“বিয়েটা তোমার কাছে প্রয়োজন ছিল, ভালোবাসার একটুও কণা ছিল না কোনকালেই। তুমি আমাকে ঠকিয়েছ। আমাকে শুধু না, আমার বাবা মা, আমার পরিবারের সবাইকে ঠকিয়েছ।” চিৎকার করে বলতে লাগলো সুরঞ্জনা।
ঠাণ্ডা মেজাজে সৌনক জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার মধ্যে কটটুকু ভালোবাসা ছিল রঞ্জনা? আমাদের মধ্যে প্রেম ছিল, ভালোবাসা ছিল, ছিল সবকিছু। কিন্তু সবকিছু যেন উবে গেছিল ওই রেজিস্ট্রেশনের দিন থেকে।’
সৌনক আর সুরঞ্জনার প্রেম করে বিয়ে হয়েছিল। দীর্ঘ বছর সাতেক একসাথে ঘোরা, খাওয়া, নিজেদেরকে অনুভব করার মধ্যে দিয়ে পরস্পর বুঝে গেছিল, ‘দে আর মেড ফর ইচ আদার’। দুটো পরিবারের সবাই সবকিছু জেনে মেনে নিয়েছিল। সৌনক সুদর্শন পুরুষ, ভালো বেতনের চাকরি করে, তাই আর কেউ না করে নি। সুরঞ্জনার মা তো খুশিতে গদগদ। অনেক আলোচনার পর যখন বিয়ের দিন ঠিক হল, একদিন সৌনক সুরঞ্জনার বাড়িতে গিয়ে শুনতে পেল, ঘরের মধ্যে আলোচনা চলছে।
-রেজিস্ট্রেশন ছাড়া এ বিয়ে সম্ভব নয়, আগে রেজিস্ট্রেশন তারপর বিয়ে। দরকারে বিয়ের দিন রেজিস্ট্রেশন হবে। তুই জানিস না, ওই সৌনক ওর বাবা মা’র কথায় ওঠে বসে। তুই ওর টাকাপয়সা কিছুই পাবি না। ওই বুড়োবুড়ি সব হস্তগত করবে। মজার বিষয় হল, তুমিও সেদিন মায়ের এই কথায় কোন প্রতিজ্ঞা না করে জোর সম্মতি দিয়েছিলে। যাক, আমাকে দেখার সাথে সাথেই সেই ভাবগম্ভীর পরিবেশ উড়িয়ে দিয়ে চোখেমুখে গদগদ ভাব এনেছিলে।
রেজিস্ট্রেশন হল, বিয়ে হল। উবে গেল ভালোবাসা। কারণ আবেগ সরে গিয়ে এল হিসাবের খাতা। আচ্ছা রঞ্জনা তুমি বলতে পারো ভালোবাসার সম্পর্কে আইনি বন্ধনের তাৎপর্য কতটা? রেজিস্ট্রেশন তো আমাদের সেই জন্য হয়েছিল যে এত বিশ্বাসের মাঝে গভীর অবিশ্বাসের জন্ম থেকে। যে ভালোবাসায় ভালোবাসাকে হার মানিয়ে শুধু শুধুমাত্র অধিকারের আইনি স্বাক্ষর হয়, সেদিন থেকে জাগতিক সম্পত্তি হিসেব নিকেশ থাকে, ভালোবাসা থাকে না। ভালোবাসা না খুঁজে আজ খুঁজে দেখো তোমার বাবা মা আর ছোট ভাইকে আমাদের বেলঘড়িয়ার ফ্ল্যাটে না থাকতে দিতাম, কোথায় গিয়ে দাঁড়াতেন? তোমার দাদা বিয়ে করে ব্যাঙ্গালোরে। ছোট ভাইয়ের ডাক্তারি ভর্তির খরচ কিন্তু আমি দিয়েছিলাম, নইলে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়তে হত। এসব কথা তো আর রেজিস্ট্রেশনে লেখা ছিল না। আমি তোমাকে ভালবাসতে গিয়ে দেখেছি তোমার চোখে মুখে সেই রেজিস্ট্রেশনের আগের আতঙ্কের ছাপ যদি সৌনক আমাকে ত্যাগ করে। মনে পড়ে যায় রেজিস্ট্রেশনের পরে তোমার মায়ের যুদ্ধজয়ের আনন্দ। এর পরে আর ভালোবাসার নাটক থাকলেও ভালোবাসার আবেগ থাকে না রঞ্জনা। আমি মনে করি ভালোবাসার সম্পর্কে রেজিস্ট্রেশন ব্রাত্য থাকাই ভালো, অন্য প্রয়োজন থাকলে তা বিয়ের পরে করাই যেতেই পারে। নইলে ভালোবাসা আর বিশ্বাসের অপমৃত্যু ঘটতে পারে।
রচনাকাল : ১/৮/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।