‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো....’ কবির এই উক্তিতে প্রতীয়মান হয় যে, প্রকৃতির এই প্রপঞ্চে ছড়িয়ে রয়েছে বৈচিত্র্যময় নৈসর্গিক সৌন্দর্য। আপনি যদি সংসার সমুদ্রে বিচরণ করতে করতে চৈত্রের চিতায় দগ্ধ হয়ে সামান্য বারিধারায় সিঞ্চিত হতে চান, কিংবা সংসার অনলে পতঙ্গের ন্যায় ঝাঁপ দিয়ে পুড়ে মরতে মরতে বাঁচার জন্য প্রকৃত সুখ অনুভব করতে চান, তাহলে আপনাকে মাঝে মাঝে নিজেকে মেলে ধরতে হবে এই প্রকৃতির বুকে। তবে অনেকের মনে হতে পারে যে রাজ্যের বাইরে বা দেশের বাইরে না গেলে ভ্রমণের স্বাদ পাওয়া যায় না। কিন্তু না, বাংলার নোবেলজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্ফুলিঙ্গ কাব্যের ১৬৪ নং কবিতায় বললেন,
“বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু”।
তাহলে এখানে একটা কথা পরিষ্কার যে, আপনার যদি অনুভব করার ক্ষমতা থাকে তাহলে আপনার রাজ্যের আনাচে কানাচে পড়ে রয়েছে উলুবনের মাঝে মুক্তের ন্যায় সৌন্দর্যবর্ধনকারী বিভিন্ন প্রাকৃতিক পর্যটনকেন্দ্র। তার মধ্যে অন্যতম একটি হল এই মুকুটমণিপুর কংসাবতী নদীর জলাধার। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও মেদিনীপুরের কিছু অংশে চাষের জল সরবরাহের জন্যই এই বিশাল জলাধার তৈরি করা হয়। ১৯৫৬ সালে, বাংলার তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী, বিধানচন্দ্র রায়ের ‘ব্রেন চাইল্ড’ ছিল এই জলাধার। কংসাবতী ও কুমারী নদীর জল ধরে রাখা হয় মানবসৃষ্ট এই রিজার্ভারে। কলকাতা থেকেও সোজা বাসে করে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জার্নিতে পৌঁছে যাওয়া যায় আপনার আমার প্রিয় বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুর পর্যটনকেন্দ্রে। ট্রেনে করে বাঁকুড়া এবং সেখান থেকে গাড়ি করে মুকুটমণিপুর পৌঁছতে মেরেকেটে লাগে ঘণ্টা দেড়েক। পিচের মসৃণ রাস্তা একসময়ে লাল মাটির পরিবেশ পেরিয়ে জয়পুরের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হারিয়ে যায় গ্রামীণ পরিবেশে।
আমরাও পৌঁছে গেলাম কলকাতা থেকে আগের দিন রাত্রে বাসে চড়ে পরেরদিন ভোরবেলায় মুকুটমণিপুর মোনালিসা লজে। তারপর একটু ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম সেই বিখ্যাত মুকুটমণিপুর ড্যামের উদ্দ্যেশে। অপূর্ব সৌন্দর্য বিশিষ্ট এই ড্যামের দিকে তাকালে বোঝা যায় কিভাবে যৌবনকে ধরে রাখতে হয়। আমরা আমাদের মানবজীবনের সঙ্গে যদি মেলাতে থাকি, তাহলে আমরা দেখতে পাই যে আমরা আমাদের যৌবনের উপবনে ঘুরতে ঘুরতে যৌবনের সঞ্জীবনী শক্তি সব নিচের দিকে নামাতে নামাতে বার্ধক্যদশায় উপনীত হই। কিন্তু কংসাবতী নদী ৪৬৫ কিমি পথ অতিক্রম করে সাগরে মেশার সাহস দেখালেও তার যৌবনকে বেঁধে রেখেছে এই মুকুটমণিপুরের ড্যামে। কিংবদন্তী অনুসারে, সমুদ্রের কাছে বাগদত্তা কংসাবতী কৃষ্ণ দামোদর নদ তাঁর রূপে আলিঙ্গন করতে ছুটে এলে কংসাবতী দ্রুত ধাবমান হয়ে সমুদ্রে মিলিত হয়। এখানেই তাঁর পবিত্রতা, এখানেই প্রকৃতির বুকে থাকা প্রাকৃতিক নিয়মের এক অপ্রাকৃত মহিমা। বর্ষার সময় যখন