মা হল মাতৃত্বের স্বাদ। পরম তৃপ্তির স্বাদ। সন্তানের বদনে মধুর ডাক যখন মায়ের কর্ণে পৌঁছায় কোন মায়ের নারীজন্ম সার্থক হয়ে যায়। কথায় বলে, যে মেয়ে মা হতে পারে নি, সে পূর্ণ মেয়ে হয়ে উঠতে পারে নি। তাই আমাদের সমাজে, বলা ভালো সমগ্র পৃথিবীতে সকল জীবের মধ্যে এই মায়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মা হওয়ার মধ্যে নারীর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বেঁচে থাকা। নারীর মধ্যে মায়ের সত্ত্বায় দক্ষ প্রশাসক, অভিভাবক, পরিচালক, শিক্ষক, পথপ্রদর্শক আর প্রবল ত্যাগীর জীবন লুকিয়ে থাকে। তার ফলাফল পরবর্তী প্রজন্ম কেমন হবে তা নির্ধারিত হয়ে যায় মায়ের চরিত্র অনুসারে। তাই শুধু সন্তানের জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না, মা হতে গেলে চাই মানবিকতা, নিষ্ঠা, ভক্তি, প্রেম, বাৎসল্যরস আর সঠিক দিশা। বর্তমান সমাজে অনেক নারী দিশাহারা। তারা অনাচার, ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে অনিচ্ছাকৃত সন্তানের জন্ম দিয়ে হয় গর্ভপাত করাচ্ছে নইলে সন্তানের জন্ম দিয়ে রাতের অন্ধকারে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলছে। এরা গর্ভধারিণী হলেও জীবনে মা হয়ে উঠতে পারে না যেমন, তেমন মহাভারতের অধিরথ সুত জায়া রাধা গর্ভে ধারণ না করলেও কর্ণকে যেভাবে লালন পালন করেছিলেন তা প্রকৃত মায়ের থেকে কোন অংশে কম না। তাই আজ আপনাদের কাছে আলোকপাত করব সন্তানের বিকাশে মায়ের ভূমিকা এবং শাস্ত্রীয় কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা প্রদান করে আমাদের নৈতিক চলাচলের মার্গ উন্মোচন করব। কারণ, যখন সমাজ উচ্ছন্নে যেতে বসে, মানুষ আর গুরুজনদের কথা মানে না, শিক্ষিত সমাজকে বাদ দিয়ে মূর্খ মঞ্চ আলো করে বসে থাকে, জ্ঞানীরা লজ্জায়, ঘৃণায় অপমানে পালিয়ে যায়, সেই সন্ধিক্ষণে আমাদের বাঁচার একটাই মাধ্যম হল নীতিশাস্ত্র। নৈতিক অধঃপতন থেকে সমাজকে না বাঁচাতে পারলে সভ্যতার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। আর এই পথে নারী, বিশেষ করে মায়ের ভূমিকা অনবদ্য। পুরুষ শিক্ষিত হলে একটা পরিবার শিক্ষিত হতে পারে, কিন্তু একজন নারী সুশিক্ষিত হলে পরে দেশের শিক্ষার মানচিত্র বদলে যায়। তাই আসুন আজ নারীকে সুন্দর মা হবার উপায় খুঁজে দিই।
