সেবার বাঘাযতীন স্টেশন সংলগ্ন সম্মিলনী মহাবিদ্যালয়ের পরীক্ষার কাজ সেরে ডাউন ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে বাঘাযতীন স্টেশনে। মধ্যাহ্নকালীন সময়ের কারণে খুব একটা ভিড় চোখে পড়ছে না। যথাসময়ে ট্রেন আসতে নির্বিঘ্নে ট্রেনে চাপলাম। কিন্তু, ট্রেনে চাপার সাথে সাথে ট্রেন চলতে শুরু করতেই না করতেই শুরু হল বাকবিতণ্ডা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কথাবার্তা গরম হয়ে গেল। আমি বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম, একটি যুবক গোছের ছেলের কনুই লেগে গেছে আর একটি বাচ্চার চোখের কোণে। বিষয়টা যা বোঝা গেল ছেলেটির অসতর্কতার কারণে বাচ্চাটার লেগেছে একটু। কিন্তু ছেলেটি ছিঁচকাঁদুনের ন্যায় কাঁদতে শুরু করেছে। ছিঁচকাঁদুনে কেন বললাম তা পরে বুঝবেন। যাইহোক বাচ্চার কান্না দেখে বাচ্চার পিতাশ্রী সেই যুবকের মাথায় চাঁটি মেরে জানতে চাইলেন
- ‘কিরে মারলি কেন?’
যুবকের সাথে রয়েছে এক তন্বী যুবতী। তার উপরে এক কামরা ভর্তি লোকের সামনে মস্তকে চপেটাঘাত খেয়ে লজ্জায় খানিকটা দোটানায় পড়ে গিয়ে ক্ষণিকের জন্য মাথা নত করে নিল। কেন হবে নাই বা। মেয়েদের সামনে যুবকদের অপদস্ত করা সেতো মৃত্যুরই নামান্তর। একটু লজ্জা একটু ঘৃণা, রাগ, ক্ষোভ, অভিমান হলেও সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে পাল্টা বক্তব্য ছুঁড়ে দিল,
-আরে মশাই, আমি কি ওকে জোর করে লাগিয়েছি, দেখতে না পেয়ে লেগে গেছে। তাই বলে তুমি আমাকে মারবে? তুমি মারলে কেন আমাকে?
-মারব না! তুমি আমার বাচ্চাকে মারবে, আর আমি ছেড়ে দেব?
ব্যাস লেগে গেল বাকযুদ্ধ। ট্রেন এগোতে থাকল, বাকযুদ্ধ চলতে থাকলো। এই করতে করতে যুবক ছেলের বাবাকে দিয়েছে ঠেলা। সঙ্গে সঙ্গে ছেলের বাবা যুবকের গলা টিপে ধরে দুজনেই উল্টে পড়ল। গেটের ধারে একগুচ্ছ দিনমজুর নিত্যযাত্রী বসে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ করে এমন ঘটনায় চলন্ত ট্রেনের বাইরে ছিটকে যাওয়ার মত অবস্থা হল যাত্রীদের। চলতে থাকল মল্লযুদ্ধ।
মাঝে একবার পাঠকদের বলে রাখি এই দুই যুদ্ধবাজদের মলাট দেখে মনে হল ভিতরের গুণগত মান কিছুই নেই বললেই চলে। যুবকের কানে ওয়্যারলেস হেডফোন, চুলের স্টাইলে আধুনিক ডিজাইন, জামাকাপড় অনেকটা রকবাজদের মতো। আর বাচ্চার বাবা তো একটু ভদ্রগোছের জামাকাপড় পরিহিত হলেও মনের মধ্যে এক সুপ্ত জানোয়ার লুকিয়ে আছে।
তা এমন যোদ্ধাদের যুদ্ধ চলাকালীন একজনের জুতো গেল খুলে, তো আর একজনের হেডফোন উড়ে গেল। এইভাবে টানাপোড়েনের কিছু মুহূর্ত চলার পরে জনতা জনার্দন বিষয়টা হস্তক্ষেপ করে। মজার বিষয়, এত কিছু চলছে যখন, তখন সেই ছিঁচকাঁদুনে মিচকে ছোঁড়া কান্না থামিয়ে মজা দেখতে শুরু করেছে এমনভাবে যে, তার কিছুই হয় নি বোঝা গেল। অনেক কথা কাটাকাটির পর থামিয়ে দিয়ে দুজনকে দুইপ্রান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হল। সাধারণ যাত্রীরা বাচ্চার বাবার উপর খেপে গিয়ে নানান কথা শোনাতে লাগলো।
লোকাল ট্রেনের ভোকাল টনিকের পাল্লায় পড়ে দুজনের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হল, বাচ্চার বাবার দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত বেরোতে থাকলো। বাচ্চার বাবা হয়ে ভিড় ট্রেনে সামান্য আঘাত লেগে যখন কাঁদছিল, তাকে বোঝানো উচিৎ ছিল যে বাবা, ভিড় ট্রেনে ওরকম একটু আধটু লাগে বাবা, কাঁদতে নেই বাবা। একটু পড়ে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তা না করে তিনি যা করলেন তা বাবা হবার যোগ্যতা হারালেন, কারণ সন্তানের সামনে বাহবা পাওয়ার মতো কাজ না করলে, তাকে বাবা বলা যায় না। তিনি যেটা করলেন, সেটা দেখে সন্তানের সহনশীলতা তৈরি হওয়া দূরে থাক, তার মনের মধ্যে হিংস্র প্রবণতা জন্ম নেবে এবং সময়ের সাথে সাথে তা বিকশিত হবে। জন্মের সাথে সাথে সবাই সবকিছু নিয়ে আসে না, জীবনের ঘটনাবহুল ঘটনা থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। জীবনে নৈতিক ও বিবেক, চরিত্র গঠন হয়। এই কারণে, আমরা প্রতিদিনের ভোকাল টনিকে আমাদের অভিজ্ঞতার স্বাস্থ্য বাড়তে থাকে। ভালো কিছু নেওয়ার চেষ্টা করে সমাজকে সুস্থ রাখুন। অন্য কোন পর্বে আবার দেখা হবে।
রচনাকাল : ১৬/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।