বর্তমান দেখনদারির যুগে এক বহুল আলোচিত 'রোগ'। হ্যাঁ রোগই বটে। নানান সময়ে নানান কারণে কখন যে এই রোগ মাকড়সার জালের মতো আপনার মনে, মস্তিষ্কে বাসা বাধবে 'আপনি ধরতে পারবেন না'। রোগের লক্ষণ? একটা সাধারণ লক্ষণ হলো, আপনার মনের মধ্যে একটা বিশ্বাস জন্মানো যে আপনি কিছুই করতে পারেন না, বা, বন্ধুমহলে আপনাকে কেউ পাত্তাই দেয়না।
এবার আসি আসল কথায়, মানে এই রোগের কারণে। আগেই বলে রাখি, এর মতামত একান্তই আমার ব্যক্তিগত, বলতে পারেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই কলম ধরলাম এই অবসাদের কারণ খোঁজার তাগিদে।
আবার চলে যাই প্রথম লাইনে, মানে, এই যুগ হলো দেখনদারির যুগ। সমাজের এক শ্রেণীর ছেলে-মেয়ে মারাত্মক ট্যালেন্টেড। তারা সবাই তাদের ট্যালেন্ট প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বরাবরই সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করেন। কেউ লেখায়, কেউ আঁকায়, কেউ গানে, কেউ রন্ধনে, কেউ নাচ করতে অথবা কেউ ছবি তুলতে, সবারই কিছু না কিছু ট্যালেন্ট আছে আর সেটা মারাত্মক লেভেলের। এবার আপনি দেখলেন আপনার এক বন্ধু এসব ট্যালেন্ট দেখিয়ে নাম করছেন, ছোটোখাটো সেলেব হয়ে গেছে। তো তাই দেখে আপনার মনে হলো, আরে পাগলা, এসব তো আমিও করতে পারি। ক্লাস নাইনে যা কিডনির লম্বচ্ছেদ আঁকতাম, দেখে স্যার ঘাবড়ে যেতেন নিজের কিডনি কেটে খাতায় বসিয়েছি কিনা। বাচ্চাবেলায় 'চলছে রেলের গাড়ি' গাইতে গিয়ে এমন কুউউউউউ কুউউউউ করে হর্ণের আওয়াজ দিতাম, সবাই বলতো আহা খাসা গলা, তারমানে আমি গানও পারি টুকটাক। তারপর কলেজের সময়ে মেসে কতো ফিউশান রান্না বানিয়েছিলাম যা খেয়ে মেসের লোকজন আর আমায় দিয়ে রান্না করতেই দিতো না, মানে আমায় আর ক্রেডিট দিতে চায়না এই আর কি, এর মানে আমি রান্নাও পারি। তাছাড়া হাতে তো মোবাইল ফোন আছেই, তাতে ৪টে ক্যামেরা, গোবরের ছবিও চকোলেট কেক মনে হয় এমন কায়দায় ছবি তুলি। আর নাচ? জেনারেটার চালিয়ে দিলে আমি সেই আওয়াজেও ব্রেকড্যান্স দিতে পারি। হু হু বাবা, আমি সব করতে পারি যখন, আমিও কেন ওদের মতো নাম করবো না সোশ্যাল মিডিয়ায়? এই চিন্তা থেকেই রোগের সূত্রপাত। ব্যাস, শুরু হয়ে যায় নিজের অপটু ট্যালেন্ট দিয়ে লোকজনকে খুশি করার চেষ্টা।
এইসমস্ত 'অ'গুণ-ধারীরা যা করেন তাকে আমরা গোদা বাংলায় বলি নকল করা। ধরুন একজন ছবি আঁকছে, আমাকেও তার মতো ছবি আঁকতে হবে এই চিন্তা থেকে শুরু হয় এক ঠান্ডা প্রতিযোগিতা, যা শেষ হয় ব্যার্থতায়। নকল করে এগোতে গেলে ব্যার্থতা অবশ্যম্ভাবী। তাই আপনি যতই সুন্দর করে গুছিয়ে প্রকাশ করুন না কেন, আসলের মতো সেই চাকচিক্য থাকেনা, তাই কেউ দামও দেয়না আপনার কাজের। আর এখান থেকে আসে অবসাদ। একই কাজ করে আমার বন্ধু ১০০০ লাইক পেল আর আমি ৫০টা! আমার দ্বারা কিছুই হবে না, আমি বেকার একদম।
অবসাদ শুরু হয়ে গেলে সব কাজেতেই খালি নিজের ব্যার্থতাই নজরে আসবে দেখবেন আপনার। আপনি হয়তো জানবেন না যার ছবি দেখে আপনি আঁকার চেষ্টা করছিলেন সে নিজেই কোনো মোবাইল অ্যাপে টেকনোলজির সাহায্যে কারুকাজ করেছে বলে নিখুঁত হয়েছে, আর আপনি সাদা পাতায় জেলপেন দিয়ে রাত জেগে কাজ করেছেন বলে গোলটা ঠিক করে হয়নি, কিন্তু আপনি যেহেতু আগেই অবসাদে ভুগতে শুরু করেছেন তাই আপনি 'বেকার'। এরপর আপনার তোলা ছবিও মনে হবে বেকার। এরপর আপনার নিজেকেই মনে হবে বেকার কিন্তু 'ডিগ্রিধারী' আপনি এটা জানলেন না যে আপনার কি দাম আর যাকে দেখে আপনি নিজের তুলনা করছেন তার শিক্ষাগত যোগ্যতা কি বা আপনার সাথে ট্যালেন্টে তুলনায় আনারই বা যোগ্যতা কি। সবাইতো আর 'জবা' নয় যে কাজের লোক থেকে উকিল হয়ে যায়, কিন্তু এরকম লোকজন ভর্তি যে আবোলতাবোল লিখে, আবোলতাবোল ছবি এঁকে বা আবোলতাবোল ছবি তুলে নানান গ্রুপ থেকে সম্মানিত হয়ে নিজে স্বনামধন্য হয়ে গেছেন অথচ তার কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতাই নেই। একবার এক ইউটিউব ভিডিওতে একজন কবির উচ্চারণে 'স' এর দোষ শুনে আর এগোইনি, বুঝে গেছিলাম পরে আর কি কি আসতে চলেছে। এদের ছাড়াও অনেকের আছে বহুমুখী প্রতিভা, তাদের প্রতিভার যা ছটা, তাতে সূর্যই ম্লান হয়ে যায়, তো আপনি আমি তো নিপাট নিরীহ মানুষ। চারিদিকের এরকম 'সফল লোকজন'দের দেখে একসময় আপনার মনে হবে এ জীবনটাই বৃথা, তাই এ জীবন রেখে কি হবে। ব্যাস, গল্প শেষ।
কয়েকজনের জীবনে অবসাদ আবার অন্যরূপে অন্যপথে এসেছে। সে হলো ভালোবাসা। সে আরেক বিষম বিষয়। সম্পর্কের শুরুতে এতো টান, কেউ কেউ তো এক মাসের মধ্যে হানিমুনের স্পটের নাম আর দুই মাসের মধ্যে ছেলে-মেয়ের নাম ঠিক করে ফেলে এতো টান! তারপর ৬ মাসের মাথায় যখন কোনো একজনের টান কমে যায় তখন অন্যজনের মনে আসে সেই রোগ, যার নাম সন্দেহ। কি করছে, কেন করছে, কেন কথা বলছে না, কেন এড়িয়ে যাচ্ছে এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে বুঝতেই পারবেন না, ধরাধরি তো পরের ব্যাপার। যেই সব শেষ হয়ে যাবে তারপর গুটিগুটি পায়ে আসবে অবসাদ। আমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না, আমি কিছু করতে পারি নি, কেয়ার করতে পারি নি, গিফট দিতে পারি নি, সব দোষ আমার এসব বলে মুখে সিগারেট নিয়ে আকন্ঠ পান করে শরীরের জলাঞ্জলি আর নিজের ফটোয় পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার ব্যাবস্থা করতে শুরু করে দেবেন আর কি। ওদিকে জানবেনও না যে ৬ মাস পরে ঝগড়ার অজুহাতে সে অন্য কাউকে তার জীবনে হাতছানি দিয়েছে, আর আপনাকে ছাড়ার ৫০দিনের মাথায় সে কমিটেড হয়ে গেছে। আপনি যদি ছেলে হন আর আপনার 'সে' যদি ওপরের কোনো এক গুণধারী সুন্দরী সেলেব হয় তাহলে তো আপনার অবস্থা আরও শোচনীয় হবে। হীনমন্যতায় সবসময় মনে হবে আপনাকে কিছু একটা করতেই হবে নিজের দর বাড়ানোর জন্যে নাহলে তার বন্ধুমহলে যদি কেউ ওর ক্রাশ হয়ে গিয়ে আপনার থেকে কিডন্যাপ করে নেয়! অবসাদ, অবসাদ, অবসাদ। এইরকম অবসাদের ফলস্বরূপ আমরা সুশান্ত সিং রাজপুতকে হারিয়েছি কিনা জানা নেই, তবে আমি আমার এক ভাইকে হারিয়েছি, আর কেউ এভাবে কাছের লোকের কোল ছেড়ে চলে যাক চাই না।
বন্ধু, অবসাদ বড় কুটিল জিনিস, সম্পর্ক থেকে শুরু করে সবকিছু, এমনকি নিজের প্রতি বিশ্বাসটাও শেষ করে দেয়। তাই, আমার মতে এমন কাজ করা উচিৎ নয় যেখান থেকে এই 'অন্যের মতো হতে হবে' এই চিন্তাভাবনা মনের মধ্যে আসে। প্রত্যেকে কিছু না কিছু গুণের অধিকারী আমরা, সেইটুকু নিয়েই যদি খুশি থাকি তাহলে হয়তো মনের মধ্যে লোকের কাছে নিজেকে সবজান্তা জাহির করার ইচ্ছেটা আসবেনা। যেটা জানি শুধু সেটাই যদি সবাই জানে তাতে ক্ষতি কিসে? আমি তো জোকার নই যে সব সময় সবাইকে খুশি রাখতে পারবো! নিজের দামটা জানা এবং অন্যকে সেটা জানানো খুব প্রয়োজন।
এইজন্য সবশেষে বলবো, 'না' বলতে শেখাটা খুব দরকারি। এটা সব দিক থেকে সাহায্য করে। বিশ্বাস না হলে এক সপ্তাহ চেষ্টা করে দেখুন (অফিসের বস বাদে)। না হলে একবার 'কার্ত্তিক কলিং কার্ত্তিক' সিনেমার কিছুটা দেখুন, শেষটুকু দেখার দরকার নেই, তাহলে আগে যা শিখবেন সে সব ভুলে যাবেন।
©দীপ-উবাচ
রচনাকাল : ৪/৮/২০২০
© কিশলয় এবং অর্ণব দত্ত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।