অশরীরীর প্রতিশোধ
আনুমানিক পঠন সময় : ৬ মিনিট

লেখিকা : যুথিকা দেবনাথ
দেশ : India , শহর : মালদা

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , মে
প্রকাশিত ৩৮ টি লেখনী ৩৩ টি দেশ ব্যাপী ১৯৫৪৫ জন পড়েছেন।
Juthika Debnath
গল্প: অশরীরির প্রতিশোধ

বলি........ও........হতচ্ছাড়ি ……..বড়লোকের বেটি,ঘুম ভাঙ্গলো?  কলতলে রাজ্যের এঁটো বাসন পড়ে রয়েছে,সাবান কাঁচা , রান্নাবান্না -সব পড়ে রয়েছে,কে করবে শুনি? রাজকন্যের মতো শুয়ে থাকলে চলবে ? শাশুড়ির এই বাজখাঁই কন্ঠস্বর ও বাক্যবাণ মালতীর নিত্যদিনের সঙ্গী। সে ধড়ফড় করে উঠে বসে, ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে-যাই মা। তড়িঘড়ি তার নিত্যকর্ম শুরু করে,জুতো সেলাই থেকে চন্ডী পাঠ সব কিছুই তাকে একা হাতে করতে হয়। শাশুড়ি তার রোগের ছুতো দেখিয়ে মালতীকে দিয়ে সব কাজ করিয়ে নেয়। মালতীও মুখ বুজে সব সহ্য করে নেয় । গ্ৰামের রতনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে প্রায় এক বছর । নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে মালতী । বাবা,মা, দাদার অমতে পালিয়ে রতনকে বিয়ে করে । সেই থেকে বাপের বাড়ীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন । প্রথম প্রথম বেশ কিছুদিন শাশুড়ি ভাল ব্যবহার করলেও মালতীর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শাশুড়ির আসল স্বরূপ ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে । স্বামী মায়ের মুখের উপর  কিছু বলত না । সে আবার বড় সাধাসিধে মানুষ । মাকেও কিছু বলত না ,মালতীকেও কিছু বলত না । এই ভাবেই মালতী মূখ বুজে  সব সহ্য করত, কারণ বাপের বাড়িতেও তার জায়গা নেই । রোজগার করার মত তার শি্ক্ষা ও নেই।
অসন বসনের অভাব নেই বলে সে সব কিছু মানিয়ে নেয় ।

রতন ও মালতীর বিবাহিত জীবন প্রায় ৪ বছর গড়িয়ে গেল ,কিন্তু মালতীর কোলে কোনো সন্তান না আসায় শাশুড়ীর  নির্যাতন ক্রমাগত বাড়তে থাকে । মালতী লক্ষ্য করে তার প্রতি রতনের উদাসীনতাও ।বিরূপ মনোভাব দিনে দিনে বাড়তে থাকে ।‌‌‌‌ আরও কিছুদিন গত হওয়ার পর সে কানাঘুষো শুনতে পায় ,রতন পুতুল নামে কোনো একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে ।শাশুড়িও নিত্য মালতীকে শোনাত ছেলের আবার বিয়ে দেবে ।মালতীর এবার ধৈর্যের বা্ঁধ ভাঙলো । তার প্রতি মানসিক নির্যাতন চরম চেয়ে বড় এঐ সীমায় পৌঁছাল ।সে জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে ঠিক করলো এই দুঃসহ জীবন সে শেষ করে দেবে ।
সেদিন  ছিল পূর্ণিমার রাত । নিস্তব্ধ ,নিঝুম উঠানের পাশে বড় বড় গাছের ফা্ঁক দিয়ে ছায়া ছায়া চাঁদের আলো এসে পড়েছে । কয়েকটি সারমেয় ও শিয়ালের চিৎকারে নিশুতি রাত যেন আরো বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে ।মালতীর চোখের সামনে তখন একটাই পথ । সেটা মৃত্যুর পথ , যেটা সেই গভীর নিশুতি রাতের চেয়ে ও আরো ভয়ংকর । সে সমস্ত ভয়ভীতিকে তুচ্ছ করে স্বামীর পাশের শয্যা ছেড়ে চুপিসারে উঠৈ পড়ে , নীরবে, ধীর পদক্ষেপে দরজাটা ভেজিয়ে উঠানে এসে দাঁড়ায় । উঠান থেকে একটা কলসী ও একটা দড়ি নিয়ে পুকুর পাড়ে এসে থামে । গলায় দড়ি দিয়ে কলসীটাকে বেঁধে পুকুরের জলে ডুবে আত্মহত্যা করে । পরেরদিন সকাল হতে না হতেই শাশুড়ির সেই বাক্যবাণ চলতে থাকে । কিছুক্ষণ কেটে যাবার পরও যখন মালতীর কোনো সাড়া পায় না ,তখন তেলেবেগুনে জ্বলে শাশুড়ি মালতীর ঘরের দরজায়ে টোকা দিতেই দেখে দরজা খোলা । ছেলেকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে । শুরু হয় খোঁজ । ইতিমধ্যেই অনেকটা সময় কেটে যায় । প্রতিবেশীদের মধ্যে ও খবরটা রটে যায় । এদিক ওদিক অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মালতীকে কোথাও পাওয়া যায় না । বেলা যখন অনেকটা গড়িয়ে গেছে তখন রতন কিছু একটা ভেবে পুকুর ঘাটে যায় । গিয়ে দেখে জলে কি যেন ভেসে রয়েছে । কিছু চিন্তা না করেই সে জলে নামে এবং দেখে মালতীর কাপড়ের আ্ঁচল ভেসে রয়েছে । টেনে তুলতেই দেখে মালতীর গলায় দড়ি দিয়ে  কলসী বাঁধা । রতনের বুঝতে দেরী  হয় না মালতী আত্মহত্যা করেছে ।

