একলা
আনুমানিক পঠন সময় : ৫ মিনিট

লেখক : মলয় বর্ধন
দেশ : India , শহর : Howrah

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুলাই
প্রকাশিত ১৪ টি লেখনী ৩০ টি দেশ ব্যাপী ৮৭৩৭ জন পড়েছেন।
Malay Bardhan
একলা থাকার অনুভূতি কি বেজায় দোষের! আশ্চর্য্য হয়ে ভাবছিল বিনয়। কিন্তু কেন দোষের? প্রশ্ন করল নিজের মনকে। বারংবার প্রশ্ন করেও সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেলো না বিনয়। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলে, রাত তখন পৌনে দুটো বাজে। আবারও চোখদুটি বুজে ভাবতে লাগলো সে। সেই স্কুলের দিনগুলির কথা মনে পড়ে গেল, কেমন বন্ধুদের কাছে পেয়ে সে নিজের একাকীত্ব ভুলে যেত, যেমন মা কে পেলে তার সকল দুঃখ ভুলে যেত। স্কুলের সব বন্ধুরা তার বাড়ির গল্প বলতো বিনয় সেগুলো মন দিয়ে শুনতো, বন্ধুরা তাকে তাদের মায়েদের হাতের করা খাবার এর ভাগ দিতো, তারা বিনয়কে পেলে একটু বেশিই ভাব করতো, কখনও ঝগড়া হতো না বন্ধুদের মধ্যে। বিনয়ের মনে তাই প্রশ্ন মনে উঁকি দেয়া স্বাভাবিক, আসলে , বিনয়ের নিজের বলতে একমাত্র মাসিই আছে, বাবা-মা কে সে ছোটোবেলাতেই হারিয়েছে। মা-বাপ হারা একটি ছেলেকে ছোট থেকে মানুষ করার জন্য নিজের কোন আলাদা সংসার পাতেননি বিনয়ের মাসি।

মাসির পাড়াতে কয়েক বাড়ির ছোট ছেলে-মেয়েদের পড়িয়ে সেই টিউশনের টাকায় দিন চলে। মাসিরও নিজের ওই বোনপোকে নিয়েই তার জীবন। বিনয়, রাতে শুয়ে শুয়ে কত আকাশ কুসুম কল্পনা করে। সে ভাবে, একদিন লেখাপড়া শেষে সে রোজগার শুরু করবে এবং নিজের মাসির সব শখ পূরণ করবে, নিজের মাসি কে সে তার মায়ের মতই ভালবাসে। কারণ, ছোট থেকে সে মাসিকেই তার আরেক 'মা' ভেবে এসেছে যে।

মাসি জানে যে, ছেলেটা বেশির ভাগ মন মরা হয়ে থাকে। কি যে ভাবে! কে জানে? সে কথা জিজ্ঞেস করতেও বড় দ্বিধাবোধ হয়। কারণ, কষ্ট হলেও বিনয় মুখে 'রা' করে না যে! মাসি সব বুঝতে পেরে আড়ালে গিয়ে চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করে। মাসির ভয় হয় যে তার কিছু হয়ে গেলে মা-বাপ মরা ছেলেটাকে দেখবে কে? মাসির মাঝে মাঝে রক্ত বমি হয়, সে কথা সে বিনয়কে জানায়নি আজ তিন চার মাস হয়ে গেলো, পাছে বিনয় স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে নিজের মাসির সেবা করতে লেগে পরে! মাসিকে যে সে চোখে হারায় তা ভালোই জানে মাসি। ডাক্তার এর সাফ জবাব, এ রোগ সারার নয়। না খেয়ে খেয়ে পেটে পিত্তি পরে গেছে, কারণ যাই রান্না হতো বেশিরভাগই বিনয়কে দিয়ে নিজে খালি পেট বা আধ পেট খেয়ে শুয়ে পড়ত মাসি। আর বিনয় "খেয়েছো কি" জিজ্ঞেস করলে মাসি তাকে 'মিথ্যা' টাই বলত। ভয় হয় যে, তার জন্য তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেলে বিনয় এর ভবিষ্যৎ কি হবে? বিনয়ের মায়ের বড় সাধ ছিল যে, ছেলে বড় হয়ে লেখাপড়া করে বড় মানুষ হবে। সব বাবা মায়েদেরই যেমনটি ইচ্ছা থাকে বিনয়ের মায়ের মৃত্যু পূর্ববর্তী সে ইচ্ছার কথা মনে করতে করতে কখন যে ঘুম চলে এলো মাসির তা বিন্দুমাত্র টের পেল না বিনয়। কারণ, সে ভেবেই চলেছিল খুজে চলেছিল মনের সব নানা প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু উত্তর খুজে পেলো না কিছুতেই।

