ভারতবর্ষের নদীবাঁধ পরিকল্পনায় বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহার অবদান
আনুমানিক পঠন সময় : ২১ মিনিট

লেখক : সনৎকুমার পুরকাইত
দেশ : India , শহর : ডায়মন্ডহারবার

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ৯৭ টি লেখনী ৪১ টি দেশ ব্যাপী ৩৮৪২৪ জন পড়েছেন।
        ‘বাংলা নদীবহুল দেশ, তার উন্নতি ও স্বাস্থ্য বড় নদী ও তাদের শাখা নদীর উপর নির্ভর করে। অতীতের নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ভয়াবহ পরিণতি আমাদের অজানা নয়। পণের শতকে বাংলার একদা রাজধানী গৌড় গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তনে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সম্মুখীন হওয়ায় পরিত্যক্ত নগরী হয়ে যায়। ……….দামোদর অববাহিকাকে প্রচুর খরচ না করেও পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। একটি ধ্বংসাত্বক নদীব্যবস্থা হয়ে উঠবে উপযোগী সম্পদ। এর দ্বারা বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদন, সারা বছর সেচের জলে অববাহিকাকে ধুইয়ে দেওয়া, রেল সড়ক যোগাযোগের চিরন্তন বিপত্তিগুলি দূর করা ও জনস্বাস্থ্য সংরক্ষন সম্ভবপর। প্রকৃতি, কায়েমী স্বার্থ ও অবিবেচক ব্যবস্থাপনার ত্র্যহস্পর্শে একদা সমৃদ্ধ যে উপত্যকা পতিত হয়ে পড়েছিল, তাই আবার প্রকৃতি, মানুষ ও বিজ্ঞানের কল্যাণস্পর্শে প্রস্ফুটিত উদ্যানের চেহারা নিতে পারে।.............. সমাজের হিতার্থে এখন বিজ্ঞানের প্রয়োগ সব দেশেই সম্ভব হচ্ছে, কিন্তু এদেশে নদী নিয়ন্ত্রণের এই সমস্যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে আলোচনা হচ্ছে না’।     - ড. মেঘনাদ সাহা

ভূমিকাঃ 
“কেন মরে গেল নদী।
আমি  বাঁধ বাঁধি তারে চাহি ধরিবারে
পাইবারে নিরবধি,
তাই মরে গেল নদী”।
                    - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

             ১৮৯৬ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর চিত্রা কাব্যগ্রন্থের দুরাকাঙ্ক্ষা কবিতায় তৃতীয় পরিচ্ছেদে উপরের কথাগুলো লিখেছেন। আবার তিনি অন্যত্র বলছেন ‘... ওগো নদী আপন বেগে পাগল পারা’। অর্থাৎ, তাঁর কথায় নদী তার উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত চলার পথে সে তার নিজের খেয়ালে চলে। তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় খেলা করে চলে। তাই নদী তার গতিপথের দুদিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে তার চলার পথে খেলা করার জায়গা খুঁজে নেয়। মানচিত্রের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় নদী তার হাজার হাজার বছর প্রবাহের ইতিহাসে বারবার প্রবাহখাত পরিবর্তন করলেও তা কিন্তু একটা নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। নদীবিজ্ঞানের ভাষায় একে নদীর এরেনা (Arena) বলা হয়।

            মানব সভ্যতার বিকাশে নদীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করে নদীকে উন্নয়নের জীবনরেখা বলে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে প্রবহমান জলধারা মানুষের জীবন জীবিকার একমাত্র সঞ্জীবনী শক্তিসম। কখনো কূল ছাপিয়ে একের পর এক জনপদ ভাসিয়েছে, আবার কখনো ঘর ভেঙেছে, নষ্ট করেছে ফসল। কিন্তু, মানুষ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় নি। তার শীতল জলধারায় মানুষ পেয়েছে অমৃতের স্বাদ, কারণ নদীই জীবনের প্রকৃত অর্থ তুলে ধরেছে আমাদের সামনে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য প্রকৃতির উপর বসিয়েছি আমাদের লোভের করাল থাবা। বিজ্ঞানের সাহায্যে নদীর বুকে বসিয়েছি দীর্ঘকায় বাঁধ, নদীকে করতে চেয়েছি নিয়ন্ত্রণ। আন্তঃরাজ্য বা আন্তঃরাষ্ট্র জলবণ্টন বিতর্ক কাটাতে নদীতে অনেক সময় বাঁধ দেওয়া জরুরী হয়ে পড়েছিল। এই সমস্যা দীর্ঘ কয়েক দশকের। তবে নদীতে বাঁধ দেওয়ার কারণ বহুমুখী। ছোটবেলা থেকে ভূগোলের পাতায় বহুমুখী নদী পরিকল্পনার কথা শুনে আসছি আর তার সাথে নদীবক্ষে বাঁধ নির্মাণের কথা জড়িয়ে থাকে। সাধারণত, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, বন্যা প্রতিরোধ এবং জলসেচের মতো মহতী উদ্দেশ্য নিয়ে কোন রাষ্ট্র তার নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকে।

            কিন্তু, সমস্যা হল এই বাঁধ নির্মাণের মধ্যে দিয়ে উদ্ভূত সমস্যার কতটা সমাধান পাওয়া যায় তা বিচারের পাশাপাশি এর ফলে একটা নদী বা তার অববাহিকা জুড়ে কি ধরনের প্রাকৃতিক বা আর্থ-সামাজিক সমস্যা নতুন করে তৈরি হয় সেটা মাথায় রাখা জরুরী। পূর্বেই বলেছি নদী তার চলার পথে উপত্যকার দুই পাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে দীর্ঘসময়ের অবকাশে খেলা করে। সেই সুযোগ না রাখলে নদী সভ্যতার উন্নয়নের চাবিকাঠি না হয়ে ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে আর তা আমাদের নিজেদের কারণে। মহাত্মা গান্ধীর কথায়, ‘The World has enough for everyone’s need, but not enough for everyone’s greed.’। তাই আমাদের লালসা পূরণে প্রকৃতির উপর অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ আনতে চাইলে তা ক্ষতিই ডেকে আনবে।

