সাম্প্রতিক কালে লোকাল ট্রেনে পরীক্ষামূলকভাবে মেট্রো রেলের মতো বিধিবদ্ধ ঘোষণা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। তো আমাদের শিয়ালদহ সাউথ সেকশনের কয়েকটি ট্রেনে মাঝে মধ্যে শুনতে পাওয়া যায়। এই ঘোষণা আগত ষ্টেশনের নাম শুনিয়ে যাত্রীদের সতর্ক করে দেওয়া হয়। তা ভালো ব্যবস্থা। বর্তমান দিনে কমবেশি অনেকেই পড়াশোনা জানেন। যারা জানে না, কিন্তু অভাবের তাড়নায় কলকাতার বুকে যেতে হয় উপার্জন করতে, তাঁদের এই ঘোষণা কাজে লাগতে পারে। যদিও মেট্রোর মত অতটা জরুরী ছিল না, তার কারণ এই ট্রেন থেকে বাইরের দৃশ্য দেখা যাওয়ায় নিত্যযাত্রীরা অনেকেই এক নিমেষে দেখে বলে দিতে পারে এর পরের স্টেশন কি বা কোথায় আছে ট্রেন, যদিও সেটা রাত্রে সম্ভব হয় না সবসময়।
তার পরেও এই ঘোষণা কার্যকরী হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকের কাছেই কারণ বর্তমান দিনে সবার হাতে কমবেশি স্মার্টফোন। ফোনে লুডো বা তাস খেলা চলে রীতিমত। অনেকে বাবার বয়সী মানুষকে সঙ্গী করে খেলা শুরু করে দেয় ট্রেনে উঠেই। নিজেদের জায়গা সুবিধামত হলেই হল, আর কার কি হল, কে উঠতে পারলো না, কে নামতে পারলো না তাঁদের এতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এমনিতেই সবার অ্যান্টেনা নামানো, তাই ছবি কাঁপে চলমান ট্রেনে। এই অ্যান্টেনার বিষয়টা একটু বলে রাখি। সেটাও এই লোকাল ট্রেনের ভোকাল টনিক হিসাবে পাওয়া। অনেকদিন আগে সেদিন প্রচুর ভিড় হয়েছে কলকাতা থেকে ফেরার ট্রেনে। তখন ঘরে ঘরে কালার টিভি যেমন আসে নি, তেমনি কেবল লাইন আসে নি। ছিল ছোট সাদাকালো টিভি তাও কয়েকজনের বাড়িতে, আর সাথে অ্যান্টেনা। ছবি ঠিক করতে এই অ্যান্টেনা অনেক উপরে রাখতে হত, ঘোরাতে হত, সেটিং করতে হত। যাইহোক, ট্রেনের দোদুল্যমানতার সাথে কেউ কেউ দুলে দুলে পাশের যাত্রীর গায়ে পড়ছে। তখন সেই ভদ্রলোক বলছেন- 'এই যে দাদা, গায়ের উপর পড়ছেন কেন? ঠিক করে দাঁড়ান। পাশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল দেখছেন তো দাদা, অ্যান্টেনা নামানো, ছবি তো কাঁপবেই। অর্থাৎ, সেই লোকটির হাতে ব্যাগ থাকায় হাত উঁচু করে হ্যান্ডবেল ধরতে পারছে না মানে অ্যান্টেনা তুলতে পারছে না। আর সে দুলছে মানে ছবি কাঁপছে।'
তা সেই তাসুড়ে বাবু বা লুডো বাবুদের খেলার মেজাজে কখন কোন স্টেশন আসছে তা মাথায় থাকে না। কারণ, খেলে চারজন, দেখে বারোজন। আর নিজেদের মধ্যে গালাগালি চলে সারাক্ষন, যতই সে বাবার বয়সী হোক আর কাকার বয়সী হোক, পাশে কোন মহিলা থাকুক আর ভদ্রলোক থাকুক, কোন ব্যাপার নেই। মজার বিষয় হল, সেই বাবার বয়সী লোকজনও হাঁটুর বয়সী লোকজনের কাছে গালাগালি খেয়ে, বাজে কথা আলোচনা করে অর্থাৎ শিং ভেঙ্গে বাছুরের দলে নাম লিখিয়ে শান্তিতে যাওয়া আসা করেন। তা যাইহোক, এভাবে চলতে চলতে কখন কোন স্টেশন এসে যায়, তার একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ঘোষণা। এই ঘোষণা শুনেও অনেকেই শেষ চাল দিয়ে তারপর চলমান ট্রেনে থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে এমন হয়েছে, পরের স্টেশনে এসে নামতে হয়েছে। অনেকে এমন অন্তিম সময়ে নামতে চলে যে অনেকেই ধাক্কা খেয়ে তার হাতের মোবাইল বা অন্য জিনিসপত্র ছিটকে যেতে চায় অসাবধানতাবশত। এটাই হল লুডো, তাস বা সর্বজনীন ভিডিও দেখার নেশা। তবে এই ঘোষণা হিন্দি বাংলা ইংরাজিতে এতবার বলে যে একটা শেষ হতে হতে আর একটা ষ্টেশন এসে যাওয়ার উপক্রম। তাই লোকাল ট্রেনে ছাগল ঠাসা ভিড়ের মধ্যে এমনিতেই মানুষের কোলাহল, মোবাইলের ভিন্ন চ্যানেলের প্রদর্শন, উচ্চগ্রামের সঙ্গীত পরিবেশন, তার সাথে সাথে এই ঘোষণা মানুষের কানের পোকা বের করে নিতে চায় যেন।
এই ঘোষণা নিয়ে একটি মজার বিষয় হল, শিয়ালদহ সাউথ সেকশনে দুটি ষ্টেশনের নাম নিয়ে বেশ হাসির রোল পড়ে। একটা হল মল্লিকপুর আর একটা হল ডায়মন্ডহারবার লাইনের হোটর। জানি না যিনি এই ঘোষণা রেকর্ড করেছিলেন তিনি বাঙালী কিনা। তবে এই মল্লিকপুর (Mallikpur) কে মধুর কণ্ঠে বলেন মালিকপুর আর হোটর (Hotar) কে বলেন হোটার। স্থানীয় মানুষ থেকে লোকাল ট্রেনের নিত্যযাত্রীরা এই ঘোষণায় বেশ বিব্রত বোধ করে। অনেক যাত্রী আবার এই দুই স্টেশন থেকে আগত যাত্রীদের মজা করতে গিয়ে খেপিয়ে তোলে। গ্রাম থেকে যাওয়া কলকাতার কাজের মাসীরা বিনা দ্বিধায় বলে দেন যে, মুখ্যু ডাইভার হলে যা হয়। ইস্টিসনের নামটাও ঠিক করে বলতি পারে না। তাঁদের ধারণা ড্রাইভার মনে মহিলা আর তিনিই ঘোষণা করে চলেছেন। এই হল আজকের লোকাল ট্রেনের ভোকাল টনিক।
রচনাকাল : ১৬/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।