগিতের অসংগতি কারও রঙিন চশমা ভেদ করতে পারে না। তাই একা থেকে দুকা হয়ে বোকা হওয়ার ধোকা খায়নি এমন পুরুষ খুব কমই আছেন। তবে এই শব্দ থেকে প্রাপ্তিও যে কিছু ঘটছে না তা কিন্তু নয়। ঘরে-বাহিরে, আকাশে-বাতাসে, বাসায়-ব্যবসায়, বিছানায়-বালিশে ছুঁয়ে দেওয়ার মতো কেউ একজন তার বসতি গড়বে অন্তরের প্রান্তরে। তারপর শিকড় গেড়ে ডালপালা বিস্তার এবং পরকে আপন করে হাসি মুখে জন্ম জন্মান্তরের জিন্দেগী লিজ দেয়া, লিজ নেয়া!
বর্ষায় নদী শুধু মাতাল নয়, উন্মাতাল হয়ে উঠে। রাজার রাজধানীতে রানীর আগমন। বাতায়নে শীতের জ্যোৎস্না। হৃদপিন্ডে অন্য এক অনুভূতি। চোখের পাতায় উচ্ছলে পড়া চঞ্চল প্রেম। প্রেয়সীর চোখের মণির দৃষ্টি গভীর থেকে গভীরে যায়। ব্যর্থ হয়ে আবার ফিরে আসে চোখের পাতায়; চোখ দেখেনা মস্তিষ্ক সুন্দর!
সূর্য ও তারায় কোন দাগ নেই; দূরে দ্বিখন্ডিত চাঁদ। রাতের আলো আঁধারীতে সব স্পষ্ট হয় না। তবুও দু’জনেই পড়তে পারে দু’জনের চোখের ভাষা- বহু প্রতীক্ষা। চোখের ভাষায় হৃদয় বিনিময়। বুকের ভেতর আছড়ে পড়ে মাতাল ঢেউ, দামাল বাতাস। প্রিয়ার আঁচল মনে হয় শংখ চিলের ডানার ভাস্কর্য্য। উড়ন্ত কিছু এলোমেলো চুল, বিছিন্ন বাতাসে সুস্নিগ্ধ ঘ্রাণ ছিটিয়ে নাক নিয়ে খেলা করে। উত্তাল তরঙ্গমালা কল্পোলোকের সৈকতে প্রতিচ্ছবি আঁকে। আর বানের জলের ন্যায় বিক্ষিপ্ত হয়ে নিজেকে মাতালের মতো সমর্পন করে সময়টা ভালোবাসার শৃংখলে বন্দি করতে দু’টো মনের আকুল চেষ্টা অবিরাম। তারপর দৃষ্টি বিনিময় অসমাপ্ত রেখে, স্পর্শ বিনিময়, নিঃশ্বাস-বিশ্বাসের বিনিময়, শরীর মন ছুঁয়ে যাওয়া উঞ্চতা বিনিময়!
আমার জানা মতো ‘ব’ অক্ষরে নির্মিত আরেক শব্দ ‘বই’ দ্বারা বোকা পুরুষটি খুবই প্রভাবিত। পেশা বাদ দিলেও নেশাগতভাবে তিনি বই ভক্ত। তাই ষোড়সী কনে যে এখানে এসে সতীনের দেখা পাবেন তা নিশ্চিত। অভ্যাসের ব্যাকারণে বইয়ের অন্যতম স্থান হল বিছানা আর বালিশ! দরজা বন্ধ করে দ্বন্ধ সেখান থেকেই শুরু হবে। বিছানায় বই থাকবে না বউ থাকবে? কোনটা আগে, কোনটা পরে? কথায়-ব্যথায়, সরবতায়-নীরবতায় একসময় ব্যকুলতা সৃষ্টি হবে। তারপর চাওয়া-পাওয়া আঁকাবাঁকা; ব্যাখ্যার ব্যাসার্ধ অসমাপ্ত রেখে বোবা হয়ে বালিশের নিচে মাথা রেখে গিন্নির অর্থহীন বক্তিতার হাত থেকে বাঁচার চেষ্টায় আপ্রাণ আকুলতা।
একসময় ঝড়ের ব্যবচ্ছেদ হলে বাচালের মতো মাথা বালিশের উপর উঠিয়ে গল্পের অন্তরালে যুক্তির বৃত্ত নিয়ে টুনাটুনির কুটুস-কাটুস শুরু হবে। ‘‘এক পাঠান যুবক গেছে বেশ্যাবাড়িতে। যাবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে গেছে কিছু পেস্তা বাদাম ও একটা পরিষ্কার চাদর। অতঃপর ফুর্তি শেষে মেয়েটি টাকা চাইল। যুবক তো অবাক! মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে উর্দুতে বললো- ‘তুম বালিস্তা লায়া তো হাম চাদর বিছায়া, তুমনে দারু পিলায়া তো হাম পেস্তা খিলায়া। মজা তুম ভি লুঠা, হাম ভি লুঠা। আভি পয়ছা কিউ মাংগতাহ।’
গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটার আগেই বাজনা শুরু হয়। এসব কি বলা হচ্ছে? বামুন হয়ে চাঁদের গল্প? তাল লয় ঠিক হওয়ার আগেই আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়ে মধ্য রাতের পদ্য শুরু করতে হয়। আনন্দে বিরতিহীন ক্রন্দন বন্ধ হয়। উঞ্চতার প্রত্যাশায় সব বোঝা সোজা নিজের মাথায় তুলে বড় ক্লান্তির অভিনয় করে পুনরায় টুনাটুনি হওয়ার আহবান রেখে বলা- জীবন ঘানীর মন্থর গতির ঘূর্ণিপাকের ক্যাচক্যাচ শব্দ, বেদনার কান্না, ধাঁধাঁ চক্রের বক্র রেখা, সব ছেড়া শাড়ীতে বেঁধে রেখে এসো নতুন করে সাজাই নতুন ধারাপাত।
প্রেয়সীর বিষ্মিত সাড়ায় অচেনা এক চর হবে। জীবনের বিষাক্ত বাতাস এই চরে কোনদিন ঝিরঝির করে বহে যাবে না। পোশাকি পশুত্ব কোনদিন গ্রাস করবে না। শুধু ভালোবাসার অনন্ত এক বসন্ত বিরাজমান থাকবে প্রেম পাখির কলরবে। চোর চোর খেলা শেষে রাত নিস্তব্ধতার চাদরে ঢেকে গেলে আবার বৃষ্টির পূর্বাভাস ভেসে আসবে বহু দূর থেকে। আকাশের বিজলির মতো মুহূর্তে- আলোয় ভরে উঠবে অস্থির চারটি চোখ। ঘুটঘুটে অন্ধকার আলোকিত হয়ে উঠবে অন্য রকম নতুন আলোয়। জানালার পাশে বসা নিশি পাখিটা ডানা জাপটিয়ে স্বাগত জানিয়ে বিদায় নেবে। তারপর অজানা থাকবে সময়, অজানা থাকবে রাতের প্রহর। মুয়াজ্জিনের ডাকে বিরক্ত হয়ে বিভক্ত হওয়ার সময় বকেয়া দেনা-পাওনা রেখে বিবর্ণ বিপন্ন বিপ্লবী মনটাকে চৌকাঠের ওপারে নিয়ে আসতে বুকটা ফেটে চৌচির হবে।
তারপরও জীবন কমিউনিস্ট পলিটিক্সের বেড়া জালে বাঁধা থাকায় নিজেকে বঞ্চিত রেখে সঞ্চিত সোনালি স্বপ্নের খুঁজে মরীচিকার পিছনে ছুটে নিকটিন ফুসফুসে টেনে টেনে বাজেটের সন্ধানে অবিরাম দৌড়াতে হবে। দিন শেষে গোধূলীর রং- এ রক্তিম হয়ে যাযাবর ফিরবে প্রেয়সীর কাছে। অপেক্ষার ছায়া প্রিয়ার চোখে; দেখে টক-ঝাল-মিষ্টির পশরা সাজাতে ব্যস্ত হবে। ভালোবাসা; ভালোবাসা ভুলিয়ে দেবে সকল নিরাশা। প্রকৃতির খেলায় দু’টি মন, দু’টি শরীর, দু’টি আত্মা এক হয়ে একাকার রবে অনন্তকাল। ঘুম কেড়ে নেবে প্রকৃতি। আদিম নেশায় মত্ত্ব হয়ে জীবনের কতো রাত নির্ঘুম কাটবে তার হিসাব অজানাই থাকবে। কতো নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হবে। কতো নতুন কথামালা নতুন সুরে কন্ঠে বাজবে। কতো আদর্শ, কতো নৈতিকতা জেগে উঠবে মনে। আর বিশ্বাস! তাকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে ভালোবাসার মাঝে, হৃদয়ের মাঝে। ভাঙ্গনের গান শুনাতে অবিশ্বাস অবশ্যই আসবে চোরের মতো আলতো পায়ে। সেই বেনিয়া অবিশ্বাসকে ভালোবাসার ইতিহাস থেকে বহিষ্কার কারতে হবে। তবেই বেশিদিন জীবনকে পাশাপাশি রেখে ‘ব’ অক্ষরে নির্মিত ‘বিরহ’ থেকে দূরে থাকা যাবে। বিরল এক অভিলাস সৃষ্টির আরাধনায় বিলুপ্ত প্রায় এক বন ডুমুরের ফুল এই আমি- পৃথিবীর যত কপোত-কপোতি বর্ষার এ ক্ষণে দ্বিতীয় বসন্তকে বরণ করতে যাচ্ছেন তাদের প্রতি বুমেরাং এক ধাঁধাঁ রেখে আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি। আশা করি বাসরের প্রথম আসরে একে অন্যের কাছে এর উত্তরটা অবশ্যই খুঁজে নেবেন-
‘‘স্বামী অনেক দিন পর বিদেশ থেকে বাড়িতে এসে দেখলেন স্ত্রী একটা ফুটফুটে ছেলে কোলে নিয়ে বসে আছেন। স্বামী দেবতা জিজ্ঞাস করলেন- বউ, বাচ্চাটা কার? স্ত্রী মুচকি হেসে চটপট উত্তর দিলেন- বাচ্চাটার বাবা যার শ্বশুর, তার বাবা আমার শ্বশুর।’’ বর কনের সাথে আপনারাও বলুন তো দেখি, বাচ্চাটা আসলে কার?
***
রচনাকাল : ১৩/৮/২০২০
© কিশলয় এবং মোঃ তোফায়েল হোসেন কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।