সুন্দরবনের সাতকাহন
আনুমানিক পঠন সময় : ১৬ মিনিট

লেখক : সনৎকুমার পুরকাইত
দেশ : India , শহর : ডায়মন্ডহারবার

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ৯৭ টি লেখনী ৪০ টি দেশ ব্যাপী ৩৭৩৫৩ জন পড়েছেন।
এক – সুন্দরবনের পরিচয়
           সুন্দরবন বলতে আমরা সাধারণ দৃষ্টিতে যা বুঝি তা হল একটি বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে নদীনালা সমন্বিত ঘন জঙ্গলের সমাহার আর উপরি পাওনা হিসাবে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের আঁতুড়ঘর। কিন্তু সুন্দরবনের সংজ্ঞা বা তার বৈচিত্র বিচার করে এটা পরিষ্কার হয় যে, সুন্দরবন বিষয়টা আপেক্ষিক। ভিন্ন চিন্তার মানুষের কাছে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সুন্দরবন ধরা দিয়েছে। হাজার হাজার বছরের ইতিহাস সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে সুন্দরবনের উত্থান পতনের সাক্ষী থেকেছেন ইতিহাসবিদ্‌রা। সুন্দরবন ও তার বিবর্তনের সাক্ষ্য থেকেছেন ভূবিজ্ঞানীরা। তাঁরা সুন্দরবনকে দেখেছে কালের ক্রমবিবর্তনে তিল তিল করে গড়ে ওঠা গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের মোহনায় নদী খাঁড়ি আর ম্যানগ্রোভের সমাহারে নবীন পলিসমৃদ্ধ পৃথিবীর বৃহত্তম নদী বদ্বীপ। জীববিজ্ঞানের ছাত্র গবেষকরা একে সারা পৃথিবীর এক অনন্য জীববৈচিত্রের ভাণ্ডার বলে জানিয়ে এসেছেন।  
সেই সুন্দরবনকে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আধুনিক সভ্যতার উন্নয়নের সাথে সাথে ক্রমবর্ধমান দূষণের মাত্রাকে মাথায় রেখে একে পরিবেশের এক পরিপূরক উপাদান বলে মনে করেন। কারণ, বায়ুমণ্ডলের দূষণের অন্যতম উপাদান কার্বন-ডাই-অক্সাইড(CO2)কে সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ শোষণ করে পরিবেশকে বিশুদ্ধ রাখে। প্রাচীন সুন্দরবনের ইতিহাসের পাশাপাশি তার যে সমাজ, সংস্কৃতি আর সভ্যতার প্রতিটা উপাদান শতসহস্র বছরের অবহেলায়, অজ্ঞতায় বিস্মৃত হয়ে আছে চাপা পড়া পললের তলায়, তা খনন কাজের মাধ্যমে পুরাতাত্ত্বিকদের কাছে সুন্দরবন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

         অপরদিকে, উন্নত দুনিয়ার ব্যস্ত মানুষের প্রতিদিনের গতে বাঁধা জীবনযাপনের বাইরে গিয়ে একটু অবসর, একটু নির্জনতা বা ইঁদুর দৌড়ের লড়াই থেকে একটু অবকাশ কিংবা নগর জীবনের ইট কাঠ পাথরের একঘেয়েমি কাটানোর এক খোলা মনের আঙ্গিনা হল সুন্দরবন। তাই সারা ভারত তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসু মানুষ ছুটে আসে ক্রমসঙ্কুচিত সুন্দরবনের প্রান্তরে। কদিনের জন্য হারিয়ে যায় সভ্য জগতের অসভ্যতামি থেকে, বিচ্ছিন্ন হতে চায় সকল সংযোগ থেকে। তাই আর পাঁচটা পর্যটন কেন্দ্রের থেকে সুন্দরবন নির্জনতা আর একান্তে সময় কাটানোর এক লম্বা পরিসরের দক্ষিণের বারান্দা। যেখানে সবুজের চাদরে মোড়া বিস্তীর্ণ জলরাশি আর বিচিত্রসব জীবের অবস্থান। সেই সুন্দরবন আমরা যারা ছাত্র, শিক্ষক গবেষক কিংবা শিক্ষাব্রতী মানুষ তাঁদের সবার কাছে সুন্দরবন হয়ে উঠেছে মৌলিক গবেষণার এক ক্ষেত্র। আর এই সুন্দরবন বা তার উপরে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রভাবে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি ও উন্নয়নকে কেন্দ্র করে রাজনীতি আর পরিকল্পনাকারীদের কাছে দুর্নীতি আর অপরিসীম লালসা পূরণের একটা মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে যেমন, তেমন সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষের দারিদ্রকে হাতিয়ার করে ভোট বৈতরণী পেরিয়ে যাওয়ার একটা সহজ পন্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজা প্রতাপাদিত্যের মৃত্যুর পরে সমৃদ্ধ সুন্দরবন মগ, পর্তুগীজ জলদস্যুদের অত্যাচারে যখন একে একে সবাই তাঁদের জমিদারি ছেড়ে পালাতে শুরু করল তখন সুন্দরবন হয়ে উঠেছিল মগের মুলুক। সুন্দরবন নামটি কিন্তু খুব প্রাচীন নয়। সমুদ্রের উপকুলে ম্যানগ্রোভের এই অঞ্চলকে আগে ভাটির দেশ বা আঠারো ভাটির দেশ বলা হত। দক্ষিণবঙ্গের সকল নদীর জল ভাটার সময় জল এই সুন্দরবনের উপর দিয়ে নেমে যেত বলে এরূপ নামকরণ ছিল। আবার বারো ভুঁইয়ার প্রাধান্যের কথা মনে রেখে এই অঞ্চলকে ‘বারো ভাঁটি বাংলা’ বলা হত। আবুল ফজল তাঁর আইনি আকবরি গ্রন্থে এই সুন্দরবনকে ভাঁটি বলে উল্লেখ করেছেন।
 
দুই - সুন্দরবনের ভূবৈচিত্র
         সুন্দরবনের ভৌগোলিক অবস্থান গাঙ্গেয় ব্রহ্মপুত্র মোহনাতে নবীন পলি সমৃদ্ধ এলাকা জুড়ে। পৃথিবীর বৃহত্তম এই লবণাম্বু উদ্ভিদের ম্যানগ্রোভের ভারতীয় অরণ্য ২১°৩১’ উত্তর থেকে ২২°৩০’ উত্তর ও ৮৮°০১’ পূর্ব থেকে ৮৯°৫১’ পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত। একসাথে প্রায় ২৫,৫০০ বর্গকিমি জুড়ে অবস্থান করত ইন্দো-বাংলাদেশের সুন্দরবন। বর্তমানে সেই এলাকা কমে গিয়ে মোট ১০,২০০ বর্গকিমিতে দাঁড়িয়েছে। ভারতবর্ষের অংশে আছে ৪,২০০ বর্গকিমি ও বাংলাদেশে আছে প্রায় ৬,০০০ বর্গকিমি। মূলত ১০২ টি ছোট বড় দ্বীপ নিয়ে গঠিত আমাদের সুন্দরবন। এর মধ্যে আবার মানুষের হস্তক্ষেপে প্রায় ৫৪ টি দ্বীপে ৫০ লক্ষের বেশি মানুষ বসবাস করে। ভারতীয় সুন্দরবন আবার দুটি চব্বিশ পরগণাতে বিভক্ত হয়ে মোট ১৯ টি ব্লক প্রায় ৯,৬৩০ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে অবস্থান করে। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলাতে ১৩ টি ও উত্তর ২৪ পরগণাতে ৬ টি ব্লক। এগুলি হল যথাক্রমে গোসাবা, বাসন্তী, ক্যানিং-১, ক্যানিং-২, সাগর, নামখানা, কাকদ্বীপ, পাথরপ্রতিমা, কুলতলি, মথুরাপুর-১, মথুরাপুর-২, জয়নগর-১ ও জয়নগর-২ এবং উত্তর ২৪ পরগণাতে হাসনাবাদ, হিংগলগঞ্জ, হাড়োয়া, মিনাখা, সন্দেশখালি-১ ও সন্দেশখালি-২। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এত বড় সুন্দরবনের প্রশাসনিক কাজকর্মের সুবিধার্থে ২০১৫ সালের ২৭শে নভেম্বর মাসে দুই চব্বিশ পরগণার সুন্দরবনের ব্লকগুলিকে নিয়ে সুন্দরবন নামক স্বতন্ত্র জেলা ঘোষণা করেন, যদিও সেই ঘোষণা এখনও বাস্তবায়িত হতে আরও সময় লাগবে পরিকাঠামোর অভাবে। যেহেতু সুন্দরবনের উন্নয়নকে কেন্দ্র করে, সুন্দরবনের পিছিয়ে পড়া মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে অনেক আগেই সুন্দরবন বিষয়ক মন্ত্রক ও সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষৎ বর্তমান, তাই প্রশাসনিকভাবে এর একটা পৃথক সত্ত্বা থাকা যুক্তিযুক্ত বলে অনেকেই মনে করছেন। কিন্তু সুন্দরবনের সদর দপ্তর কোথায় হবে বা সেই সাগর থেকে হাসনাবাদ পর্যন্ত একটা সদর দপ্তরে কাজকর্ম কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে সেই নিয়ে আরও চিন্তভাবনা করা জরুরী।

         সুন্দরবনের এই নবীন পলি অধ্যুষিত দ্বীপাঞ্চলের মৃত্তিকা উর্বর পলি দ্বারা গঠিত হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে বাঁধের ভাঙ্গনের ফলে নদী বা সমুদ্রের লবণাক্ত জল প্রবেশ করে মৃত্তিকার লবণ ও ক্ষারের সামঞ্জস্য হারিয়েছে। বিশেষ করে আইলা পরবর্তী সময়ে কৃষিকাজের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং সেই প্রভাবমুক্ত হতে প্রায় এক দশক সময় লেগে যায়। এই সুন্দরবনের নদীবিন্যাস লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে বিনুনির মতো নদীগুলি একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। প্রাচীনকালে আদিগঙ্গার ধারা সুন্দরবনের ছত্রভোগ পর্যন্ত এসে শতধারায় বিভক্ত হয়ে সাগরে মিশেছিল। সেইরূপ সুন্দরবনের অন্যান্য নদীগুলির মধ্যে মাতলা, বিদ্যাধরী, পিয়ালী, মুড়িগঙ্গা, মৃদঙ্গভাঙ্গা, হাতানিয়া দোয়ানিয়া, বড়তলা, ঝিলা, ঠাকুরান, সপ্তমুখী, মণি, গোমর, বিদ্যা, গারাল, হোগল, গুয়াসাবা, ঝিলা, করতাল, চুলকাটি, হেড়োভাঙ্গা, কালি, কালনাগিনি প্রভৃতি নদী সুন্দরবনকে রসদ প্রদান করে গেছে।
 
তিন - সুন্দরবন এলো কোথা থেকে?
             এই প্রাচীন সমৃদ্ধ জনপদ তথা সুন্দরবন সময়ের সাথে সাথে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে নানা কারণে। সুন্দরবনের প্রাচীনত্ব নির্ণয়ে তার বুক থেকে প্রাপ্ত কিংবা নবীন পলিতে চাপা পড়া ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদান অতীতের কথা বলে। এই জেলার এক কৃতি সন্তান ঐতিহাসিক দুইধারার মধ্যে সম্পর্ক দেখাতে গিয়েসুন্দরভাবে বলেছেন, “কেবলমাত্র ভূ-তত্ত্ববিদগণ এ দেশকে নবীন বলিয়াছেন বলিয়া প্রাচীনকালে ইহার অস্তিত্ব ছিল না এরূপ স্থির করা আদৌ যুক্তিযুক্ত নহে। ভূ-তত্ত্ববিদগণ লক্ষ লক্ষ বৎসরের কথা বলেন, কারণ তাঁহাদের অনুসন্ধান ঐতিহাসিকদের ন্যায় পাঁচ সাত হাজার বৎসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নহে। এ জন্য তাঁহাদের নিকট যে দেশ নবীন, ঐতিহাসিকদের নিকট তাহা বহু প্রাচীন।” ক্ষেত্রসমীক্ষায় জানা যায়, সুন্দরবনের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাল, সেন, কুশান, গুপ্তসহ বিভিন্ন যুগের নিদর্শন আর পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের আগমনের (১৭৫৭) সাথে সাথে একসময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মগ, পর্তুগীজ জলদস্যুর (১৬০০-১৮০০) অত্যাচারে সুন্দরবন জনশুন্য হয়ে পড়লেও পুনরায় জঙ্গল হাসিল করে চাষাবাদ শুরু হয়। তারপর ধীরে ধীরে এখানে বাংলাদেশ, মেদনিপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া বা বীরভূম থেকে নিপীড়িত মানুষজনদের নিয়ে কুলি মজুর করে সুন্দরবনে বসতি স্থাপনের মাধ্যমে শুরু হয় জঙ্গল অধিগ্রহণের শুরু। প্রথমদিকে সুন্দরবনের কোন সীমানা না থাকলেও রাজস্ব সংগ্রহের সুবিধার্থে উইলিয়াম ড্যাম্পিয়ার ও লে. হজেস এর সাথে তৎকালীন যশোরের কালেক্টর ও জাজ টিলম্যান হেঙ্কেল ১৮৩০ সালে জমি জরিপের মধ্যে দিয়ে সুন্দরবনের সীমানা নির্ধারণ করতে শুরু করেন। এই জরিপ চলে প্রায় ৫০ বছর ধরে। জরিপের পরে সুন্দরবনের উত্তরদিকে যে কাল্পনিক সীমারেখা টেনে দেওয়া হয় সেটাই ড্যাম্পিয়ার-হজেস লাইন নামে পরিচিত। এই কাল্পনিক রেখা দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ডায়মন্ডহারবারের কাছে কুলপি অঞ্চল থেকে উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বসিরহাট পর্যন্ত বিস্তৃত। যার উত্তরে জনবসতি ও দক্ষিনে লোনা মাটির আবাদে ঘন সবুজ অরণ্য। সুন্দরবনের এই রেখা পেরিয়ে যদি উন্নত দুনিয়ার মানুষ নিজেদের কর্মকাণ্ড প্রসার না ঘটাত, তাহলে হয়তো আজকের সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতো ভাবতে বসতে হতো না। সময়ের সাথে সাথে মানুষ অরণ্যকে সংহার করতে করতে সেদিনের কোর এরিয়া আজ বাফার এরিয়াতে পরিণত হয়েছে। সুন্দরবনের গর্বের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের নিরাপদ নির্জন আবাসস্থল আজ বিপদাপন্ন মানুষের লোভের কারণে। তাই সুন্দরবনকে টিকিয়ে রাখতে গেলে প্রশাসনিক স্তর থেকে নতুন এক সীমারেখা টানা জরুরী যার দক্ষিনে আর মানবসভ্যতার কোন হস্তক্ষেপ আইনসম্মত হবে না।

        সুন্দরবনের নামকরণে অনেকের ভিন্ন ভিন্ন ধারণা বর্তমান থাকলেও বহুল প্রচলিত কাহিনী হল সুন্দরবনের নাম সুন্দরী নামক ম্যানগ্রোভের আধিপত্যের কারণে সুন্দরবন নামটাই প্রচার হয়। তবে ইংরেজ আসার আগে ফরাসীদের ঔপনিবেশিক কালে এই স্থানের নাম ছিল স্যান্ডারবন। পরবর্তীকালে ব্রিটিশরা আসার পর সোঁদরবন থেকে পরিবর্তিত হয়ে সুন্দরবনের বর্তমান নাম হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। সুন্দরবনের বেশীরভাগ অংশটাই দেশভাগের ফলে অধুনা বাংলাদেশের মধ্যে পরে বলে অনেকেই সুন্দরবনের নামকরণে বাংলাদেশের আধিপত্যের কথা তুলে ধরেন। বাংলাদেশের বরিশাল জেলার সুন্ধা নদীর উপত্যকায় এই জঙ্গল থেকে এর নাম সুন্ধার বন, যা পরবর্তীকালে সুন্দরবন হয়েছে। আবার অনেকেই ভাবেন যে ম্যানগ্রোভের অরণ্য দেখে সুন্দ্রি বন বলে অভিহিত করেন তাই আজকের সুন্দরবন নামে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা পায়। যাইহোক, সুন্দরবনের নামের উৎস বৈচিত্র যেমন, তেমন তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট। সুন্দরবনের জনবসতি বাড়ার সাথে সাথে সুন্দরবন বিভিন্নভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে শুরু করে।

চার - সুন্দরবনের জনবসতি
           সুন্দরবনের জনবসতি নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে আমাদের জানতে হবে যে রাজা প্রতাপাদিত্যের(১৬১১) পরাজয়ের পর, মগ ও পর্তুগীজ দস্যুদের ক্রমাগত অত্যাচারের ফলে এবং বারবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে সমৃদ্ধশালী সুন্দরবনের জনবসতি থেকে পলায়ন করতে করতে ১৭৩৭ সালের দিকে সুন্দরবন ফাঁকা হয়ে যায় এবং দীর্ঘদিনের পরিত্যক্ত এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে জঙ্গল গজিয়ে উঠে আজকের সুন্দরবন গড়ে ওঠে। ১৭৭৭ সালে রেনেল সাহেবের মানচিত্রে দেখা যায়, সুন্দরবন কলকাতা ছাড়িয়ে হাওড়া, হুগলীর বেশ কিছু অংশে ম্যানগ্রোভের অধিষ্ঠান ছিল। আদিগঙ্গার দুই তীরে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের ১৮৮৮ সালে বাঘ ঘুরে বেড়ানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। শোনা যায় কেওড়া গাছের আধিক্যের কারণে কোলকাতার কেওড়াতলা এলাকার নামকরণ করা হয়েছে। ম্যানগ্রোভের অন্যতম প্রজাতি গড়িয়া গাছের আধিক্যের কারণে গড়িয়া এলাকার নামকরণ হয়েছে। এছাড়াও পূর্ব কলকাতার জলাভূমি সল্টলেকও সুন্দরবনের সাথে যোগাযোগের এক অন্যতম মাধ্যম ছিল বলে মনে করা হয়। সুন্দরবনের প্রাচীনত্ব খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় কোন কোন এলাকা প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর পূর্বে গড়ে ওঠে। মেট্রোরেলের কাজ করার সময় বা বিভিন্ন কারণে কলকাতায় খনন কাজ করার সময় ম্যানগ্রোভের একাধিক উদ্ভিদ মূল মাটির নিচে চাপা পড়া অবস্থায় খুঁজে পাওয়াতে প্রমাণ হয় যে ১৮০০ সালের দিকে কলকাতাতে সুন্দরবন বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীকালে ১৮৩১ সালে ড্যাম্পিয়ার-হজেস লাইন টানার পর সুন্দরবনের জনবসতিতে ধীরে ধীরে জনসংখ্যা যোগ হতে থাকে। বিশেষ করে যশোরের কালেক্টরেট ও জাজ টিলম্যান হেঙ্কেল(১৭৮১) আর ড্যানিয়েল হ্যামিল্টনের(১৯০৭) নেতৃত্বে শুরু হল সুন্দরবনের জঙ্গল হাসিল করে আবাদ করার কাজ। এই কাজের জন্য সুন্দরবনে জনবসতি স্থাপন ও আবাদ করতে জমি লিজ দেওয়া হয়। ফলে একরের পর একর জমি অরণ্যশুন্য করে ফেলা হল। প্রকৃতপক্ষে সুন্দরবনের আদিবাসিন্দা বলতে কাউকে ঠিক বোঝায় না। সবাই একে একে বিভিন্ন স্থান থেকে এসে সুন্দরবনে ঘাঁটি গেড়ে বসেছেন নিজেদের অপরিসীম লালসা পূরণের তাগিদ নিয়ে। জঙ্গল হাসিল করার কাজে বাংলাদেশ, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়খণ্ড, মানভুম, ময়ূরভঞ্জ, সিংভুম, বিলাসপুর, নাগপুর প্রভৃতি এলাকা থেকে অত্যাচারিত, নিপীড়িত নিচুতলার মানুষ যারা আদিবাসী, দলিত, পৌণ্ড্র সম্প্রদায়ের লোকজন আসতে থাকে সুন্দরবনে কুলি মজুরের কাজ নিয়ে। তারপর শুরু হল জঙ্গল কাটা, প্রাণী হত্যা আর মানুষ প্রাণীতে পাশাপাশি সহাবস্থান। এই সুন্দরবনের গোসাবাতে ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন সাহেবের উদ্যোগে প্রথম সমবায় ভিত্তিতে গ্রামোন্নয়নের কাজ শুরু হয়। সেই সুত্রে এই সুন্দরবনের গোসাবাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৯৩২) ও মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত সচিব তথা মহাদেব দেশাইকে পাঠিয়েছিলেন। তার আগে পর্যন্ত এই এলাকা গরু, সাপ আর বাঘের নিভৃতে বিচরণ করার ক্ষেত্র ছিল। শোনা যায়, এই তিন প্রাণীর আদ্যক্ষর নিয়ে গোসাবা দ্বীপের নামকরণ হয়েছিল। বর্তমান সুন্দরবনের প্রায় ৫,৩৬৫ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে মনুষ্যবসতি ও কৃষিজমি গড়ে উঠেছে। বর্তমানে ৫৪ টি দ্বীপের মোট জনসংখ্যা ৫০ লক্ষের বেশিতে দাঁড়িয়েছে।

           ১৯০৭ সালে হ্যামিল্টনের জঙ্গলে এসে অবস্থান করা কিংবা জঙ্গল হাসিল করার কাজটা তৎকালীন সময়ে প্রশংসা পেলেও বর্তমান দিনে সুন্দরবনের কথা ভাবলে সেটাকে সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে অপরাধ বলে মনে করা হয়। একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে যে, ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ থেকে আগত উদ্বাস্তু দণ্ডকারণ্য থেকে এনে ঝড়খালির অপরপ্রান্তে ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ বাঘের ডেরাতে থাকার জন্য ছাড়পত্র দিয়েছিল। সেই জঙ্গল কেটে অতি সত্বর তারা যে জনবসতি গড়ে তুলে মরিচঝাঁপি থেকে নেতাজীনগর তৈরি করেছিল তা এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, তাতেই সরকার আঁতকে উঠেছিল। তাই সেখান থেকে উঠে যাওয়ার নির্দেশ দিলে তা অমান্য করার কারণে পুলিশের গুলি, কাঁদানে গ্যাস তথা বোমা মেরে তাঁদেরকে মারা হয় কিংবা পলায়ন করতে বাধ্য করে। সাময়িকভাবে তা নৃশংস ও অমানবিক বলে মনে হলেও সরকারের সেই সিদ্ধান্ত অনেকের মতে সঠিক ছিল। কারণ সেদিন যদি এই আধিপত্য থামিয়ে না দেওয়া হত মানুষ প্রকৃতির লোভের লড়াইয়ে মানুষের কাছে প্রকৃতির পরাজয় ঘটে বর্তমান সুন্দরবনের কোনকিছুই থাকতো না। কারণ ওদের দেখে অন্য শরণার্থীরা জলপথে এসে এক এক করে দ্বীপের পর দ্বীপের জঙ্গল কেটে হাসিল করে দিত। বিশেষ করে বর্তমানের রোহিঙ্গা সমস্যা এই সুযোগ কাজে লাগাত।

পাঁচ - সুন্দরবনের ঐতিহ্য
          সুন্দরবনের ঐতিহ্য আলোচনা করতে গেলে ইতিহাসের পাতা উল্টে পিছিয়ে যেতে হয়। কারণ সুন্দরবনের প্রাচীন ঐতিহ্য, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের নিভৃত পরিভ্রমণ ক্ষেত্র আর পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ এক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা প্রদান করেছে। ইতিহাসের পাতা খুললে সুন্দরবনের বুক থেকে প্রাচীনকালের গুপ্ত, কুশান, পাল, সেন, মোঘল আমলের যে মানবসভ্যতা ও তাঁদের সংস্কৃতি ছিল তা সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে স্থানে পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ব প্রদান করেছে এর প্রত্নসামগ্রী। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা বা তৎকালীন অবিভক্ত চব্বিশ পরগণাসহ সমগ্র সুন্দরবনের ইতিহাস ও ভূগোল চর্চায় প্রাচীন পুরাতত্ত্ব বা পুরাতাত্ত্বিক উপাদান বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। আমরা সুন্দরবন নিয়ে অনেক আলোচনা শুনি বা পড়ি, কিন্তু এই সুন্দরবনের প্রাচীনত্ব নিয়ে মানুষের মনে বিভিন্ন মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। সেই প্রাচীনত্ব বা ঐতিহাসিক সময়ে সুন্দরবনের ভূগোল চর্চা বা সমসাময়িক সময়ের সমাজব্যবস্থা বা সংশ্লিষ্ট এলাকার ভূ-প্রাকৃতিক চরিত্র কেমন ছিল তা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের সমাজবিজ্ঞানে ইতিহাসের সাথে ভূগোলের মেলবন্ধন ঘটানোটা জরুরী হয়ে পড়ে। তাই আমরা আজ ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখে নেব সুন্দরবনের পুরাতাত্ত্বিক উপাদানের কোথায় কোথায় এর ভূগোল চর্চা লুকিয়ে।
নানা শিল্পদ্রব্য নির্মাণের সাথে সাথে এই জেলার বাণিজ্যেরও প্রসার হয়েছিল অতি প্রাচীনকাল থেকে। বানিজ্য দুরকম ছিলঃ অন্তর্বাণিজ্য (বাংলা ও ভারতের মধ্যে) এবং বৈদেশিক বহির্বাণিজ্য – সিংহল, সুবর্ণভূমি, সুমাত্রা, যবদ্বীপ প্রভৃতি পূর্ব এশিয়ার নানাস্থানে। আবার পশ্চিমে মিশর, গ্রিস, রোম, ভূমধ্যসাগরের ক্রিট দ্বীপেও। এসব বিবরণ পেরিপ্লাস গ্রন্থে (১ম শতক) ও টলেমীর বিবরণীতে(২য় শতক) পাওয়া যায়। অন্তর্বাণিজ্য জল ও স্থল উভয়পথেই হত। সরস্বতী, গঙ্গা, বিদ্যাধরী, যমুনা, ইছামতী প্রভৃতি নদী দিয়ে পণ্যদ্রব্য সারা বাংলা ও পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়ত। সেদিন এসব নদী কোলাহলে মুখরিত ছিল। প্রাচীন স্থলপথও অনেক। য়ুয়ান চোয়াং সপ্তম শতকে যে পথ দিয়ে সমতট থেকে ২৪ পরগণার ওপর দিয়ে তাম্রলিপ্তে আসেন সে পথে পূর্ববঙ্গে ও কামরূপে ২৪ পরগণার পণ্যদ্রব্য গরুর গাড়ি করে যেত, এতো অসম্ভব কল্পনা নয়। এছাড়া গঙ্গাতীর ধরে শ্রীচৈতন্যের নীলাচলে যাত্রার বহুজন লাঞ্ছিত প্রাচীন পথ যাকে আমরা দ্বারীর জাঙ্গাল বলে জানি সে পথও বানিজ্য পথ ছিল। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় ইংরেজ আমলে যত রেলপথ হয়েছে সেগুলি অধিকাংশই প্রাচীন স্থলপথের ওপরেই নির্মিত। 

          সন্ধ্যাকর নন্দী রামচরিতে পালরাজধানী রামাবতীর বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন – ‘প্রশস্ত রাজপথের ধারে কনক পরিপূর্ণ ধবল প্রাসাদ শ্রেণী মেরুশিখরের ন্যায় প্রতীয়মান হইত এবং ইহার উপর স্বর্ণকলস শোভা পাইত। নানাস্থানে মন্দির, স্তূপ, বিহার, উদ্যান, পুষ্করিণী, ক্রীড়াশেল, ক্রীড়াবাপী ও নানাবিধ পুষ্প, লতা, তরু, গুল্ম নগরের শোভা বৃদ্ধি করত। হীরক, বৈদূর্যমণি, মুক্তা, মরকত, মাণিক্য ও নীলমণিখচিত আভরণ, বহুবিধ স্বর্ণখচিত তৈজসপত্র ও অন্যান্য গৃহোপকরণ, মহামূল্য বিচিত্র সূক্ষ্মবসন, চন্দন, কুমকুম, কর্পূরাদি গন্ধদ্রব্য এবং নানা যন্ত্রোত্থিত মন্ত্রমধুর ধ্বনির সহিত বিশুদ্ধ সঙ্গীত-রাগিণী নাগরিকদের ঐশ্বর্য, সম্পদ, রুচি ও বিলাসিতার পরিচয় প্রদান করিত।’ সাধারণ পরিচারিকাগণও মূল্যবান বস্ত্র ও অলংকারে ভূষিত থাকত। রামচরিতে সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বঙ্গভূমির মনোরম বর্ণনাও আছে যার থেকে আমাদের চব্বিশ পরগণা তথা সুন্দরবন ব্যতিক্রম নয়।

         সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘বাঙালীর ইতিহাস নাই, কে লিখিবে? তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সবাই লিখিবে’। তাই ইতিহাস কথা বলে, দেখায় নতুন করে পথ চলার রাস্তা। কারণ, আমরা অতীতের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ হয়ে বর্তমানের  আলোয় আলোকিত হয়ে ভবিষ্যতের পথে পাড়ি দিতে থাকি। প্রাচীনকাল থেকে যত সভ্যতা, সংস্কৃতি কালের প্রবাহে প্রবহমান হয়েছে তার ইতিহাস ধরা থাকে তাঁদের উপাস্য দেব বিগ্রহ, দেবদেউল, মন্দির, মসজিদ বা তার গাত্রে চিত্রিত নকশায়। ইতিহাসের এই সকল উপাদান কালের স্রোতে বিলীন হয়ে যাওয়া মানবসভ্যতার ভূগোলের উপাদানকে প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে থাকে। এমনি একটি উপাদান আজও স্বমহিমায় বিরাজমান সুন্দরবনের মথুরাপুর-২ ব্লকের জটার দেউল। 

ছয় - পর্যটনে সুন্দরবন
        সুন্দরবন এখন বিশ্বের এক অমোঘ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। গবেষক, পরিবেশবিদ্‌দের পাশাপাশি সারা দেশ তথা বিশ্বের বহু পর্যটক সুন্দরবনের টান অনুভব করে আসছে। সমগ্র সুন্দরবন জুড়ে আমরা দেখলে দেখতে পাই যে, কোথাও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে পর্যটক আসে তো, কোথাও প্রাচীন প্রত্নতত্ত্বের টানে পর্যটকের ভিড় হয়। সুন্দরবনের বেশ কয়েকটি জায়গায় ধর্মীয় ভাবাবেগ জড়িয়ে রয়েছে কয়েক হাজার বছর পূর্ব থেকে। সেইসকল পর্যটনকেন্দ্রগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সজনেখালি, সুধন্যখালি, নেতিধোপানি, দোবাঁকি, বুড়ির ডাবরি, কলস দ্বীপ, বনিক্যাম্প, চুলকাটি, কাকমারি, কুমিরমারী, ঝড়খালি, লোথিয়ান দ্বীপ, ভগবতপুর, মরিচঝাঁপি, কৈখালি, পিয়ালি দ্বীপ, ক্যানিং, ডাবু, সাগরদ্বীপ, গঙ্গাসাগর, বেনুবন, মৌসুনি, জম্বুদ্বীপ, বকখালি, ফ্রেজারগঞ্জ, কাকদ্বীপ, ছত্রভোগ, চক্রতীর্থ, অন্ধমুনি, জটার দেউল, ময়দা, বহরুক্ষেত্র, জয়নগর, হেনরি আইল্যান্ড, ঝিঙ্গেখালি, হরিণভাঙ্গা, ঘোড়ামারা, সুপারিভাঙ্গা, লোহাচড়া সহ একাধিক স্থান পশ্চিমবঙ্গের পর্যটনে সুন্দরবন নতুন পালক যুক্ত করেছে। সুন্দরবনের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পীঠস্থান এই সুন্দরবন। এই সুন্দরবনে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য যেমন এসেছিলেন তেমনি এখানকার গঙ্গাসাগরের কপিলমুনির আশ্রমকে কেন্দ্র করে সারা ভারতবর্ষের পুণ্যকামী ভক্তের দল ভিড় জমাতে শুরু করে মকরসংক্রান্তির পুণ্যস্নানের জন্য। ছত্রভোগে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের পাদুকার ছাপ আজও বিদ্যমান যাকে কেন্দ্র করে বাৎসরিক পূজা ও মেলায় প্রচুর বহিরাগত ভক্তের আগমন ঘটে। এছাড়াও এখানে নন্দার স্নানযাত্রা, অন্ধমুনির মেলা ইত্যাদি বিদ্যমান। সর্বোপরি রয়েছে, শীতের মরশুমে সুন্দরবনে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ম্যানগ্রোভের অরণ্যে খাঁড়িতে খাঁড়িতে ঢুকে ভ্রমণের স্বাদ নেবার হাতছানি। আগামীদিনে সুন্দরবনের এই সকল অঞ্চলকে আরও একটু বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করলে পর্যটনের বিকাশ ঘটানো সম্ভব হবে। 

সাত - সুন্দরবনের প্রাপ্তিযোগ
          ভারতীয় সুন্দরবনে মোট ১৪৩৫ রকম প্রজাতির প্রাণী বিদ্যমান যা মধ্যে ৯৮৯ টি প্রজাতি অমেরুদণ্ডী, ৪৪৫ টি প্রজাতির মেরুদণ্ডী ও একটি হেমিকিউট প্রাণীর সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রকৃতির অবাধ উম্মুত্ত পরিবেশের মাঝে এ বাংলার ঈর্ষনীয় সম্পদ সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ অরন্য অঞ্চল। নোনা জল, কাদামাটি ঘন হয়ে থাকা হেতাল বন, কত নদী আর অসংখ্য খাঁড়ি-পৃথিবীর সব চাইতে বড় ব-দ্বীপ। এই  বনের প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। মূল্যবান প্রাণিজ, জলজ ও বনজ সম্পদ মিলিয়ে এ বন অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের আধার। সুন্দরবনের সম্পদ অসচেতনভাবে মাত্রাতিরিক্ত আহরণ, যথেচ্ছ ব্যবহার এবং নির্বিচারে বন নিধনের কারণে এই বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বনের এ অবক্ষয় চলতে থাকলে সুন্দরবনের অস্তিত্ব এক সময় বিলীন হয়ে যাবে। সুন্দরবন সুরক্ষায় পরিবেশ, প্রাণ ও জীবন বান্ধব বৈচিত্র্যময় উন্নয়ন উদ্যোগ গ্রহন ও বাস্তবায়ন। সুন্দরবনের জনজীবনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অনিশ্চয়তা এবং অভিযোজনের সমস্যা। উন্নয়নের ঘাটতি ও আর্থসামাজিক সমস্যা। নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য  দৃষ্টিনন্দন, ঐতিহ্যবাহী, সৌন্দর্যের প্রতীক, রূপের জাদুকর সুন্দরবন আজ সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংস হতে যাচ্ছে।  গবেষকরা বলেছেন,  সংবিধান অনুযায়ী  বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এর  জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করা। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নানা সংকটের কারণে আজ চরম হুমকির সম্মুখীন। জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ ছাড়াও বন্যপ্রাণী শিকার এবং বন ধ্বংসের মতো মানুষের বিবেক বর্জিত কর্মকাণ্ড এর জন্য কম দায়ী নয়। সুন্দরবনের জন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন ও তার সঠিক বাস্তবায়ন। তার মধ্যেও ১৯৭৩ সালের ১ লা এপ্রিল প্রায় ২৫৮৫ বর্গকিমি আয়তনের বনাঞ্চলকে চিহ্নিত করে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছিল এবং ১৯৮৭ সালের ৬ ই ডিসেম্বর জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রপুঞ্জের ইউনেস্কো সুন্দরবনকে World Heritage Site ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার অনেক আগেই ১৯৮৪ সালের ৪ ঠা মে সুন্দরবনকে জাতীয় উদ্যান বা National Park ঘোষণা করে। পরবর্তীকালে ১৯৮৯ সালে ভারত সরকার সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা করেন। 

 তাই এহেন সমৃদ্ধ জৈব অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গবেষক, পরিবেশবিদ্‌ বা সমাজকর্মী মানুষ যেভাবে প্রকৃতির স্পন্দন অনুভব করে, সেটা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকে না। সবাই সুন্দরবনকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে এসেছে কালের নিয়মে। সুন্দরবনের উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের একটাই রাস্তা, সেটা হল সুন্দরবনকে ভালোবাসা, আর সেটা সুন্দরবনের আদি বাসিন্দা যাঁদের জল জঙ্গল জীবন করে দিন কাটে তাঁরা ছাড়া এর উন্নয়ন কোনভাবে পরিপূর্ণতা পায় না। তাই একদল নবীন গবেষক ও প্রবীণ অভিজ্ঞ পরিবেশকর্মীর প্রবন্ধে আমরা সুন্দরবনের চালচিত্র খুঁজে পাই। পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে আমরা একের পর এক অভিজ্ঞতার ফসল তুলে নেব। 
রচনাকাল : ১৭/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 25  Cambodia : 1  Canada : 276  China : 18  Europe : 6  France : 1  Germany : 6  Hungary : 22  India : 1106  Ireland : 40  
Japan : 5  Romania : 2  Russian Federat : 6  Saudi Arabia : 2  Singapore : 1  Sweden : 11  Ukraine : 8  United Arab Emi : 2  United Kingdom : 5  United States : 903  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 25  Cambodia : 1  Canada : 276  China : 18  
Europe : 6  France : 1  Germany : 6  Hungary : 22  
India : 1106  Ireland : 40  Japan : 5  Romania : 2  
Russian Federat : 6  Saudi Arabia : 2  Singapore : 1  Sweden : 11  
Ukraine : 8  United Arab Emi : 2  United Kingdom : 5  United States : 903  
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সুন্দরবনের সাতকাহন by Sanat Kumar Purkait is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৪৮৩৬০৩
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী