(এক)
আজ থেকে অনেক বছর আগেকার কথা, তা প্রায় ত্রিশ বছর আগে। যখন বয়সে আমি খুব ছোট হলেও মনে প্রাণে খুব ধনী ছিলাম। আমার চারপাশে কত ছেলেমেয়ে ঘুরে বেড়াতো। কারণ আমার কাছে নয় নয় করে তিন টাকা পঁয়ত্রিশ পয়সা তখন। প্রতিদিনের দশ- কুড়ি পয়সা জমিয়ে জমিয়ে একটু পসার হয়েছে না বলা ভালো বেশ পসার হয়েছে সেই আশির দশকের সাত আট বছরের বালকের। তখন তো কোনদিন দশ পয়সা তো কোনদিন কুড়ি পয়সা স্কুলে যাওয়ার আগে মিলতো, কোনসময় তাও জুটতো না।
(দুই)
আমার কাছে এখনও দেখা যাচ্ছে সেই পুরানো দিনের জমানো পয়সার মোট পরিমাণ দুই টাকা নব্বই পয়সা। আজ অনেকটা নষ্ট হতে বসেছে, কিন্তু এগুলো এখন পুরাতাত্ত্বিক উপাদান হতে চলেছে। আমাদের অনেকেই এগুলো ছোটবেলাতে একটা পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতাম স্বপ্ন কেনার জন্য। এখনকার মতো সাইকেল ছিল না, সাত মাইল মাটির রাস্তা হেঁটে তবে স্কুলে যাওয়া। সেখানে না ছিল আইসিডিএস, না মিড ডে মিল আর না চাল ডাল আলুর পসরা। তবে হ্যাঁ আমরা যখন ক্লাস ফোরে উঠলাম স্কুলে স্কুলে রুটি দেওয়া শুরু হল। বড় বড় এক আউন্স রুটি। হেডমাস্টার মশাই ছিলেন গনেশ বাবু। তিনিই ঠিক করলেন আমাদের ক্লাস ফোরের ফার্স্ট বয় অর্থাৎ আমার সহপাঠী অভিনন্দন (নাম পরিবর্তিত) রুটি কাটবে আর সেকেণ্ড বয় হিসাবে আমি রুটি বিতরণের দায়িত্বে থাকবো। বিনিময়ে কখনো ভাগে সাধারণের তুলনায় দ্বিগুন বা তিনগুন রুটি আমাদের পাওনা। তখনকার প্রাথমিক স্কুল আমাদের কাছে ছিল মন্দির। মাস্টারমশাইরা ছিলেন দেবতা। রুটি বিতরণের মাঝে পড়াশোনা কোনভাবেই বিঘ্ন ঘটতো না। দারুণ মজার দিন ছিল। অভাব ছিল, কিন্তু তা আনন্দের নয়।
(তিন)
আমাদেরকে রুটি দেওয়া যেদিন থেকে শুরু হল বাড়ি থেকে পয়সা দেওয়াটাও অনিয়মিত হয়ে গেল বা কমে দশ পয়সাতে ঠেকল। পান্তাভাত খেয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে হাঁটা। তখন আমাদের গ্রাম থেকে একসাথে এক ক্লাসে ঐ দূরের স্কুলে যেতাম আটজন, যার মধ্যে তিনজন মেয়ে। গ্রামেও স্কুল ছিল, কিন্তু সতর্ক অভিভাবক ভরসা করতেন না। তা সেই আটজনের মধ্যে একজন স্বঘোষিত দলনেতা ছিল যার নেতৃত্বে সকলের পয়সা জমা করতে হত। তারপর স্কুল শুরুর পূর্বে সে মুড়ি চানাচুর কিনে আনলে আমরা সবাই মুঠো মুঠো করে শেয়ার করতাম। কেউ বেশি নিলে দলনেতার গালাগাল ছিল যেমন, তেমন দলনেতা কোন কোনদিন পয়সা ইনভেস্ট না করেই রসদ নিত। ব্যস, স্কুলের ক্লাস শুরুর আগে আমাদের টিফিনের পয়সা খতম। এবার ভরসা সেই রুটি আর জল।
(চার)
স্কুলবাড়ি একেবারে কাঁচা মাটির ছিল, তারপর আস্তে আস্তে ইটের দালান হয়েছে, বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল আরও কত কি। আমরা তখন বাড়ি থেকে আসন নিয়ে যেতাম। গনেশবাবুর প্রচেষ্টায় প্রথম ক্লাস ফোরের ছাত্রদের জন্য বেঞ্চের ব্যবস্থা হল। ক্লাস ওয়ান বা ইনফ্যান্ট লেভেলের বাচ্চাগুলো ভাবতো আমরা মহাপুরুষের দল, তাই আমাদের স্থান উপরে হয়েছে, ওরা মেনেও নিয়েছিল। মাঝেমাঝে দেবদর্শনের ন্যায় উঁকি দিত। ওরা একেবারে উল্টোদিকের কোনে বসতো। একটা হলঘরে চারটে ক্লাস পাশাপাশি চলতো, কোন দেওয়াল বা পার্টিশন ছিল না। বাইরে বসতো শিশু শ্রেণির ফুলকুঁড়ির দল। দ্বিতীয় শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা করুণ দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালেও তৃতীয় শ্রেণির পাজিগুলো সুযোগ পেলেই একটু করে বেঞ্চে বসে স্বর্গ সুখ অনুভব করতো। শুধু বেঞ্চে বসার জন্য অনেকেই ভালো করে পড়াশুনা করতো।
(পাঁচ)
যাইহোক, শুরুতেই যেহেতু মুলধন শেষ, তাই পরিকল্পনা করতে হবে টিফিনে কি করণীয়। দলনেতার নির্দেশে টিফিনে আমরা কাছেপিঠে ফলের গাছ, বিশেষ করে ঋতুভিত্তিক যে ফল পাওয়া যায় যথা তেঁতুল, আম, জাম, আঁশ, বেল, কয়েতবেল, ডেবো, জামরুল ইত্যাদি। তপ্ত দুপুরে যখন সবাই নিশ্চিন্ত ঘুমে আচ্ছন্ন তখন শুরু হতো আমাদের অভিযান। বাড়ি থেকে নুন কাগজে মুড়ে নিয়ে যাওয়া হতো ভিটামিন-সি'র সাথে যুদ্ধ করতে। অনেক সময় ধরাও পড়েছিলাম আম চুরি করতে গিয়ে। এখন সেইসব লোক আমাদেরকে যখন আপনি সম্বোধন করে, মনে পড়ে যায় সেইসব পাগালামির দিনগুলো। সবথেকে বেশি উদরস্থ করেছিলাম কাঁচা বা পাকা তেঁতুল। এখনও মনে হয় তার মাতাল করা গন্ধ অনুভব করি।
(ছয়)
ক্লাস চলাকালীন পাঠগ্রহন আর পরবর্তী পরিকল্পনার মাঝে খিদে বিষয়টা কেমন একটা বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্কুল শেষে যখন ফিরতাম মাঠের রাস্তা ধরে, হাতে থাকতো একটা করে বাঁশের কঞ্চি। মাঠে চাষ করা রাঙা আলু খুঁচিয়ে তুলে খেতে হবে যে। মাঝেমাঝে পেট ব্যাথা করতো এই রাঙা আলুর দৌলতে। এছাড়াও মটরশুঁটি বা মুগ, মুসুর সব লুট হতো নিয়ম করে। ফেরার পথে একজায়গায় ছিল একটা আখ বাগিচা। সেখানে মাঝে মাঝে অতি সন্তর্পণে প্রবেশ করে আমরা মুখমিষ্টি সেরে ফেলতাম। অনেক সময় কচিধানের শিস খেয়েছি কিংবা অড়হর কড়াই বা তালশাঁস। কোন কোনদিন বন্ধুদের লুকিয়ে জমানো পয়সা থেকে জলবরফ, নারকেল বরফ বা চিড়ে, সিমুই, বিস্কুট, আম বা বেলের ফ্লেভার বরফ খেয়ে ওষ্ঠাগত প্রাণকে বাঁচিয়েছি। এসব রোমহষর্ক অভিযানের পর অনেক সময় বাড়িতে এসে উত্তমমধ্যম পেয়েছি।
(সাত)
বন্ধু সহপাঠীদের মধ্যে অনেকেই আজ সুপ্রতিষ্ঠিত, তাই ইতিহাসের এই সত্য তাঁদের মানতে কষ্ট হতে পারে। সেজন্য তাঁদের নাম এখানে প্রচ্ছন্ন রাখলাম সচেতনভাবে। এত অভাবের মাঝেও আমি ধনী হলাম পয়সা কাটিং করে জমিয়ে। একটা ধাপাস বল কিনতে হবে বা একসেট স্কেচপেন কিনতে হবে বা মেলায় গিয়ে কৃষ্ণের ছবি কিনতে হবে এই ভেবে। মাঝেমাঝে চাঁদা তুলে ধাপাস বল বা ক্রিকেটের ব্যাট, উইকেট, বল জুটে যেত। যার যত ক্ষমতা, সে তত বেশি ব্যাটিং করার সুযোগ পেত। অনেকে সারা বিকেল জুড়ে বল কুড়িয়ে ফিল্ডিং করে যেত, ব্যাট হাতে আসতো না। তাও সেসব দিনে আনন্দ ছিল। তখন বারোজন মিলে একটা বল কিনে খেলা হতো, আজ এক একজনের হাতে অনেক বল কেনার পয়সা আছে, কিন্তু খেলার মতো একসাথে এগারো জন ছেলে নেই। সবার হাতে মোবাইল, সবাই মত্ত পাবজি জাতীয় গেম এ।
(আট)
অনেক স্মৃতির মাঝে আর একটি কথা না বললে আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কেচ্ছা সম্পূর্ন হয় না। সেটা হল, লেখাপড়াতে প্রথম সারিতে থাকলেও জ্যাঠামি করা ছিল আমার নেশা। একবার গণিত পরীক্ষায় সব প্রশ্নের উত্তর করতে পেরেছিলাম, শুধু সাত এর দাগের অঙ্ক সমাধানের উপায় কোনভাবেই মনে পড়ছে না। চার নাম্বার হাত ছাড়া হয় আর কি। শেষে সাত এর দাগের উত্তর লিখলাম, "এই অঙ্কটা আমি পারবো না।" ব্যস, রেজাল্ট বেরোবার পর বিরানব্বই পেয়েই অঙ্কের মাস্টারমশাই মোহিনীমোহন বাবুর তলব। সবকিছু শুনে হাসলেন যেমন, তেমন পাকামির জন্য বকাও দিলেন, বাবাকেও জানালেন।
(নয়)
আজ অনেক কিছু হাতের কাছে যাঁদের জন্য সেইসকল প্রনম্য মাষ্টারমশাই গনেশবাবু, মোহিনীমোহনবাবু, তাপসবাবু ও আরও একজন মাষ্টারমশাই( নাম মনে নেই, মানে খুব কঠিন নাম ছিল)দের প্রতি আমি আজও কৃতজ্ঞ। আমার বিদ্যালয় এনায়েতপুর অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা। এখনকার মতো দশ বারোজন করে শিক্ষক ছিল না হয়তো, কিন্তু আন্তরিকতা ছিল। মিড ডে মিলের থেকে স্যারেদের সন্তুষ্টি ছিল বেশি ভালো, সাইকেলের থেকে প্রগতি পত্রের প্রগতিই ছিল বেশি কাম্য। তাই রোদে পুড়ে, জলে ভিজে(বই এর ব্যাগ পলিথিনে থাকতো), শীতে কেঁপে আমাদের শরীর খারাপ করতো না, শরীর খারাপ করতো রেজাল্ট খারাপ হলে। আজ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে গিয়ে বুঝতে পারি আসল কাজ ঐ বুনিয়াদি বিদ্যালয়েই হয়ে যায়, উচ্চশিক্ষার পীঠস্থানে শিক্ষকদের কাজ অনেক হাল্কা। তাই সেই বুনিয়াদি প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রণাম।
(দশ)
তারপর একদিন চলেই গেলাম বড় স্কুলে। তখন কিছুই কষ্ট হয় নি, নতুনের নেশায় দৌড়ে বেড়াচ্ছি। আজ ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে গিয়ে খুব কষ্টই হয়। যাইহোক, আজ অনেক পয়সা এসেছে কিন্তু সেদিনের সেই ধনী আর হতে পারিনি আজও। সেই আনন্দ নেই, নেই সেই স্বপ্নফেরীর পরিকল্পনা। চারিদিকে হিংসা, একে অপরকে শুধুই আড়চোখে দেখা আর লকডাউনের বাজারে আমরা চাকুরীজীবির দল হলাম শ্রেনীশত্রু, বিশেষ করে যারা আজও গ্রামের মানুষের পাশে পড়ে আছি। যতই সাহায্যের হাত বাড়াও না তুমি, ওরা ভুখা পেটে তোমার বেতনের ক্যলকুলেটর হয়ে দিন কাটাবে। এখানেই ধনীর ধন শেষ। হিংসার মাঝে আনন্দ আর শান্তি উধাও। যাক আমি না হয় অতীত থেকে সে আনন্দ কুড়িয়ে আনলাম। পুরানো দিনের পয়সা গুলো দেখে আজকের পয়সার মূল্যমান নির্ধারণ করলাম। একবার আমার দু'টাকা হারিয়ে গেছিল, তখন আমার অবস্থা যা হয়েছিল, তা আজ লাখটাকার সমান। পরের পর্ব ক্রমশ প্রকাশ পাবে। ততক্ষন ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
রচনাকাল : ১৬/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।