সাগরদ্বীপের অতীত
আনুমানিক পঠন সময় : ১৮ মিনিট

লেখক : সনৎকুমার পুরকাইত
দেশ : India , শহর : ডায়মন্ডহারবার

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ৯৭ টি লেখনী ৪১ টি দেশ ব্যাপী ৩৮৪৯০ জন পড়েছেন।
ভূমিকাঃ
        ‘সব তীর্থ বারবার/গঙ্গাসাগর একবার’ এই প্রবাদ প্রবচন বাংলা ব্যাকরণ ছাড়িয়ে দেশ কাল পাত্রের সীমানাকে ছুঁয়ে ফেলেছে। কেউবা বলে পৌরাণিক দিক থেকে গঙ্গাসাগরের মাহাত্ম্য বিচার করে একথার প্রচলন আবার কেউ বা বলে তীর্থযাত্রীদের কষ্টের পরিমাণ মাথায় রেখে এই কথা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নামের মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে যে এখানে সাগর ও গঙ্গা অর্থাৎ নদীর সাথে সমুদ্রের মেলবন্ধনস্থল। একটি নদীর মোহনায় যেরকম অস্থিরতা থাকা স্বাভাবিক বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের কোন নদী যখন দক্ষিণ দিকের কোন সাগরে গিয়ে মেশে তার প্রাকৃতিক অস্থিরতা একটু বিচিত্র প্রকৃতির হয়ে থাকে। তাই আমরা যারা সমাজবিজ্ঞানের চর্চা করে থাকি তাঁদের কাছে অবশ্য ভৌগলিক প্রতিবন্ধকতাই প্রধান কারন বলে ধরে নেব। আসমুদ্র হিমাচল বিস্তৃত এই ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গার ভূপ্রকৃতি বিভিন্ন রকম। হিমালয়ের বন্ধুরতার সাথে সাথে দ্বীপাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব একটা সময় মানুষের প্রব্রজনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সভ্যতার বিকাশ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন এই ধারনার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। যে সাগরে সন্তান বিসর্জনের কথা আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতায় পেয়েছি, সেই গঙ্গাসাগরে বর্তমানে সেই প্রতিবন্ধকতাসমূহ অনেকাংশে হ্রাস করা গেছে। তাই এই প্রবাদ প্রবচন আজ ইতিহাসের পাতায় জায়গা পেয়েছে। গঙ্গাসাগরের পৌরাণিক পুণ্যগাথার কথা মাথায় রেখে মানুষ একবার নয়, এখন বারবার যাচ্ছে পুণ্যতোয়া গঙ্গাসাগরের কপিল মুনির সাধনস্থলে।

ভৌগোলিক অবস্থানঃ 
          ভারতের দক্ষিনে অবস্থিত এই সাগরদ্বীপ ভারতীয় সুন্দরবনের মধ্যে সব থেকে বড় দ্বীপ। এর ভৌগোলিক অবস্থান তথা অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাগত বিস্তার ২১°৩৭'২১'' উত্তর থেকে ২১°৫২'২৮'' উত্তর পর্যন্ত আর ৮৮°০২'১৭'' পূর্ব থেকে ৮৮°১০'২৫'' পূর্ব পর্যন্ত। এর উত্তর ও পশ্চিমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে হুগলী নদী বয়ে যায় আর পূর্বদিকে মুড়িগঙ্গা এবং দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। উত্তর দক্ষিনে এই দ্বীপের বিস্তৃতি প্রায় ৩০ কিমি দীর্ঘ এবং সাগরদ্বীপ মোট ১২ কিমি প্রশস্ত। সমুদ্র সমতল থেকে দ্বীপের গড় উচ্চতা ৬.৫ মিটার (১৯৮৩)। এই ভৌগোলিক স্থানের উপর জল, বায়ু, সমুদ্র বা জোয়ারি শক্তি সদাই কার্যকরী। যার ফলে সাগরদ্বীপের ভূগোল সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম আকার ধারন করেছে। কথিত আছে সাগরদ্বীপ একটা সময় নাকি ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত ছিল। কিন্তু ইতিহাস ঘেঁটে তার প্রমান কোথাও মেলে না। ১৭৭৬ সালের রেনেল ও ডুরির  মানচিত্রেও একটা নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন ছিল আবার যখন আদি গঙ্গা তার পুরানো পথে প্রবাহিত হত তখনও এই স্থান নদীদ্বারা পৃথক ছিল। বিশিষ্ট উপকূলীয় ভূমিরূপবিজ্ঞানী তথা বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. আশিস পালের কথায় সাগরদ্বীপের অবস্থান বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে এই দ্বীপ কোনকালেই মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত ছিল না। তবে মূল ভূখণ্ডের সাথে তার দুরত্ব অনেক কম ছিল, সেটা বর্তমানে অনেকটাই বেড়েছে। তিনি এও বলেন যে, সাগরদ্বীপের সাথে ঘোড়ামারা দ্বীপের বা লোহাচরা দ্বীপের যোগসূত্র বিদ্যমান সেটা কখনো জলের উপরে আবার কখনো জলের কিছুটা নিচে পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে তারও পূর্বে মূল ভূখণ্ডের সাথে সাগরদ্বীপের কোন যোগসূত্র ছিল কিনা তার কোন প্রমান মেলে নি। কিন্তু শুভেন্দু জানা তাঁর সাগরদ্বীপের অতীত গ্রন্থে বলেছেন, ‘.......... বহুপূর্বে এটি মূল ভূখন্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ক্রমে তা বিচ্ছিন্ন হয়। কিন্তু ঠিক কবে এটি বিযুক্ত হয় তার কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। তবে মূল ভূ খন্ডের সঙ্গে যুক্ত যে ছিল তা রেনেল প্রমূখের মানচিত্রে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে’। কিন্তু পূর্বেই বলেছি রেনেলের আদি মানচিত্রে ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত এই ধরনের কোন যোগসূত্র পাই না। যাইহোক বর্তমান সাগরদ্বীপের অবস্থান সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক সময়ের ভাষ্য তথা খনার বচন ‘সব তীর্থ বারবার/গঙ্গাসাগর একবার’ কে সত্য প্রমান করে এবং সাগরদ্বীপ যে খুব সহজে মানুষ পৌঁছাতে পারতেন না তা একেবার অকাট্য সত্যি। 
   
প্রাচীনত্বঃ 
         পশ্চিমবঙ্গের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গের উন্মত্ততা আর পাগলা ঢেউয়ের খেয়ালী খেলাঘর সাগরদ্বীপ। প্রকৃতির এ খেলাঘর ঠিক কবে কখন উৎপত্তি হয়েছিল তার স্পষ্ট কোন তথ্য আজো উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি। এর নামকরণ নিয়েও রয়েছে নানা মত। তবে ইতিহাস পর্যালোচনা সাপেক্ষে ধারনা করা হয় যে, এ দ্বীপের বয়স প্রায় ৫৫০০-৬০০০ বছর। ভূমিভাগের বিবর্তনে সাগরদ্বীপের উদ্ভব এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাস্তবিক ক্ষেত্রে সাগরসঙ্গম এক বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূমিগত প্রকৃতিকে নির্দেশ করে। নদীপথে আগত জলস্রোতের নিম্নাভিমুখী সমুদ্রস্রোতে গঠিত এই দ্বীপটির ভূ-বৈচিত্র্য সাধিত হয়েছে গঙ্গানদী বাহিত পলিরাশি ও সমুদ্র তরঙ্গ বাহিত বালুকারাশির দ্বারা। বেঙ্গল ফ্যানের ওপর ভূমির পর্যালোচনা নির্দেশ করছে পূর্বে এই সাগরসঙ্গম অবস্থান করত রাজমহল পাহাড়ের পূর্বপ্রান্তে। গঙ্গার এই সঙ্গমে দ্রুতগতিতে অধিক পললায়ন-এর প্রভাবে এই নদী বারংবার শাখায়িত হতে থাকে এবং বদ্বীপভূমি সম্প্রসারিত হতে থাকে। ১৫৫০এর জাও দ্য ব্যারোসের বাঙলার ভূমি ও নদনদীর মানচিত্রে সাগরদ্বীপের অবস্থান দেখা যায়। এর পূর্ববর্তীকালীন মানচিত্রগুলিতে সাগরদ্বীপের অবস্থান বিশেষভাবে চোখে পড়েই না বর্তমানে সাগরদ্বীপের অবস্থানের স্থানে। আবার ১৭৭১ সালে রেনেল ডুরির মানচিত্রে সাগরদ্বীপের অবস্থান পরিষ্কারভাবে লক্ষনীয়। সমুদ্রসঙ্গমের এই অপূর্ব প্রকৃতিক শোভায় সূর্যাস্তের শোভামন্ডিত আলো আঁধারি খেলা যেন এক স্বপ্নিল আমেজ তৈরি করে। একদিকে সমুদ্রের চঞ্চলতা ও উদ্দামতা এবং অন্যদিকে শ্যামল বনানীর উচ্ছলতা সমগ্র পরিমন্ডলকে আপ্লুত করে। 

       প্রথমদিকে সাগরদ্বীপ কুল্পী থানার অন্তর্গত থাকলেও পরে কাকদ্বীপ থানার আয়ত্বে আসে। তারও পরে সাগরদ্বীপ নিজস্ব থানা পায় ঘোড়ামারায়। কিন্তু আরও সুবিধের জন্য থানা চলে আসে মুড়িগঙ্গায়। পরে এই মুড়িগঙ্গা থেকে থানা সরে আসে বর্তমান রুদ্রনগরের কাছে ক্ষুদিগুড়িয়ার পুলে। এই রুদ্রনগরকেই বর্তমান সাগরদ্বীপের রাজধানী বলা চলে। এখানেই ব্লক অফিস, পঞ্চায়েত সমিতি, সাগর গ্রামীন হাসপাতালের মূল কেন্দ্র, ব্লক কৃষি উন্নয়ন অফিস, এবং জমি নিবন্ধীকরণ কার্যালয় ও প্রধান পোস্ট অফিস। তবে এই স্থানের প্রাচীনত্ব নিয়ে আলোচনা করলে দেখতে পাই মেগাস্থিনীসের ইন্ডিকা গ্রন্থে প্রাপ্র তথ্য অনুযায়ী এ অঞ্চল গঙ্গারিডিদের ছিল। বহু বছর তাঁরা এখানেই রাজত্ব করেছিলেন। কেউ কেউ সাগরদ্বীপকে গঙ্গারিডির রাজধানীও বলতে চান। গবেষক দেবেশ দাস তাঁর ‘বঙ্গ সংস্কৃতির সীমানা’য় এই অঞ্চলকে প্রাসী ও গঙ্গারিডির আধিপত্য বা রাজ্য বলে দাবী করেন। খ্রীস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে এ স্থান যে গঙ্গারিডির ছিল তার প্রমাণ আমরা ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘আইন-ই-আকবরীতে’ও পাই। তাছাড়া সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোর খুলনার ইতিহাস’এ একে গঙ্গারীডিদের এলাকা বলে স্বীকার করেছেন। এবং তার প্রমানও দিয়েছেন তিনি বিভিন্নভাবে। যদিও নিখিল রায়ের গবেষনায় সাগরদ্বীপ ছিল প্রতাপাদিত্যের রাজধানী। সতীশ চন্দ্র মিত্র তা স্বীকার করেন না। তাঁর মতে নৌ বাণিজ্য কেন্দ্র বা প্রধান ঘাঁটি ছিল, রাজধানী কখনোই নয়। যাইহোক, সাগরদ্বীপের গুরুত্ব নিয়ে মতান্তর থাকলেও তাঁর প্রাচীনত্ব নিয়ে সবাই সহমত পোষণ করেছেন। 
  
ইতিহাসের পাতায় সাগরের অবস্থানঃ
        ভারতের সর্বযুগের সর্বশ্রষ্ঠ লেখক কালিদাস, অতীতের শ্বেতদ্বীপ আজকের গঙ্গাসাগরের প্রকৃতিকে প্রণাম জানিয়েছেন শ্লোকের মাধ্যমে। সামনে আদিগন্ত সমুদ্র, পশ্চাদপটে শ্যামল বনানী আর বালুকাময় বেলাভূমি আর মহর্ষি কপিলের মন্দির বাঙলার অন্যতম প্রধান তীর্থ-পর্যটন কেন্দ্র। সুন্দরবনের অন্যান্য অঞ্চলের মতই একদা সাগরদ্বীপ ছিল সমৃদ্ধতম জনপদ। ১৬৮৮এর সুনামিতে সাগরদ্বীপের প্রায় দু’লক্ষ মানুষ ভেসে যায় এবং দ্বীপটি শ্রীহীন হয়ে পড়ে। ইওরোপিয়রা বাংলা বাণিজ্যের শুরুতেই নজর দেয় এই দ্বীপে। ব্রিটিশার জেমস প্রাইসের লেখায় পাই গঙ্গাসাগরের উল্লেখ। ১৬৮৩তে হেজেস এখানে একটি হিন্দুমন্দির দেখেছেন। এখানকার রাজা নাকি বছরে দু’লাখ টাকা তীর্থকর আদায় করতেন। লুইল্লিয়ার নামে আর এক ইওরোপিয় সাগরদ্বীপে দুই সাধুকে দেখেছিলেন। ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে আলেকজাণ্ডার হ্যামিলটনের সময় পুরোনো স্মৃতি খুঁড়ে সাগরদ্বীপ ভারততীর্থের অন্যতম পবিত্র তীর্থস্থান হয়ে ওঠে। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দের ‘সমাচার দর্পন’ এ সাগরদ্বীপের কথা পাওয়া গেছে যেমন, তেমন আবার সংবাদে প্রকাশ ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র চার আনা খাজনায় সাগরদ্বীপের ইজারা দেওয়া হয়। ১৮৩৩ ও ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের সাইক্লোন সাগরদ্বীপকে তছনছ করে দেয়। শুধুমাত্র ১৮৬৪-র ঝড়ে পাঁচ হাজার জনের মৃত্যু হয়। মেগাস্থিনিস, হিউয়েন সাঙের বিবরণেও গঙ্গাসাগর স্থান পেয়েছে। বঙ্কিম সাহিত্যে অজর অমর এক চরিত্র নবকুমার গঙ্গাসাগর থেকে ফেরার পথে কপালকুণ্ডলাকে অর্জন করে। রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতায় সাগরসঙ্গমে সন্তান বিসর্জনের করুণ কাহিনী তো সকলেরই জানা। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ওয়েলেসলি এসে দেখলেন, ওই বছরেই তেইশটি শিশু সন্তান বিসর্জনের ঘটনা ঘটেছে। আইন করে এই প্রথা নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু পুরনো প্রথা স্মরণে আজও কখনও চোখে পড়ে প্রথম সন্তানকে সাগরজলে বিসর্জন দিয়েই তুলে নিচ্ছেন কোনও মা।

        খ্রীস্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীর পর পর সাগরদ্বীপে মানব সভ্যতার কোন অস্তিত্ব বলতে প্রতাপাফিত্যের আমল। অর্থাৎ সময়ের বিচারে যা খ্রিস্টীয় ১৬শ-১৭শ শতাব্দী। অনেকে এর মাঝের সময় কালপর্বে সাগরদ্বীপকে জঙ্গলময় অঞ্চল হিসেবে মনে করেন। কিন্তু পরবর্তীকালের সতীশচন্দ্র মিত্র, নরোত্তম হালদার, প্রভাত কুমার ঘোষ, সুকুমার সেন প্রমুখ গবেষকগণ খ্রিস্টিয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়েও সাগরদ্বীপের মানব সভ্যতার অস্তিত্বের কথা প্রমাণ করেন। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মন্দিরতলা, ধবলাট, বিশালাক্ষীপুরের কাছাকাছি অঞ্চলে এমন বহু প্রত্ন সামগ্রীর সন্ধান পাওয়া গেছে যেগুলি পরীক্ষা করে দেখা গেছে তা পাল ও সেন যুগের। যা সময়ের নিরিখে তা খ্রিস্টিয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীর। অতএব গবেষকদের অনুমান যে মিথ্যে নয় তার প্রমাণ সেইসব প্রত্নসামগ্রীগুলি।

        শুধু তাই নয়, সাগরদ্বীপের প্রাচীনত্ব বুঝতে বা বোঝাতে গেলে কেবল ইতিহাসের পাতাতেই নয়, মৎস্য, বায়ু এবং পদ্মপুরাণ এর মত হাজার হাজার বছরের প্রাচীন শাস্ত্র বা মহাকাব্যে সাগরতীর্থ সম্পর্কে উল্লেখ আছে। কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ এবং কয়েকটি মঙ্গলকাব্যেও ছড়িয়ে আছে গঙ্গাসাগর প্রসঙ্গ। ‘মহাভারত’-এর বনপর্বে দেখা যায়, স্বয়ং যুধিষ্ঠির সাগরসঙ্গমে এসেছিলেন। গঙ্গাসাগরের পুরাণ বর্ণনা আদতে, রাজা সগরের নাতি ভগীরথের ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ওঠার কাহিনী, বা সাগরের সঙ্গমস্থল কিভাবে পরিণত হল তীর্থক্ষেত্র গঙ্গাসাগরে বা পরবর্তীকালে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হল কপিলমুনি আশ্রম সেসকল বিষয় এখানে আলোচ্য নহে।

       খ্রিস্টিয় ৪৩৭ অব্দে সাগরে একটি প্রচীন মন্দিরের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। কিন্তু নদীর পথ পরিবর্তনের ফলে সে মন্দির সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এর পরেও দু’বার মন্দির নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সমুদ্রগ্রাসে কোনওটাই স্থায়ী হয়নি। বর্তমান মন্দিরটি আদি মন্দির স্থল থেকে প্রায় দুই কিমি দূরে অবস্থিত। ১৩৮০-৮১ (ইং ১৯৭৩-৭৪) বঙ্গাব্দে লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে তৈরি করান অযোধ্যার হনুমানগড়ি মঠের মোহন্ত রামদাসজি মহারাজ। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে উইলসন সাহেবের বর্ণনানুযায়ী মন্দির চত্বরে ছিল প্রকাণ্ড এক বটবৃক্ষ, যার পাদদেশেই ছিল শ্রীরাম ও হনুমানের মূর্তি। সে মন্দির বর্তমানে নেই। বলা ভালো সেই স্থান আজ সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মন্দির পিছনে সরতে সরতে বর্তমান মন্দিরটি সপ্তম মন্দির (মতান্তরে অষ্টম মন্দির)। 

          প্রায় দু’হাজার বছর আগে (মধ্যযুগে) এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর সুন্দরবন সৃষ্ট হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের দাবি। সেই সাথে সাথে সাগরদ্বীপ সহ বিভিন্ন দ্বীপের বিকাশ ঘটে। তবে এক সময় এই অঞ্চল ছিল সমুদ্র গর্ভে। ভূমিকম্পের পর উত্থান ঘটেছে। অতীতেও সুন্দরবনের জঙ্গল ও তার আশপাশে জনবসতি ছিল। দুই ২৪পরগনা এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পাওয়া প্রত্নত্তত্ব থেকে জৈন ও বৌদ্ধবিহার, বৌদ্ধমুদ্রা, ভগ্নমঠ, স্তূপের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। মিলেছে কুষাণ, পাল, সেন, গুপ্ত, শুঙ্গ, মৌর্য যুগের নিদর্শন। বিজয় সেন, লক্ষণ সেন, পাঠান ও মোগল, বারোভূঁইয়া, ইংরাজরা শাসন করেছে সুন্দরবন। পরে সম্রাট আকবরের সুবেদার শায়েস্তা খাঁ’র আমলে আরাকান দেশ থেকে এসে পর্তুগীজ (১৬২৮-১৬৩৩) ও মগ (১৭১৮-১৮০০) জলদস্যুরা এই বনবাসীদের উপর অত্যাচার করেছে। সীমাহীন অত্যাচারে এক সময় জনশূন্য হয়ে পড়ে ছিল সুন্দরবন। আবার বারবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও ধ্বংস হয় এখানকার জনপদ। পরবর্তী সময়ে ইংরেজরা সুন্দরবনে রাজত্ব শুরু করলে (১৭৫৭) পুনরায় নতুন করে জনবসতি গড়ে ওঠে। প্রথমদিকে সুন্দরবনের কোনও সীমানা ছিল না। পরে ইউরোপীয়রা বন কেটে চাষযোগ্য করে স্থানীয় জমিদারদের মধ্যে ইজারা দিতে থাকে। ১৬৫৭ সালে শাহসুজা এই বনাঞ্চল থেকে রাজস্ব সংগ্রহের জন্য সরকারের অধীনে আনেন। ঊইলিয়ম ড্যাম্পিয়র ও লে হজেস এবং যশোরের তৎকালীন জজ ও কালেক্টর টীলম্যান হেঙ্কেল উদ্যোগী হয়ে সুন্দরবনের জমি জরিপ করে সীমানা নির্ধারণ করেন (১৮৩০-১৮৮৩)। ১৭৬৪ তে তৈরী হয় সমগ্র সুন্দরবন ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানচিত্র।

সাগরদ্বীপের ভূগোল ও পরিবেশগত অবক্ষয়ঃ  
        Indian Space Research Organization অর্থাৎ ISRO এর মতে ভারতীয় সুন্দরবনের জমি প্রতি বছর একটু একটু করে কমে যাচ্ছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী গত দশকে প্রায় ৩.৭১% শতাংশ অন্যান্য বনভুমির সাথে ম্যানগ্রোভ এবং প্রায় ৯,৯৯০ হেক্টর এলাকা ক্ষয়ের ফলে সমুদ্রে হারিয়ে গেছে। সুন্দরবনের ক্ষয় মানে সুন্দরবনের দ্বীপাঞ্চলের ক্ষয়সাধন। সাগরদ্বীপ বা ঘোড়ামারা দ্বীপ প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার বারে বারে হয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের School of Oceanographic Studies এর অধ্যাপক ড. তুহিন ঘোষের গবেষণায় দেখা গেছে যে সমুদ্রের সাথে গঙ্গার মিলনস্থলের এই দ্বীপগুলি তথা সাগর, ঘোড়ামারা, লোহাচরা, বেডফোরড দ্বীপ ইত্যাদি অঞ্চলগুলি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হচ্ছে বলা ভাল তাদের মূল আয়তনের হ্রাস ঘটছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে একটি পর্যবেক্ষণে দেখা যায় লোহাচরা, বেডফোরড দ্বীপ তাদের মূল অবস্থান থেকে সরে গিয়েছে। আর ঘোড়ামারা দ্বীপ নিজের জমি হারানো বা মানুষকে উদ্বাস্তু করাতে উল্লেখযোগ্য। এই দ্বীপ ১৯৭৫ সালে ৮.৫১ বর্গকিমি এলাকা থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১২ তে ৪.৪৩ কিমিতে পৌঁছায়। এই ভূমিরূপগত প্রাকৃতিক ক্ষয় পদ্ধতি থেকে সাগরদ্বীপও বাদ যায় না। অধ্যাপক ঘোষের মতে, ১৯৮০ সালে বাস্তুকারগণ হলদিয়া বন্দরকে পুনুরুজ্জীবিত করতে যে উদ্যোগ নেন তার ফলশ্রুতি হিসাবে জলতল বৃদ্ধি ও সাগরদ্বীপসহ সংলগ্ন দ্বীপাঞ্চলের ক্রমনিমজ্জনের ঘটনা ঘটছে। পরিবেশ বিজ্ঞানী সুভাষ দত্তের মতে,"There is unauthorized construction, there are illegal encroachments of brick kilns and shrimp farming, If we can't arrest these things then the pressure on the land will become even more adverse." 

         সাগরদ্বীপের উপকূলীয় ভুমি প্রাকৃতিক ক্ষয়ের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও মানবীয় কার্যকলাপ এর জন্য অনেকাংশেই দায়ী যদিও সময়ের নিরিখে তার পরিমাণ অনেকটা কম। সাগরদ্বীপের উপকুলভাগের প্রধান প্রধান ভূমিরূপ হল কর্দমাক্ত মাঠ, লবণাক্ত জলাভূমি, বালুকাময় বেলাভুমি, বালিয়াড়ি ও ম্যানগ্রোভ অরন্য। বিজ্ঞানী গিরিশ গোপীনাথ ও সেরালাথানের গবেষণায় দেখা গেছে ১৯৬৭ সালের ভুসংস্থানিক মানচিত্র ও ১৯৯৬-১৯৯৯ সালের স্যাটেলাইট চিত্র থেকে জানা গেছে সাগরদ্বীপের উপকূলীয় অবস্থান বা তাঁর দৈর্ঘ্য এবং সাগরদ্বীপের মোট আয়তনের মধ্যে প্রায় ২৯.৮ বর্গকিমি এলাকা হ্রাসের একটা সুস্পষ্ট প্রভেদ লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়াও আরও প্রায় ৬.০৩ বর্গকিমি এলাকা বিপদসঙ্কুল অবস্থায় আছে। শুধু ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত মাত্র দুই বছরে ১৩.৬৪ বর্গকিমি এলাকা সমুদ্রগর্ভে চলে যায়। আবার পরবর্তী এক বছরে অর্থাৎ ১৯৯৯ সালের শেষদিকে আরও ৩.২৬ বর্গকিমি এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়। দ্বীপের দক্ষিণপূর্ব, দক্ষিণপশ্চিম ও উত্তরপূর্ব দিকে বেশী ভীষণভাবে ক্ষয়প্রবন বলে চিহ্নিত করা গেছে। সাগরদ্বীপ অন্যান্য দ্বীপের ন্যায় প্রাথমিক লগ্নে নদীবাহিত পলি ও কাদা কনা সঞ্চিত হয়ে তৈরি হয় বলে ইহা সমুদ্রের জোয়ার ভাটা, ঝড়ঝঞ্ঝা বা সমুদ্রের স্রোতের মুখে এই দ্বীপ ক্ষয়প্রবন বলে আমরা জানি। পরিবেশের বিভিন্ন কারনে সমুদ্রের জলতল বৃদ্ধির জন্য সাগরদ্বীপের অধিকাংশ অঞ্চল সমুদ্রের জলে প্লাবিত হয়ে দ্বীপাঞ্চল ক্ষয় হতে থাকে সময়ের সাথে সাথে।
 
         জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে সভ্যতার উন্নত মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বজায় রাখতে বা তাঁদের প্রাথমিক চাহিদা পূরণ করতে মানুষ তাঁর করাল থাবা বসিয়েছে প্রকৃতির দুর্গম স্থান তথা পর্বত, মালভূমি বা দ্বীপাঞ্চল ও উপকুল অঞ্চল। সেই কারনে এই সকল দ্বীপাঞ্চলকে পরিবেশগত বা মানুষের কারনে যখন নানাভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তখন তা থেকে রক্ষা করতে আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষ এইসব অঞ্চলে সাধারণত নিজভুমি থেকে উৎখাত হয়ে এখানে বসতবাটি নির্মাণ, মাছের চাষ কিংবা অন্যান্য কৃষিকাজ করার জন্য দুর্গম দ্বীপাঞ্চলে আসতে থাকে। আমরা খোঁজ নিলেই দেখতে পাই, সমগ্র সাগরদ্বীপ জুড়ে মেদিনীপুর বা বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের বসবাস। তারা নানান কারনে বিভিন্ন সময়ে এইস্থানে এসে বসবাস শুরু করেন। দ্বীপটি ঊণবিংশ শতাব্দীর আধুনিক সভ্যতায় মেদিনীপুরের অন্তর্গত ছিল। মেদিনীপুরের রসুলপুরের দিয়ে এর যোগাযোগ রক্ষা হত। স্বাভাবিকভাবে মেদিনীপুরের মানুষদের সঙ্গে দ্বীপটির আর্থ-সামাজিক এক যোগাযোগ তৈরি হয়। বনজ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে জীবন ধারণের জন্য সেখানকার মানুষরা দ্বীপটিকে বারবার ব্যবহার করতে থাকে। প্রয়োজনে কেউ কেউ বসবাসও শুরু করে। ভোগলিক কারণে দেখা যায় দ্বীপটি নৈকট্যের বিচারে মেদিনীপুর অপেক্ষা দক্ষিণ ২৪ পরগনার অনেক কাছে। দূরত্বের কারণে মেদিণীপুর থেকে এর প্রশাসনিক কাজ কর্ম পরিচালনা করা খুব কঠিন। প্রশাসনিক এই অসুবিধের কথা মাথায় রেখে ইংরেজ আমলে ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৮০২ সালে একে দঃ ২৪ পরগণার আওতায় নিয়ে আসা হয়। প্রথমে এর মহকুমা ছিল ডায়মন্ড হারবার। বর্তমানে তা কাকদ্বীপ মহকুমার অন্তর্গত। যাইহোক, সাগরদ্বীপে জল, স্থল ও বায়ুমণ্ডলের ক্রমাগত প্রাকৃতিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে এই দ্বীপের উপকুল অঞ্চল গতিশীল হয়ে উঠেছে। এর উপকুলভাগ জোয়ারি শক্তির প্রভাবে প্রভাবিত। এই অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ অরন্য, খাঁড়ি বা কর্দমাক্ত জলাভুমিগুলি এই স্থানের প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝা তথা সাইক্লোন, সুনামি বা জোয়ার ভাটা ইত্যাদি ও বিভিন্ন মানবীয় কার্যকলাপের প্রভাবযুক্ত।  

         সাগরদ্বীপের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে অর্থাৎ বেগুয়াখালির কাছে সমুদ্র তরঙ্গের প্রভাবে সব থেকে বেশী ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। ইতোপূর্বে আমার আলোচনায় উঠে এসেছে যে তুলনামূলক গবেষণায় দেখা গেছে সাগরের বেশীরভাগ ভুমি ধ্বংস হয়েছে ষাটের দশক থেকে নব্বই এর দশকের মধ্যে। কিন্তু এর পাশাপাশি সঞ্চয়ের বিষয়টাও লক্ষনীয়। দ্বীপের দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে অনেকটা এলাকা জুড়ে বিভিন্ন সময়ে সঞ্চয়ের ফলে স্থল্ভাগের পরিমাণ বেড়েছে। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে এই দুবছরে প্রায় ০.৪৮ বর্গকিমি এলাকার উত্থান ঘটেছে। আবার পরের এক বছরে দেখা যায় প্রায় ০.০৮ বর্গকিমি বা ১৯৬৭-১৯৯৯ এই সময়কালে মোট প্রায় ৬.০৩ বর্গকিমি জমি প্রাপ্তি ঘটে সঞ্চয়ের কারনে। 

         গবেষক Colemann (1969) এর মতে সাগরদ্বীপ প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন পলি, কাদা বা বালুকাময় তটভূমি ও ম্যানগ্রোভের সমাহারে সাগরদ্বীপের নির্মাণ ঘটলেও এখানকার পলল পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে এই পলিতে বালির পরিমাণের থেকে কাদাকনার পরিমাণ অনেক বেশী। পশ্চিম উপকুলে বালির পরিমাণ বেশী হলেও পূর্ব উপকুলে পলির মাত্রা তুলনামূলক বেশী। প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন যে নদীবাহিত পললের মধ্যে বালি, পলি ও কাদা আনুপাতিক হারে অবস্থান করে। তাঁর গবেষণায় আরও প্রকাশ পায় যে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র মোহনায় যে পলি আসে তাতে ৭০% এর বেশী পলিকনা আর মাত্র ৩০% এর কাছাকাছি বালিকনা থাকে। যে মৃত্তিকায় বালির থেকে পলি কনা কম থাকে তা ক্ষয় প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশী হয়ে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে ভিন্ন উপাদানের অবস্থানের ফলে সাগরদ্বীপের উপকুলের ক্ষয়ের হারও ভিন্ন প্রকৃতির। 

        আবার বিজ্ঞানী Allison ও তাঁর সঙ্গীরা ২০০৩ সালে একটি গবেষণায় গবেষক Colemann এর সাথে সহমত পোষণ করেন। তিনি এই বদ্বীপ গঠনের পক্রিয়া গুলির উপর নির্ভর করে সাগরের উত্থানকে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করেন। অর্থাৎ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ক্রমান্বয়ে G1, G2,G3 ও G4 চারটি ভাগে ভাগ করেন এবং দ্বীপের প্রাথমিক গঠনকে G1 স্তর বলে অভিহিত করেন যা সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় ২৫০০-৫০০০ খৃষ্টপূর্বাব্দ সময়ে। তিনি বলেন যে সেই সময়ে বেশকিছু ছোট ছোট দ্বীপ তথা ধবলাট, বেগুয়াখালি, মুড়িগঙ্গা, কচুবেড়িয়া, বোটখালি, রামকৃষ্ণপুর, গভাচাহাক, শিকারপুর, হরিণবাড়ি, টাওয়ার আইল্যান্ডসহ নানান দ্বীপ একত্রিত হয়ে এই সাগরদ্বীপের সৃষ্টি হয়। এই দ্বীপগুলি বিভিন্ন জোয়ারের জলে পূর্ণ খাঁড়ি বা খাল তথা চেমাগুরি খাল, গঙ্গাসাগর খাল, সাতবাঁকি খাল, মুরিগঙ্গা খাল ইত্যাদি  দ্বারা পৃথক ছিল। আমরা পুরানো মানচিত্র অর্থাৎ ১৯০২ সালের মানচিত্রে এই ধরনের খালগুলির অবস্থান পায়। সেখানে চেমাগুরি খাল প্রায় দ্বীপটিকে আড়াআড়ি কেটে ১০ কিমি রাস্তা প্রবাহিত হয়েছে। বিজ্ঞানী Allison এর মতে দ্বীপের পশ্চিমদিক দ্বীপ গঠনের পরিণত অবস্থায় পৌঁছে গেছে। এইভাবে দেখা যায় সাগরদ্বীপের ইতিহাসে ভূমিরূপগত ভৌগোলিক পরিবর্তন এসেছে বিভিন্ন সময়ে। আমরা সাগরের উত্তর দিকের উপকুল ১৮৮১ সালের সাথে বর্তমানে মেলাতে গেলে বর্তমানে অনেক কিছুই খুঁজে পাই না বা অন্যভাবে পাই। কারন সমুদ্রবিজ্ঞানী জি. দাসের মতে ১৮৮১ সালের পূর্বে সাগরদ্বীপের সাথে ঘোড়ামারা, লোহাচরা, খাশিমারা বা সুপারিভাঙ্গা দ্বীপগুলি সুস্পষ্টভাবে যুক্ত থাকলেও তার পরে নানান প্রাকৃতিক বহিঃশক্তির কারনে এবং ১৯১৪ সালে পুরোপুরি এই দ্বীপ গুলি সাগরের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিজ্ঞানী Allison বলেন ঐতিহাসিক সময়কালে সাগরের বিভিন্ন উপকুল ক্ষয় পেয়ে ক্রমশ ছোট হওয়ার সাথে সাথে পশ্চিমাংশ ক্ষয় পেতে পেতে প্রায় ৩-৪ কিমি পিছিয়েছে। সাগরদ্বীপের প্রাকৃতিক ধ্বংশের পিছনে অন্যান্য শক্তির সাথে সাথে সাইক্লোন একটি বড় খলনায়কের ভুমিকা পালন করে কারন এর সাথে প্রচণ্ড বেগে বায়ুপ্রবাহ, বন্যা ও মুষলধারে বৃষ্টিপাত জড়িয়ে থাকে। Indian Meteorological Department তাঁদের প্রতিবেদনে জানায় যে ১৯২১-১৯৩০ এই দশ বছরে ৫৬ বার সাইক্লোন আছড়ে পড়েছে যখন ১৯৫১-১৯৬০ এর রিপোর্ট বলছে ৩২ বার সাইক্লোনে সাগর বিধ্বস্ত হয়েছে। সাগরের উপরে গবেষণারত বিজ্ঞানী Emery ও Aubrey (১৯৮৯) এর মতে বঙ্গোপসাগরের উত্তরাঞ্চলে সব থেকে বেশী ভুমিক্ষয় হয়েছে সাইক্লোনের কারনে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বরিষ্ঠ অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায় (২০০০) এর মতে ১৮৬০ থেকে মোট ভুমিভাগের প্রায় ৭১ বর্গকিমি ক্ষয় পেয়েছে যা সাগরদ্বীপের সমগ্র এলাকার একচতুর্থাংশ। Bakshi ও তাঁর সহকর্মীদের মতে সাগরদ্বীপে প্রতিবছর প্রায় ২.৬ মিমি  করে জলতল বৃদ্ধি পাচ্ছে যার কারন হিসাবে নিম্ন গাঙ্গেয় দ্বীপাঞ্চলের অবনমনকে অনেকাংশে দায়ী করা যায়। একই কথা Allison এর রিপোর্টে প্রকাশ পায়। তিনি বলেন সুন্দরবনের পশ্চিমাংশের বছরে ১-৪ মিমি করে সমুদ্র গর্ভে নিমজ্জন ঘটছে। কারন হিসাবে তিনি বলেন দ্বীপাঞ্চলের গৃহস্থালি বা শিল্পাঞ্চলের কাজে ভৌমজলের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলনের কারনে এই অবনমন।  ১৮৬৪ সালে এই দ্বীপের জনসংখ্যা ১৪৬৬ জন যা ৫.২ জন প্রতি বর্গকিমি। কিন্তু বর্তমানে এই হার ৯৩৫ জন পতি বর্গকিমি। এই জনবৃদ্ধি ও তাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা ঠেকাতে সমুদ্রের যে উপকূলীয় নিয়ন্ত্রন রেখা বা অঞ্চলে (Coastal Regulation Zone-CRZ) তারা প্রবেশ করছে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ তথা ম্যানগ্রোভ অরন্য, কর্দমাক্ত জলাভূমি বা বিস্তীর্ণ বালুকাময় বেলাভুমিসহ উপকুলীয় বাস্তুতন্ত্রের অবৈজ্ঞানিক ব্যবহারের ফলে ভুমির স্থিরতা নষ্ট করছে।  এর ফলে সাগরদ্বীপের ভবিষ্যৎ পরিবেশগত অস্থিরতার জন্য অপেক্ষমাণ। 

পরিবেশগত ব্যবস্থাপনাঃ 
          দক্ষিনের সাগরে ঘেরা এই সাগরদ্বীপের মানুষের ভবিষ্যতের সুনিশ্চিত জীবনযাত্রার জন্য বর্তমান পরিবেশগত বিপর্যয় রুখে দেওয়া আশু প্রয়োজন। আগামিদিনে মানুষকে উন্নত এবং নিরাপদ জীবনযাত্রার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হলে সাগরের উপকুল বরাবর যে ক্রমবর্ধমান ক্ষয়ের ফলে ভুমির অবনমন বা ভুমিহ্রাসের ঘটনা ঘটছে তা বন্ধ করতে হবে। উপকুল অঞ্চল বরাবর ম্যানগ্রোভের বিকাশ ঘটাতে হবে। সাধারন মানুষের বিচরণ নিয়ন্ত্রন করতে হবে যাতে করে প্রচুর পরিমাণে কাদা উত্তোলন বা বালি খননের অভ্যাস বা অসাধু ব্যবসা বন্ধ করা যায়। ভৌমজলের উত্তোলন বন্ধ করে পানীয় জলের আধুনিক সরবরাহ ব্যবস্থা আনা দরকার। সাগরের ভুমিপুত্র তথা এলাকার মানুষের মধ্যে এই সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নানান প্রচার সেমিনার বা আলোচনাসভা করতে হবে। মানুষকে এই উপকুলের ভালো মন্দ বা তার সুদুরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে বেশী করে ওয়াকিবহাল করতে হবে। নিজেদের প্রতিরোধ ওদের নিজেদের করতে হবে। পরিশেষে সাগরদ্বীপের এই ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া রুখে দিতে সরকারী উদ্যোগে  সকল প্রকার প্রস্তুতি নিতে হবে। যে সাগরদ্বীপ এত হাজার হাজার বছর ধরে সমগ্র জনজাতির ইতিহাস, রাজনীতি, ধর্ম বা প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী হয়ে আসছে তা অনিয়মে বা কিছু মানুষের অতিরিক্ত লোভানলে বা কিছু মানুষের অজ্ঞতার কারনে তা বিনাশের পথে চলে যাবে তা হয় না। সাগরদ্বীপ বা গঙ্গাসাগর আজ সারা ভারতবর্ষের আবেগের সাথে জড়িয়ে। গঙ্গোত্রী থেকে সাগর পর্যন্ত ভগীরথের যে প্রতিধ্বনি মানুষ শুনেছিল সেই প্রতিধ্বনি শুনতে শুনতে আজও হিমালয়ের পাদদেশ থেকে চলে আসে সাগরের বুকে ভেসে থাকা এক টুকরো পবত্র ভুমি। কালের করাল গ্রাসের হাত ধরে কপিল মুনি বা গঙ্গা মায়ের মন্দির হয়তো বেশ কয়েকবার সাগরের বক্ষদেশে মুখ লুকিয়েছে। তাতে কি আবার নতুন করে স্থান দিয়েছে সাগরদ্বীপ, নির্মাণ হয়েছে মন্দির, এসেছে ভক্তের দল। সরকারের এই দ্বীপ কে জড়িয়ে জাতীয়স্তরে সম্মান জড়িয়ে। তাই এই দ্বীপের আধুনিকীকরণের পাশাপাশি দ্বীপের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে এমনটা মনে হয় না।
 
গ্রন্থসুত্রঃ 
 আদিগঙ্গা ও বর্তমান গঙ্গার প্রেক্ষিতে সাগরদ্বীপ- নীলরতন মাইতি ও প্রসিত রায়চৌধুরী 
 আদিগঙ্গার তীরে- প্রসিত কুমার রায়চৌধুরী
 চব্বিশ পরগণা উত্তর-দক্ষিণ-সুন্দরবন- কমল চৌধুরী
 দক্ষিণ ২৪ পরগণা- আঞ্চলিক ইতিহাসের উপকরণ – কৃষ্ণকালী মণ্ডল
 দক্ষিণ ২৪ পরগণার আঞ্চলিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি- গোকুল চন্দ্র দাস
 পশ্চিমবঙ্গের পূজা পার্বণ ও মেলা- অশোক মিত্র 
 বাঙ্গালার ইতিহাস- রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
 বিশ শতকের সাগরদ্বীপ- ব্যোমকেশ মাইতি
 সাগরদ্বীপের অতীত- শুভেন্দু জানা 
 সাগরদ্বীপের অতীত- কৃষ্ণকালী মণ্ডল
 সুন্দরবনের ইতিহাস-কানাইলাল সরকার
 Coastal Geomorphology and Environment- Ashis Paul
 Historical Changes of Ganges-Brahmaputra Delta Front- MA Allison
 India-A Regional Geography-R.L. Singh
 Morphology of Sagar Island, a part of Ganga delta- AK Paul & MK Bandopadhya
 Rapid Erosion of the coast of Sagar Island, West Bengal-India-Girish Gopinath & P. Seralathan 

রচনাকাল : ১৭/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 1  Bangladesh : 9  Canada : 145  China : 12  France : 1  Germany : 1  Hungary : 2  India : 916  Ireland : 32  Japan : 1  
Philippines : 1  Romania : 2  Russian Federat : 19  Saudi Arabia : 3  Serbia : 1  Ukraine : 6  United Kingdom : 1  United States : 722  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 1  Bangladesh : 9  Canada : 145  China : 12  
France : 1  Germany : 1  Hungary : 2  India : 916  
Ireland : 32  Japan : 1  Philippines : 1  Romania : 2  
Russian Federat : 19  Saudi Arabia : 3  Serbia : 1  Ukraine : 6  
United Kingdom : 1  United States : 722  
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সাগরদ্বীপের অতীত by Sanat Kumar Purkait is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪২৪২২
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী