আমার ছাত্রজীবনে মাষ্টারমশাইদের অনেক কাণ্ডকারখানা দেখে নিজের মনে মনে ভীষণ রাগ হত। কিন্তু তাঁরা আচার্য, গুরুদেব মানুষ। তাঁরা প্রণম্য, শ্রদ্ধেয়। তাঁদের কাজকে সমালোচনা করার মতো শক্তি ছিল না, অন্তত বাড়ির শিক্ষাতে তা আটকে যেত। তাই রাগ হলেও কিছু বলা হয়ে ওঠে নি আর। সময়ের সাথে সাথে অনেক দেখেছি, আর বুঝেছি আমি ভুল ছিলাম। আবার এটাও দেখেছি কয়েকজন শিক্ষকের আচরণ বা সিদ্ধান্ত ভুল ছিল যার কারণে তাঁরা আমার মনে জায়গা পেয়ে গেছে। অনেকটা সেই সুনাম না করতে পারো বদনাম করে খবরের শিরোনামে থাকা আর কি। তাই আজ লোকাল ট্রেনের ভোকাল টনিকে সেই রকম এক অভিজ্ঞতা তুলে ধরব আপনাদের সামনে। মাঝখানে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। আমি স্কুলের চাকরী ছেড়ে কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দিয়েছি প্রায় বছর পাঁচেক পেরিয়ে গেল। তা একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে লোকাল ট্রেনে চড়েছি। একটু পরেই বুঝলাম পাশের যাত্রী একজন মাষ্টারমশাই। না অচেনা ব্যক্তির সাথে আলাপ জমে না এত তাড়াতাড়ি আর আমাকে তখনও কেমন কেমন ছাত্র ছাত্র মনে হত সবার। হয়তো চিন্টে মার্কা ফিগারের কারণে। সে যাইহোক তাতে আমার কোন কষ্ট হয় নি কোনদিন, কারণ আমি আজও ছাত্র আছি, ভবিষ্যতে থাকব। আমাদের পেশার শর্ত এটাই। যতদিন আপনি পড়াবেন ততদিন আপনি শিক্ষক হবেন, যদি আপনি ততদিন ছাত্র থাকেন। পড়াতে গেলে পড়তেই হবে যে।
যাইহোক, একজন অফিসার বা মাষ্টারমশাই হোক, তিনি তো আর এত জুনিয়র ছেলের সাথে আলাপ করার মধ্যে কি পাবেন। আমি চিনলাম যেভাবে, সেটা হল প্রথমত বেশ সন্ধ্যে গড়িয়ে এসেছে। স্কুল শেষে মনে টিউশন করে ট্রেন ধরেছেন। একটু চুপচাপ থাকার পরে যখন ডায়মন্ডহারবার থেকে ট্রেন ছেড়ে দিল, তখন ব্যাগ থেকে একটা খাতার বাণ্ডিল বের করলেন। মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার উত্তরপত্র। আমার কপালে কোনদিন এসব খাতা তখনও পর্যন্ত জোটে নি। তবে দূর থেকে দেখেছি বহুবার। এর গুরুত্ব এখন বুঝি বেশি করে।
মাষ্টারমশাইয়ের কোনদিকে আর ভ্রুক্ষেপ নেই। তার গন্তব্য স্টেশনে নামার আগে টার্গেট পূরণ করতেই হবে। শুরু হল পাতা ওলটানো আর লাল কালির ঘ্যাচা ঘ্যাচ টান। তিনি হয়তো ঠিক দেখছেন। মূল্যায়নের কোন ত্রুটি হয়তোবা হচ্ছে না। কোথাও হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সহানুভূতি দেখিয়ে নাম্বার বেশি দিয়ে অনেককেই পাশ করতে সহায়তা করছেন। আমি ততদিনে বুঝে গেছি বিষয়টা। আমি যখন ছাত্র ছিলাম, এগুলো দেখলে আমারও মাথা গরম হয়ে যেত। আমি কোন কোন সময় কোন একটা পেপারে যদি সত্তরের ঘরের নিচে নাম্বার পেয়ে বাড়ি ফিরতাম, বাবার উক্তিও তেমন হতো। যদিও আমরা দু’ভাই শিক্ষকতায় আসার পরে বাবার তেমন বক্তব্য আর শুনি না। আসলে মাস্টারমশাইয়ের মূল্যায়নের থেকে ছেলেদের গুণ ও মাণ সম্পর্কে বাবা হয়তো বেশি নিশ্চিত ভরসার জায়গায় ছিলেন। এটা শুধু আমার বাবা না, অনেক অভিভাবকের কাছে এমন অভিমত পেয়েছিলাম, ঘটনাচক্রে আজও পাই।
ঘটনা হল আমার অপরপাশে এবং উল্টোদিকে যে যাত্রীরা ছিলেন তাঁরা প্রায় সবাই স্থানীয়, কয়েকটা স্টেশন পরেই নেমে যাবেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কানাঘুষো করতে শুরু করেছেন।
- কেন ছেলেমেয়েরা ফেল করবে না!! এভাবে কেউ খাতা দেখে?
- সারাদিন টিউশন পড়িয়ে ব্যবসা করবে আর ট্রেনের মধ্যে খাতা দেখছে!
- কিছুই পড়ছে না, শুধু লাল কালি দিয়ে কেটে দিয়ে যাচ্ছে! কি সর্বনাশ রে ভাই?
একজন মাতাল গোছের লোক তো বলেই ফেললেন, - শালারা, বউয়ের সাথে ঝগড়া করে খাতা দেখে আর কম নাম্বার দেয়। ঐ জন্যে আমার ছেলে চা দোকানে দিয়ে এসেছি।
- আচ্ছা দিদি, তুমি বল, ছেলেরা সব ভুল লিখেছে? সব তুই কি করে লাল কালি দিয়ে কেটে যাচ্ছিস!!
- কোন স্কুলের খাতা গো, পাশ থেকে একজন আমাকে ইশারা করলেন। আমিও ইশারায় জানিয়ে দিলাম, জানি না আমি। শুনেই মুখটা কেমন করে ঘুরিয়ে নিলেন।
এতক্ষন চারিদিকে এইসব নানান কথাবার্তা চললেও সেই শিক্ষকের কোন হেলদোল নেই। তিনি তাঁর খেয়ালে খাতা দেখে চলেছেন। অভিজ্ঞতার উপর ভর করে পাঁচ মিনিটের পরিবর্তে তিনি দু’মিনিটে একটা খাতা দেখতেই পারেন। সে ব্যাপারে আমরা বাইরে থেকে বুঝতে পারবো না। সেটা আমিও অনেক পরে মানে শিক্ষকতায় আসার পরে বুঝেছি। কিন্তু ওঁরা তো সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন চিরকাল। তাই ওদের কাছে এই ঘটনা লোকাল ট্রেনের ভোকাল টনিক হয়ে রয় চিরকাল। নেমে যাওয়ার সময়ও দেখলাম, কানাঘুষো চলমান ধারায় ট্রেনের সাথে সমান্তরাল ধারায় এগিয়ে চলেছে।
এখানে শিক্ষক শিক্ষিকাদের প্রতি আমার পরামর্শ, লোকাল ট্রেন পাবলিক প্লেস, ভিন্নধর্মী, ভিন্ন চরিত্রের মানুষ সেখানকার যাত্রী। সেখানে নাইবা করলেন আপনার পেশার গোপনীয়তার প্রকাশ। যে কাজের উপর এতগুলো ভবিষ্যৎ নির্ভর করে, তা নিয়ে মানুষের আবেগ অনেক বড়। তাই আপনার এই কাজ লোকাল ট্রেনে না করে বাড়িতে বা স্কুলে করুন। বিনিময়ে লোকাল ট্রেনের পাবলিক প্লেসে বই পড়ুন, পেপার পড়ুন। তাতে সাধারণ যাত্রীর কাছে অধরা বিষয় অধরাই থাকবে আর সেটা থাকাটা জরুরী। যে পেশার গোপনীয়তা যত সেই পেশার মানুষের সমাজে সম্মান তত বেশি। সেদিনের সেই শিক্ষকের ন্যায় কিছু শিক্ষকের পাবলিক প্লেসে বিশেষ করে লোকাল ট্রেনে এধরণের আচরণে গোটা শিক্ষকসমাজ সাধারণ মানুষের চোখে ঘৃণ্য হয়ে গেছে। তাঁদের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা বা ভক্তি চলে গিয়ে পুকুরঘাটে, বাজারে হাটে, চাষের মাঠের আলোচনায় শিক্ষক শ্রেণীশত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আজকের ভোকাল টনিকের দাওয়াই হল, আপনার পেশাগত গোপনীয়তা আপনি লোকাল ট্রেনে উন্মুক্ত করবেন না। ভালো থাকুন। কোথাও যাবেন না। একটু পরেই ফিরব পরের পর্ব নিয়ে।
রচনাকাল : ১৬/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।