সকল বন্ধুদের সে চোখে হারাতো, আজ তাই তাড়াতাড়ি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়ল। আজ যে গরমের ছুটি শেষ হয়ে স্কুল খুলছে এতদিন পর, অনেকদিন পর স্কুলের সব বন্ধুদের সঙ্গে তার দেখা হবে, কথা হবে, টিফিনটাইমে খেলবে সে - সব কিছু যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছিল বিনয়ের। আনন্দ হচ্ছে বুঝতে পেরে মাসি সকাল সকাল ভাতের হাঁড়ি চাপিয়ে দিল। বিনয়কে বলল, "বিনু, সোনা, আজ তোর স্কুল খুলছে না রে?" বিনয় হেসে বলল, "হ্যাঁ গো। আজ কি মজা হবে, বন্ধুদের সঙ্গে আজ এত্তোদিন পর খেলব, গল্প করব। মাসি এক গাল হেসে বললে, "নে বিনু, খেয়েনে। আজ স্কুলে যেতে দেরী করিস নে। আমি চাইনা 'মাস্টার জী' তোকে বকা দিক দেরী করার জন্য। তুই যা বেয়ারা হয়েছিস, পড়ার নাম শুনলেই তোর ঘুম পায়" -এই বলে পাতে ভাত-আলুর ভাজা এবং এক বাটি ডাল খেতে দিয়ে মাসি কেমন যেন কিছু না বলেই চলে গেল বাড়ির বাইরে। বিনয় হাতে মুখে তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠল, তারপর স্কুল ইউনিফর্ম পরে দ্রুত পা বাড়াল স্কুলের পথে।

রোজ স্কুলে যাবার আগে বিনয়ের মাসি ওকে কালো টিকা লাগিয়ে দিত এবং বিনয়ও মাসিকে প্রণাম করে স্কুলে যেত। আজ তেমনটা হল না। বন্ধুদের সাথে দেখা হবে এই আনন্দে বিনয় ভুলেই গেল মাসিকে প্রণাম করার কথা! স্কুলে দ্রুত পৌছে সে মাস্টারের বাহবা পেল কারণ, এত তাড়াতাড়ি সে কোনদিন স্কুলে এসে পৌঁছায়নি এর আগে। স্কুলের সব মাস্টার মশাইরা 'বিনয়ের' প্রশংসায়ে পঞ্চমুখ হল। তাতে অবশ্য বিনয় যতটা না খুশি হল তার থেকে বেশি খুশি সে হল সব বন্ধুদের পাশে পেয়ে। আনন্দের জোয়ারে ভেসে গেল বিনয়। সারাটা দিন ক্লাস করে স্কুলছুটি হলে সে যখন মনের আনন্দে হাসি মুখে বাড়ির পথ ধরে যাচ্ছিল তখন কেমন যেন আজানা এক ভয় তার মনকে গ্রাস করল! স্কুলের সব মজার ঘটনা আজ সে মাসিকে খুলে বলবে, সে যে আজ পড়া পারেনি তা জানতে পারলে মাসি রাগ করবে বলেই হয়ত 'ভয় '।

বাড়ির সামনে যেতেই সে দেখতে পেল থিকথিকে ভিড়। পাড়ার যদুকাকা, সাবিত্রীমাসি, রুদ্রদাদা সবার চোখে জল! এটা দেখে ভয়ে বুক খেপে উঠল বিনয়ের। কি হয়েছে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে দেখলে পাশেই ঘরের দাওয়াতে পরে তার মাসির নিথর দেহ!! মৃতার মুখ থেকে রক্ত ঝরছে তখনও। বিনয়ের চোখ যেন এসব দেখে 'লাল হয়ে এল'। মনের সব আনন্দ এক নিমেষে বদলে গেল চরম হতাশা, দুঃখ, শোকে! মা-বাবার পর আজ তার আদরের মাসির অকালমৃত্যূতেও সে মুখে 'রা' পর্যন্ত কারলো না। চোখের জলে সে যখন তার প্রিয় মাসিকে বিদায় জানাতে শ্মশানে রওনা হতে যাবে  তখন পাড়ার ডাক্তারকাকুর কাছে জানতে পারল মাসির অসুখের কথাখানি। ডাক্তার বিনয়কে জানালেন যে, তার মাসির সকাল থেকে রক্ত বমি হয়েছিল, সে কথা সে চেপে রেখেছিল, পাছে বিনয় সেটা জানতে পেরে স্কুলে না যায়। এই কারণেই তাহলে বুঝি মাসি তখন তার খাবার সময় মুখে কাপড় গুজে বাড়ির বাইরে কোথাও চলে গিয়েছিল! এক এক করে সব বুঝতে পারল বিনয়। মাসি ছাড়া যে তার নিজের এই পৃথিবীতে কেউ ছিল না কেন মাসি তাকে এভাবে 'একলা' করে চলে গেল!! তবে কি মানুষকে এভাবেই একলা জীবন কাটাতে হয়! মৃত্যু এক এক করে মানুষকে একলা করে দেয় তার কাছের জনের থেকে! একলা থাকাই কি তাহলে তার নিয়তি! সে কি দোষ করেছিল যে আজ তার প্রিয় মাসিও তাকে এভাবে ছেড়ে চলে গেল! শত এমন প্রশ্ন ভিড় করলো মনে। আসলে মাসিকে সে নিজের আরেক 'মা' মনে করত তাই আজ মাসিকে হারিয়ে সে 'একলা' থাকার সেই অনুভুতির সাক্ষী হল যেই প্রশ্নের উত্তর তার মনের কাছে এতদিন অজানাই ছিল।
রচনাকাল : ৫/৮/২০২০
© কিশলয় এবং মলয় বর্ধন কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 1  China : 9  Europe : 1  France : 4  Germany : 2  India : 75  Russian Federat : 19  Saudi Arabia : 7  Sweden : 12  Ukraine : 5  
United States : 84  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 1  China : 9  Europe : 1  France : 4  
Germany : 2  India : 75  Russian Federat : 19  Saudi Arabia : 7  
Sweden : 12  Ukraine : 5  United States : 84  
লেখক পরিচিতি -
                          মলয় বর্ধন, ৭ ই জুন হাওড়া জেলার বালিতে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি ছবিও আঁকেন । ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি তার দারুণ আগ্রহ । তিনি সাহিত্যচর্চা করতে, গল্প লিখতে ও পড়তে ভালোবাসেন । তিনি বড়গল্প, ছোটগল্প, নাটক, কবিতা লেখেন । এছাড়া, কমিক্স করা তার অন্যতম সখ । তাছাড়া, তিনি বিভিন্ন অনলাইন পত্র -পত্রিকাতেও লেখেন ।  
                          
© কিশলয় এবং মলয় বর্ধন কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
একলা by Malay Bardhan is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪০৭৩৪
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী