সকাল সকাল "দৈনিক সত্যবচন" পত্রিকার প্রথম পাতার খবরটা পড়ে সারা গায়ে একটা শিরশিরানি বয়ে গেল ঋতমের।
হেডলাইনটা ছিল- "একজন উঠতি লেখকের লেখা গল্পের মাধ্যমে পঁচিশ বছরের পুরোনো এক অভিনেত্রীর রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার আনসলভড্ কেস রিওপেন"!
ঋতম খবরটা পড়ে দেখে যে সুনীতা নামের এক মধ্যবয়স্কা মহিলা দাবী করছেন যে পত্রিকার এই গল্পের সাথে পঁচিশ বছর আগে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়া এক অভিনেত্রীর কেসের সাদৃশ্য আছে। সেই সময় পুলিশ কোনোরকম ক্লু না পাওয়ায় কেসটা আনসলভড্ হয়েই থেকে যায়। পুলিশকে কেসটা রিওপেন করে পুনরায় তদন্ত শুরু করার অনুরোধ জানায় সেই মহিলা।
****************************
ঋতম সরকার একজন উঠতি লেখক। প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়ায় টুকটাক লেখালিখির মাধ্যমে হাতেখড়ি। তারপর ধীরে ধীরে তার লেখাগুলো পাঠকদের কাছে সমাদর পাওয়া শুরু করলে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতেও সেগুলো পাঠানো শুরু করে। এখন বিভিন্ন নামী পত্র-পত্রিকাতেও তার গল্প বেরোয়।
গত মাস থেকে একটা প্রবলেম শুরু হয়েছে ঋতমের।
আসলে ইঙ্ক পেনে লেখালিখি করতে পছন্দ করে সে। আর এই প্রবলেমের সূত্রপাত একটা ইঙ্ক পেন। তার এক বন্ধুর বাবার অ্যান্টিক জিনিসের দোকান আছে। সেখান থেকে ঋতম একটা সুন্দর দেখতে কিন্তু বেশ পুরোনো দিনের ইঙ্ক পেন পছন্দ করে নিয়ে আসে। পেনটার নিবটা খুবই সুন্দর, চক্চকে ছুরির ফলার মত ধারালো আর মজবুত। আগের ইঙ্ক পেনটা খারাপ হয়ে যাওয়াতে ঋতম এখন এটা দিয়েই লেখালিখি করে।
এই ইঙ্ক পেনটা দিয়ে যখনই কোনো গল্প লেখা শুরু করেছে, তারপর সেই গল্প মাঝপথে থামিয়ে একটু ব্রেক নিয়েছে। ফিরে এসে গল্পের বাকীটা আবার লিখতে গেলে দেখে সেই গল্পটা আমূল বদলে গিয়ে তার পরিবর্তে অন্য একটা গল্প লেখা রয়েছে। বারবার তার লেখা গল্পটা বদলে গিয়ে সেই একই গল্প ফিরে আসছে। এর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না ঋতম।
****************************
এবার একটা নামী পত্রিকায় লেখা পাঠাতে হবে। তাই সে মাঝে কোনো ব্রেক না নিয়ে একটানা রাত জেগে বসে বসেই গল্পটা লেখা শেষ করে। তারপর ঘুমাতে চলে যায়। পরদিন সেই গল্পটা পত্রিকার অফিসে বাই পোস্টে পাঠিয়ে দেয়।
সেই পত্রিকাতে যখন গল্পটা ছাপা হয়, সেটা পড়ে ঋতম রীতিমত চমকে যায়!
"আরে এটা তো আমার লেখা গল্পটা না! এটা তো সেই বদলে যাওয়া গল্পটা!"
কাগজে খবরটা বেরোনোর পরদিন ঋতমের বাড়িতে পুলিশ আসে। ঋতম পরিষ্কার বলে যে সে এই ব্যাপারে কিছুই জানে না। সম্পূর্ন কাল্পনিক গল্প লিখেছে সে। তবে পুলিশের কাছ থেকে সেই ইঙ্ক পেন আর গল্প বদলে যাওয়ার ব্যাপারটা পুরোপুরি চেপে যায় সে।
****************************
- তুমি আমার সাথে এটা করতে পারলে অনিতা?
- কি বলতে চাও তুমি ঋষি?
- আমি তো শুধুমাত্র..
- আমার সব সম্পত্তি নিজের নামে ট্রান্সফার করতে চাইছো..
- বাহ্..ঠিক ধরেছো। দ্য গ্ৰেট অ্যাকট্রেস অনিতা সেনের হাজব্যান্ড হিসেবে এটুকু তো দাবী করতেই পারি। তোমার যা কিছু সবই তো আমার। পাশের জমিতে তোমার পৈতৃক বাড়িটা ভেঙে যে নতুন বাড়িটা উঠছে, সেটাও তো আমারই হবে। আর তুমি কিনা এইসব সম্পত্তি নিজের বোনেকে দিতে চাইছো! কথা দিচ্ছি তোমার অবর্তমানে তোমার সম্পত্তির সাথে সাথে তোমার বোনের দায়িত্বও আমি নেব। ওকে আমার হৃদয়ের রাণী...
- শাট আপ ইউ স্কাউন্ড্রেল! আমি জানতাম আমার সম্পত্তি আর বোনের উপর তোমার কুনজর প্রথম থেকেই আছে। সেই জন্যেই আমি এই ডিসিশানটা নিয়েছি।
ঋষিকে কথাগুলো বলে অনিতা যেই পিছনদিকে ঘুরেছে, সাথে সাথে তার পেটের ভিতর কে যেন একটা জিনিস দিয়ে বারবার আঘাত করতে থাকে। অনিতার পেট থেকে গলগল্ করে রক্ত বেরোতে থাকে।
অনিতা পেট চেপে ধরে মেঝেতে পরে গেল। তারপর মুখ তুলে সেই আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে সে! তারপর নিস্তেজ হয়ে পরে।
****************************
- কে..কে ওখানে?
মাঝরাতে আচমকা ঘুমটা ভেঙে যায় সুনীতার। খাটের পাশের আরাম কেদারায় কে যেন বসে আছে। তার হাতে একটা জিনিস চক্চক্ করছে।
- আমাকে চিনতে পারছিস না রে সুনি?
- অনি দি..না..এ হতে পারে না..
- হতে তো অনেক কিছুই পারে না রে বাবু। এই যেমন ধর, ঋষিকে বাদ দিয়ে আমার সমস্ত সম্পত্তি শুধুমাত্র তোকেই দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুই এরকম বেইমানি করলি! এত লোভ তোর! এই বাড়িটা তখন তৈরী হচ্ছিলো, ওখানে আমার বডিটা পুঁতে দিলি। আর তার সাথে ঋষিকেও..
- দি..তু..তুমি জানলে কি করে?
- ঋষির খবর কেউ না জানলেও আমি সব জানি বাবু। তোরা দুজন আমাকে মৃত মনে করে এই আন্ডার কনস্ট্রাকশন বাড়ির সামনে নিয়ে আসলি, তখনও আমার শরীরে প্রান ছিল। ঋষি মাটি খুঁড়ে আমার বডিটা সেখানে শোয়ানোর পর তুই ঋষিকেও পিছন থেকে একইরকমভাবে এই ইঙ্ক পেন দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে আমার বডির উপর ফেলে দিলি। ঋষি তো তার উচিত শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু আমি যে এখনো শান্তি পাইনি!
- ক্ষমা করে দাও দি। আমি ভুল করে ফেলেছি। আমি তোমার সেই ছোট্ট সুনি..
- অনেক হয়েছে বাবু, আর না।
অনিতার আত্মা ধীরে ধীরে সুনীতার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। তার হাতে চক্চক্ করছে সেই ইঙ্ক পেনটা।
বাতাসের তরঙ্গে ছড়িয়ে পরলো তীব্র এক আর্তনাদ- দিইইই..
****************************
পরদিন সকালে "দৈনিক সত্যবচন" পত্রিকার ভিতরের দিকের পাতায় একটা ছোট্ট করে খবর চোখে পরলো ঋতমের।
"নিখোঁজ অভিনেত্রীর কেস রিওপেন করানো সুনীতার মৃতদেহ পাওয়া গেল তার ঘরের বিছানায়।"
তারপর ঋতম সেই ইঙ্ক পেনটা তার বাড়িতে কোথাও খুঁজে পেলো না।
****************************
(সমাপ্ত)
রচনাকাল : ৯/৮/২০২০
© কিশলয় এবং শুভেন্দু ভৌমিক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।