সবাই যখন নেমে পায়ে পায়ে দৌড়ে এগিয়ে চলেছে বাস স্টপেজের দিকে, মেয়েটি তখনও নির্বাক হয়ে হাঁ করে একদৃষ্টে চলে যাওয়া ট্রেনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্ল্যাটফর্মের একপ্রান্তে। কিছু যেন বুক ফাটিয়ে বলতে চাইছে চৈতালি। কিন্তু মুহূর্তে ঘটে যাওয়া ঘটনায় না বলা ভালো দুর্ঘটনায় সকল ভাষা হারিয়েছে। চৈতালি, চৈতালি বিশ্বাস কলকাতার কলেজে পড়ে। পারিবারিক অর্থনীতি ভালো না হলেও মোটামুটি চলে যায়। তাই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর কলকাতার ভালো কলেজে ভর্তি হয়। কলকাতায় গিয়ে দেশের চৈতি আজ চৈতালি হয়ে গেছে। কত কি শিখেছে। বাড়ির লোক, পাড়ার লোক, গ্রামের লোক তার দিকে তাকিয়ে দেখে, তার পরিবর্তনের দিকে তাকিয়ে ভাবে। আর চৈতালির পরিবর্তন নিয়ে চৈতালির গর্বে বুক ভরে যায়। বাড়ির সুবিধা অসুবিধার দিকে চৈতির কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এভাবেই চলছিল সব।
বছরের শুরু থেকেই বাবার শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। ডাক্তার ওষুধ পালা করে সবই চলছে। গত রাত থেকে মায়ের শরীরটাও ভালো নেই। তাই মা সকালবেলায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে চৈতালিকে শুধালো-
“চৈতি, মা আজ আর কলেজে না গেলে হয় না। দেখ না, আমার শরীরটা একেবারে ভালো নেই, তুই যদি দুপুরের রান্নাটা করতিস”।
চৈতালি সোজা কথায় জানিয়ে দিল, আমার দ্বারা কলেজ কামাই করা সম্ভব হবে না। সামনে পরীক্ষা। প্রচুর চাপ। তুমি একটু বেলার দিকে উঠে আসতে আসতে করে নিও। ছোটবেলায় চৈতি মা বাবা অন্তঃপ্রাণ হলেও, এখন বেশ কয়েকমাস ধরে একটু অন্যরকম চলাচল করছে। গতমাসে যখন বাবার চিকিৎসার জন্য টাকার খুব প্রয়োজন, চৈতি তার কন্যাশ্রীর টাকা দিতে চায় নি, দেয়ও নি। কারণ পড়াশুনার খরচ চালাতে হবে। দুদিন না যেতে যেতেই একটা ঢাউস মোবাইল কিনে আনল আর সারাদিন সেই মোবাইলে কি মুখ গুঁজে থাকে। রাতভর চৈতির ঘর থেকে কথা বলার আওয়াজ শোনা যায়। মেয়ে বড় হয়েছে, তার ভাবনার উপরে অসুস্থ বাবা মা কথা বলতে চায়ও না।
আজ ১৪ ই ফেব্রুয়ারি। কি সব ভ্যালেন্টাইন’স ডে না কি সব ব্যাপার স্যাপার আছে। সবাই নাকি আজকে ভালবাসতে পারবে। বহুদিনের জমানো কথা আজ অন্তত মন খুলে বলে দিতে পারবে। আজকের দিনের জন্য কোনরকমের বিপদের ঝুঁকি থাকে না নাকি। অন্তত ভালোবাসার বিষয়ে। যদিও চৈতালির সেটার দরকার নেই, কারণ চৈতালি এখন একটি শহরতলীর ছেলের সাথে প্রেম করছে। সকাল সকাল কলেজ, পরীক্ষা ইত্যাদির দোহাই দিয়ে সাতটা সাতের লোকাল ধরে কলকাতা চলে গেল। নিবারণ তাঁকে আজ প্রথম কলকাতার বিখ্যাত পার্কে ঘুরতে নিয়ে যাবে। তাই সে অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশি সাজগোজ করে বেরিয়ে গেল। মনের মধ্যে নব উড়ন্ত পক্ষীর তার ডানার উপর বিশ্বাস প্রতিস্থাপনের ন্যায় আনন্দ কাজ করছে। নিবারণের সাথে এই লোকাল ট্রেনে যেতে যেতে একদিন পরিচয় হয়েছিল। কিন্তু, ওঁর বাবার চাকরীসুত্রে ওরা এখন হাওড়াতে থাকে। তাই কলেজ ছাড়া আর দেখা হয় না। যাইহোক, ওরা আজ গেল ভ্যালেন্টাইন হতে।
কিন্তু, আজ রাতে একটু অন্যরকম চৈতালিকে দেখা গেল। নিবারণ তাকে কলকাতার পার্কে ঘুরতে যাওয়ার নাম করে এমন একটি পার্কে নিয়ে গেল যেখানে শতশত কপোত কপোতি বসেছিল। এমনিতেই আজ ভ্যালেন্টাইন এর স্বাধীনতা। সেখানেই বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে যখন আধার ঘনিয়ে এলো, নিবারণের কাছে ধরা পড়ে গেল গ্রাম থেকে উঠে আসা দামাল মেয়ে, তন্বী চৈতি। ঝোপের আড়ালে বিসর্জন দিয়ে দিল উনিশটা বসন্ত ধরে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় পাহারা দিয়ে থরে থরে সাজিয়ে রাখা চৈতালির যৌবনের দীপশিখার প্রথম প্রতিমা। প্রথমে গ্রাম্য আবেগ আর সরলতা, শহুরে ভোগবিলাসের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও, পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে চৈতির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এল। নানান কথাবার্তা আর ভালোবাসার শেষ স্মারক নিয়ে ভাবতে ভাবতে যখন ঘড়ির দিকে তাকাল, তখন একটু রাত হয়ে এসেছে। তাই আর দেরী না করে, নিবারণ তাকে স্টেশনে এসে রাতের বাড়িতে ফেরার লোকাল ট্রেনে তুলে দিল।
ট্রেনের মধ্যে নানান চিন্তা নিয়ে চুপ করে বসে চৈতি। বাবা মায়ের কথা আজ খুব মনে পড়ছে। সকালে মায়ের কথা মনে পড়ছে। শহরে এসেছিল পড়াশুনা করতে, সেটার কথা মনে পড়ছে। আর তিনটি ষ্টেশনের পরে তাকে নামতে হবে। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। নিবারণের ফোন। ফোনটা রিসিভ করে কথা বলতে বলতে কখনও অভিযোগ, মান, অভিমান, রাগ আর ভালোবাসা দুঃখে চোখ থেকে জল পড়ছে। ফোনের উল্টোদিকে কি যে কথা বলছে তা জানা গেল না। ট্রেন থেকে নেমে গেল চৈতালি। ফোনটা তখনও কাটে নি। তাই নেমে আবার কানে তুলে নিল ফোনটা। ট্রেন এগোতে শুরু করল। চৈতালি তার খেয়ালে ফোনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলল প্ল্যাটফর্ম ধরে চলন্ত ট্রেনের পাশাপাশি। দূরত্ব মাত্র দুই থেকে আড়াই ফুট। মহিলা কামরা থেকে নেমে তখনও প্রথম কামরার স্থানে পৌঁছায় নি, ট্রেনের সাত থেকে আটটি কামরা বেরিয়ে গেছে, অর্থাৎ বেশ গতি পেয়ে গেছে ট্রেন, লোকাল ট্রেন তো।
এমন সময় চলন্ত ট্রেনের গেটগুলোতে বেশকিছু ছেলে প্রায় প্রত্যেকটা গেটে ঝুলতে ঝুলতে যায়। সেটা লোকাল ট্রেনে যেতে যেতে গত দুই বছরে চৈতালিও ভালো করে জেনে গেছে। কিন্তু আজ তার মাথার মধ্যে অন্য কিছু জায়গা দখল করে বসে গেছে। মুহূর্তের খেয়ালে চলন্ত ট্রেনের গেট থেকে একটু ঝুলে একজন চৈতালির কান থেকে মোবাইলটা তুলে নিল। চৈতালিকিছু বুঝে ওঠার আগে ট্রেন চলে গেল অনেক দূরে। যতই বুঝছে চৈতালি, তার থেকে ট্রেন আরও দূরে চলে যাচ্ছে। দূরে যাচ্ছে তার সাধের মোবাইল। হারিয়ে যাচ্ছে কন্যাশ্রীর টাকার অপব্যবহারের ফসল। পড়াশুনার অহমিকায় বাবার ওষুধ কিনতে টাকা না দেওয়ার যে নৈতিকতা তা মাটিতে গেল মিশে। জন্ম নিল বিবেক, দংশাতে শুরু করল চৈতির হৃদয়ে। আজ এই হৃদয় দেওয়া নেওয়ার দিনে মনে হচ্ছে হৃদয়টাকে বিদীর্ণ করে বুক চিরে বের করে আনতে চায়। চৈতি যখন চলে যাওয়া ট্রেনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে নিজের বিসর্জনের কথা মেলাতে নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে, ঠিক তখন কে যেন ঐ ট্রেনে নামা এক পরিচিত যাত্রী বলে গেল-
‘কি রে চৈতালি, তোর বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে গেল, তুই গেলি না?’
লোকাল ট্রেনের ভোকাল টনিক আর ভ্যালেন্টাইন ডে’র প্রেমের গল্প বাঙালীর যোগাযোগ বাড়ালেও সংযোগ কেটে দিয়েছে। হারিয়েছে আবেগ, এনে দিয়েছে বেগ।
রচনাকাল : ১৬/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।