কান খাড়া করে সব কথা শুনছেন তিনি। পাশের ঘরে নাতনি আর বউমার তর্কের আওয়াজ উঁচুতে উঠছে ক্রমশ।
“সারাক্ষণ এভাবে থাকা যায় নাকি? পার্কে গেলে কী হবে?”
“কী হবে তুমি বেশ জানো – ন্যাকা সেজো না। পার্কে গিয়ে তোমরা বন্ধুরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরো – হাগ করো – তোমাদের ওই কী যেন – হ্যাঁ হ্যাঁ হাই-ফাইভ – ওগুলো অত্যন্ত বিপজ্জনক। স্যোশাল ডিস্ট্যান্সিং তোমরা কেউ মেনটেন করো না।“
“তাহলে আমরা শুধু স্কাইপ আর জুম আর টিমে কথা বলবো নাকি সারা জীবন? এখন তো আর লকডাউন নেই। তাহলে…”
“তোমাদের যবে আক্কেল হবে, তারপর আবার বেরোবে। আমি তো ছাড় দিয়েইছিলাম। তোমার বাবা তোমাদের পার্কে দেখে এসে আমাকে বলল তোমরা সে ছাড়ের কী ধরণের অপব্যবহার করছো… ।“
দড়াম করে দরজাটা খুলে বেরিয়ে এলো তিয়াস। তারপর দুমদুম করে চলে গেলো বারান্দায়। সশব্দে বারান্দার দরজাটা বন্ধ হলো।
ওঁর খুব কষ্ট হলো মেয়েটার জন্যে। আহা – কতই বা বয়েস – এই তো পনেরোয় পড়লো। এই বয়েসে তো বন্ধুদের সঙ্গে হইচই করবেই…
কষ্ট হলেও অবশ্য ওঁর বিশেষ কিছু করার নেই। সংসারে ওঁর কথার বিশেষ ওজন নেই – অনেককাল হলো। না –বউমা খারাপ ব্যবহার মোটেই করে না, বরং যত্নই করে। তবে কিনা ওঁর কথা বা মতামতকে বিশেষ পাত্তা দেয় না। এক্ষেত্রে তো আরোই দেবে না – কারণ বউমা যেটা বলেছে, সেটা যুক্তিযুক্ত।
সাতপাঁচ ভেবে শেষে আস্তে আস্তে বারান্দার দরজাটা খুলে বাইরে এলেন। ভেবেছিলেন তিয়াস বোধহয় খুব রেগে থাকবে – দেখলেন সে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছে। তবে মুখ দেখে মনে হচ্ছে না সেটা সে খুব মন দিয়ে শুনছে। একটা অস্থির ভাব।
উনি পাশে এসে দাঁড়ালেন। তারপর খুব নিচু স্বরে জিগ্যেস করলেন “গান শিখবি?”
“গান?” অবাক হলো তিয়াস। “কী গান?”
“ওই আর কী – আমি যেসব গান, মানে আমার…”
“মা শিখিয়েছিল কয়েকটা। তবে আমার তেমন ভালো লাগে না। ঠিকমতো বুঝতে পারি না।“
“আমি বুঝিয়ে দেবো।“ বললেন উনি। “দাঁড়া – আগে গীতবিতানটা নিয়ে আসি।“
“গীতবিতান !!” বলে হাসলো তিয়াস। “এখন সব নেটে পাওয়া যায়। এই নাও – এই সাইটে খুঁজে দেখো।“
খুঁজে পেলেন উনি। অবশ্য গীতবিতানটা আনতে যা সময় লাগতো, তার চেয়ে একটু বেশিই সময় লেগে গেল – তা হোক! তারপর সেটাকে আস্তে আস্তে পড়তে লাগলেন।
“এই যে মুক্তির কথা বলেছেন – সেটা আমাদের অন্ধকার থেকে মুক্তি। মানে আমাদের মনের অন্ধকার… তাই এ মুক্তি আলোয় আলোয়। আজকের পৃথিবীতে, যখন এক অসুখের আতঙ্কে আমরা উৎকণ্ঠ হয়ে আছি – আপনজনকে হারাবার ভয় পাচ্ছি প্রতিমুহূর্তে, তখন এই প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি নিশ্বাসে আসছে আমাদের মুক্তি।“তিয়াস ভুরু কুঁচকে শুনছে। সবটা ঠিক বুঝতে পারছে না। কিন্তু বলতে বলতে ওঁর মুখে যে জ্যোতির্বলয় ফুটে উঠছে সেটা টের পাচ্ছে। আর না বুঝেও কেমন যেন ভালো লাগছে তার। বিশেষত বোঝাতে বোঝাতে উনি একটু করে গেয়ে উঠছে আর তার গা শিরশির করে উঠছে তখন।
পেছন থেকে সমীরণের গলা পাওয়া গেল। “দেহ মনের সুদূর পারে, হারিয়ে ফেলি আপনারে…”। বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে সে – গলা ছেড়ে গাইছে। তিয়াসের চোখ গোল গোল হয়ে গেল।
“বাবা – তুমি গান গাইতে নাকি?”
“এটা আমাদের স্কুলের প্রেয়ারে গাওয়া হতো রে। এটা জানবো না? “ বলল সমীরণ।
“থামলি কেন – গা” বললেন উনি। সমীরণ আবার গাইতে শুরু করলো। তিয়াসও।
এসব গানের আওয়াজে মন্দিরা বারান্দায় এসে পড়েছেন। তাকে দেখেই তিয়াস বলল “মাম্মা – বাবা গান গাইছে – আর আমিও। এই গানটা জানো তুমি?”
“এটা সবাই জানে রে। “
“তাহলে আমাদের সঙ্গে গাও। ওয়েট আ সেকেন্ড – দিয়াকে ডেকে নিই স্কাইপে? ও তো বেঙ্গলি – ওরও ভালো লাগবে। হয়তো ওর মা-বাবাও জয়েন করবে। “
স্কাইপ চালু হলো। সোনাঝরা বিকেলে প্রবাসী দুটি পরিবার, যার কনিষ্ঠ সদস্যারা বাংলা ভালো করে জানে না, তারা দুটি আলাদা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই গানটা গেয়ে উঠলো।
আঘাতে বেদনায় বিষণ্ণ পৃথিবীর ওপর ছেয়ে আছে কালশিটে রঙের আকাশ। কিন্তু তার একপ্রান্ত আলোকিত হয়ে উঠছে রক্তিম সূর্যাস্তে। সেই সোনালি আলোয় দেখা যাচ্ছে ওঁর সাদা দাড়ি আর আলখাল্লা। উনি গাইছেন। প্রায়-অন্ধকার আকাশে মুঠো মুঠো মুক্তির আশা ছড়িয়ে পড়ছে।
রচনাকাল : ২৫/৭/২০২০
© কিশলয় এবং তথাগত চক্রবর্তী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।