লোকাল ট্রেনের ভোকাল টনিক (অষ্টম পর্ব)
আনুমানিক পঠন সময় : ৩ মিনিট

লেখক : সনৎকুমার পুরকাইত
দেশ : India , শহর : ডায়মন্ডহারবার

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ৯৭ টি লেখনী ৪১ টি দেশ ব্যাপী ৩৮৪৮৬ জন পড়েছেন।
Sanat Kumar Purkait
তখন আমি তেইশ। সদ্য মাষ্টার ডিগ্রী পরীক্ষা দিয়ে শহরতলীর একটি স্কুলে ডেপুটেশন পোষ্টে পড়ানোর সুযোগ পেয়েছি। কি যে আনন্দ মনের মধ্যে সে আর কি করে বোঝায়। সত্যি সেসব দিনগুলিতে অনেক সুখের ছিল শিক্ষকতা। আমি একেবারে তরুণ তুর্কী। সদ্য বেঞ্চ ছেড়ে চেয়ার টেবিলে বসার অধিকার অর্জন করে আমার শরীরে যত ক্লান্তি ছিল সব দূর হয়ে গেছে। আগে যে ছেলেটি সূর্যোদয় দেখত না, সে এখন সকাল ৭ টার মধ্যে বেরনোর জন্য প্রস্তুত। যাইহোক, গল্পের শুরুটা এখানে একটা কারণে। সেটা হল, আমার বাড়ি থেকে স্কুল যেতে দুটো লোকাল ট্রেন চড়তে হত। আজকের ঘটনার সুত্রপাত, ডাউন বজবজ লোকালে মাঝেরহাট স্টেশন। আমার সাথে বালিগঞ্জ থেকে সঙ্গী হিসাবে পেতাম শহর থেকে আসা এক ইংরাজির দিদিমণি। যাইহোক, সচরাচর, এই বজবজ ট্রেন অন্যান্য ট্রেনের থেকে তুলনায় কম ভিড় থাকে। নিত্যদিনের যাতায়াতে আমাদের এই বজবজ লোকালে যাতায়াতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচা। প্রাণ খুলে শ্বাস নিতে নিতে প্রকৃতির বুক চিরে কোন এক অজানার সন্ধানে যেন কুঝিকঝিক করতে করতে এগিয়ে যাওয়া। 

স্বাধীনভাবে যাওয়া আর জানালার ধারে বসা, কখনও আবার একটু গেটে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাওয়া কে আর ছাড়ে। এমন এক দিনে, ম্যাডাম বসে আছেন জানালার ধারে। উল্টোদিকের সিটে আমি একটি বই নিয়ে মুখ গুঁজে আছি। সেসময় ফোনের এত পসার ছিল না, আর আমি যেহেতু সদ্য ছাত্র থেকে শিক্ষক হয়েছি আমার কাছে মোবাইল ফোন তখনও অধরা। অগত্যা আমি বই পড়ছি। ম্যাডামের কাছে একটি নোকিয়া ফোন। বর্তমান সময়ের কাছে সেই মডেল অপ্রচলিত হলেও তখনকার দিনে ওটা বেশ আভিজাত্য প্রদান করত। ফোনের সাথে রিবন লাগিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখা একটা শিল্প বললে কম হতো। এভাবে রোজ যাতায়াত কেউ যে আমাদের লক্ষ্য করছে সেটা আমরা অনুভব করিনি। কিছু ছেলে অকারণে প্রতিটা স্টেশনে ওঠানামা করতো চলন্ত ট্রেনে।

সেদিনও একটি ছেলে জানালা রড ধরে ছুটতে ছুটতে ট্রেনটা যখন গতিশীল হয়ে যাচ্ছে তখন সে ট্রেনে উঠছে। এটা দেখতে দেখতে আমরা অন্যযাত্রীর মত উদাসীন থাকলাম। কারণ এইসব বাপে খেদানো মায়ে প্যাঁদানো ছেলের দল শহর ও শহরতলীতে প্রচুর ঘুরত যাঁদের জীবনটাই হল একটা চ্যালেঞ্জের। ম্যাডাম মোবাইলে মুখ গুঁজে থাকলেও বুঝতে পারছেন যে ছেলেটি তাঁর সামনের জানালা ধরে ছুটে ছুটে ট্রেনে উঠছে আর নামছে। কিন্তু সমস্যাটা হল মাঝেরহাট স্টেশনে। যখন ট্রেনটা অনেক জোরে ছুটতে শুরু করেছে। সেইসময় একটা হাত ছোঁয়া মেরে ম্যাডামের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে নিল। ম্যাডাম কোনকিছু বুঝে ওঠার আগে তাঁর গলায় রিবনের টান পড়তে মুহূর্তের মধ্যে মাথা নিচু করে রিবনটা খুলে দিয়ে সে যাত্রা নিজেকে বাঁচালো। ফলে মোবাইল মুক্ত হয়ে যেতে ছেলেটি রড ছেড়ে দিয়ে স্টেশনে ল্যান্ড করতে গিয়ে সপাটে পড়ল। ফাঁকা স্টেশনে কে কোথায় পড়ল, জানি না কেউ আর ফিরে দেখল কিনা। আমরা যখন পরের স্টেশনে নেমে স্টেশন মাষ্টারের কাছে অভিযোগ দায়ের করলাম, তিনি ফোন করে জানতে পারলেন যে একটু আগে প্ল্যাটফর্মে কিছু একটা জটলা হচ্ছিল। ঠিক আছে যদি কিছু জানা যায়, আপনাকে বাড়ির নাম্বারে ফোন করে জানানো হবে।

তারপর থেকে আজ চোদ্দ বছর কেটে গেল, কে সেই ছেলে, আর কোথায় গেল মোবাইল তাঁর সন্ধান কেউ দিতে পারেন নি। তবে আমি যতদিন ওখানে পড়াতে গেছি আমাদের কামরা পরিবর্তন করি নি। পরিবর্তন শুধু হয়েছে আমাদের জানালার রড ধরে কেউ আর বাঁদরামি করে না। একটা মোবাইলের বিনিময়ে লোকাল ট্রেনের যে ভোকাল টনিক হিসাবে সে যা পেয়েছিল, তার সাঙ্গপাঙ্গ সেই কাজ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল।

রচনাকাল : ১৬/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 1  China : 6  Germany : 1  India : 70  Russian Federat : 8  Ukraine : 5  United States : 51  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 1  China : 6  Germany : 1  India : 70  
Russian Federat : 8  Ukraine : 5  United States : 51  
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
লোকাল ট্রেনের ভোকাল টনিক (অষ্টম পর্ব) by Sanat Kumar Purkait is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪২৪১০
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী