আজ বাইশে শ্রাবণ নিয়ে কিছু লিখতে বসে বিশ্বকবির প্রয়ানের সাথে সাথে আর একজনের চলে যাওয়ার কথা যে বড্ড মনে পড়ছে। জানি না আজ কোনো গল্প লিখবো , না কোনো কবিতা না কি কোনো প্রবন্ধ ! কোন আঙ্গিকে কোন গান গাইলে অন্তরের সুখ-দুঃখ সঠিক ভাবে ব্যক্ত করা যায় তা তো আমি তাঁর থেকেই শিখেছিলাম একদিন। তিনি বোলতেন , শুভারম্ভে এমন রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া উচিত যা কি না শুনলেই মানুষের মন-প্রাণ অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করে।
' আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে "
তাঁর খুব পছন্দের গান ছিলো। তিনি আর কেউ নন, তিনি ছিলেন পরম পূজনীয় আমার বাবা। কেনো জানি না বাইশে শ্রাবণের কথা লিখতে বসে তাঁর স্মৃতিচারণ এতো অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়লো।আর সে জন্যই আমার চোখের পাতা অশ্রুসিক্ত হোলো । হ্যাঁ , আমার বাবার কাছে কবিগুরুর কিছু কথা শুনেছিলাম।হঠাৎ কোরেই তাই অতীত টা উঁকি দিলো। সব ক্ষেত্রেই মৃত্যু টা খুব যন্ত্রণাদায়ক কষ্টদায়কও বটে। রবিঠাকুরের অন্তরাত্মাকে চিনতে শিখেছিলাম আমার বাবার হাত ধোরেই। তাই হয় তো আজ মনে পড়ে গ্যালো ।
* * * * * * * * * *
যাক এবার আসি বাইশে শ্রাবণের প্রসঙ্গে। ২৫শে বৈশাখ নিয়ে লিখতে বোসলে আনন্দে কলম চলে কিন্তু যিনি জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আছেন তাঁর অন্তিম সময় নিয়ে যাই লিখি না কেনো তা বড়ই বেদনাদায়ক। যদিও বিশ্বকবির শেষ ইচ্ছে ছিলো , যেনো তাঁর নামে জয়ধ্বনি না ওঠে। তিনি ভীষণ ভাবে ফিরতে চেয়েছিলেন শান্তিনিকেতন।সেখানে কোলাহল ছিলো না ; শান্ত , নিঃশব্দ প্রকৃতির কোলেই থেকে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই অনন্তকালে কে শোনে তাঁর কথা।
* * * * * * * * * *
অবশেষে এলো সেই দিন , ৭ই আগস্ট ১৯৪১ আর বাংলার ১৩৪৮ সালের ২২শে শ্রাবণ।জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নেমেছে লোকের ঢল। বেলা ১২ টা বেজে ১৩ মিনিট । কবির ডান হাত কাঁপতে কাঁপতে কপালের কাছে গিয়েই পড়ে গ্যালো। অন্যভুবনে পাড়ি জমালেন সকলের প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবি চলে যাওয়ার দুদিন আগে এলেন কবির বন্ধু ডঃ নীলরতন সরকার । অভ্যাসবশে নাড়ি দেখলেন। তারপরে কবির হাতে হাত বোলাতে লাগলেন। দুই বন্ধুর নিবিড় চাউনিতে ফুটে উঠেছে তখন অসহায়তা। ধ্বন্বন্তরী হয়েও সেদিন অর্জুনের হাত থেকে যেনো গাণ্ডিব খসে পড়লো। নীলরতনের কিছুই যে আর করার নাই।উঠে চলে যাওয়ার সময় দরজার কাছে গিয়ে বার বার ফিরে দেখলেন পরম বন্ধুকে। তিনি জানতেন , এই তাঁর শেষ দ্যাখা। আর কবি ? হ্যাঁ , তিনিও জানতেন , তাই তাঁর চোখ দিয়ে নিঃশব্দে জল গড়িয়েছিলো। সেদিন নীরবে বোলেছিলেন কি ? হে বন্ধু বিদায় !
* * * * * * * * * *
মানুষের অন্তিমকালে সবার প্রয়োজনই বোধহয় ফুরিয়ে যায়। তাই ডঃ বিধানচন্দ্র রায় ও অপারক রয়ে গেলেন। তাই তো ,
প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নতুন আবির্ভাবে-
কে তুমি ?
মেলেনি উত্তর !
বৎসর বৎসর চলে গেল ,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল
পশ্চিমসাগরতীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়-
কে তুমি?
পেল না উত্তর।
* * * * * * * * * *
আমি আজ বাইশে শ্রাবণ নিয়ে লিখতে বোসে একজন ঠাকুরের (কবিকেই বোঝানো হয়েছে) অন্ধভক্তের কথা জানি যিনি ঠাকুরের বাগানের ফুল দিয়েই ঠাকুরের আসন ফুলে ফুলে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। গভীর ভালোবাসার মালা গেঁথে ছিলেন || এই হোলো গাঁথা মালার নমুনা ,
" দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি,
তাই চমকিত মন, চকিত শ্রবণ,তৃষিত আকুল আঁখি।।
চঞ্চল হয়ে ঘুরিয়ে বেড়াই,সদা মনে হয় যদি দেখা পাই---
যেতে যেতে পথে পূর্ণিমারাতে চাঁদ উঠেছিল গগণে।
দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে কী জানি কী মহা লগনে।
তখন দেখি, পথের কাছে মালা তোমার পড়ে আছে।
বুঝেছিলাম অনুমানে এ কন্ঠহার দিলে কারে।
কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া
চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি গোপনে তোমারে, সখা, কত ভালোবাসি।
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা
মম শুন্য গগণবিহারী।
আমি আপন মনের মাধুরী মিশাায়ে তোমারে করেছি রচনা---
সংসার যবে মন কেড়ে লয়, জাগে না যখন প্রাণ।
তখনো, হে নাথ, প্রণমি তোমায় গাহি বসে তব গান
অন্তরযামী, ক্ষমো সে আমার শুন্য মনের বৃথা উপহার---
চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে,নিয়ো না নিয়ো না সরায়ে।
জীবন মরণ সুখ দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিব জড়ায়ে।।
স্খলিত শিথিল কামনার ভার বহিয়া বহিয়া ফিরি কত আর--
নিজ হাতে তুমি গেঁথে নিও হার, ফেলো না আমারে ছড়ায়ে।
চরণ ধরিতে দিও গো আমারে"।
* * * * * * * * * *
সেই শৈশবে , " জল পড়ে পাতা নড়ে " থেকে শুরু কোরে বয়সের প্রত্যেকটি ধাপে তিনি ছিলেন । আজও তাঁকে নিয়েই লেখা হচ্ছে কবিতা , গাওয়া হচ্ছে তাঁর গান । নারী-পুরুষ তাদের প্রেম নিবেদন কোরছে তাঁরই সৃষ্টির সুরে। তাই তো অত্যাধুনিক যুগেও আজও তাঁর মৃত্যুদিন সকল বাঙালীর কাছে একটি বিশেষ দিন হিসেবে চিন্হিত। এই দিন তাই আজও শ্রাবণের ধারার মতো সংগোপনে সকলের মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আজও মনে হয় তিনি আছেন , তিনি থাকবেন ।তিনি যে অমর তাঁর সৃষ্ট গীতবিতান অমর। তাঁর সৃষ্ট সবই যে আজ ও জীবন্ত ।
রচনাকাল : ৬/৮/২০২০
© কিশলয় এবং লিজা মন্ডল কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।