            ভারতবর্ষের নদীবাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত আলোচনা অনেকদিন আগে থেকে হয়ে এলেও বেশীরভাগ প্রকল্প স্বাধীনতা বা তার পরবর্তীকালে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। দীর্ঘদিনের পরাধীনতার গ্লানি, দীর্ঘ বঞ্চনার পরে ক্ষমতার স্বাদ, উন্নয়নে অতিরিক্ত তৎপরতা এবং অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিভাজনে নদীর প্রাকৃতিক অবস্থানে নদীর জলবণ্টনে নিয়ন্ত্রণ আনা- নানা কারণে নদীবাঁধ নির্মাণে নানান জটিলতা তৈরি হয়। সেই নদীবাঁধ নির্মাণে যেমন সেচবাস্তুকার ছিলেন, তেমন পরিবেশবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি বিজ্ঞানীদের মতামত গুরুত্ব দেওয়ার কথা হয়েছিল। এমনই একজন আন্তর্জাতিকখ্যাতি সম্পন্ন ভারতীয় বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহা, যিনি পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের গবেষণার পাশাপাশি ভারতের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

ড. মেঘনাদ সাহার সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ
           ড. মেঘনাদ সাহা সম্পর্কে এখানে আলোচনা করার সুযোগ বেশী নেই, তবে একটি কথা বললে তাঁর মেধা সম্পর্কে অনেকটাই বোঝা যাবে। ১৯১৬ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, তখন তিনি শিক্ষক নিয়োগের জন্য ভালো প্রতিভার অন্বেষণ করতে গিয়ে খুঁজে বের করেন এই ড. মেঘনাদ সাহা ও ড. সত্যেন্দ্রনাথ বোসকে যারা পদার্থবিজ্ঞানের স্কলার হয়েও গণিত বিভাগের প্রভাষকের পদে যোগ দেন। তারপর বাকিটা ইতিহাসের পাতায়। অন্য অনেক বিদুষকের বিপরীতে মেঘনাদ সাহা ভারতবর্ষের নানাবিধ সমস্যা যেমন: নদী ব্যবস্থাপনা, রেলওয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ভারতের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এসব নিয়ে লেখালেখি করেন এবং ভারত জুড়ে এসব বিষয়ে সাংস্কৃতিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। তাঁর সারাজীবনের অন্যতম প্রেরণা ছিল জাতির জন্য বিজ্ঞান সচেতনতা এবং বিজ্ঞানের মাধ্যমেই জাতির স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা। তাই ১৯৩১ সালে তিনি Academy of Sciences of the United Provinces of Agra and Oudh প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩২ সালে তিনি এর প্রেসিডেন্ট নিয়োজিত হন। ড. সাহার বাল্যকাল থেকে নদী ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আগ্রহ গড়ে ওঠে কারণ তাঁর গ্রাম বছরে প্রায় চার মাস জলে ডুবে থাকত। তাঁর মতে, ঐ অঞ্চলের মানুষের হাঁটতে শেখার আগে সাঁতার শিখতে হত বাঁচার তাগিদে। পরবর্তীকালে নদীবিজ্ঞানে নদী ও বন্যা নিয়ন্ত্রনে তিনি যে অবদান রাখেন তা এই প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়।

ড. মেঘনাদ সাহার নদী পরিচয়ঃ
           বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহা সায়েন্স কংগ্রেসের বোম্বে অধিবেশনের মূল সভাপতির ভাষণের এক অংশে নদী বিজ্ঞান গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার দাবী জানিয়ে তার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেছিলেন। ১৯১৩ সালে যখন তিনি মাষ্টার ডিগ্রীর ছাত্র ছিলেন সেইসময়ের প্রবল বন্যায় বর্ধমান বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, শস্যহানি হয় এমনকি বহু জনবসতি জলের তলায় চলে যায়। সেই থেকে নদী ও বন্যা সম্পর্কে তাঁর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা দেখা যায়। বন্যাত্রাণে যেহেতু তিনি তারকেশ্বর ও উলুবেড়িয়া অঞ্চলে দীর্ঘদিন স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেন তাই বন্যা নিয়ে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল। শুধু তাই নয় এর ঠিক দশ বছর পরে অর্থাৎ ১৯২৩ সালের উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ বন্যায় যখন কলকাতার সাথে দার্জিলিং এর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত বা নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে বন্যাত্রাণের কাজের অভিজ্ঞতা তাঁকে এর সমাধানের রাস্তা খুঁজতে প্রেরণা যোগায়।

          উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরেই মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় উত্তরবঙ্গের বন্যা ও তার প্রতিকার নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ঐ বছরেই আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সত্তরতম জন্মবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থে বন্যা নিয়ে অপর একটি প্রবন্ধে তথ্যপূর্ণ ব্যাখ্যার মাধ্যমে হাইড্রোলিক গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার আবশ্যকতা তুলে ধরেন। এই প্রবন্ধে তিনি আরও বলেন যে, বাংলার বন্যা সমস্যা নিরাকরণে নদী সম্পর্কীয় গবেষণা ও গবেষণাগার স্থাপনের কথা ইতোপূর্বে অনেকেই বলেছেন যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন গঙ্গার উপর একাধিক সেতুর নির্মাতা ভারত সরকারের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার এফ. স্প্রিং(১৯০৩)। কারণ এই ধরনের গবেষণাগারের সাহায্যে নদীর বন্যা, সেচ ও নাব্যতাসহ জলশক্তি সম্পর্কে সব ধরনের সমস্যার সমাধান করা যাবে বলে মনে করতেন। তিনি এই নদীগবেষণাকে নিবিড়তা প্রদান করতে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠক্রমে ঢোকাতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে আমেরিকা, বার্লিন বা ভিয়েনার মত দেশগুলির নদীগবেষণাগারকে মডেল ধরে আমাদের এখানেও গড়ে তুলতে হবে সেইরূপ সংস্থা। কেউ তাঁর কথায় কর্ণপাত করেন নি তখন। যদিও পরবর্তীকালে তাঁর ধারনা ও প্রস্তাবের আংশিক রূপায়ন হয় প্রায় এক দশক পর হরিণঘাটার বেঙ্গল রিভার রিসার্চ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। 

নদীপরিকল্পনা গ্রহণের কারণঃ 
          বাংলা নদীমাতৃক দেশ, তার উপনদী, শাখানদী বা নদী অববাহিকার আয়তন কিংবা নদীর উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলশ্রুতি হিসাবে নদী তীরবর্তী অনেক শহর নগর পরিত্যক্ত হয়েছে, অপ্রত্যাশিত বন্যার প্রকোপে পড়েছে, বিচ্ছিন্ন হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, মানুষ দুরারোগ্য ম্যালেরিয়া-কালাজ্বরের সম্মুখীন হয়েছে (১৮৫০)। যে রাঢ় বাংলা মুঘল ও ব্রিটিশ সময়কালে স্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য সুখ্যাত ছিল সেই স্থান আজ ধীরে ধীরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের স্বীকার হয়ে গেল শুধুমাত্র যত্রতত্র অবৈজ্ঞানিকভাবে রেললাইন সম্প্রসারণ, সেতু নির্মাণ আর বালি জমে ভাগীরথী জলঙ্গির মতো নদীগুলির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায়। এই রেলস্থাপনে অনিয়ম নিয়ে ড. সাহা তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। ড. সাহা একটা সুন্দর কথা বলতেন যে, ‘সমাজের হিতার্থে এখন বিজ্ঞানের প্রয়োগ সবদেশেই সম্ভব হচ্ছে, কিন্তু এদেশে নদীনিয়ন্ত্রণের এই সমস্যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে আলোচনা হচ্ছে না’।

         স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী সময়ে দেশের সম্পদের যথোপযুক্ত ব্যবহারের জন্য প্রথমেই বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে নদী পরিকল্পনার কথা ভাবা হয়। এই বহুমুখী নদী পরিকল্পনাগুলির সুফল হল বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্পে জলসরবরাহ, জলপথে পরিবহণ ও মৎস্য চাষ প্রভৃতি। পরিকল্পনার বর্তমান ইতিহাস পর্যালোচনাকালে দুটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য- প্রথমত, ১৯৩৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি ভ্যালি অথোরিটি গঠিত হয় এবং স্বাধীনতার অনেক পূর্বেই অর্থাৎ ১৯৩৮ সালে প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক ড. মেঘনাদ সাহা ভারতের National Institute of Science এ বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে নদী পরিকল্পনার বিষয়ে তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে জোরালো সওয়াল করেন। সেখানে তিনি দেখান যে অতীতে বন্যার ফলে কিভাবে পাটলিপুত্র আজ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে বা বদ্বীপ অঞ্চলের শহর ক্রমশ মাটির নিচে বসে যায় সময়ের সাথে সাথে। এসকল তথ্য বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি আলোচনা করেন।

ড. সাহার সাথে দামোদর নদী পরিকল্পনার যোগসূত্রের কারণঃ 
        ড. সাহা বাংলাদেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠা এবং কলকাতা শহরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করলেও তারকেশ্বর ও উলুবেড়িয়াতে বন্যার সময় স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করতে গিয়ে এই দামোদরের বন্যার কারণে চোখের সামনে ক্ষয়ক্ষতি বা ভয়াবহতা লক্ষ্য করেছিলেন। দামোদর নদী উপত্যকা পরিকল্পনার পিছনে যে করুণ ইতিহাস বর্তমান ছিল তা হল এই উপত্যকা প্রায় দুই শতকের বেশী সময় ধরে ভয়াবহ বন্যায় বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া। বহু বন্যার মধ্যে উল্লেখের দাবী রাখে ১৭৩০, ১৮২৩, ১৮৪৮, ১৮৫৬, ১৮৮২, ১৮৯৮, ১৯০১, ১৯১৩, ১৯১৬, ১৯২৩, ১৯৩৫ ও ১৯৪৩ এর বন্যা। দামোদর নদ প্রায় ২৫,২৩৫ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার (অধুনা ঝাড়খণ্ডে) তার অববাহিকা বিস্তৃত। ১৯৪৩ সালের বন্যায় সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের রোষ যখন গণআন্দোলনের রূপ নিল তখন প্রথম বাংলার সরকার বর্ধমানের মহারাজার সভাপতিত্বে একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ কমিটি গড়ে দেন। যদিও ঐ বন্যা ১৯১৩ সালেও বন্যার মতো প্রবল না হলেও রেললাইন বিচ্ছিন্ন, বহু গ্রাম জলের তলায় চলে যায়। তাছাড়া একদিকে বিশ্বযুদ্ধের আবহ আর তার সাথে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ব্রিটিশ নাস্তানাবুদ। সেইসময় কলকাতার সাথে যোগাযোগ রাখা বা অস্ত্রসরবরাহ, খাদ্যের সংস্থান এই বন্যার কারণে ভীষণ সংকট তৈরি করে।  

দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন গঠনে ড. সাহার ভূমিকাঃ  
          তাই মাঝের অনেকটা সময় নদী, বন্যা বা বাঁধ নিয়ে আলোচনা অনেকটাই খাতাকলমে থেকে গেলেও ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসের ঐ বন্যায় তা আবার নবীকরণ হয়ে যায়। তার সবথেকে বড় কারণ, কলকাতার সাথে সারা ভারতের সাময়িক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। ড. সাহা এবার তাঁর চিন্তাভাবনা জনমানসে প্রসার করে জনমত গড়ে সরকারকে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। বাংলার সরকার বাধ্য হয়ে বর্ধমানের মহারাজার সভাপতিত্বে দামোদরের বন্যা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেন যার অন্যতম সদস্য ছিলেন ড. মেঘনাদ সাহা। মজার বিষয় হল, ১৯২৩ সালে গ্লেন ও সবেরয়ালের দামোদরের বন্যা সংক্রান্ত চার খণ্ডের সরকারী রিপোর্টের কোন হদিশ পাওয়া গেল না। ড. সাহার উদ্যোগে একজন অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে তাঁর ব্যক্তিগত কপিটি সংগ্রহ করে কমিটি কাজ শুরু করে উপকূলভাগে কংক্রিটের বাঁধনির্মাণ, সেচ পরিকল্পনা ও বৃক্ষরোপণের সুপারিশ করেন। প্রায় দশ কোটি টাকা ব্যয়ের সুপারিশ সরকার গ্রহণ করলেন এবং তা কার্যকর করার জন্য একজন সরকার ইঞ্জিনিয়ারকে দায়িত্ব দেন।
কিন্তু সেই রিপোর্টে ড. মেঘনাদ সাহা জোর দিয়ে একটি সুপারিশ করেন যে টেনেসি ভ্যালি অথরিটির মত একটি কর্তৃপক্ষের অধীনে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন গঠন করা জরুরী। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত তাঁর সাথে ড. কমলেশ রায়ের বিখ্যাত নিবন্ধ ‘Planning for the Damodar valley’ ভারতের নদী পরিকল্পনার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। টেনেসি ভ্যালি অথরিটি সংক্রান্ত কাজকর্ম ও তার প্রযুক্তি নিয়ে ড. সাহার প্রগাঢ় জ্ঞান ছিল। তাই, প্রতি প্রবন্ধে, বক্তৃতায় তিনি এ বিষয়ে আলোকপাত করেন। অবশেষে তিনি তৎকালীন ভাইসরয়ের ক্যাবিনেট সদস্য ড. বি. আর. আম্বেদকরের সাথে দেখা করে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ফলে আম্বেদকরের আগ্রহে ভারত সরকার দামোদর ভ্যালি গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং ডি. এল. মজুমদারকে আমেরিকায় পাঠানো হয় টেনেসি ভ্যালি অথরিটির প্রযুক্তিগত প্রণালী জেনে আসার জন্য। মজুমদারের তৈরি এই গঠনের খসড়া পাওয়ার পরে ভারত সরকার তা অনুমোদন দেন। তাঁর ধারনার সার্থক রূপ পায় স্বাধীনতার পরবর্তীকালে। টেনেসি ভ্যালি প্রকল্পের অনুসরণে ১৯৪৮ সালের ৭ ই জুলাই দামোদর উপত্যকা প্রকল্প বা ডিভিসি গঠিত হয়। কিন্তু, ড. সাহার প্রচেষ্টায় টেনেসি ভ্যালির বিশেষজ্ঞ ভুরদুইন সাহেবকে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন এর পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনার ভার দেওয়া হয়। তাঁর রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯৪৮ সালে বহুপ্রতীক্ষিত ডিভিসি’র কাজ শুরু হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, যে ড. সাহা ভুরদুইনকে আনার সুপারিশ করেন, তিনিই আবার ড. সাহার রিপোর্ট নস্যাৎ করে দিয়ে যে ‘Preliminary Memorandum on the unified Development of the Damodar River’ শীর্ষক রিপোর্ট পেশ করলেন তার সাথে বিজ্ঞানী সাহার ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত ‘Planning for the Damodar Valley’ প্রবন্ধের অনেকাংশে মিল খুঁজে পাওয়া গেল। যাইহোক, সেটাই ছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম কোন বহুমুখী নদী পরিকল্পনা। 

          ড. সাহা কোনভাবেই পিছিয়ে না গিয়ে, তিনি নদীর বহুমুখী পরিকল্পনার ভিত্তিতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন পরিকল্পনায় জলসেচ ও জলবিদ্যুৎকে অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছেন। তার পরবর্তীকালে বিশ্বের প্রায় প্রতিটা বড় নদীর ক্ষেত্রে একে একে বহুমুখী নদী পরিকল্পনার কথা ভাবা হয়। সম্প্রতি প্রশ্ন উঠেছে যে এই পরিকল্পনা কতটা সফল হয়েছে অর্থাৎ বাঁধগুলি বন্যানিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অন্যান্য সুফল কি কি দিতে পেরেছে। বরং সময়ের সময়ের সাথে সাথে আলোচনা গড়িয়েছে যে এই বাঁধগুলিই নদীর বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেচের জল অপ্রতুল, বাঁধ নির্মাণের ফলে বহু চাষের জমি জলের তলায় চলে যাচ্ছে, প্লাবিত হচ্ছে বহু গ্রাম ও নগর, জলমগ্ন হচ্ছে অরণ্য, বাস্তুহারা হয়ে পড়ছে মানুষ। এখন প্রস্তাব এসেছে বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করা হোক। বর্তমানে নদীবাঁধ ভেঙ্গে দেওয়ার ডাক দিচ্ছেন পরিবেশবিদ্‌দের একাংশ। 