কয়েক দিন  শোকপর্ব ও শেষকৃত্য সম্পন্ন করে রতন ও তার মায়ের স্বাভাবিক জীবনযাপন চলতে এথাকে । একটা মাস ঘুরতেই রতন ওর প্রেমিকা পুতুলকে বিয়ে করে । পুতুল মালতীর মত এত শান্ত স্বভাবের নয় ,বরং বলা যায় একটু দজ্জাল প্রকৃতির । শাশুড়ির বাজখাঁই কন্ঠস্বর ও বাক্যবাণ তার কাছে নস্যাৎ হয়ে গেল । তার প্রত্যুত্তরের তীরের ফলায় জোঁকের মুখে নুন পড়ার মত শাশুড়ি গুটিয়ে গেল ।রতন ও পুতুল সুখে সংসার করতে লাগল । কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু অদ্ভূত,আজব জিনিস তাদের নজরে পড়ত । দরজায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ, হঠাৎ হঠাৎ রাতের দিকে পেঁচার ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ , ছায়ামূর্তি,কারও অস্পষ্ট কান্নার আওয়াজ ইত্যাদি । রতন ও পুতুল অ‌নেক সময় মনের ভুল  ভেবে এসেগুলি উড়িয়ে দিত ।
এক বছরের মাথায় পুতুলের কোল আলো করে সন্তান এলো, ফুটফুটে একটি পুত্র ।সবাই খুব খুশি । শিশুটির যখন তিন মাস বয়স তখন একদিন পূর্ণিমার রাতে ঘটল এক মর্মান্তিক অদ্ভুত ঘটনা । মধ্যরাতে পুতুলের একটু ঘুম ভাঙতেই দেখল বিছানায় শিশুটি নেই । হন্তদন্ত হয়ে রতনকে ডেকে তুলল । ঘরের দরজা খুলে উঠানে দাঁড়াতেই তাদের নজরে পড়ল একটা বড় নিমগাছের ডালে একটি দোলনা দুলছে । দোলনায় একটি অস্পষ্ট নারীমূর্তি ও তার কোলে একটি শিশু । ভয়ে রতনদের সারা শরীর অবশ হয়ে গেল, বোবার মত তারা সেদিকে তাকিয়ে রইল । যখন সম্বিত ফিরল তখন দেখে কোথাও কিছু নেই । খুঁজতে খুঁজতে ভোর হয়ে গেল । ভোরের আলোয় দেখতে পেল সেই নিম গাছের তলায় তাদের সন্তান মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে ।
 মালতীর প্রতিশোধ স্পৃহার  আগুন জ্বলতেই থাকল । তার দেহ হীন প্রেতাত্মা রতনদের পিছু ছাড়ল না । রতনরা এএশান্তি স্বস্ত্যয়ন করলেও লাভ কিছু হল না । মালতীর  পৈশাচিক প্রেতাত্মা শান্তি পেল না । বছরের মাথায় পুতুল আবার একটি ফুটফুটে পুত্রের জন্ম দিল । সন্তানটির
যখন এক মাস বয়স তখন একদিন পুতুল রাতের বেলায় তার শিশুটিকে স্তন্যপান করানোর জন্য যখন কোলে তুলে নিল ,তখন দেখে শিশুটির দেহ শক্ত হয়ে গেছে । মাথাটা উল্টা দিকে ঘোরানো আর মুখে রক্ত । সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে পুতুল চিৎকার করে উঠে অজ্ঞান হয়ে গেল । তার চিৎকারে সবাই ছুটে এসে যা দেখল তাতে সকলের শরীর শিউরে উঠল । সকলের চক্ষু স্থির হয়ে গেল । পুতুল সেই যে অজ্ঞান হল  আর তার জ্ঞান ফিরল না । সে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ল । ডাক্তার এসে তাকে মৃত ঘোষণা করল । রতন ও তার মা ভয়ে, হতাশায় পাগলের মত হয়ে গেল । কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে তারা কিছুদিন ঘরবাড়ি তালাবন্ধ করে এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করল । কয়েক মাস এভাবে কেটে যাওয়ার পর যখন রতনরাএকটু স্বাভাবিক হল, তখন একদিন রতনের মা রতনকে বলে  কিছু ভালোমন্দ বাজার করে নিয়ে আসতে । অনেক দিন আত্মীয় বাড়ীতে রয়েছে , তাই রতনের মায়ের এমন ইচ্ছাঊ। রতন বিকেল বেলা হাটে গেল বাজার করতে । বাজার করার পর কিছু পরিচিত লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যাওয়ায় গল্পগুজব করতে একটু দেরি হয়ে গেল । তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের শুরু । সেদিনও ছিল পূর্ণিমার রাত । জোৎস্নালোকে সে বাড়ীর পথ ধরলো ।পথে একটা শ্মশান পড়ে । তার পাশ দিয়েই রাস্তা । রতন প্রফুল্ল মনে অনেক বাজার করে ফিরছিল । তার পরেরটা সকলের অজানা । মা অপেক্ষায় থেকে থেকে অজানা আতঙ্কে কাঁদতে লাগলো । পাড়ার লোকেরা এগিয়ে গিয়ে ও রতনের দেখা না পেয়ে ফিরে এলো । সকলেই  আশঙ্কায় অপেক্ষায় অনিদ্রায় রাত কাটালো । পরেরদিন সকাল হতেই সবাই আবার বেরিয়ে পড়লো রতনের খোঁজে । হাটের পথের দিকে এগোতে গিয়েই শ্মশানের পাশে বড় বটগাছের দিকে নজর পড়তেই সকলের চক্ষু চড়কগাছ । তারা দেখে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় রতন গাছের ডালে ঝুলে রয়েছে । চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে । থলেটা ও মাছ, মাংসের কাঁটা , হাড়গোড় পড়ে রয়েছে গাছের নিচে । সকলে সেই দৃশ্য দেখে হতভম্ব ও বাকরুদ্ধ । রতনের মা সেই যে বোবা হল আর তার মুখে কথা ফুটল না ।এবার বোধহয় মালতীর প্রতিশোধের আগুন নিভল, তার আত্মা চির শান্তি পেল । 

যুথিকা দেবনাথ
রচনাকাল : ২০/৬/২০২০
© কিশলয় এবং যুথিকা দেবনাথ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 1  China : 17  France : 1  Germany : 2  Hungary : 1  India : 76  Russian Federat : 5  Saudi Arabia : 6  Sweden : 12  Ukraine : 5  
United States : 102  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 1  China : 17  France : 1  Germany : 2  
Hungary : 1  India : 76  Russian Federat : 5  Saudi Arabia : 6  
Sweden : 12  Ukraine : 5  United States : 102  
লেখিকা পরিচিতি -
                          শ্রীমতি যুথিকা দেবনাথ একজন গৃহবধূ। জন্ম ৯ ই জুলাই অধুনা বিহারের কাটিহার শহরে। পিতার কর্মসূত্রে পরবর্তীতে মালদহে বসবাস। শিক্ষা জীবন সম্পূর্ণ মালদহ মহাবিদ্যালয় থেকে কলাবিভাগে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দমদম ক্যান্টনমেন্টে স্থায়ীভাবে বসবাস।
       ছাত্রজীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি উনি গীটারেও শিক্ষা লাভ করেছেন। স্কুল জীবনে কবিগুরুর কিছু লেখনীপাঠ থেকে সাহিত্যানুরাগের  জন্ম। কলেজ জীবনে প্রবেশের পর কিছু কবিতা ও গল্প রচনা দিয়ে লেখালেখি শুরু।মে,২০২০ থেকে কিশলয় ই-পত্রিকার একজন নিয়মিত লেখিকা। 
                          
© কিশলয় এবং যুথিকা দেবনাথ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
অশরীরীর প্রতিশোধ by Juthika Debnath is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪০৯০৫
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী