বন্ধুরা অনেকদিন পর আবার ফিরে এলাম লোকাল ট্রেনের ভোকাল টনিক নিয়ে। আশা করি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আজকের ভোকাল টনিকে প্রেমের কথা জানাবো। তখন সবে সবে মোবাইল একটু একটু করে সবার হাতে হাতে আসতে শুরু করেছে। মানে ব্যাপারটা এমন আর কি, মোবাইল থাকলে বেশ ভালো লাগা কাজ করত। থাকলে পরে নিজেকে বেশ সম্ভ্রান্ত বলে মনে হত, অন্যেরা কি ভাবত তা জানার দরকার নেই। যাইহোক, কলকাতার কলেজে পড়ার সুত্রে অভিকে অনেক সকালের ট্রেন ধরতে হত। অভি মানে অভিনন্দন রায়। ডায়মন্ডহারবার হাই স্কুল থেকে অনেক নাম্বার পেয়ে পাশ করে শহরের কলেজে ভর্তি হয়েছে। ডায়মন্ডহারবার থেকে ট্রেনে ওঠায় জায়গা পেতে অসুবিধা হত না। কাজের লোক কলকারখানার শ্রমিকদের সাথে যাতায়াতে অভি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এভাবে যেতে যেতে একবছর পরে একদিন তাঁদের বগিতে তাঁরা যেখানে ওঠে, সেখানে একটি সোমত্ত সুন্দরী মেয়ে উঠে বসল। হতেই পারে, কিন্তু সবাই অবাক হল যে মেয়েটি রোজ ঐখানে আসতে শুরু করেছে। লোকাল ট্রেনে কিন্তু পরিচিত লোক না হলে উদ্বাস্তু সমস্যায় পড়তে হতে পারে। দু এক দিন ম্যানেজ হলেও পরে কিন্তু খুব চাপের ব্যাপার। আর যদি আপনি ওদের অসভ্য আচরণে বিপ্লব ঘোষণা করেন তাহলে আপনার নির্ঘাত বগি পরিবর্তন করতেই হচ্ছে। আর যদি ওদের এই আচরণে পেল্লাই দিয়ে হাসিমুখে দেশ রসাতলে গেলেও বসে গীটার বাজানোর ভাব নিতে পারেন তাহলে আপনিই যেন কত দিনের চেনা, কোথায় যেন দেখেছি? এমন ভাব কেউ না কেউ নিয়ে বসবেন। তবে একটা ব্যতিক্রম মহিলাদের ক্ষেত্রে, আর সেই মহিলা যদি সুন্দরী হয় তাহলে তো আর কথা নেই। নিজেরা দাঁড়িয়ে পায়ের ঘামে মোজা ভেজাবে তবু সে মেয়েকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা চাই। তা উপাসনার ক্ষেত্রে তাই হল। উপাসনা মানে সেই সোমত্ত সুন্দরী। সেও কলকাতার কলেজের নতুন ছাত্রী।
যাইহোক দুদিন না যেতে যেতেই অভির সাথে আলাপ হয়ে গেল পড়াশুনার সুত্রে। কিন্তু, উপাসনার দিকে নজর চলে গেল এক খেটে খাওয়া মানুষের মেহনতি ভরা দৃষ্টি। রতন দত্ত। রতন একটা কারখানার ঠিকাকর্মী। পয়সা উপার্জন করে মোটামুটি। সে উপাসনাকে নিয়ে অনেক আকাশপাতাল ভাবতে শুরু করে দিন কাটাতে লাগলো। এমনিভাবে অভি আর উপাসনার একটু একটু করে যখন প্রেম দানা বাঁধছিল, সেই সময় হল বিপর্যয়। উপাসনার পারিবারিক প্রভাব প্রতিপত্তি বিশাল। যাইহোক, অভি’র অনুপস্থিতিতে রতন দুএকটা কথা বলার মধ্যে দিয়ে ভাব জমাতে চাইতো। চোখে মুখে স্বপ্ন নিয়ে সেও মোবাইল কিনে ফেলে। তারপর একদিন অভিনন্দন না আসায় উপাসনার পিছু পিছু গিয়ে দেখল উপাসনা বালিগঞ্জ নামে। অভিনন্দন যাদবপুর নেমে যায় সেটা এর আগে থেকে জানতো রতন। তাই একদিন উপাসনাকে বলল-
-ম্যাডাম আপনার ফোন থেকে একটা ফোন করা যাবে? আমি না আজ মোবাইল ফেলে এসেছি।
-ঠিক আছে, নাম্বার বলুন আমি করে দিচ্ছি।
নাম্বার বলার পরে উপাসনা কল করার পরে কেউ ধরল না, কারণ ফোনটা বাড়িতে নেই, আছে রতনের পকেটে ভাইব্রেট করা। আসল উদ্দেশ্য উপাসনার নাম্বার নেওয়া।
বেশ, সেদিন চলে গেল। উপাসনার নাম্বার পেয়ে রতন অনেক রাত্রে একটা মেসেজ করে প্রস্তাব দিল যে ম্যাডাম আপনাকে আমি পছন্দ করি, নানান রকম অনভিপ্রেত কথাবার্তা আর কি। প্রথমত রাত্রে ফোন, তার উপরে একজন অপরিচিত লোকের কাছ থেকে এমন প্রস্তাব, সেটা কোনভাবে মানতে পারছে না উপাসনা। ফোন কেটে দেয়। নাম্বার কোথা থেকে পেয়েছে সেটাও বুঝতে পারছে না।
পরেরদিন অভিনন্দন আসতে পারে নি। উপাসনা এসে গোঁজ মেরে একটা বই খুলে মাথা গুঁজে বসে গেল। কিন্তু ফাঁকা ট্রেনে সেই রতন এসে তার পাশেই জায়গা পেয়ে গেল। ধীরে ধীরে দু এককথার মাঝে রতন বলেই ফেলল,
-ম্যাডাম, কাল রাত্রে না বলে দিলেন!!! একবার ভেবে দেখলে হত না।
-আপনি ফোন করেছিলেন? কিন্তু, নাম্বার কোথা থে....?
উপাসনার মনে পড়ে যায়, গতদিনের কথা। এই কারণে আমার ফোন থেকে কল করতে বলেছিলেন তাহলে?
প্রচণ্ড রেগে যায় উপাসনা। রতন অনেক কথা বলতে চাইলেও কোন কথা শুনতে চাই না। ধীরে ধীরে লোকাল ট্রেনের কামরা ভরে যায় নিত্যযাত্রীতে।
সেইদিন রাত্রে আবার ফোন যায়। ফোন রিসিভ করে না উপাসনা। সমস্ত ঘটনা সে অভিনন্দন কে জানায়। সিমটাও বদলে ফেলতে পারছে না। হাজার টাকা খরচ করে এই বিএসএনএল এর সিম অনেক কষ্ট আর সময় ব্যয় করে পেয়েছে।
যাইহোক পরেরদিন অভি আর উপাসনা ট্রেনে আসতেই দেখে রতনবাবু আগে থেকেই হাজির। অভিকে দেখে রতনের মাথা এমনিতেই গরম হয়ে যায়। অভিনন্দন তাকে ভদ্রভাবে জিজ্ঞাসা করাতে সে আরও রেগে গেল। ব্যাস শুরু হল কথা কাটাকাটি। এতদিনে কামরাতে সবাই অভি আর উপাসনাকে চিনে গেছে। ওরা দুজনে সমবয়স্ক, সমমনস্ক কলেজ পড়ুয়া প্রেমিক। সবাই জানে, তাতে কারোর কোন আপত্তিও নেই। কিন্তু আজ এই ঘটনা জানতে পেরে সবাই রতনকে তিরস্কার করতে শুরু করল। রতন পরিস্থিতি বুঝে চেপে গেল। কিন্তু মনে মনে ভাবতে শুরু করলো, যে এর একটা প্রতিশোধ নেবে সে।
সারারাত ঘুমাতে পারে না রতন। পরেরদিন রবিবার। ভোর রাতে একটা প্ল্যান মাথায় চলে এল।
এমনিতেই আজ সবার ছুটি। তবুও রতন বেরিয়ে পড়ল। সকাল সকাল উঠে দোকান থেকে কয়েকটা কালো মার্কার পেন কিনে নিয়ে স্টেশনে হাজির। ট্রেন ঢুকতে না ঢুকতেই ট্রেনে উঠেই জানালার উপরে উপাসনার নাম্বার দিয়ে লিখে দিল রাতের রজনীগন্ধা। কোথাও লিখল নিঃসঙ্গতা কাটাতে ফোন করুন, তার নিচে উপাসনার নাম্বার। রবিবার হলেও আসতে আসতে দু একজন করে লোক উঠতে শুরু করছে। এভাবেই বেশ কয়েকটা জায়গায় লিখে নেমে এল।
ব্যাস, রবিবার বেলা বাড়ার সাথে সাথে ট্রেন যত বিভিন্ন সেকশনে রান করছে, ততই মানুষের চোখে পড়ছে এই বিজ্ঞাপন। সন্ধ্যে না হতে হতে উপাসনার ফোন বাজতে শুরু করলো। বাজে প্রস্তাব আসতে শুরু হল একের পর এক। উপাসনা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সাময়িক ফোন বন্ধ করে রাখলেও, রাত্রে অভিকে ফোন করার জন্য যেই খুলেছে, আবার সেই এক চিত্র। তার মধ্যে অভিকে ঘটনাটা জানিয়ে উপাসনা ফোনটা রাখল। সে রাত্রে আর ফোন এল না।
পরেরদিন যথারীতি উপাসনা আর অভিনন্দন লোকাল ট্রেনে চেপে বসল। অনেকটা হালকা হল ব্যাপারটা। কারণ রতনকে দেখছে না তাঁরা। কিন্তু রাত্রে বাড়ি ফিরতেই ফোন আসতে শুরু করলো, আজকে আবার সংখ্যায় একটু বেশি। উপাসনা বেশ সমস্যায় পড়ল। সেদিনের মত ফোন সাইলেন্ট করে রেখে শুয়ে পড়ল। সকালে উঠে তার চক্ষু চড়কগাছ হবার জোগাড়। মোবাইলের ডিসপ্লেতে ৭২ টা মিসড কল। বাড়ির লোককে না জানালেও অভিকে জানালো, কিন্তু ট্রেন ধরার তাড়ায় বেশি কথা হল না। ট্রেন আসতে উঠে জায়গা নিয়ে বসে সবেমাত্র দুএকটা কথা শুরু করেছে, অভি ব্যাগটা বাঙ্কারে তুলতে গিয়ে দেখতে পেলে ট্রেনের দেওয়াল জুড়ে উপাসনার নাম্বার আর নোংরা বিজ্ঞাপন। উপাসনাকে বলল-
-আর কোন ব্যাখ্যার দরকার নেই, সব ঐ রতনের কাজ। পরেরদিন অভি আর উপাসনার বাড়ির লোক পরামর্শ করে রতনের নাম্বারে ফোন করতে স্যুইচড অফ্ পেল। থানায় গিয়ে ডায়েরি করল।
উপাসনা তার সিম বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু ঐ বগিতে অভিনন্দন, উপাসনা বা রতন কাউকে আর দেখা যায় নি। এতদিনে অভিনন্দন আর উপাসনার হয়তো বিয়ে হয়ে গেছে। রতন হয়তো আগের থেকে এখন শান্ত কিংবা কোথাও বেলাল্লাপনা করে চলেছে। আমাদের লোকাল ট্রেন যেমন মিষ্টি প্রেমের সন্ধান দেয়, তেমন মিষ্টি প্রেমের দুষ্টু ত্রিভুজে ছুরিকাঘাত করতেও পারে। তাই সাবধানে পা ফেলুন। আবার দেখা হবে অন্য কোনদিন অন্য কোন টনিক নিয়ে। ভালো থাকুন। প্রসঙ্গত গল্পের চরিত্র সম্পূর্ণভাবে কাল্পনিক। যদি নাম ও ঘটনার সাথে কোথাও সাদৃশ্য খুঁজে পান, অনুগ্রহ করে এড়িয়ে যাবেন।
রচনাকাল : ১৬/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।