প্রকৃতির নিয়মে নদীগুলিতে যৌবনের জোয়ারে প্লাবিত হয়, তখন সে তার মধু প্লাবিত করে দেয় নিচের দিকে অর্থাৎ মেদনিপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দিকে। এই ধরনের অনেক নদী সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে, কালের করালগ্রাসে মৃত্যুর কাছে হার মেনেছে। সভ্যতার বিকাশে নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য, তা সত্ত্বেও সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে মানুষের অনন্ত চাহিদাকে সামাল দিতে গিয়ে প্রকৃতির অনেক সম্পদ বিনষ্ট করেছে, তার মধ্যে এই নদীর বিনাশ অন্যতম। আমরা দেখেছি আদিগঙ্গার বুক চিরে কিভাবে মানবসভ্যতার উন্নয়নের জীবনরেখা মেট্রোরেলের সম্প্রসারণ হয়েছে। কিন্তু না, কংসাবতীর ক্ষেত্রে তা হয় নি। সমাজের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে বেশ কয়েকটি জেলার চাষাবাদে জলের সরবরাহ বজায় রাখতে একার কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়েছে। চিরযৌবনা কল্লোলিনী কুমারী কংসাবতী তাঁর মহিমায় সকলকেই করে চলেছে মাধুর্য মণ্ডিত।
যাইহোক, আমরা লকগেট পেরিয়ে চলে গেলাম কংসাবতীর পাড়ে, যেখানে আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত বিভিন্ন নামের নৌকা সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষমাণ। পকেট থেকে ১০০ টাকা জনপ্রতি খরচা করলেই সুযোগ মিলবে কংসাবতীর কোলে চড়ে বনপুকুরিয়াতে মৃগয়াক্ষেত্র ও সুপ্রাচীনকালের পরেশনাথ মন্দিরে। আমরা সবাই বোটে করে এগোতে থাকলাম নদীবক্ষে ভাসতে ভাসতে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, যে নদী বা ড্যামে জোয়ার ভাটা নেই সেখানে জলরাশি সমুদ্রের ন্যায় উছল প্রাণচঞ্চল কেন? তার কারন, নদী বা ড্যামের জলরাশির উপর যখন বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ফাঁকা জায়গা বাতাস প্রবাহের সুযোগ পায়, তখন সেইজলরাশিতে ঢেউ সৃষ্টি হয়। ভূগোলের ভাষায় জলরাশির উপর এই উন্মুক্ততাকে ফেচ বলা হয়। এই সুযোগে আমরা স্থানীয় নদী বা এই এলাকার প্রাচীনত্ব নিয়ে জানবো।
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান ডিভিশনের ৭টি জেলার একটি বাঁকুড়া। সমতল বাংলা ও ছোটোনাগপুর মালভূমির মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করেছে পশ্চিমবঙ্গের এই জেলাটি। একসময়ে মল্ল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল বাঁকুড়া জেলার স্থান ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই জেলা তার মন্দির নগরী ও টেরাকোটার কাজে সুনাম অর্জন করেছে ঐতিহাসিক কাল থেকে। সেই মধ্যযুগ থেকে বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী হয়ে ইতিহাসের পাতায় বারেবারে উঠে এসেছ এই অঞ্চলের নাম। সেই ১০০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর অঞ্চলের তৎকালীন দিহার এলাকায় গড়ে উঠে ছিল মানব সভ্যতা। সেই সময় দ্বারকেশ্বরের উত্তর তীরে বসবাস শুরু করেন দ্রাবিড় গোষ্ঠার লোকজন। প্রাচীন কালে রাঢ় বাংলার অংশ বাঁকুড়ায় ইন্দো-ইউরোপীয়দের প্রভাব ভালই ছিল। ভৌগোলিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে বাঁকুড়া খুঁজলে দেখা যাবে অনেকটা ত্রিভুজের আকারে রয়েছে এই জেলা। পূর্বে রয়েছে দুই মেদিনীপুর ও হুগলী জেলা। পশ্চিমে প্রতিবেশী পুরুলিয়া ও দক্ষিণে পশ্চিম মেদিনীপুর। জেলার উত্তর প্রান্তে বয়ে চলা দামোদরের হাত ধরে বর্ধমানের সঙ্গে বাঁকুড়ার ছাড়াছাড়ি। খাতড়ার বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলাদ্বয়ের সীমান্তবর্তী এলাকায় কংসাবতী ও কুমারী নদীর সংগমস্থলের উপর কংসাবতী বাঁধ ও নির্মিত জলাধার।
১৯৫৬ সালে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কালে সেচের সুবিধার জন্য এই বাঁধ ও জলাধার নির্মিত হয়। বাঁধটির দৈর্ঘ্য ১০,০৯৮ মিটার ও উচ্চতা ৩৮ মিটার। জলাধারের আয়তন ৮৬ বর্গ কিলোমিটার। আগেই বলেছি, এই জলাধারকে ঘিরে মুকুটমণিপুরে একটি মনোরম পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। কংসাবতী ও কুমারী নদীর সঙ্গমস্থল, মুকুটমণিপুর। বর্তমানে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাটির বাঁধ রয়েছে এখানে। প্রকৃতির ক্যানভাসে, বনজঙ্গলের সবুজ ও নদীর নীল জল মিলে এঁকে দিয়েছে এক স্বপনের দেশ । আবেশটাকে ধরে রেখেছে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টিলা গুলি। এই মুকুটমনিপুর জলাধারটি টুরিস্ট দের কাছে বিশেষ আকর্ষণ এর জায়গা। কংসাবতীর দিগন্তবিস্তৃত জল এবং পাহাড় জঙ্গল এ ঘেরা সৌন্দর্য মনকে ছুঁয়ে যায়। বাঁধ ছেড়ে বেরিয়ে রায়পুরের পাশ দিয়ে দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত হয়ে মেদিনীপুর জেলার বিনপুর অঞ্চলে প্রবেশ করেছে কংসাবতী। ভৈরববাঁকী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে এরপর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় প্রবেশ করেছে এই নদী। কংসাবতী সেচ প্রকল্প এই জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষ আবাদ এর উন্নতি সূচিত করে। কেশপুরের কাছে নদী দুটি শাখায় ভাগ হয়ে গেছে। একটি শাখা দাশপুর অঞ্চলের উপর দিয়ে পালারপাই নামে প্রবাহিত হয়ে রূপনারায়ণ নদের দিকে এগিয়ে গেছে ও অপর শাখাটি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে কালিয়াঘাই বা কেলেঘাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। কংসাবতী নদী পুরুলিয়া খাতড়া, মুকুটমনিপুর, মেদিনীপুর,খড়গপুর ও হিজলী শহরকে জল সরবরাহ করে । এই নদীর বালি ও নুড়ি বাড়ি নিমার্ণ ও স্থানীয় গ্লাস শিল্পে ব্যবহৃত হয় । শুধু তাই নয়, এই ড্যামের জলকে পরিশুদ্ধ করে পানীয় জলের সংস্থান করা হয়েছে।
জানা যায়, ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি সময়ে কেন্দ্রীয় নদী কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী খাতড়া ব্লকের কাঁকড়াদাড়া- কেল্যাতি-পরকুল -ঘাগড়া এলাকায় এই জলাধার নির্মাণ করা হবে বলে ঠিক হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে এই প্রকল্পের বাস্তুকার জহরলাল দাসের নেতৃত্বতে মুকুটমনিপুর সংলগ্ন চিটগিরি-অম্বিকানগরের মাঝে কাঁসাই ও কুমারী নদীর সঙ্গমস্থলে এই প্রকল্পের স্থান নির্বাচন হয়। ১৯৫৯ সালের ২৪ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের তত্কাললীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় কংসাবতী পরিকল্পনার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এই প্রকল্পে ১৭৩টি মৌজার মধ্যে বাঁকুড়ার খাতড়ার ৩০টি, রাণীবাঁধের ৩৩টি ও পুরুলিয়ার মানবাজার ব্লকের ১১০টি মৌজা অন্তর্ভুক্ত হয়। কুমারী অববাহিকায় থাকা সারেঙ্গগড়, চিয়াদা, কাটাকুমারী, ঘোলকুড়ি, পুড্ডি গ্রামের সঙ্গে বড্ডি গ্রামটিও জলের তলায় নিমজ্জিত হয়।
কংসাবতী বা কাঁসাই দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান নদী। এইনদীর গতিপথ প্রায় ৪৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। পুরুলিয়া,বাঁকুড়া,ও মেদিনীপুর জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত এই নদীটি একটি বর্ষার জলে পুষ্ট নদী। কালিদাসের মেঘদূত ও অন্যান্য সংস্কৃত সাহিত্যগ্রন্থে এই নদী কপিশা নামে উল্লিখিত। পুরুলিয়া জেলার ঝালদার মুরুগুমা অঞ্চলে প্রায় ৬০০ মিটার উঁচু পাহাড় ঝাবরবন কাঁসাই নালার আকারে কংসাবতী নদীর উৎপত্তি। নিকটবর্তী অযোধ্যা পাহাড় থেকে সাহারঝোরা নামে একটি ছোট নালা এরপর সাম্প্রতিক অতীতে সংবাদের শিরোনামে আসা সেই ভুতুড়ে স্টেশন বেগুনকুদারের কাছে কংসাবতীতে মিশেছে। তেলদিহি গ্রামের কাছে বান্দু বা বন্ধু নদী কংসাবতীতে পড়েছে। এরপর কংসাবতী পুরুলিয়া-চান্ডিল রেললাইন পেরিয়ে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে কিছুদূরে কারমারা নামার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ভেদুয়া গ্রাম পার হয়ে এই নদী বাঁকুড়া জেলায় প্রবেশ করেছে। বাঁকুড়াতেই কংসাবতীর প্রধান উপনদী কুমারী নদীর সঙ্গে এর মিলন। বাঁধ ছেড়ে বেরিয়ে রায়পুরের পাশ দিয়ে দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত হয়ে মেদিনীপুর জেলার বিনপুর অঞ্চলে প্রবেশ করেছে কংসাবতী। ভৈরববাঁকী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে এরপর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় প্রবেশ করেছে এই নদী। কেশপুরের কাছে নদী দুটি শাখায় ভাগ হয়ে গেছে। একটি শাখা দাশপুর অঞ্চলের উপর দিয়ে পালারপাই নামে প্রবাহিত হয়ে রূপনারায়ণ নদের দিকে এগিয়ে গেছে ও অপর শাখাটি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে কালিয়াঘাই বা কেলেঘাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। জেলার প্রধান দুটি নদী দ্বারকেশ্বর ও কংসাবতী । এছাড়া বাঁকুড়ার বিভিন্ন প্রান্ত দিয়ে বয়ে চলেছে অন্যান্য নদী যেমন শিলাবতী, গন্ধেশ্বরী, শালি, জয়পণ্ডা, বিরাই ও আমোদা।
অপরদিকে কুমারী কংসাবতীর প্রধান উপনদী। এটির উৎপত্তিস্থলও অযোধ্যা পাহাড়। পাহাড়ের পূর্ব ঢাল বেয়ে নেমে আসার সময় কয়েকটি ছোটখাট নালার সঙ্গে মিলিত হয়েছে কুমারী। তারপর দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত হয়ে পুরুলিয়া-চান্ডিল রেললাইন পেরিয়ে বরাভূম ও মানবাজার ছুঁয়ে এটি বাঁকুড়ায় প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে যে চারটি উপনদী কুমারী নদীতে মিশেছে, তারা হল – হনুমাতা ও নাঙ্গাসাই (ডানদিকের উপনদী) এবং ঝোর ও চাকা (বাঁদিকের উপনদী)। অন্যদিকে ঝাড়খণ্ডের টোটকা নদী বান্দোয়ান পেরিয়ে মাঝিডিহির কাছে কুমারী নদীতে মিলিত হয়েছে। মুকুটমণিপুরে ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ কুমারী নদী কংসাবতীতে পতিত হয়েছে।
এই কংসাবতী প্রকল্পের টানে আপনি বছরের যে কোন সময় ঘুরতে আসতে পারেন। কারন শীতের সময় তো অসাধারন এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে হাল্কা মিঠে রোদে স্নান করতে করতে এগিয়ে যাবেন বনপুকুরিয়ার দিকে। যাত্রাপথে কিশোর যুবতী তন্বীরা তাঁদের নিজস্বী তুলতে ভোলে না। পরিযায়ী পাখির দল মনের আনন্দে কেউ বা ভাসে জলের পরে, কেউবা উড়ছে আকাশপানে। এখানে কংসাবতির জলে না আছে কুমীরের ভয়, না আছে বনপুকুরিয়াতে বাঘের ভয়। আপনি স্বচ্ছন্দে বিরাজ করতে পারেন এই প্রকৃতির নির্জন প্রান্তরে।
আবার গ্রীষ্মকালে এই মুকুট মণিপুরে আসতে পারেন অন্য একটি আকর্ষণে। ড্যামের জল টা অনেকটা কমে যায় বটে। এই জল কমে গেলে জলে নিমজ্জিত শতাব্দী প্রাচীন লক্ষ্মী জনার্দনের মন্দিরের আত্মপ্রকাশ ঘটে থাকে। আর এই মন্দিরের কারনে প্রচুর সমাগম ঘটে রাজ্য ও রাজ্যের বাইরের পর্যটকদের। মার্চ মাসের শেষদিকে জলাধারের জল কমে গেলেই এই মন্দির ধীরে ধীরে প্রতীয়মান হয়। স্থানীয় সুবুদ্ধি পরিবারের অন্যতম সদস্য সুবুদ্ধি পতি বলেন যে তাঁদের পূর্বপুরুষ কৃষ্ণচন্দ্র পতি ছিলেন অম্বিকানগরের রাজার সভাপণ্ডিত, যার বুদ্ধিমত্তার স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে সুবুদ্ধি উপাধি প্রদান করেন অম্বিকারাজন এবং সেই সঙ্গে তাঁকে ঝরিয়া, পরেশনাথ ও পুরনাপানি মৌজা তিনটি দান করেন। তাঁরাই এই লক্ষ্মী জনার্দনকে প্রতিষ্ঠা করে পূজা করতে থাকেন ও ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে এই আলোচ্য মন্দিরটি নির্মাণ করালেও বাঁধ নির্মাণকালে তা ছাড়তে হয়। কিন্তু শ্রমিকদের আন্তরিকতার কারনে মন্দিরটি অক্ষত রয়ে যায়। এইরকম মন্দির দেখতে আপনি আসতে পারেন গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ মাথায় করে।
বর্ষাকালে মুকুটমণিপুরে পর্যটক আসে এই শান্ত কোমলমতি কংসাবতীর চপল রূপ দেখতে। প্লাবিত হয়ে যায় যায় অবস্থায় পৌঁছে ড্যাম। তখন লকগেট খুলে দেওয়া হয়। প্লাবিত হয় সারাবছরের শুষ্ক নদীখাত। কংসাবতী সবাইকে আনন্দ প্রদান করে মিলিত হয় তাঁর পরম প্রেমিক সাগরের সাথে। বছরের অন্য সময়ে ত্যাগ স্বীকার আর অধ্যাবসায়ে তাঁকে করে তোলে ভয়ঙ্কর। তীব্র গতিতে ছুটতে থাকে তাঁর যৌবনের ডালি নিয়ে। সাগর তাঁকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নেয়। এইরূপ মাতাল কংসাবতীকে দেখতে বর্ষাকে উপেক্ষা করে চলে আসে বহু পর্যটক। যারা যেতে পারেন নি তাঁদের জন্য এই প্রতিবেদন মুকুটমনিপুরের প্রতি এক অজানা আকর্ষণ তৈরি করবে আশা করি।
বসন্তের ডালি নিয়ে অপেক্ষা করে মুকুটমণিপুর। মহুয়া আর পলাশের রঙে রাঙিয়ে পর্যটকদের কাছে লালমাটির দেশ বাঁকুড়া সর্বত্র তাঁর অতিথি আপ্যায়নের পশরা সাজিয়ে অপেক্ষা করে নিজের সবটুকু উজাড় করে দেওয়ার জন্য। চারপাশে ঘন সবুজ, দূরে পাহাড়ের আলতো আন্দোলন, মাঝে টলটলে নীল জল— মুকুটমণিপুরের বর্ণনা এভাবে কি ভাষাই বর্ণনা করা যায়! তা দেখে নয়ন যুগল শান্ত করতে হয়, মনকে দিতে পরম প্রেমের প্রশান্তি মাখানো মুহূর্ত। তাই সারাবছর জুড়ে মুকুটমনিপুরের মাথায় বাংলার পর্যটনের মুকুট লাগানো থাকে।
আমাদের নৌকা এগিয়ে চলেছে। ঘণ্টা খানেক নৌকাবিহারের পর আমরা নামলাম গিয়ে এক জঙ্গলে ঘেরা প্রাচীন গ্রাম বনপুকুরিয়া যেখানে গড়ে উঠেছে সোনার বাংলা ‘ডিয়ার পার্ক’। মিনিট দশেকের পথ, তার পরে সাইকেল ভ্যানই সহায়। তারপরেই দেখা যাবে ‘সোনার হরিণ’। সোনার হরিণ বটে। তাহা হরিণ হরিণ শুনে যাওয়া হল বটে, তবে তন্ন তন্ন করে খুঁজে তার কি ধরা মেলে গো। কোথায় তারা! মায়াবী হরিণের পাল্লায় আমরাও পড়লাম। দেখা নেই যথারীতি। শীতের এই সময়টা ওরা সবুজ কচি তৃণ গুল্মের খোঁজে গভীর জঙ্গল কিংবা কংসাবতীর উপকুলের দিকে চলে যায়। বন দফতরের বিশাল এলাকা। খাঁচার বাইরে গ্রামের বাচ্চারা কচি ডালপালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বিক্রির আশায়। পর্যটকদের হাত থেকে সেই সবুজ পাতা খেয়ে যায় হরিণের দল।
যাঁরা ইতিহাস ভালবাসেন, তাঁদের জন্য রইল একটি ছোট্ট তথ্য। মুকুটমণিপুর জলাধার থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে প্রাচীন শহর, অম্বিকানগর। এক সময়ে এই স্থান ছিল জৈন ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান। আমরা আর অম্বিকানগরে না গেলেও ফেরার পথে গেলাম ১৫০০ বছরের প্রাচীন মূর্তি বিশিষ্ট পরেশনাথ মন্দিরে যেখান থেকে কুমারী নদী ও কংসাবতী নদীকে পৃথকভাবে চেনা যায়। যাওয়ার আগে একটা কথা বারেবারে মনে পড়ে যাচ্ছিল। দুই বাংলার কবি কাজী নজরুল ইসলামের গানে ‘খেলিছ এ বিশ্বলয়ে বিরাট শিশু আনমনে......’। এই সুন্দর ভুবনে যেভাবে প্রকৃতির অপ্রাকৃত লীলাভুমি তা সত্যি সত্যি সর্বশক্তিমান তৃতীয় পুরুষের অস্তিত্বকে স্মরণ করায়।
আমরা মুকুটমণিপুরে ফিরে এলাম। ঘরে ফেরার পালা। এই বাঁধের নিকটে বাঁকুড়ার বিশেষ বিশেষ ক্ষুদ্র ও কুটীর শিল্পের সম্ভার নিয়ে অপেক্ষা করে স্থানীয় লোকজন। বর্তমানে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে এই স্থানে অনেকগুলি বিশ্ববাংলার ব্র্যান্ড লাগানো দোকান তৈরি করে দিয়েছে। সেখান থেকে কিছু পশরা কিনে প্রত্যাবর্তনের পথে। পরিশেষে বলি, এই ভ্রমণ কাহিনী লিখতে গিয়ে যাঁদের রচনা, প্রতিবেদন বা সহযোগিতা নিয়েছি তাঁদের সবাইকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ রেখে ধন্যবাদ জানাই আমাদের বি. এড. কলেজের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মী বৃন্দকে। তাঁদের সহযোগিতা না থাকলে আমার এই মুকুটমণিপুর ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
---------------
রচনাকাল : ১৭/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।