ভুমিকাঃ
বাঁকুড়া জেলার পুরাতত্ত্ব নিয়ে আমাদের এবারের সংখ্যার মুখ্য বিষয় হলেও পাঠকদের জন্য একটু অন্যরকমের পরিবেশন করছি। এই পুরাতাত্ত্বিক বিষয় বা ঘটনা নিয়ে আমাদের বাঁকুড়া জেলার সাথে সুদূর কলকাতার যে এক পরম আত্মীয়তা বর্তমান তা নিয়ে আজকের আমার আলোচনা। পুরাত্তত্বের ডালি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরনগরী বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর। একসময়ের শাক্তরাজাদের এই মল্লভূমি রাজা বীর হাম্বীরের সময় থেকে পরবর্তী রাজারা একের পড় এক মন্দির বানিয়ে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বৃন্দাবনের অনুকরণে লালবাঁধ, শ্যামবাঁধ, যমুনাবাঁধ বা কালিন্দীবাঁধের ন্যায় বেশ কয়েকটি বৃহৎ জলাশয় খনন করে তৎকালীন বিষ্ণুপুরকে বাঙলার বৃন্দাবন নামে খ্যাত করেন। এই বিষ্ণুপুরের আশেপাশে বেশ কয়েকটি গ্রামের নাম অযোধ্যা, মথুরা বা বৃন্দাবনপুর নাম দেন। অনেকেই এই বিষ্ণুপুরকে গুপ্ত বৃন্দাবন নামে চিনতেন। এই বিষ্ণুপুর একসময় বনবিষ্ণুপুর নামে খ্যাত ছিল যা প্রাচীন মল্লভুম রাজ্যের রাজধানী নামে সুপরিচিত। এখানে অনেক পুরাতত্ত্বসমৃদ্ধ মন্দির বা প্রতিষ্ঠান থাকলেও আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় দুটি। এখানে আমরা দেখে নেব পুরাতাত্ত্বিক মন্দির মদনমোহন মন্দির, মন্দিরের মদনমোহন ঠাকুর আর বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত দলমর্দন বা দলমাদল কামান কিভাবে বর্তমানে আলোকে প্রতিভাত হয়ে আছে।
মারাঠি বর্গী আক্রমণের কবলে বাংলাঃ
১৭৪১-১৭৫১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাঙলার পশ্চিম সীমান্তের জেলাগুলি প্রায়শই আক্রান্ত মারাঠা সেনাদের দ্বারা। যারা এককথায় বর্গী নামে পরিচিত ছিল। আজও সেই বর্গীদের অত্যাচারের করুণ ইতিহাস শোনা যায় ইতিহাসের পাতায়। তাদের এই লুটসন্ত্রাসের বিষয় প্রতিবছর নিয়ম করে চলতে থাকছিল। এই আক্রমণের শিকার বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, মেদিনীপুর, ওড়িশা, বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলে। আক্রমণের গুরুদায়িত্বে যারা থাকতেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ভাস্কর রাম কোলহাটকর পণ্ডিত সংক্ষেপে ভাস্কর পণ্ডিত, মারাঠা সাম্রাজ্যের অন্তর্গত নাগপুর রাজ্যের মহারাজা রঘুজী ভোঁসলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনিই প্রথম মারাঠাদের বাংলা অভিযানে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ভাস্কর ছিলেন রনকুশলী বর্গী নেতা। এই নেতার নেতৃত্বে বাঁকুড়া জেলা অর্থাৎ তৎকালীন মল্লভূমিসহ বিষ্ণুপুর আক্রান্ত হয়।
বর্গী আক্রমণের ভয়াবহতাঃ
বাঁকুড়ার ভূমিপুত্র ফকিরনারায়ণ কর্মকার তাঁর বিষ্ণুপুরের অমরকাহিনী গ্রন্থের ব্যাখ্যা অনুসারে ঝাড়খণ্ডের গভীর জঙ্গল অতিক্রম করে মল্লভূমে প্রবেশ করেন ভাস্কর পণ্ডিত। উদ্দেশ্য বিষ্ণুপুর লুণ্ঠন। বিষ্ণুপুরের দক্ষিণে গড়ের বাইরে ফেললেন বিশাল ছাউনি।এদিকে বর্গী সৈন্যের এক বৃহৎ দল তখন বিষ্ণুপুরের ৩২ মাইল পূর্বে গড় মান্দারণ লুঠ করে বর্তমান হাওড়া রোড ধরে কোতুলপুর, কুম্ভস্থল,জয়পুর প্রভৃতি গ্রাম ছারখার করে বিষ্ণুপুরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকেন। কুম্ভস্থল,জয়পুরের অধিনায়কেরা বাধা দিলে নির্মমভাবে তাদের হত্যা করে তারা নায়ক ভাস্কর পণ্ডিতের সঙ্গে যোগ দেয়, ফলে তাদের শক্তি আরো বৃদ্ধি হয়। আর এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কুম্ভস্থল জয়পুরের অধিনায়কেরা। সংবাদ পৌঁছায় বিষ্ণুপুর রাজদরবারে।কিন্তু ধর্মীয় ভাবনায় আত্মনিবেদিত রাজা গোপালসিংহদেবকে জানালে তিনি কোন প্রতিকারের চেষ্টা করেননি। যুবরাজ কৃষ্ণসিংহদেব কুমার গোবিন্দসিংহদেবকে সঙ্গে নিয়ে পিতার অজ্ঞাতসারে সামরিক শক্তিকে যথাসম্ভব শক্তিশালী করে তোলার চেষ্টা করেন। মায়ের আদেশ মতো কিছু সৈন্য গড় রক্ষার জন্য রেখে অবশিষ্ট বাহিনী নিয়ে চলে যান মুণ্ডমালা ঘাটে।চতুর ভাস্কর পণ্ডিত কাউকে জানতে না দিয়ে পরিখা কেটে এগিয়ে যেতে থাকে, ফলে কামান ও গোলাগুলির আঘাত তাদের মাথার উপর দিয়ে পার হয়ে যায়। সকলে সংবাদ দেয় গোপালসিংহদেবকে কিন্তু রাজা তাঁর ভক্তি নিষ্ঠায় অবিচলিত থাকে। সকলকে নির্দেশ দেন মদনমোহনের হাতে সমর্পিত রাজ্য রক্ষা করার হ'লে তিনিই করবেন। একদিকে রাজ আজ্ঞা আর অপরদিকে বর্গীদের আতঙ্ক সমস্ত বিষ্ণুপুর বাসীকে জাগিয়ে দেয়। মানুষ মদনমোহন দেবের প্রার্থনায় পথে বের হয়ে যান তাঁর নাম সংকীর্তনে বিষ্ণুপুরের আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে পড়ে নেমে আসে ভক্তিরসের ফল্গুধারা। মারাঠাদের কর্ণকুহরেও সেই গুরুগম্ভীর ধ্বনি প্রবেশ করে। তাদের মধ্যেও একটা ত্রাসের সঞ্চার হয় ভাবে দেবতা রক্ষিত গড় বুঝি অজেয়। সারা দিনরাত চলতে থাকে প্রভুর নামসংকীর্তন।
কুলদেবতা মদনমোহনের দলমাদলের অমর কাহিনীঃ
কিংবদন্তীতে প্রকাশ- শেষরাতে বিষ্ণুপুরের আকশবাতাস বিকম্পিত করে গর্জে উঠে ভয়াল দলমর্দন। প্রচণ্ড গর্জনে আলোড়িত দিগ্বিদিক। বহুঘর বাড়ি ভূমিসাৎ। ওদিকে অসংখ্য বর্গী হতাহত। অবসম্ভাবী মৃত্যুভয়ে বর্গীরা দ্বারকেশ্বর পার হয়ে চলে যায়। বাকী অংশ ভাস্কর পণ্ডিত সহ পলায়ন করেন বিষ্ণুপুরের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত হেঁড়ে পর্বতের জঙ্গলের পথে।এদিকে সংকীর্তনকারী রাজা ও তার দল হঠাৎ সেই ভীষণ শব্দে চমকে উঠেন। গোপালসিংহ তলব করেন তাঁর গোলন্দাজ সেনাদের, জানতে চান কে অগ্নি সংযোগ করলে দলমর্দন কামানে। এক গোলন্দাজ করজোড়ে বলেন মহারাজ উত্তরগড় মুণ্ডমালা ঘাটের পরিখা পাহাড়ের উপর আমি ছিলাম,আপনার নির্দেশমতো আমি সমস্ত রাত মদনমোহনকে ডেকেছি আর বর্গীদের গতিবিধি লক্ষ্য করে গিয়েছি। রাত্রিশেষে যখন বর্গীরা প্রায় গড়ের কাছে এসে গেছে তখন দেখি একটি সাদা ঘোড়ায় চড়ে নীল পোষাক পরা একটি প্রায় বছর বারোর ছেলে সেইদিকে উর্ধশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে। সুন্দর গন্ধে বাতাস ভরে উঠেছে চারিদিক আলোকিত তার অঙ্গজ্যোতিতে, হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে আমি পড়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরলে দেখি বর্গীদের প্রাণ নিয়ে পলায়নের হুড়োহুড়ি। তারপর শত খুঁজেও তাকে আর দেখতে পেলাম না।
মদনমোহনের প্রতি রাজভক্তিঃ
মহারাজ রোমাঞ্চিত হয়ে বলেন কী করে পাবি তাঁকে? ভক্তের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি তাঁর কাজ করে চলে গেছেন।ওরে চল চল সব মন্দিরে যাই। কিন্তু মন্দিরে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এক গোয়ালা।করজোড়ে বলেন প্রভু আপনার আদেশ মতো আমি মদনমোহনের জন্য দই নিয়ে আসছিলাম এমন সময় নীল পোষাক পরা বছর বারোর একটি ছেলে হঠাৎ এসে বলে বর্গীদের সাথে লড়াই করে খুব ক্লান্ত। পিপাসায় ভেতর শুকিয়ে যাচ্ছে। আমাকে কিছু দই দাও, খেয়ে তৃষ্ণা মেটাই। দেখলাম সারা অঙ্গে বারুদ।এক নিঃশ্বাসে দই খেয়ে যাবার সময় দাম না দিয়ে একগাছি সোনার বালা দিয়ে বললেন বাবাকে এটা দেখালেই তোমার সব দোষ মাফ করে দেবেন। এই শুনে সকলে তার নামসংকীর্তন করতে করতে মন্দির গিয়ে দেখেন, রত্নবেদীতে দুগ্ধফেননিভ শয্যায় শ্রীমতী শায়িতা নীচে দণ্ডায়মান অবস্থায় মদনমোহন। একহাতে নেই স্বর্ণবলয়.......।এটাই হল তৎকালীন সময়ের ঘটনা। এর সত্যাসত্য বিচার বা বিশ্বাস অবিশ্বাসের বিষয়টা আলাদা আঙ্গিক। এই দলমাদল কামান মূলত দলমর্দন এর অপভ্রংশ। এখানে দল শব্দের অর্থ শত্রু আর মর্দন শব্দের অর্থ দমন। শোনা যায়, ১৭৪২ সালে মদনমোহন নিজের হাতে এই কামানের সাহায্যে বর্গীদের নিধন করার পড় এই কামানের এরূপ নামকরণ। এছাড়াও বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের অনেক কামান ছিল, যার বেশীরভাগ ব্রিটিশ শাসনকালে সরিয়ে ফেলে। তবে সবথেকে এই কামানটি ছিল সবথেকে বড় ও ভারী। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার বিষ্ণুপুরের পর্যটনবিকাশে একটা বেদির উপর স্থাপন করে সাধারনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। ৬৩ টি লোহার আংটা পেটাই করে এটি তৈরি করা হয়। এর দৈর্ঘ্য ৩.৮ মিটার, ব্যাস প্রায় ২৯.২ সেমি। এর ওজন প্রায় ১১২ ক্যুইন্টাল। বর্তমানে ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগের অধীনে এর রক্ষনাবেক্ষন হয়ে আসছে। প্রায় ৩০০ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও রোদ ঝড় বৃষ্টিতে এই কামানের কোনরূপ বিকৃতি লক্ষ্য করা যায় নি। এই কামান মদনমোহন ব্যবহার করেছিলেন বর্গীনেতা ভাস্কর পণ্ডিতের উপর।
বিষ্ণুপুরের মদনমোহন মন্দিরঃ
এবার আমরা দেখে নেব, কে এই মদনমোহন আর তাঁর অবস্থান কোথায়? বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ দুর্জন সিংহ ১৬৯৪ সালে এই একরত্ন ইটের মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিন শতাধিক বছরের এই পুরানো মন্দিরের গাত্রে নিচের দিকে বিভিন্ন পশুপাখি, ভগবান কৃষ্ণের লীলা, দশাবতার ও অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনী পোড়ামাটির ভাস্কর্যে রুপায়িত করা আছে। আর উপরের দিকে আছে যুদ্ধের বিভিন্ন দৃশ্য। মন্দিরের গর্ভগৃহে ড্রাগনসদৃশ পৌরাণিক ভাস্কর্য নির্মাণ লক্ষ্য করা হয়েছে। এখানেই আছেন আমাদের আলোচ্য মদনমোহন ঠাকুর। তাঁর নিত্যসেবা, রাস, দোল ও নামযজ্ঞ আজও হয়ে চলেছে। বিষ্ণুপুরের মদনমোহন মন্দির আর কলকাতার বাগবাজারের মদনমোহন মন্দিরের মদনমোহন একই। বিষ্ণুপুরের মদনমোহন মন্দিরটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ সংস্থা কর্তৃক রক্ষনাবেক্ষন হলেও বাগবাজারের স্মৃতিবিজড়িত সমসাময়িক মন্দিরটি বড়ই অনাদরে পড়ে আছে। তাই এই জাগ্রত মদনমোহন কিভাবে কলকাতার সঙ্গে বাঁকুড়ার যোগসূত্র তৈরি করল সেটাই জানব।
উত্তর কলকাতার বিখ্যাত বাগবাজার ঘাট এর বামদিকে একটু এগিয়ে গেলে প্রায় এক বিঘা জমির উপর স্থিত সুপ্রাচীন গোকুল মিত্রের বাড়ি ও সেই পৌরাণিক স্মৃতি বিজড়িত মদনমোহন মন্দির। পুরান মতে, এই গোকুল মিত্র পূর্ব জন্মে বাঁকুড়ার বনবিষ্ণুপুরের কেশব গোয়ালা ছিল। তার সেবায় প্রীত হয়ে ইহজন্মে ভগবান মদনমোহন বাঁকুড়ার বনবিষ্ণুপুর থেকে এসে গোকুল মিত্রের কাছে ধরা দেন এবং তার মেয়ে লক্ষ্মীপ্রিয়াকে উদ্ধার করেন। এই লক্ষ্মীপ্রিয়া নামে লক্ষ্মী হলেও নাকি দেহে মনে সমস্ত অলক্ষ্মীর ছাপ আর কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্থ। মদনমোহন নিজেই তার কাছে গিয়ে তার অঙ্গ স্পর্শ করে তাঁকে কৃপা করেন। প্রমান স্বরূপ মদন মোহনের চুড়া বাঁশি বাগানের বাড়িতে লক্ষ্মীপ্রিয়ার কাছে রেখে অন্তর্ধান হয়েছিলেন। এই হল সেই লক্ষ্মীপ্রিয়া যিনি পূর্বজন্মে সত্যবতী নামে পরিচিত ছিলেন।
বাগবাজারের মদনমোহন মন্দিরঃ
রবীন্দ্র সরণি ও মদন মোহন তলা স্ট্রিটের সংযোগ স্থলে অবস্থিত এই বাড়িটি ১৭৩০ সালে তৈরি। এই বাড়িটি ছিল গোকুল মিত্রের, যিনি ১৭৮৪ সালে লটারির মাধ্যমে চাঁদনি চক বাজারের স্বত্ব পেয়েছিলেন। এই বাড়িতে পরবর্তীকালে ১৭৬১ সালে গোকুল মিত্র এই মদন মোহনের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন, সামনেই আছে একটি ঠাকুর দালান, যার স্তম্ভগুলি দোতলার উচ্চতার সমান। গোকুলচন্দ্র তাঁর বাড়ির দোতলায় নতুন কুলদেবতার জন্য মন্দির তৈরি করলেন। এক তলায় তৈরি হল ঠাকুরদালান, বাড়ির পাশে আলাদা রাসমঞ্চ, দোল, ঝুলন, জন্মাষ্টমী, রাস প্রভৃতি অনুষ্ঠানে মদনমোহন ও রাধিকার বিগ্রহ ওই দালান-রাসমঞ্চে এনে বসানোর জন্য। গোকুল মিত্রের সেই ঠাকুরদালান আজও আছে। দোল, রাস উৎসব হয় সেখানে। জনশ্রুতি, আর্থিক সমস্যায় পড়ে বিষ্ণুপুরের রাজা গোপাল সিংহ মদনমোহনের মূর্তিটি গোকুল মিত্রের কাছে বন্ধক রেখেছিলেন।
মদনমোহন বিগ্রহ বিভ্রাট ও কিংবদন্তীঃ
গোকুলচন্দ্র মিত্রের আদি বাড়ি ছিল বালিতে। তিনি বর্গি হামলার সময়ে কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেন। লবণ ব্যবসায়ী গোকুলচন্দ্র প্রচুর টাকা রোজগার করেন। ও দিকে ওই বর্গিদের হামলাতেই ক্ষতিগ্রস্ত বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ জমিদারি রক্ষা করতে এক বিশাল অঙ্কের টাকা ধার নেন গোকুলচন্দ্রের কাছ থেকে। পরিবর্তে বন্ধক রাখেন কুলদেবতা মদনমোহনকে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, ওই বিগ্রহ ছিল রাজবংশের সৌভাগ্যের প্রতীক। তাই অবস্থার ফেরে বন্ধক দিলেও চৈতন্য সিংহ টাকা শোধ দিয়ে কুলদেবতাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসেন। এ দিকে ঘটনাচক্রে মদনমোহন ঘরে আসার পর থেকে গোকুলচন্দ্রের অবস্থারও উন্নতি হতে থাকে। ধর্মীয় সংস্কারবশে তিনি বিগ্রহ ফেরত দিতে রাজি হলেন না। ঘটনা গড়াল আদালত পর্যন্ত।
ইতোমধ্যে চতুর গোকুলচন্দ্র আরও একটি বিগ্রহ তৈরি করিয়ে রাখেন এবং বিচারের সময়ে চৈতন্য সিংহকে আসল মদনমোহন বিগ্রহ চিনে নিতে বলা হল। হুবহু এক রকম দেখতে হলেও দু’টি বিগ্রহের মধ্যে থেকে আসল বিগ্রহ বেছে বিষ্ণুপুরে নিয়ে গেলেন মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ। আর অন্যটি রইল গোকুল মিত্রের কাছে, মিত্র পরিবারের কুলদেবতা হয়ে। গোকুল মিত্র কান্নাকাটি করাতে মদনমোহন কথা দিলেন আমি বিষ্ণুপুরে গেলেও বছরে একদিন তোমার গৃহে আসবো তোমার হাতের সেবা নিতে। সেই থেকে প্রতিবছর কালীপূজার পরের দিন অন্নকূট উৎসব হয় এই বাগবাজারের মদনমোহন মন্দিরে। প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। এভাবেই বাঁকুড়ার মদনমোহন আর বাগবাজারের মদনমোহন মিলেমিশে একাকার হয়ে আজও বিদ্যমান। ইতিহাস অস্বীকার না করা গেলে মানুষের মনের এই বিশ্বাস অস্বীকার করার যুক্তি দেখি না। এই সকল তথ্য সংগ্রহে যে সকল গ্রন্থ, পত্রপত্রিকা, ওয়েবপেজ বা স্থানীয় মানুষজন সকলের কাছে বর্তমান প্রবন্ধের উপস্থাপক বিনীতভাবে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন।
গ্রন্থসুত্রঃ
জেলা লোকসংস্কৃতি পরিচয়গ্রন্থ -বাঁকুড়া, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
পশ্চিমবঙ্গের পূজা পার্বণ ও মেলা (৪র্থ খণ্ড) – অশোক মিত্র (সম্পাদিত)
বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি – অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্তবিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
বাঁকুড়া পরিক্রমা – আশুতোষ ভট্টাচার্য, বুক সিণ্ডিকেট, কলকাতা
বিষ্ণুপুরের অমরকাহিনী – ফকির নারায়ণ কর্মকার
মন্দির নগরী বিষ্ণুপুর – বিশ্বজিৎ ব্যানার্জি
Bengal District Gazetteers (Bankura District) – L.S.S. O’Malley, Govt of West Bengal, Kolkata, 1995
Temples of Bengal – Chitrolekha International Magazine on Art & design, Vol-2, No-1, 2012
রচনাকাল : ১৭/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।