         ১৯৪৮ সালে এই প্রকল্পের যাত্রা শুরু হলেও শেষ হতে অনেকটা সময় লেগেছিল। কিন্তু তার অনেক আগেই ড. সাহা আবার ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসের ‘সায়েন্স এন্ড কালচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা ও ড. কমলেশ রায়ের ‘Planning for the Damodar Valley’ শীর্ষক প্রবন্ধটি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ পরিচালিত জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকার ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় রবীন বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক ভাষান্তর বিজ্ঞানের পাতায় প্রকাশিত হয়। সেই নির্দেশিকা অনুসারে ১৯৪৮ সালে ডিভিসি গঠিত হবার পর এ সম্পর্কে অনেক কাজ হয়েছে। কিন্তু তাঁদের মূল বক্তব্যের অনেক কিছুই রূপায়িত হয় নি।

বহুমুখী নদীপরিকল্পনা ও ড. মেঘনাদ সাহার সুপারিশঃ 
        আবার ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার লগ্নে প্রকাশিত ‘সায়েন্স এন্ড কালচার’এর জুলাই সংখ্যার সম্পাদকীয় বিভাগে ‘Multipurpose Development of Indian Rivers’ প্রবন্ধে নদীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন ড. সাহা। বিশেষজ্ঞরা যদি তাঁর নির্দেশ পালন করতেন তাহলে দেশের অনেক লাভ হত। কিন্তু তা করা হয় নি। সেই প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি বলেন যে, যে কোন প্রকল্প রূপায়নে নিম্নোক্ত ধাপগুলি অনুসরণ করা প্রয়োজন যা নিম্নে হুবহু তুলে দেওয়া হল-
1. জল, খনিজ, মৃত্তিকা, উদ্ভিদ প্রভৃতি উৎসের ও ভূভাগের নিজস্ব চরিত্রের মাপজোখ প্রথমেই করা প্রয়োজন।
2. পরিকল্পনা হবে বহুমুখী যাতে শক্তি, নৌ-চলাচল, সেচ, ভূমির সদ্ব্যবহার, বন্যারোধ প্রভৃতি একসঙ্গে দক্ষতার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে হবে।
3. পরিকল্পনার পূর্ণ চিত্র অঙ্কন করে নিতে হবে।
4. নির্মাণকাজের সমান্তরালে গবেষণার সুযোগ থাকবে যাতে সর্বোত্তম নির্মাণকার্য সম্ভব হয়।
5. সমগ্র উপত্যকার বিকাশের মধ্যে দিয়ে পরিকল্পনার সর্বাধিক সুফল আশা করা যায়।
পরবর্তীকালে, ড. সাহা ভারতের পার্লামেন্টের সদস্য হয়ে নদীপরিকল্পনার ভুল ত্রুটি তুলে ধরে বক্তব্য পেশ করেছেন এবং তৎকালীন ভারত সরকারের কাছে স্মারকপত্র পেশ করে বলেন যে DVC গঠনের বিল প্রণয়নের সময় দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের সদস্য নির্বাচনে যুক্তির থেকে ভাবের আশ্রয় বেশী প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এই সদস্য নির্বাচনে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিলেও রাজনৈতিক কারণে সরকার তাঁর কথায় কর্ণপাত করেন নি।

বাঁধের আয়ুবৃদ্ধিতে ড. মেঘনাদ সাহার পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শঃ 
         ড. সাহার মতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ নির্মাণের উপযুক্ত স্থানগুলিকে তিনি মোটামুটি দুইভাগে ভাগ করেন। প্রথমভাগ বরাকরের সঙ্গমের উপরের অংশে দামোদরের ও তার উপনদীগুলির উপরের জায়গা এবং অন্যভাগে বরাকর ও তার উপনদীগুলির উপরে নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গা। তাই এই দামোদর ও বরাকর উপত্যকার বৈশিষ্ট পর্যালোচনা করে দেখেন যে দামোদর ও তার উপনদীগুলির উৎস যে ছোটনাগপুর অঞ্চলে, সেখানকার মাটির চরিত্র খুব আলগা এবং স্থানটি গাছপালার পরিমাণও কম। এই মাটি নদীর জলের টান ছাড়াও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সহজেই ধ্বসে নদীবক্ষে নেমে আসে। বিপুল পরিমাণ বালি, পলি ও কাঁকড় বহন করতে গিয়ে নদীর খাত অগভীর হয়ে যায়। ফলে বাঁধের উপর জলের বিরাট চাপ ক্রিয়া করে। বাঁধের আয়ু কমতে থাকে। তাই এই আলগা মাটির ক্ষয় রুখতে অত্যধিকহারে বৃক্ষরোপণ ও বনসংরক্ষন দরকার। তাছাড়া উদ্ভিদের আচ্ছাদন থাকলে পরে মৃত্তিকার জল শোষণের ক্ষমতা বেড়ে যায় বলে অনেক বিজ্ঞানী ধারনা পোষণ করেছেন। কিন্তু এর পক্ষে ও বিপক্ষে যা বলা যায় তা থেকে কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে-
1. বৃক্ষরোপণ ও অন্যান্য ভূমিসংরক্ষন ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে বাঁধের আয়ু বৃদ্ধি করা যাবে। স্বাভাবিক বন্যাসীমার শীর্ষ এর ফলে প্রায় ২০ শতাংশ কমে যেতে পারে।
2. বৃক্ষরোপণ ও বনসংরক্ষনের মধ্যে দিয়ে বৃষ্টিপাতের উপর নিয়ন্ত্রণের যে ধারনা তা অধ্যাপক সাহা ও রায় নস্যাৎ করে দিয়ে বলেন এর ফলে মাটির তলার জলতল উঁচুতে ওঠে বলে যে দাবী করা হয় তা নিয়ে তর্কের অবকাশ থাকতে পারে।
3. প্রলয়ের মত যে বন্যা ধেয়ে আসে তা প্রশমিত করতে শুধুমাত্র বৃক্ষরোপণের ব্যবস্থা যথাযথ নয়।
সবথেকে বড় সমস্যা হল নদীখাতে পলি জমা। নদী যত দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসে তার বুকে পলি সঞ্চয়ের সম্ভাবনা তত বেশী। দামোদরের পলিসঞ্চয়ের ক্ষেত্রে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করলেও তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে সেই সময় যে হারে পলি পড়ছে, সেই হার অপরিবর্তনীয় থাকলে প্রস্তাবিত বাঁধগুলির আয়ু কমপক্ষে ২০০ বছর হবে। তবে ড. সাহার মতে বাঁধের এর থেকে আয়ু বাড়াতে গেলে নিচের ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করা আবশ্যক-
1. নদী অববাহিকায় বেশী করে বৃক্ষরোপণ ও বনসংরক্ষন করতে হবে।
2. ধাপ তৈরি ও উঁচু করে বেড় দেওয়া।
3. উৎসমুখে ছোটখাটো জলস্রোতগুলিকে থিতানোর জন্য উপযুক্ত জলাধার তৈরি করে দেওয়া।
4. বাঁধের জলাধারের নিচের দিকের স্লুইস গেটগুলি ব্যবহার করে তলার জমে থাকা বালি ঘুলিয়ে দেওয়া, যাতে তা স্রোতের টানে বাইরে গিয়ে পড়ে। জলপ্রবাহ শক্তিচালিত তলকর্ষণ-এর এই পদ্ধতি পুরানো ও কার্যকরী।
5. যান্ত্রিক তলকর্ষণ অর্থাৎ আবর্জনা অপসারণ। কিছুটা ব্যয়সাধ্য হলেও অপসারিত বস্তু অন্য কোথাও অর্থকরীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া, দামোদর উপত্যকায় কয়লাখনিতে বালির বিরাট চাহিদা রয়েছে। অন্যদিকে বাড়ি তৈরির উপকরণ হিসাবে বালির চাহিদাও রয়েছে। একারণে দামোদর অঞ্চল থেকে কলকাতা ও তার আশেপাশের অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বালি নিয়ে আসা হয়। এই বালি আনা যদি জলপথে করা সম্ভব হয় তাহলে খরচ অনেকটাই কম হওয়ার কারণে বালির চাহিদা বাড়বে। অপ্রয়োজনীয় বালি তুলে ফেললে নির্মিত বাঁধগুলির আয়ু আরও কয়েকশ বছর বেড়ে যাবে।

অরণ্যায়ন, ভূমিক্ষয় নিবারণ প্রকল্প ও নদী নিয়ন্ত্রণে ড. মেঘনাদ সাহার অবদানঃ  
          ড. সাহার কথায়, ‘Free thinking is good, but right thinking is better’। অর্থাৎ সমাজের উন্নতিকল্পে কাজ করতে গেলে সঠিক ভাবনা করাটা ভীষণ জরুরী। দামোদর-বরাকর উচ্চ অববাহিকা অঞ্চলের ভূমিক্ষয় নিবারণের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে অরণ্যায়নের সুপারিশ করা হলেও এর মূল উদ্দেশ্য ছিল নদীখাত ও জলাধারের পলিপতন রোধ করার জন্য। অরণ্যায়নের মধ্য দিয়ে দামোদর নদীর নিয়মিত বন্যা রোধ করা সম্ভব হবে বলে অনেকেই মনে করতে শুরু করলেন এবং তার সাথে সাথে এটাও জোর দিয়ে বলা হল যে বন্যা প্রতিরোধে ড্যামের বা বাঁধের প্রয়োজন গৌণ। ড. সাহা তাঁর Collected works of Meghnad Saha গ্রন্থে বলছেন –‘….. afforestation can, under no circumstances whatsoever, prevent catastrophic floods of the type that frequently ravage the Damodar Valley.’ মেঘনাদ সাহার এই অরণ্যায়ন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের সম্পর্ক নিয়ে দারুণভাবে সমালোচিত হয়েছে। অনেকেই গভীর বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে অরণ্যায়ন, বন্যা বা বৃষ্টির পরিমাণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সেই ধারনা একেবারে বিতর্কিত। S.M. Woodward অর্থাৎ টেনেসি ভ্যালির মুখ্য পরিকল্পনাকারীর মতে, টেনেসি ভ্যালিতে অরন্যের আচ্ছাদন না থাকার কারণে বন্যার তীব্রতা হ্রাস পেয়েছে। মিঃ ই. এল. গ্লাস দামোদরের বন্যা বিশ্লেষণ করে বলেন যে, অরণ্যায়নে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার কোন অর্থ দেখছি না। কারন এখানকার বন্যার প্রধান কারণ অত্যধিক বৃষ্টিপাত অধিক সময় ধরে ঘটা। তিনি অবশ্য এটাও স্বীকার করেছেন যে, অরণ্যের আচ্ছাদন ছোট ছোট বন্যা ও মৃত্তিকার ক্ষয়রোধে ভূমিকা রাখে। কিন্তু, ড. সাহার কথায়, ‘….in the regions of ample precipitation where both soil and sub-soil are of fine sandy character and forest cover is absent.’ তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করে Professor Barrows অরণ্যায়নের সপক্ষে বলেছেন, ‘…the chief utility of afforestation and land treatment measures is in soil conservation, lengthening of the life of dams, retardation of normal flood crest to about a maximum of 20 percent.’ কখনও তাঁকে অযথা সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে, আবার কখনও তাঁকে প্রত্যাখ্যান করার কারণে প্রত্যাখ্যান করেছেন। 

          ড. সাহা বিশ্বাস করতেন, ‘Nature, vested interests and thoughtless management made a once prosperous Valley a wilderness, but Nature, Man and Science can again make it a smiling garden.’ একথা তুলে ধরতে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ‘the need for a hydraulic research laboratory’, ‘irrigation research in India’, ‘planning for the Damodar Valley’, ‘the Damodar Valley reclamation scheme’, ‘multipurpose development of Indian rivers’, ‘public supply of electricity in India’, ‘national fuel policy’, ‘oil and invisible imperialism’, ‘fuel in India’, ‘scientific research in national planning’, ‘principles of regional planning’, ‘problems of independent India’, ‘national planning commission’, ‘the five year plan’ সহ একাধিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। শুধু গাঙ্গেয় বন্যার উপরে ১১ টি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন যার ছত্রে ছত্রে তাঁর দূরদর্শিতার পরিচয় ফুটে ওঠে। এছাড়াও মেঘনাদ সাহা ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় অপ্রশস্ত কালভার্ট রেখে ব্রিটিশের এই রেলপথ সম্প্রসারণের তীব্র সমালোচনা করে বলেছিলেন,‘If there be anything like justice in the world, the people of Burdwan are entitled to compensation from parties concerned, for these terrible inflictions on them.’ উত্তরবঙ্গ সম্পর্কে তাঁর মতামত ছিল,‘The railway authorities in North Bengal build railways with insufficient waterways. These are responsible for devastating flood and outbreak of malaria in North Bengal as well as for fall in fertility of soil.’

উপসংহারঃ
 একজন প্রথিতযশা বিজ্ঞানী হয়ে ড. মেঘনাদ সাহার মূল কাজ ছিল চার দেওয়ালের ল্যাবের মধ্যে গবেষণা করা। কিন্তু, তিনি দেশের স্বার্থে, দশের স্বার্থে মাটিতে নেমে কাজ করেছিলেন। আর এটা মনে হয় সম্ভব হয়েছিল কেবল দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসেছিলেন বলে। তিনি যেমন ভালো ছাত্র ছিলেন, তেমন একজন ভালো শিক্ষক, গবেষক, বিজ্ঞানী, সমাজসচেতক, পরিকল্পনাবিদ্‌। কিন্তু যখন তিনি বারেবারে বলেও রাজনৈতিক কারণে তাঁর মতাদর্শ সঠিক হলেও উন্নয়নের রাজনীতিতে তা গ্রহণ হচ্ছে না দেখলেন। তখন তিনি অবশেষে ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং দেশের কল্যাণে বহু ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণ করেন। কিন্তু একজন পদার্থবিজ্ঞানী হয়ে গণিতের কাটাকুটি খেলার সাথে সমাজবিজ্ঞানেও পারদর্শিতার পরিচয় দেন তা তাঁর নদীবন্যা ও বাঁধ পরিকল্পনা সংক্রান্ত লড়াই প্রমান করে। এবিষয়ে ড. সাহা যা বলেছিলেন তা এককথায়, “It is possible to treat the Damodar river basin, at no great cost, to full measures of planned reclamation, and thus convert a destructive river system into a beneficial agency, producing large amount of electrical power, ensuring water for irrigation and flushing the river basins throughout the year, removing the eternal menace to rail and road communication, and guaranteeing public health. Nature, vested interests and thoughtless managements made a once prosperous valley a wilderness but Nature, Man and Science can again make it a smiling garden.” -M. N. Saha and K. S. Ray(1944)

 রাজনৈতিক তর্জা আর ক্ষমতার দম্ভ এবং একটি চিরাচরিত সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের যে স্থায়ী পরিকল্পনায় আবেগ ব্যতিরেকে বিজ্ঞানের যুক্তি বেশী দরকার ছিল, অনেক ক্ষেত্রে ভারত সরকারের তাড়াহুড়ো করে প্রকল্পের উদ্বোধন বা তার প্রয়োগ কিংবা বিজ্ঞানীর সুপারিশকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের মতো কাজ করার কারণে অনেক প্রকল্প পরবর্তীকালে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। পরিকল্পনায় যে গলদ ছিল তা বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ারদের অনেকেই স্বীকার করে নিয়েছেন। আসলে খুব তাড়াহুড়ো করে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হয়েছিল। দামোদর ভ্যালি ও হীরাকুঁদ বাঁধের ত্রুটি বা দুর্বলতা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। তার সাথে ভাকরা নাঙ্গাল প্রকল্পও ত্রুটি মুক্ত ছিল না। স্বাধীনতার পরে ডিভিসি’ই হল ভারতের প্রথম কোন বহুমুখী নদী পরিকল্পনা যার মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে নিম্ন দামোদর উপত্যকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। তাই অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে মানুষের এই প্রকল্পের উপর একটা উচ্চ প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু ১৯৫৬ সাল ও ১৯৫৯ সালে মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে যে ভয়াবহ বন্যার সাক্ষী থাকল নিম্ন দামোদরের বাসিন্দা তাতে মানুষের ডিভিসির উপর পাহাড় প্রমান প্রত্যাশার পারদ চড়চড় করে নেমে শুন্যতে পৌঁছায়। শুরু হল ত্রুটি অনুসন্ধানের। সংবাদ মাধ্যমগুলিও এমন বিরূপ মন্তব্য করতে শুরু করল যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সর্দার মানসিং এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গড়তে বাধ্য হয়েছিল। অনুসন্ধান রিপোর্টে দেখা গেল প্রকল্প রূপায়নে ড. সাহার সুপারিশ অনুসারে কাজ হলে আজকের এই পরিণতির সম্মুখীন হতে হত না। তিনি এই বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি গৌণ করে দেখেছিলেন, প্রাথমিক কাজ হিসাবে অরণ্যায়নের দাবী করেছিলেন। আবার যখন ডিভিসি গড়ার পরিকল্পনা হল, সেখানেও তিনি বন্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে করনীয় যে সকল কর্মসূচী গ্রহণের কথা বলেছিলেন, তার সাথে সরকার অর্থনৈতিক লাভের জন্য সেই প্রকল্পে সেচ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টা মুখ্য ধরে অন্তর্ভুক্ত করে আর সেখানেই বহুমুখী নদী পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। শুধু তাই নয়, ড. মেঘনাদ সাহা থেকে শুরু করে কপিল ভট্টাচার্য পর্যন্ত একাধিক আন্তর্জাতিক নদী বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে গঙ্গার উপর ফারাক্কা ব্যারেজ করে সার্বিক বিফল হয়েছিল কারণ সেখানেও গঙ্গার গতিপথ বা তার প্রাকৃতিক চরিত্রকে গুরুত্ব না দিয়ে ঔপনিবেশিক মানসিকতা আর রাজনৈতিক দাদাগিরিটাই বেশী প্রাধান্য পেয়েছিল।  

গ্রন্থসূত্রঃ
 করমহাপাত্র, সূর্যেন্দুবিকাশ, ‘মেঘনাদ সাহাঃ জীবন ও সাধনা’, শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, ১৯৯৬
 পুরকাইত, তারক, ‘নদীবাঁধের রাজনীতি ও রবীন্দ্রনাথের মুক্তধারা’ IJHSSS, Vol-III, Issue-III, November, 2016
 পুরকাইত, সনৎকুমার, ‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে-একটি সমাজ বিজ্ঞানীয় অনুসন্ধান’ ৩য় সংখ্যা, ২য় বর্ষ, ভূগোল ও পরিবেশ, জুলাই-আগস্ট, ২০১৮ 
 ভট্টাচার্য, কুমকুম, ‘দামোদর-বাঁধ নির্মাণের একাল ও সেকাল’, প্রতীতি(সঃ), হুগলী  
 রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘দামোদর উপত্যকা পরিকল্পনা (মূল প্রাবন্ধিক - মেঘনাদ সাহা ও কমলেশ রায়)’, জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকা, সংখ্যা-২, ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৯
 রায়, গৌতম, ‘তিস্তা থেকে ছিটমহল’, ১১-১২ সংখ্যা, ৬২তম বর্ষ, গণবার্তা, কলকাতা
 রুদ্র, কল্যাণ, ‘বাংলায় বন্যা থেকে বাঁচা বা বন্যাকে নিয়ে বাঁচা’, ৩য় সংখ্যা, ৩৭ বর্ষ, উৎস মানুষ, জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০১৭, কলকাতা
 সান্যাল, তপোব্রত, ‘প্রসঙ্গঃ এ-বছরে দক্ষিণবঙ্গের বন্যা’, ৪র্থ সংখ্যা, ৩৭ বর্ষ, উৎস মানুষ, অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০১৭, কলকাতা   
 সাহা, মনোজ কুমার, ‘রাঢ় বাংলার দুরন্ত নদী দামোদর’, লেজার আর্ট, হুগলী, ২০০৮
 সেনগুপ্ত, দেবাশিস, পরমেশ গোস্বামী ও কল্যাণ রুদ্র, ‘জল’, এভেনেল প্রেস, বর্ধমান, জানুয়ারি, ২০১৪ 
 Naik. Pramod V., ‘Meghnad Saha and his contributions’, Historical Notes, Current Science, Vol-111, No. 1, July, 2016
 Saha, M.N. & Roy, K.S. ‘Planning for the Damodar Valley’, Science & Culture, July, 1944

রচনাকাল : ১৭/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 3  Canada : 222  China : 19  Europe : 5  France : 1  Germany : 3  Hong Kong : 1  Hungary : 7  Iceland : 6  India : 1023  
Ireland : 64  Japan : 6  Romania : 3  Russian Federat : 23  Spain : 1  Sweden : 11  Ukraine : 9  United Arab Emi : 2  United Kingdom : 1  United States : 709  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 3  Canada : 222  China : 19  Europe : 5  
France : 1  Germany : 3  Hong Kong : 1  Hungary : 7  
Iceland : 6  India : 1023  Ireland : 64  Japan : 6  
Romania : 3  Russian Federat : 23  Spain : 1  Sweden : 11  
Ukraine : 9  United Arab Emi : 2  United Kingdom : 1  United States : 709  
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
ভারতবর্ষের নদীবাঁধ পরিকল্পনায় বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহার অবদান by Sanat Kumar Purkait is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪০৪৭৯
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী