মেয়েটা বাড়িতে এসেও মাঝে মাঝে চোখের জল ফেলছে। মা ছাড়া তার যন্ত্রনা কেউ জানে না। সোনারপুর থাকেন ঐন্দ্রিলা দেবী ও মেয়ে রঞ্জিতা। মায়ের সাথে মেয়ে গড়িয়াহাটে শপিং করতে গেছিলেন। ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তাই আর দেরী হবার আশঙ্কায় সোনারপুর-বারুইপুর লোকালের প্রত্যাশা না করে সামনে যে ট্রেন পেল সেটাতেই উঠে পড়েছেন। দুজনের হাতে বেশ কয়েকটা করে ব্যাগ রয়েছে। বালিগঞ্জ থেকে ওঠার সময় একটু ফাঁকা থাকলেও বসার জায়গা জোটে নি। আর সোনারপুর নামতে হবে বলে আর ভিতরের দিকে না গিয়ে দরজা থেকে একটু ভিতরের দিকে দাঁড়িয়ে গেল।
একে একে স্টেশন পেরোতে থাকলো, আর ট্রেনের উদর পূর্ণ হতে শুরু করলো। তার থেকে বড় কথা, যেখানে সোমত্ত সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে বিদুষী ঐন্দ্রিলা কামরার সম্মুখে দাঁড়িয়ে, সেখানে ইচ্ছে করেই অনেকে ভিড় করতে শুরু করলো। মা মেয়ে তখনও জানেন না, তাঁদের জন্য কি অপেক্ষা করছে। তাঁদের সমস্ত মনোযোগ সদ্য কেনা গড়িয়াহাটের পশরার উপর। মা মেয়েকে ফিসফিস করে বলতে থাকলো রঞ্জা সবকটা ব্যাগ সাবধানে নিয়ে নামবি। মেয়ে রঞ্জা নিজের উপরে পূর্ণ আস্থা রেখে সেও মাকে সাবধান করে বলে মা, তুমি এতগুলো নিয়ে নামতে পারবে? নাকি আমি দুটো ব্যাগ নেব?
এসব কথা কিন্তু সেইসব বাঙলা মায়ের দামাল সন্তানরা কানখাড়া করে শুনছিল। যখন জানতে পারলো যে ওরা সোনারপুর নামবে, তখন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিল যে এদেরকে নামতে দেওয়া যাবে না। ব্যাস, কথামত কাজ শুরু হল নরেন্দ্রপুর স্টেশন ছাড়ার পর যখন দুজনে দেওয়াল ছেড়ে এগিয়ে এল আর কারশেডের কাছে এসে ক্ষনিকের তরে আলো গেল নিভে। হামলা চলল নীরবে। ভিড়ের মাঝে চিৎকার আর ঠেলাঠেলি। নামতে পারলো না সোনারপুরে, বলা ভালো নামতে দিল না তাঁদেরকে। কেউ কেউ বলতে লাগলো, লেডিসে না উঠে এখানে মরতে এসেছে! ঠিক হয়েছে। কেউ আবার বলতে থাকলো সোনারপুর-বারুইপুর লোকাল ছেড়ে কেন হে বাপু এই ট্রেনে আসা? তখনও জানে না কেউ রঞ্জিতা কতটা যন্ত্রনার গভীরে ডুবে গেছে।
একটা বইয়ের মলাটকে অবিকৃত রেখে যেমন প্রতিটা অক্ষরকে এলোমেলো করা যায়, ঠিক তেমনভাবে ভিড়ের মাঝে এক গণ্ডা হাতের গতিশীলতায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল রঞ্জার তেইশটা বসন্তের সঞ্চিত যৌবনের কিশলয়। চোখের জলে আর নীরব ক্রন্দনে রঞ্জা সকল শক্তি নিয়ে টিকেছিল ভিড়ের মাঝে একা হয়ে। হাতে তার ব্যাগ, কিছুই করার ছিল না। সুভাষগ্রাম স্টেশনে গিয়ে নামলেন, তাও কয়েকজন যুবকের সহানুভূতি আর সহযোগিতায়। নেমেই রঞ্জা অজ্ঞান হয়ে গেল। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায়ও নেই। যাইহোক, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু, আজও রঞ্জা গুমরে কাঁদে সেই ভয়াবহ যন্ত্রনা আর সহনশীলতার মাত্রার কথা ভেবে। আর কোনদিন সেইভাবে লোকাল ট্রেনে ওঠে নি। বলা ভালো লোকাল ট্রেনের ভোকাল টনিকের ট্রমা কাটে নি।
রচনাকাল : ১৬/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।