রেস্তোরার আলোটা ত্যারছা হয়ে এসে পড়েছে সামনের রাস্তায়। সেই আলোয় দাঁড়িয়ে আছে রোহন। একটু অস্থির, ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখছে, চুল ঠিক করছে থেকে থেকে। তাছাড়া খেয়াল রাখছে ওর নিজের মুখে আলোটা ঠিকমতো পড়ছে কিনা।
আসলে এটা ওর প্রথম টিন্ডার ডেটিং কিনা!
গত ছ’মাস কারোর সঙ্গে রোহনের সেভাবে কথাই হয় নি। লকডাউনের লৌহকপাট শিথিল হলেও মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগটা কেমন যেন ম্লান হয়ে গেছে। আগে যে অফিসের পার্টি হতো মাঝে মাঝে, কখনো বা বন্ধুদের পিৎজা পার্টি বা কোন মেয়ের সঙ্গে এমনি এককাপ কফি খাওয়া – সেসব যেন গতজন্মের কথা।
তাই প্রথমে আপত্তি থাকলেও শেষে এই টিন্ডার ডেটিং অ্যাপেতেই নাম লিখিয়েছে সে। এতে খরচা আছে কিছুটা, কিন্তু তবু তো কারোর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হবে, কথা হবে। হয়তো অন্য কিছুও – বলা যায় না।
মেয়েটি এসে রোহনের ঠিক সামনে দাঁড়ালো। তারপর বলল “রগস-১৩ ?”
মাথা হেলিয়ে সায় দিলো রোহন। ওটা ওর টিন্ডার পাসওয়ার্ড। তারপর বললো “আসল নাম রোহন। তোমার?”
“তুলি। টিন্ডারে ‘দ্য বিচ’। আমাদের আজকের বুকিং নম্বর ৩২৭। কী, ঠিক আছে?”
হাসলো রোহন, যদিও মাস্কের আড়ালে সেটা বোঝা গেলো না। তারপর বলল “চলো, রেস্তোরায় যাই?”
“দাঁড়াও – তার আগে এটা দেখে নাও।“ তুলি ওর মোবাইলে একটা সার্টিফিকেট দেখালো। তুলির কোভিড টেস্টের সার্টিফিকেট। দুদিন আগে করা। রেজাল্ট নেগেটিভ।
“আর এই ট্র্যাকার অ্যাপ দেখাচ্ছে যে গত দুদিনে আমার সঙ্গে কোন কোভিড পেশেন্টের কন্ট্যাক্ট হয় নি। কাজেই – অল ওকে।“
যদিও এসব নিয়ম টিন্ডার-অ্যাপেই বলা ছিল, তবুও রোহন কেমন একটু থতমত খেয়ে গেল। আনাড়ি হাতে নিজের কোভিড সার্টিফিকেট আর ট্র্যাকার অ্যাপটা খুলে মোবাইলটা তুলির হাতে তুলে দিল। দুটোকেই মন দিয়ে দেখে ফেরত দিতে দিতে তুলি বলল “ক্লিন। চল, যাওয়া যাক।“
“রেস্তোরায়?”
“এত তাড়া কিসের? আগে এই সামনের পার্কে এক চক্কর হেঁটে নি?” বললো তুলি।
ফুটফুটে চাঁদের আলো পার্কে। আজ বোধহয় পূর্ণিমা। ওরা দুজন হেঁটে চলেছে পার্কে। কথা বলছে মৃদুস্বরে। তুলির চোখের তারায় চাঁদের প্রতিবিম্ব।
দুজনের দূরত্ব কমে আসছে ক্রমশ। হাতের গ্লাভস খুলে ফেলেছে দুজনেই।
পার্কের অন্যপ্রান্তে পৌঁছে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো তুলি। তারপর রোহনের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। দূরত্বটা কমে গেল আরেকটু।
রোহনের বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে এবার। তুলির বাঁ হাত রোহনের গলা জড়িয়ে ধরেছে। কী অসম্ভব মাদকতা ওর পারফিউমের গন্ধে !
অব্যক্ত স্বরে রোহন কোনমতে বলল “মাস্কটা খুলবে না?”
খিলখিল করে হাসলো তুলি। তারপর ডানহাতের এক টানে খুলে ফেললো নিজের মাস্কটা। তারপর রোহনেরটাও।
টকটকে লাল লিপস্টিক-মাখা তুলির ওই পুষ্পপুটতুল্য ঠোঁটের ফাঁকে ঝিলিক মারলো ঝকঝকে সাদা দাঁতের পাটি। পূর্ণিমার আকাশ-ধোয়া চাঁদের আলোয় রোহন দেখতে পেল তুলির শ্বদন্তটি একটু বেশিই দীর্ঘ। আর তাতে স্পষ্ট লাল দাগ।
রোহনের গলা জড়িয়ে থাকা তুলির নরম কোমল হাতটা হঠাৎ ইস্পাতকঠিন হয়ে উঠেছে। রোহনের গলার কাছে তখন একটা তীক্ষ্ণ অসহ্য যন্ত্রণা।
রচনাকাল : ২৫/৭/২০২০
© কিশলয় এবং তথাগত চক্রবর্তী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।