আমরা জানি যে দুটি দেহ এক মনে, এক প্রাণে মিলিত হলেই তবে নবজাতকের নব তনুর উৎপত্তির পরিবেশ তৈরি হয়। সংসারে মা হল ক্ষেত্র, বাবা হল বীজ। বাবা প্রদান করে থাকে, মা গ্রহণ করে। সেই সুত্রে, ক্ষেত্র যদি না ভালো হয়, বীজের গুণ ও মান যতই ভালো হোক না কেন তা কোনদিন ভালো অপত্য প্রদান করতে পারে না। তাই বাবার থেকে মায়ের চলাচলে অনেক বিধিনিষেধ মেনে চলার বিধেয়। প্রমান আছে অনেক মাতাল পিতার সন্তান সুনাগরিক হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে শুধুমাত্র মায়ের কারণে। মা ভালো বলে এই সংসারে কোন খারাপ প্রভাব তার সন্তানের উপর বিস্তার করতে দেন নি। আমরা এক্ষেত্রে, হিরণ্যকশিপু, প্রহ্লাদ আর মাতা কয়াধূর কথা মনে করতে পারি। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক সুধীর চক্রবর্তী বলেন, ‘স্বতন্ত্র দুজনের দেহভাণ্ডের দুই বস্তুর অভূতপূর্ব সাক্ষাৎ সম্ভাবিত করে নতুন এক জীবন পিণ্ডকে। তার ক্রমবিকাশের বস্তুগত বিবরণটিও লৌকিক কল্পনায় চমকপ্রদভাবে জারিত হয়ে এইভাবে বর্ণিত যে,
'প্রথম মাসে মাংসশোণিতময়/দুইমাসে নর নাভী কড়া অস্থি-র উদয়।/ তিনমাসে তিনগুণে জীবের মস্তক জন্মায়/ চতুর্থেতে নেত্র কর্ণ ওষ্ঠ চর্ম লোম আনে।/পঞ্চমেতে হস্ত পদাকার/ পঞ্চতত্ত্ব এসে তবে করলেন সঞ্চার/ সেইদিন হলো জীবের আকার ও প্রকার/ছয়মাসেতে ষড়রিপু বসিল স্থানে স্থানে।/সপ্তমেতে সপ্তধাতু যে/এরা আপন শক্তি লয়ে বসিল এসে/অষ্টমেতে অষ্টসিদ্ধি এল ভোগের কারণে।/নয় মাসে দশ ইন্দ্রিয় না রহে গর্ভধামে’।
এইভাবে মাতৃগর্ভে স্থিত শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশের স্তরগুলি গানের ছন্দে বেঁধে তত্ত্বের আকারে তুলে ধরা আছে। এই গানের অর্থ সবাই উদ্ধার করতে পারে না। প্রকৃত শিক্ষা আর সঠিক গুরুর সন্ধান না পেলে এই তত্ত্ব অপ্রকট থেকে যায়। কিন্তু, এটা সত্য যে মায়ের গর্ভে সন্তানের লালন পালন যে কষ্টকর পরিস্থিতি এবং তার যে জৈবিক পরিণতি তা বিচার করলে দেখা যাবে শিশুর ভালোমন্দ সবকিছু নির্ভর করে মায়ের উপর। কারণ, তাঁর গর্ভটাই শিশুর দশ মাসের আবাসস্থল। তাই তাঁর আচরণ, ব্যবহার, চলাফেরা, রুচি, পছন্দসহ নানান চরিত্র সব গর্ভস্থ শিশুর উপরে প্রভাব বিস্তার করে, বলা ভালো শিশুর মধ্যে সঞ্চারিত হতে থাকে। তাই শিশুর কথা ভেবে মাকে যত্নশীল হতে হবে। মায়ের মুখ থেকে শিশু বলে, মায়ের কান থেকে শিশু শোনে। তাই মাকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। নইলে মহাভারতের ট্র্যাজিক হিরো অভিমন্যুর মতো করুন পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে শিশুকে আর দায়ী থাকবে মাতা। আসুন আমরা বরং জেনে নিই অভিমন্যুর কথা।
অভিমন্যুকে দেখলে আমরা দেখতে পাই, ভগবান কৃষ্ণ যিনি সৃষ্টি স্থিতি লয় প্রলয়ের মালিক তার মামা হয়েও তাঁকে নির্মমভাবে মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মরতে হয়েছিল। কেন? সেখানেও তত্ত্ব বলছে অভিমন্যু মাতা, অর্জুন ঘরণী, কৃষ্ণ ভগিনী সুভদ্রা দেবীর একটিমাত্র ভুলের কারণে অভিমন্যুকে অকালে মরতে হল। শাস্ত্র বলছে, অভিমন্যু যখন মাতৃগর্ভে অবস্থান করছিল এমন একদিন পিতা অর্জুন যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করে মাতা সুভদ্রার ঘরে আসে। সেখানে বিশ্রামরত সুভদ্রাকে স্নেহের বশে ঘুম পাড়াতে যুদ্ধের গল্প শোনাতে শুরু করেন। এই গল্প করতে করতে অর্জুন যুদ্ধের রণকৌশল শেখাতে শুরু করেন। একদিন যখন অর্জুন সুভদ্রাকে দুর্ভেদ্য চক্রব্যূহে প্রবেশ এবং বের হওয়ার শিক্ষা প্রদান করছিলেন তখন গল্পের মাঝেই সুভদ্রা ঘুমিয়ে পড়েন। মায়ের সাথে সাথে মায়ের গর্ভে থাকা সন্তান অভিমন্যুও সেই শিক্ষা অর্জন করছিলেন। মাতা সুভদ্রা যখন ঘুমিয়ে পড়লেন ততক্ষণে অর্জুন এই চক্রব্যূহে প্রবেশের কৌশল বর্ণনা করেছিলেন, যেটা অর্জুনপুত্র অভিমন্যু মাতৃগর্ভে থাকাকালীন শিখে নেন। অর্জুন যথারীতি তার এই শিক্ষাপ্রদানের শেষপর্ব রণভূমির চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার গল্প করছিলেন। কিন্তু, মাতা সুভদ্রার নিদ্রার সাথে সাথে গর্ভে স্থিত সন্তানও নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ে এবং অর্জুন কিছুই জানতে পারে না। অভিমন্যু মনে প্রাণে চেয়েছিলেন মা তুমি আর একটু জেগে থাকো, কিন্তু অবসন্ন মা ঘুমিয়ে পড়ার সাথে সাথেই অভিমন্যুর শিক্ষা থমকে যায়। সেই শিক্ষার বলে যখন কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে পাণ্ডবদের শিবিরে যুদ্ধে কোন মহারথী চক্রব্যূহে প্রবেশ করার মত কাছেপিঠে ছিল না, তখন অদম্য সাহসী অভিমন্যু প্রবল দাপটের সাথে চক্রব্যূহে প্রবেশ করে একাধিক রথী মহারথীর সাথে যুদ্ধ করেই চলেছেন। কিন্তু যখন একে একে সপ্ত মহারথী চারদিক থেকে তাঁকে ঘিরে ফেলে আক্রমণ করতে উদ্যত হন, তখন চাইলে পরেও অভিমন্যু সেই স্থান ত্যাগ করে পলায়ন করতে পারে নি। কারণ সে শিক্ষা অভিমন্যু অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিল শুধুমাত্র মায়ের অলসতা আর অজ্ঞানতার কারণে।
আবার মাতা কুন্তীর জন্য কর্ণ কানীন পুত্র। সমাজে ব্রাত্য, সমাজ তাঁকে ভালো চোখে নেবে না বলে মাতা সবার অজান্তে নবজাতক কৌন্তেয়কে জলে ভাসিয়ে দেয়। শুধু মায়ের একটা সিদ্ধান্তের কারণে কৌলীন্য থাকা সত্ত্বেও পাণ্ডুর জ্যেষ্ঠ পুত্র মহামতি কর্ণের পরিচয় হয়ে দাঁড়ালো নিম্নবর্গীয় সুতপুত্র। যার জন্য সকল শক্তি থাকা সত্ত্বেও অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষায় তাঁকে বঞ্চিত করা হয়। নইলে অর্জুনের সমকক্ষ বীর হতে পারত কর্ণ। শুধুমাত্র মায়ের কারণে তার সন্তান কুলীন ক্ষত্রীয় বংশজাত হয়েও নিচুজাত বলে পরিগণিত হয়ে জীবন কাটিয়ে গেল।
এবারে পাঠকের সামনে আমরা এমন একজনের কথা তুলে ধরব তাঁর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধায় মাতা হেঁট হয়ে গেলেও তাঁর জন্মবৃত্তান্ত আপনাদেরকে থমকে দিতে পারে। কিন্তু না, সেখানেও মায়ের গুরুত্ব অনেকখানি। আমরা মহাভারতপ্রণেতা মহামুনি শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস যিনি ব্যাসদেব নামেও সুপরিচিত, তাঁর কথা বলব। যিনি মহাভারত ছাড়াও একাধিক শাস্ত্রের রচয়িতা। হিন্দু শাস্ত্রের ধারক বাহক। সেই বেদব্যাস বা ব্যাসদেব তার মাতা সত্যবতীর কুমারী সন্তান ছিলেন, পাতি বাংলায় বললে হয় জারজ সন্তান। আমরা মহাভারতের পাতা উল্টে দেখলে দেখতে পাব যে সত্যবতী ওরফে মৎস্যগন্ধা জন্মদোষে মাছের গর্ভে স্থান পায় বলে তাঁর নাম এরূপ হলেও রূপে গুণে তিনি ছিলেন অতুলনীয়া। জন্মের পর থেকে পালক পিতার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে নদীতে মাঝি হয়ে নৌকা চালনা করতেন। সেইস্থান দিয়ে মহামুনি পরাশর একদিন তীর্থে যাওয়ার সময় অলৌকিক – রূপলাবন্যবতী, মুনিজন মনোহারিণী, সুচারুহাসিনী, দাসনন্দিনীকে দেখার সাথে সাথে মদনবেদনায় অতিমাত্র ব্যাকুল হইয়া বললেন, ‘হে কল্যাণী! তুমি আমার মনোভিলাষ পূর্ণ করো’। সে কহিল, ‘ভগবন! ঐ দেখুন নদীর উভয় পাড়ে পার হইবার নিমিত্ত ঋষিগণ উপস্থিত আছেন, এ অবসরে কিরূপে আপনার মনোরথ সিদ্ধি হইবে?’ সে কথা শুনে মহামুনি পরাশর তাঁর ক্ষমতা বলে নদীতীর কুয়াশায় ঢেকে দিলে, কন্যা এবার তাঁর কুমারিত্ব হরণ, কানীন সন্তান আর সমাজের বিধান নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলেন। তখন অত্যন্ত প্রীত হয়ে মুনিবর তাঁহাকে বর দিলেন, তাঁর অভীষ্ট পূর্ণ করলে তাঁর কুমারীত্ব নষ্ট হবে না আর তাঁর ইচ্ছেমত তাঁর দেহ থেকে মাছের গন্ধ দূর হয়ে সুন্দর গন্ধ প্রকাশ পেল যা কয়েক যোজন দূর হতে ঘ্রাণ পাওয়া যেত। সেই থেকে তাঁর নাম মৎস্যগন্ধা থেকে পদ্মগন্ধা হয়। মুনিবর আরও বলেন যে, আমার ঔরসে তোমার গর্ভের সন্তান ত্রিভুবন বিজয়ী পণ্ডিত হবে। সত্যবতী এইরূপে যমুনা নদীর তীরে এক দ্বীপে পুত্র প্রসব করলেন। প্রভূততেজা পরাশরপুত্র মাতৃনির্দেশক্রমে তপস্যার জন্য স্থান ত্যাগ করার পূর্বে বলে গেলেন, ‘মাতঃ! কার্যকাল উপস্থিত হইলেই আমাকে স্মরণ ক্রিলেই আমি আসিব’। এভাবেই ব্যাসদেবের জন্ম হল কুমারী মায়ের জারজ সন্তান হিসাবে। কিন্তু মায়ের সততায় আর নিষ্ঠায় পুত্রের জন্ম দেওয়ার পরেও সমাজে তাঁর কোন অপরাধ হল না মুনিবরের কৃপায়। যে সন্তান জারজ সন্তান বলে ব্যাসদেবকে সবাই জানলো সেই সন্তান বেদ, মহাভারত, ভাগবত প্রভৃতি গ্রন্থের মত জ্ঞানের সমুদ্র তৈরি করেন। তা শুধু মায়ের পবিত্র ক্ষেত্রে বাবার মহাতেজপূর্ণ বীজের সঞ্চারের কারণে। যে জন্মের পরেই মায়ের কল্যাণে মাকে ত্যাগ করে তপস্যায় চলে গেল। এহেন সন্তানের মা হওয়ার মধ্যে মাহাত্ম্য আছে।
ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ হয়ে গেল সেই মায়ের ভুলের কারণে। মহাভারতের ব্যাখ্যা অনুসারে ধৃতরাষ্ট্রের পিতা বিচিত্রবীর্য পুত্র উৎপাদনের আগেই মৃত্যুবরণ করেন। ফলে বিচিত্রবীর্যের দুই স্ত্রী অম্বিকা ও অম্বালিকা অপুত্রক থেকে যাওয়া এবং ভীষ্মের কঠিন প্রতিজ্ঞায় যখন মাতা সত্যবতী চিন্তাগ্রস্থ হলেন, তখন রাজ্য ও রাজকর্ম পরিচালনার কথা ভেবে রানি সত্যবতী ও ভীষ্ম দুজনে মিলে ব্রাহ্মণের সাথে পরামর্শ করে ঠিক করেন যে সত্যবতী-পরাশরের পুত্র অর্থাৎ সত্যবতীর প্রথম পুত্র ব্যাসদেব মায়ের দিক থেকে বিচিত্রবীর্যের ভ্রাতৃস্থানীয়। সুতরাং রাজ্যপাট বাঁচাতে তাঁকে দিয়ে রানি অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে পুত্র উৎপাদন করানো যেতে পারে। তৎকালীন সময়ে এমন ক্ষেত্রজ সন্তানের জন্ম বৈধ ছিল নিতান্ত প্রয়োজনে। সেইমত, ব্যাসদেবকে রাজি করিয়ে রানি সত্যবতী তার পুত্রবধূ অম্বিকা আর অম্বালিকার কাছে গেলেন। তাঁদেরকে ধর্মজ্ঞান প্রদান করে বলেন যে তোমরা ব্রতধারনপূর্বক পরিশুদ্ধ হয়ে শয়নকক্ষে অবস্থান করবে। আজ রাতে তোমাদের এক দেবর আসবেন তোমাদের সাথে মিলিত হতে। হস্তিনাপুরের রাজ্যপাট রক্ষা করতে এটাই বিধান। শাশুড়ি মায়ের আদেশ আর পুত্রাকাঙ্ক্ষায় তারা প্রস্তুত হয়ে প্রতিক্ষা করলেন সুবেশ সজ্জিতা হয়ে। এমন সময় ভগবান ব্যাস তার সত্য পালন করবার জন্য প্রথমে অম্বিকার ঘরে প্রবেশ করলেন। প্রদীপ্ত দীপশিখায় অম্বিকা দেখতে পেলেন বিরাট ঋষির কৃষ্ণবর্ণ নয়নযুগল, পিঙ্গল জটাভার, বিশাল শ্মশ্রু প্রভৃতি অতি ভয়ঙ্কর আকার নিরীক্ষণে ভয় পেয়ে মাতা অম্বিকা চোখ বন্ধ করে নিলেন আর নয়ন মুদে ভীষ্মের কথা ভাবতে লাগলেন। কারণ, অপহরণকাল থেকে ভীষ্মের প্রতি দুর্বল ছিলেন এই অম্বিকা। ফলে, অতীন্দ্রিয় জ্ঞানসম্পন্ন মহামুনি ব্যাসদেব বললেন এর পুত্র অলৌকিক ধীশক্তিসম্পন্ন, বলবান, সুবিদ্বান, মহাবীর্য, মহাভাগপুত্র হবেন যিনি শতপুত্রের জন্ম দেবেন, কিন্তু মায়ের দোষে তিনি জন্মান্ধ হবেন। পাঠকের নিকট এখানেই প্রকাশ যে সন্তানের জন্ম তো দুরস্ত তার জন্মের পরিকল্পনা বা গর্ভগ্রহণ কাল থেকে মায়ের সকল প্রভাব সন্তানের উপর পরিবাহিত হতে থাকে। মহাভারতের এই কাহিনী অনেকের কাছে গল্পকথা বা কল্পকাহিনী বলে মনে হতে পারে, কিন্তু মহাভারত হল এক নীতিশিক্ষার আকর গ্রন্থ।
আবার আমরা আরও একটু এগিয়ে গেলেই দেখতে পাবো অম্বালিকার পুত্র কেন পাণ্ডুর হয়ে গেল? সেখানেও মাতা অম্বালিকার অপরাধ প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। অম্বিকার সন্তানের জন্মান্ধ হবার কথা শুনে মাতা সত্যবতী আর একটি পুত্র উৎপাদনের অনুরোধ করাতে ব্যাসদেব অম্বালিকার ঘরে প্রবেশ করাতে তার বিশালাকার দেহ, কৃষ্ণবর্ণ আর জটাজুটধারী অদৃষ্টপূর্ব ভীষণমূর্তি মহাপুরুষকে দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অম্বালিকা পাণ্ডুর বর্ণ ধারণ করেন। তার ফলে তার অম্বালিকার পুত্র জন্ম থেকে পাণ্ডুর হয়ে রইল। মায়ের ভুলে জন্ম থেকে একটি শিশু প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়ার চরম নিদর্শন রয়ে গেল।
অন্ধ বা পাণ্ডুর সন্তানকে দিয়ে রাজ্য পরিচালনা বা রাজ্যের মঙ্গলসাধন নিয়ে চিন্তিত হয়ে ব্যাসদেবকে আবার স্মরণ করলেন মহামতি ব্যাসদেবকে। একটি সুন্দর সুপুরুষ সৌম্যকান্তি সন্তান উৎপাদনের অনুরোধ করাতে ব্যাসদেব আবার অম্বিকা নিকট গমন করলেন। কিন্তু এ কথা জানতে পেরে তার বিশালাকার দেহ আর উগ্র গন্ধের কথা মনে করে শাশুড়ির কথা অমান্য করে অম্বিকা নিজে শয়নকক্ষে না গিয়ে পাঠিয়ে দিলেন তার এক দাসীকে। নিজের বেশভূষা অলঙ্কার দিয়ে সেই অপরূপ শুদ্রা দাসীকে শয়নকক্ষে পাঠিয়ে দিলে ভগবান ব্যাসদেবের প্রতীক্ষায় রইলেন দাসী। তিনি উপস্থিত হলে তাঁকে সেবা যত্ন পূর্বক তার ঔরসে পরম আবেশে গর্ভধারণ করলেন যার ফলে জন্ম নিলেন পরমধার্মিক বিদূর, যিনি বিদ্যা ও বুদ্ধিতে মহাভারতের এক প্রনম্য চরিত্র হয়ে ওঠেন। এখানে আবার শিক্ষার বিষয় যে মাতা নিম্নবর্গীয় হতে পারে, কিন্তু তার সততা আর নিষ্ঠা, প্রেম আর ভক্তি সুসন্তান ভূমিষ্ঠ করাতে পারে।
এছাড়াও আমরা যদি ভাগবতের পাতা খুলে দেখি ভক্ত প্রহ্লাদের পিতা ছিলেন সমাজবিরোধী হিরণ্যকশিপু। কিন্তু তার মা কয়াধু ছিলেন এক পরম ভক্ত। তাঁর ভক্তিতে সন্তান এমন ভক্ত হয়ে জন্ম নিতে পেরেছিল। মায়ের গর্ভে থাকাকালীন মা কয়াধূ দিবারাত্রি ঈশ্বরের আরাধনা করেছেন। নিষ্ঠাসহ, সততার সাথে জীবন কাটিয়েছেন, অত্যাচারী স্বামীর কৃতকর্মে সর্বদা ক্ষমা ভিক্ষা চেয়েছেন। তাই এমন একটি সুসন্তানের মা হতে পেরেছিলেন তিনি। যখন পিতা হিরণ্যকশিপুকে ভগবান নৃসিংহ রূপ ধারণ করে হত্যা করার জন্য তাঁর পেট চিরে নাড়ি বের করে মুখে দিয়েছিলেন তখন ভক্ত প্রহ্লাদ ভগবান কে প্রশ্ন করেছিলেন ভগবান কি করছেন আপনি? এমন করলে ভক্তসমাজ তো ভীত হয়ে পড়বে। তখন ভগবান উত্তর দিয়েছিলেন, আমি কি আর রক্ত মাংস খাওয়ার জন্যে তোমার পিতার উদর চিরেছি, তোমার পিতার ইচ্ছা পূর্ণ করার পাশাপাশি দেখতে চাইছি যার ঔরসে তোমার মত ভক্ত জন্মগ্রহণ করে তাঁর নাড়ি বা রক্তটা কিরূপ হয়?
ইতিহাসের পাতায় কিংবা শাস্ত্রের আনাচে কানাচে খুঁজলে আমরা এরকম ভুরিভুরি উদাহরণ খুঁজে পাব, যেখানে, মায়ের সততা, নিষ্ঠা, ভক্তি বা তাঁর সুচরিত্রের কারণে সন্তানের মর্যাদা বা প্রতিষ্ঠা সুগম হয়েছে। তাই আমার মহিলা পাঠক যারা আমার প্রিয় মা, বোনেরা আমার এই লেখা পড়লেন, তাঁদের কাছে একান্ত অনুরোধ, সন্তান লালনে পালনে মায়েদের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সন্তান গর্ভধারণ থেকে জন্ম পর্যন্ত মায়ের আচার ব্যবহার সবকিছু সন্তানের উপর বর্তায়। তাই আপনাদের কাছে একান্ত আবেদন সুসন্তানের জননী হতে গেলে নিজেকে সংযত ও ত্যাগী হতে হবে। বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষিত সমাজের অনেকেই পশ্চিমী দুনিয়ার আঁচে পুড়ে শাস্ত্র বা ইতিহাসের এই সকল ব্যাখ্যা হয়তো মানতে পারবেন না। তথ্য বা তত্ত্বের এই কচকচানি অনেকের মনোগ্রাহী না হতে পারে। কিন্তু, একটা মাথায় রাখতে হবে যে এই সকল নীতিশাস্ত্র বা মহাকাব্য যুগে যুগে মানুষকে পথ দেখিয়েছে। সাধারণত ঘটনা ঘটার পরে যা লিপিবদ্ধ হয় তাকে ইতিহাস বলা হয়, আর যেটা লেখার পর ঘটানো হয় তা নাটক নামে অভিহিত করা হয়। আমাদের এইসকল শাস্ত্র অনেকাংশে সমাজকে অন্ধকার থেকে টেনে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার অন্যতম অবলম্বন। পরিশেষে বলি, যে সকল গ্রন্থ বা পত্রপত্রিকা থেকে তথ্য আহরণ করে আমি সমৃদ্ধ হয়ে আপনাদের কাছে আমার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারলাম, সেসকল বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইয়ের কাছে আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ। সবাইকে ভালো সন্তানের জননী হবার শুভেচ্ছা জানিয়ে এখানে ইতি টানলাম। ভালো থাকবেন।
পুনশ্চঃ শুধু নিষ্ঠা আর ত্যাগের মধ্যে দিয়ে কিভাবে সন্তানকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করিয়ে দিতে হয় সেটা অনেক মহাপুরুষের মা করে দেখিয়েছেন। জানোয়ারের বাচ্চা তাঁদের মায়ের গণ অনুসারে কুকুর, বিড়াল, গরু, গাধার বাচ্চা হয়ে জন্মায়, বড় হয় ও মারাও যায়। কিন্তু, মানুষের বাচ্চা জন্মের মধ্যে দিয়ে মানুষ হয় না, তাঁকে শিক্ষা, সংস্কৃতি আর নীতিশিক্ষা দিয়ে মানুষ করে তুলতে হয় মনুষ্যত্ব প্রদান করে। এইজন্য বাড়িতে কোন গুরুজন বা মহাপুরুষের আগমন ঘটলে আমাদের বলতে শোনা যায়, ‘বাবা, একটু আশীর্বাদ করুন, আমার ছেলেটা যেন মানুষ হয়!’
-----------------
রচনাকাল : ১৭/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।