সুন্দরবনের জনজীবনে জলবায়ুগত বিপর্যয়ের প্রভাব
আনুমানিক পঠন সময় : ১১ মিনিট

লেখক : সনৎকুমার পুরকাইত
দেশ : India , শহর : ডায়মন্ডহারবার

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ৯৭ টি লেখনী ৩৮ টি দেশ ব্যাপী ৩৫১৮৫ জন পড়েছেন।
ভূমিকাঃ
             সুন্দরবনের অবস্থানগত বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে এর জলবায়ু বা আবহাওয়ার একটা প্রভাব থাকে। এমনিতেই একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘নদীর ধারে বাস/ভাবনা বারো মাস’। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় সবসময় মাথায় করে সুন্দরবনের মানুষ আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, আয়লা, বাঁধের ভাঙ্গন ইত্যাদি সমস্যার মধ্যে জীবনযুদ্ধে টিকে মানুষ প্রমাণ করতে আজও সচেষ্ট যে মানুষ প্রকৃতির সম্পর্কে মানুষ জয়লাভ করবেন। কিন্তু প্রকৃতির উপর মানুষের এই আধিপত্য কালের ক্রমবিবর্তনে মানুষের কাছে ফেরত এসেছে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সাক্ষী বহন করে। যে সুন্দরবন এর উত্তর সীমা আজকের তিলোত্তমা কলকাতা নগরীর মাঝখানে ছিল, তা সময়ের সাথে সাথে মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মাত্র তিন শতাধিক বছরের মধ্যে সুন্দরবনের সীমানা সঙ্কুচিত হয়ে একেবারে বঙ্গোপসাগরের বুকে ভাসমান দ্বীপগুলির মধ্যে সীমিত হয়েছে। মানুষের এই পরিবেশের উপর করাল গ্রাসের কারণে পরিবেশ বিভিন্নভাবে অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। মানুষের উপর প্রকৃতির অভিমান নয়, মানুষ মানুষের জন্য নিজের গর্ত নিজেই খুঁড়ে বসেছেন। তাই সুন্দরবনের ক্ষেত্রে আমরা মনে করি বাঘ লোকালয়ে আসে না, মানুষ বাঘালয়ে অবস্থানের কারণে মানুষের বাঘের হাতে প্রাণ যায়। 

            জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব মানবজাতিসহ সমগ্র জীবজগতের উপর বর্তাবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ, মানুষের কারণে পরোক্ষভাবে হলেও জলবায়ুর আংশিক পরিবর্তন ঘটে থাকে। তবে সময়ের সাথে সাথে মানুষের অভিযোজন করার ক্ষমতাই এই বিপদ থেকে উতরে দিতে পারলেও ক্ষনিকের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিপর্যয়ের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া ভীষণ চাপের হয়ে দাঁড়ায়। সারা বিশ্বজুড়ে এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ, প্রভাব আর তা থেকে মুক্তির উপায় খোঁজার জন্য নিরন্তর গবেষণা চলমান। কেউ বা বলেন যে জলবায়ু পরিবর্তনের সবথেকে বড় বিপর্যয় গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি যার ফলস্বরূপ বিশ্ব উষ্ণায়নের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করা হয়। এর সাথে সাথে হিমালয়ের শিখরে অবস্থিত তুষারের অপরিমিত হারে দ্রুত গলন আর উপকূলীয় অঞ্চলসহ বদ্বীপগুলোর সময়ানুক্রমে সমুদ্রে নিমজ্জন হবে। সুন্দরবন বিশ্বের সবথেকে বড় লবণাক্ত জলের ম্যানগ্রোভ অধ্যুষিত নদী দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের সাথে নিবিড় যোগাযোগের কারণে জলবায়ুর পরিবর্তনে এখানে সমুদ্রের জলতল বৃদ্ধির ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছে। এর পিছনে প্রকৃতির রোষানল যতটা আছে তার থেকে মানুষের প্রভাব কোন অংশে কম নহে।

সুন্দরবনে দুর্যোগের ইতিহাসঃ
             ইতিহাস কথা বলে। আমরা সুন্দরবনের দিকে তাকালে দেখতে পাই, যে এই সুন্দরবন এমন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল না। সেখানে কোলাহলে মুখর হয়ে ছিল জনবসতি। সুন্দরবনের নদীনালা ধরে চলত দেশের অন্তঃবানিজ্য ও বহির্বাণিজ্য। আদিগঙ্গার ধারা যখন তার পুরানো খাত ধরে এসে শতমুখী গঙ্গা হয়ে সুন্দরবনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রবাহিত ছিল, তখন দেশের বানিজ্য তরী সুন্দরবনের অধুনা গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করত। রাজা প্রতাপাদিত্যের আমল থেকে পাল, সেন কিংবা গুপ্ত ও মুঘলদের সময় এই সুন্দরবনের সমৃদ্ধি বারেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে এর প্রাকৃতিক কু-প্রভাব। বারবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সুন্দরবনের অধিকাংশ অঞ্চল। জলের তলায় চলে গেছে একাধিক দ্বীপ। শোনা যায় ১১০০ সালে যে বন্যা হয়েছিল তার কারণে সুন্দরবনের সমগ্র জনবসতি জলের তলায় চলে যায়। প্রাণে বাঁচতে সেই সময়কার রাজা ও জমিদাররা কলকাতা ও হুগলী জেলায় অবস্থান করে। প্রজারাও নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। সময় বয়ে গেলেও সেই বন্যাবিধ্বস্ত সুন্দরবনে জনপদের প্রত্যাবর্তন না হওয়ার ফলে একে একে জঙ্গলে ঢেকে যায়। সুন্দরবনের লোহাচরা ও সুপারিভাঙ্গা ধীরে ধীরে সমুদ্রের বুকে বিলীন হয়ে গেছে যেমন, তেমনি সাগরদ্বীপের বিখ্যাত কপিল মুনির বর্তমান মন্দির অষ্টম মন্দির হিসাবে বিদ্যমান। তার আগের মন্দির গুলো বারেবারে প্রাকৃতিক জলবায়ুগত দুর্যোগে একে একে সমুদ্রের গভীরে বিলীন হয়ে গেছে। আজও সেই বৈচিত্র্যপূর্ণ সুন্দরবনের জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব সমভাবে বিদ্যমান।  

সুন্দরবনের জলবায়ু পরিবর্তনঃ
               সুন্দরবনের জলবায়ু বলতে আলাদা করে কিছু হয় না, কারণ একটা জলবায়ু তার দৈশিক ও কালিক পরিসর এতটা বেশি যে সুন্দরবন আলাদা করে কোন জলবায়ু তুলে ধরে না। তবে উপকূলীয় অবস্থান এবং ভৌগলিকভাবে ক্রান্তীয় অবস্থান এর জলবায়ু ক্রান্তীয় জলবায়ুর মধ্যে ধরা হয়ে থাকে। তবে এর বিস্তীর্ণ জলরাশির মাঝে গভীর জঙ্গলের আচ্ছাদন কোন একটি বিশেষ জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত হলেও পৃথক কিছু বৈশিষ্টের কারণে মনে হতে পারে যে এর সুন্দরবনের একটি আলাদা জলবায়ু বিদ্যামান। যাইহোক, Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC) এর মতে ক্রান্তীয় বনভূমি সবথেকে বেশি বিরূপ আবহাওয়া বা জলাবায়ুর মধ্যে অবস্থান করে। অর্থাৎ আবহাওয়ার বিভিন্ন খারাপ প্রভাব নিয়ে ক্রান্তীয় বনভুমির উদ্ভিদ প্রজাতি অবস্থান করে। যেমন- ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত এর খামখেয়ালীপনা, লবণতার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, আবহাওয়ার চরম অবস্থা তথা বন্যা, খরা এবং ঘূর্ণীঝড়ের প্রভাব সবথেকে বেশি পরে জঙ্গলের উপর। আর বাংলাদেশ তথা ভারতীয় সুন্দরবনের এই অংশ যেহেতু ক্রান্তীয় অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত, তাই এই সুন্দরবনের জলবায়ুগত বিপর্যয়, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং জনজীবনে তার প্রভাব বিদ্যমান হওয়াটাই স্বাভাবিক।
 
সুন্দরবনের জনজীবনে প্রভাবঃ 
               পূর্বেই বলেছি সুন্দরবন বঙ্গোপসাগরের দ্বীপাঞ্চল এবং ইহা বৃহত্তর গাঙ্গেয় ব্রহ্মপুত্রের উপকূলীয় অঞ্চল হিসাবে পরিগণিত। উত্তর গোলার্ধের দেশ তথা ভারতের স্থল্ভাগের দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থানের কারণে বিস্তীর্ণ জলরাশির উপর উন্মুক্ত ক্ষেত্রের (বিস্তীর্ণ জলরাশির উপর এই উন্মুক্ত ক্ষেত্রের ভূমিরূপবিদ্যার ভাষায় ফেচ বলা হয়) উপর আগত বায়ুর শক্তি বাড়াতে যেমন সহজ হয়, তেমন এই শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহের কারণে বিপর্যয়ের মাত্রা অনেকটাই ধ্বংসাত্বক করে তোলে। প্রাকৃতিক কারণের সাথে সাথে মানুষের ক্রিয়াকাণ্ডে সুন্দরবন এমনিতেই বিধ্বস্ত, তার উপর ২০০৯ সালে ঘটে যাওয়া বিধ্বংসী আয়লার প্রভাবে সুন্দরবনের অনেক কিছুই আজ বিপন্ন। গত তিন দশকে সুন্দরবনের স্বাভাবিক তাপমাত্রার পরিমাণ প্রায় প্রতি দশকে ০.৫ ডিগ্রী হারে বেড়েছে যা বিশ্ব উষ্ণায়নের হারের আট গুণ বেশি। এই কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের একটা উল্লেখযোগ্য তপ্তবিন্দু হিসাবে তকমা পেয়েছে আমাদের সুন্দরবন। ১৯৮০ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ১.৫ ডিগ্রী, যার কারণে অনেক ধরনের প্রাণী এবং উদ্ভিদ প্রজাতি বিপন্ন হবার আশঙ্কা রয়েছে। 

সমুদ্রের জলতল বৃদ্ধি ও দ্বীপের নিমজ্জনঃ   
           সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ ড. জি. কে. দাসের কথায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের জলতলের বৃদ্ধি ঘটার ফলে সারা বিশ্বের স্বাভাবিক হারের তুলনায় গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রের বদ্বীপ অঞ্চলের নিমজ্জনের হার তুলনামূলকভাবে বেশি নথিভুক্ত হয়েছে। এই নিমজ্জনের স্বাভাবিক হার গড়ে ১ মিমি প্রতি বছর, সেখানে সুন্দরবনে সমুদ্রে নিমজ্জনের হার ২.২ মিমি প্রতি বছর। সুন্দরবনের গভীর জঙ্গল যেখানে কোন কোন ক্ষেত্রে জলে স্থলে মিশে থাকে প্রায়সময়, কিংবা গড় সমুদ্র সমতল থেকে মাত্র কয়েক মিটার উঁচু সেখানে মানুষের প্রবেশ খুব একটা থাকে না। সুন্দরবনের বিখ্যাত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার এর নিভৃত স্থান এই কোর এলাকায়। কিন্তু এত দ্রুত সমুদ্র সমতলের উত্থানের কারণে, এই সকল স্থানগুলির অনেক জায়গা ভাটির সময়ও জলে ডুবে থাকছে। তিনি আরও বলেন যে গত ২০০০ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্কের গবেষণায় দেখা যায় যে সুন্দরবনের এই অঞ্চলগুলি আগামী পঞ্চাশ বছরে প্রায় ২৮ সেমি নিমজ্জিত হবে ধীরে ধীরে। সেতাকে যদি লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয় ৯৬% ম্যানগ্রোভ জলাভূমি বাঘেদের বাসভূমি তলিয়ে যাবে জলের তলায়। সমুদ্রজলতলের এই বৃদ্ধি ও দ্বীপের নিমজ্জনের ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতান্ত্রিক বৈষম্য দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। আবার World Wildlife Fund for Nature Conservation এর হিসাবে সুন্দরবনের প্রায় ৭৫০০ হেক্টর বনভূমি জলের তলায় চলে যেতে পারে শুধু এই নিমজ্জনের কারণে। 

মৃত্তিকা ও মিষ্টি জলের লবণের বৃদ্ধি ও খনিজের সামঞ্জস্য হ্রাসঃ 
            সমুদ্রের জলতলবৃদ্ধির কারণে আগামী তিনদশকের মধ্যে প্রায় ১১ টি দ্বীপ জলের তলায় তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি দ্বীপ বুলচেরি, বাঙ্গাদুনি ও ডালহৌসি দ্বীপ হল সুন্দরবনের টাইগার রিজার্ভ প্রোজেক্টের অন্তর্গত বাঘের আবাসস্থল। সমুদ্রের জলতলের হঠাৎ বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রের লবণাক্ত জল নদীর খাঁড়ি বেয়ে উপকুলের অভ্যন্তরভাগে প্রবেশ করে মিষ্টি জলের সাথে মিশে যায়। ফলে মাছ চাষের ক্ষতি হয়। নদীর জল আর আশেপাশের মৃত্তিকা লবণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে কৃষিকাজ থেকে মৎস্যচাষে বিরূপ প্রভাব পড়ে। এমনকি আয়লার সময় বা তার পরে পানীয় জলসহ দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় ফ্রেশ ওয়াটারের অভাব পরিলক্ষিত হয়। কারণ মিষ্টি জলের সাথে লোনা জলের মিশ্রণের ফলে খনিজের পরিমাণে হেরফের লক্ষ্য করা গেছে যা বেশকিছু উদ্ভিদের অস্তিত্ব রক্ষার পক্ষে কষ্টদায়ক। বিশেষ করে সুন্দরবনের গর্ব তথা ম্যানগ্রোভের প্রধান প্রজাতি সুন্দরী গাছের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে কমতে শুরু করেছে। এই সংকট কাটানোর জন্য রাজ্য বনদপ্তর বাইন জাতীয় গাছের বীজ সমগ্র সুন্দরবনে ছড়িয়ে সাম্যতা আনার চেষ্টা করে চলেছে।

কৃষিকাজে প্রভাবঃ
           সুন্দরবনে মানুষের আগমন বলা ভালো সুন্দরবনে মানুষ প্রকৃতি সুন্দর সম্পর্ককে বিনাশ ঘটিয়ে মানুষের যে আধিপত্য বিস্তারের কাজ শুরু হয়েছিল একদা, তার সবথেকে বড় আবেগ ছিল আবাদ করা। সুন্দরবনের জঙ্গল হাসিল করে চাষের জমি, বাসস্থানের জমি বের করে সেখানে থাকা ও নিবিড়ভাবে চাষাবাদ করা। সুন্দরবনের গোসাবা দ্বীপে ১৯০৩ সালে প্রথম ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিল্টন সাহেবের হাত ধরে আবাদের কাজ শুরু হয় এবং আবাদের কাজ এত প্রসার হয়েছিল শহর থেকে অনেক দূরে অবস্থান করলেও এখানে সমবায়তন্ত্র প্রচলন হয় এবং সেই সমবায়ে আলাদা করে এক টাকার নোট ছাপানোর কাজ শুরু হয়। এটা যেমন সমগ্র সুন্দরবনের কৃষিকাজের ইতিহাসে গর্বের, তেমনিভাবে বলা যায় কৃষিকাজ সার্বিকভাবে নিরভার করে আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপাদানগুলির উপর। সেই আবহাওয়া ও জলবায়ুর ঋণাত্মক উপাদানগুলির প্রভাবে সুন্দরবনের কৃষিকাজ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ আজ। বারেবারে এই সুন্দরবন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে। যার কারণে এখানকার মৃত্তিকা যেমনভাবে লোনাজলের স্বাদ পেয়েছে, তেমনিভাবে এখানকার মাটি ও জলের খনিজের সমন্বয় নষ্ট করে দিয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ আয়লার প্রভাবে কৃষিজমি যখন নদীর লোনা জলের তলায় অবস্থান করে, তার ফলে হয়তো কিছু পলি সঞ্চয় হয়েছে। কিন্তু এক দশক পেরিয়ে গেলেও চাষের জমির উৎপাদনশীলতা আর ফেরত পাওয়া যায় নি। আয়লা অধ্যুষিত অঞ্চলের কৃষিকাজে সাফল্য আনতে নানান রকম শঙ্কর বীজের প্রয়োগ ঘটাতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞানীর দল। স্থিতিশীলতা ফিরতে ফিরতে আবার একটা দুর্যোগের সম্মুখীন হয়ে সুন্দরবনের কৃষিকাজ বাধার সম্মুখীন হয়।

আর্থ-সামাজিক প্রভাবঃ
          সুন্দরবনের মানুষ খুব কম চাহিদা নিয়ে বাঁচে। কারণ এরা অত্যাচারিত হয়ে বিহার, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া বা মেদনিপুর ও বাংলাদেশ থেকে এসে এই জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিল। তাই জঙ্গলের মধু, কাঠ আর ফল, নদীর মাছ, কাঁকড়া আর চিংড়ি আহরণ করে কোনরকমে কাটে দিনযাপনের গ্লানি। সঙ্গের সাথী ছিল চাষের জমি, কিংবা ভাগচাষী বা বর্গাদার বা প্রান্তিক চাষি হয়ে একটু রসদ জোগাড় করার উপায়। কিন্তু বারেবারে দুর্যোগের কারণ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। সমীক্ষাতে প্রকাশ, আয়লার পরে যখন চাষের জমি বা বসতবাটি দুই হারিয়ে নিঃস্ব, তখন বাড়ির পুরুষেরা আর জঙ্গলে মধু বা কাঁকড়া, মাছ ধরা বা চাষের জমির দিকে না তাকিয়ে থেকে তারা ভিনরাজ্যের চেন্নাই, মুম্বাই, গুজরাটের বিভিন্ন জায়গায় কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। কেউ যদি চাকরী পেয়ে যায় তাহলে শহর বা শহরতলিতে একটা মাথা গোঁজার আস্তানা তৈরি করে ফেলে। এক্ষেত্রে সোনারপুরের গোসাবা কলোনি উল্লেখযোগ্য। অনেক বাড়িতে মেয়েরা বিভিন্ন কুটীরশিল্পের কাজ করে দিন গুজরান করেন। তবে, বর্তমানের কৃষিকাজ ও জলবায়ুর খামখেয়ালিপনার কারণে কৃষিতে উৎপাদনশীলতায় যে স্থানীয় মানুষ অসন্তুষ্ট, তা তাদের কথায় প্রমাণিত। তারা আগের থেকে অনেক ভালো আছে বলে দাবী করছে। এই জলবায়ুর পরিবর্তনে বা তার খেয়ালে এখানকার মানুষের হাতে অর্থ এসেছে অন্য পথে। তারা অনেকেই আজ স্বাবলম্বী। কিন্তু জলবায়ুর এই নির্মম পরিহাসে সম্পদের হানি ঘটতেই থাকে।  

বর্তমান সুন্দরবনের অবস্থাঃ
           সুন্দরবনের জলবায়ুর এই খেলা এবং স্থানীয় মানুষের কাছে সরকারের ভোট রাজনীতি, সব মিলিয়ে সারাবছর ধরে এই দুর্যোগের মোকাবিলা করতে সরকারের একটা পৃথক দপ্তর বর্তমান। সুন্দরবন উন্নয়ন দপ্তর ছাড়াও সুন্দরবন উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রক দেখভাল করে। আয়লা থেকে করুন শিক্ষা পাওয়ার পরে বর্তমানে সুন্দরবনের অধিকাংশ দ্বীপে বিশেষ করে দক্ষিণের যে দ্বীপগুলিতে মানুষের বসবাস আছে সেখানে রিং বাঁধ দেওয়ার কাজ চলছে। এর আনুমানিক খরচের লক্ষ্য এক হাজার কোটি টাকা। আবহাওয়া হোক আর জলবায়ু হোক, মানুষের এই প্রতিরোধে কি তা রোখা সম্ভব, সাময়িকভাবে হয়তো তা প্রতিহত করা যায়। মানুষ প্রকৃতির এই সহাবস্থানে প্রকৃতিকে তার মত করে খেলার সুযোগ দিতে হয়, কারণ মানুষ আজ প্রকৃতির বুকে থাবা বসিয়ে মানুষের বিপদ মানুষ ডেকে এনেছে। আজকের হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে রিং বাঁধ দিলেও তার পরিকল্পনা সঠিকভাবে না করলে আগামী এক বছরে তা বিনষ্ট হবে এবং তার সুফল থেকে স্থানীয় মানুষ বঞ্চিত থেকে যাবে। অজ্ঞ মানুষ জানেই না এর পিছনে কত ভয়ঙ্কর খেলা চলছে, শুধু বাইরের তৎপরতা আর বাতুলতা দেখে তাদের মানসিক প্রশান্তি। প্রকৃতিকে যদি তার জায়গা ছেড়ে রেখে আমরা ঐ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে দ্বীপাঞ্চলের বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে উঁচু বাড়ি তৈরি করাতে পারতাম তাহলে রিং বাঁধের কোন প্রয়োজন পড়ত না। কারণ তাদের কথায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনেক হয়েছে কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এই আয়লাতে, যেটা গত একশ বছরেও চোখে পড়ে নি। সুতরাং, অতীত থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত বলে মনে করি। দুর্নীতি আর উন্নয়নের ঝাপসা কাঁচে মুড়ে না রেখে সুন্দরবন ও সুন্দরবনবাসীর যদি উভয়কে টিকিয়ে রাখতে হয় তাহলে পরিবেশবান্ধব সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 

তথ্যসুত্রঃ
 চৌধুরী, কমল, ‘চব্বিশ পরগণা (উত্তর, দক্ষিণ ও সুন্দরবন), কলকাতা
 পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা সংখ্যা, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ২০০০
 পুরকাইত, সনৎকুমার, ‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে-একটি সমাজ বিজ্ঞানীয় অনুসন্ধান’ ২য় সংখ্যা, ৩য় বর্ষ, ভূগোল ও পরিবেশ, জুলাই-আগস্ট, ২০১৮
 পুরকাইত, সনৎকুমার, ‘জটার দেউল – সুন্দরবনের প্রাচীন ভূগোল চর্চায় এক অন্যতম পুরাতাত্ত্বিক উপাদান’ ৩য় সংখ্যা, ৩য় বর্ষ, ভূগোল ও পরিবেশ, নভেম্বর-ডিসেম্বর, ২০১৮  
 পুরকাইত, সনৎকুমার, ‘সাগরদ্বীপের ভূগোল ও ভূগোলের সাগরদ্বীপ’ অপ্রকাশিত 
 সান্যাল, তপোব্রত, ‘প্রসঙ্গঃ এ-বছরে দক্ষিণবঙ্গের বন্যা’,৪র্থ সংখ্যা, ৩৭ বর্ষ, উৎস মানুষ, অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০১৭, কলকাতা
 রায়চৌধুরী, প্রসিত, ‘আদি গঙ্গার তীরে’, কলকাতা, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স
 সুন্দরবনের আর্থ-সামাজিক সমীক্ষার প্রতিবেদন, ডিসেম্বর, ২০১৮, ভূগোল ও পরিবেশ 
 Das, Goutam Kumar: Sea-level Rise, Subsidence and Impact of Climate Change in the Sunderbans, Frontier, ISSN 0016-2094, January 2019.



রচনাকাল : ১৭/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 2  Bangladesh : 15  Cambodia : 1  Canada : 540  China : 19  Europe : 2  France : 4  Germany : 2  Hungary : 13  Iceland : 1  
India : 2735  Ireland : 46  Romania : 2  Russian Federat : 16  Saudi Arabia : 4  Sweden : 11  Ukraine : 8  United Kingdom : 1  United States : 851  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 2  Bangladesh : 15  Cambodia : 1  Canada : 540  
China : 19  Europe : 2  France : 4  Germany : 2  
Hungary : 13  Iceland : 1  India : 2735  Ireland : 46  
Romania : 2  Russian Federat : 16  Saudi Arabia : 4  Sweden : 11  
Ukraine : 8  United Kingdom : 1  United States : 851  
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সুন্দরবনের জনজীবনে জলবায়ুগত বিপর্যয়ের প্রভাব by Sanat Kumar Purkait is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৩৭৬৭৪২
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী