ছেলেটা তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। লোকাল ট্রেনের করুণা তার উপর প্রবলধারায় বর্ষিত হয়েছে সবেমাত্র। ঘটনা হল সকালের দিকে ট্রেনগুলিতে এমনিতেই ভিড় থাকে। গ্রামের মানুষ খুব একটা গ্রামে আর কাজ করতে চাইছেন না। এমনকি মেয়েরাও না। তাই সকাল থেকেই ভিড় হতে শুরু করে। এমন একটি দিনে রাজীব কলেজ স্ট্রিট যাবে বলে লোকাল ট্রেনে চেপে বসেছে। স্বাভাবিক নিয়মে সিট ফাঁকা থাকলেও তাকে বসতে দেওয়া হবে না। এর আগেও সে বেশ কয়েকবার লোকাল ট্রেনে গিয়েছে, তাই এব্যাপারটা বুঝে গেছে। তাই সে বসার চিন্তা মাথায় না রেখে একটা সাইড নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
স্টেশন এক এক করে পেরিয়ে যায় আর ভিড় বাড়তে থাকে। এভাবে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে নিত্যযাত্রীর রোজনামচা তৈরি হয়। যাইহোক, রাজীব দাঁড়িয়ে আছে। তখনও মোবাইলের রমরমা না হলেও তাস খেলার বহর কম ছিল না। যাইহোক ভিড় প্রচুর হয়েছে। মাঝের একটি স্টেশন থেকে এক মাঝবয়সী মহিলা উঠে কাঁচুমাচু হয়ে ভিতরের দিকে এগোনোর চেষ্টা করতে থাকলো। অনেক চেষ্টা করে রাজীবের সামনে এসে দাঁড়ালেও আর এগোতে পারছেন না। তার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে দেখে, পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য রাজীব নিজের জায়গা থেকে সরে দাঁড়িয়ে সেই মহিলাকে দাঁড়াতে দিল। নিরাপদে দাঁড়িয়ে গেল সেই আধুনিকা। রাজীবের সাথে শুরু হল অকারণ ঠেলাঠেলি। দুটো কারণে রাজীবকে এই চাপ নিতে হল, এক ঐ মহিলাকে তাঁদের থেকে সরিয়ে মাঝখানে সে হাজির হয়েছে। আর ভিড়ের কারণে একদল উচ্ছন্নে যাওয়া যুবক যে প্রকৃতির সাথে মিশে অবাঞ্ছিত সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিল তা ঝাড়েমূলে বিনাশ ঘটানোর জন্য।
একদল যুবকের অকারণ চাপ আর ঠেলাঠেলিতে রাজীবের সকল শক্তি ব্যর্থ হল। এতক্ষনে প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে গেল যাতে সেই মহিলা অন্ততঃ কোন অস্বস্তিতে না পড়েন। কিন্তু রাজীব যখন তার এক হাত আলগা করে হাতের ব্যাগ সামলাতে ব্যস্ত, ঠিক তখন এক ধাক্কা এলো। সেই ধাক্কা সামলাতে না পেরে আধুনিকার গায়ে রাজীবের ছোঁয়া লেগে গেল। আর তৎক্ষণাৎ, মেয়েটি খেঁকিয়ে উঠে বলে দিলেন,
- এই যে দাদা, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না? বাড়িতে কি মা বোন নেই?
রাজীব বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলো, যে সে ইচ্ছাকৃতভাবে তার দিকে চেপে আসে নি। পিছন থেকে ক্রমাগত চাপ আসায় সামলাতে পারে নি। ঠিক সেইসময় আরও একবার চাপ এল। রাজীব মেয়েটির দিকে আরও একবার চেপে গেল। তৎক্ষণাৎ, মেয়েটি তার চুলের মুঠি ধরে নাড়া দিয়ে সজোরে দুবার চড় কষিয়ে দিল। কোনকিছু বোঝার আগেই যারা এতক্ষন ঠেলাঠেলি করছিল, তারাই ঘুরে গিয়ে রাজীবের উপরে হামলে পড়ল এবং বেধড়ক মারতে মারতে বলল-
শালা, বাইরে ঘাটে চলতে পারিস না ঠিক করে। ভদ্র ঘরের মেয়েদের সাথে বাঁদরামি না? দিদি, আপনি ভাববেন না, আমরা দেখে নিচ্ছি। শালা উদ্বাস্তুর দল, কোথা থেকে এসে আমাদের বগির বদনাম করে দিয়ে যাবে। তখন ভিতরে যারা বসেছিল, কোন কিছু না জেনে, বলতে লাগলো-
মার না শালাকে, মেরে নামিয়ে দে। শালা এখনও ট্রেনের ভিতরে কেন? ছুঁড়ে ফেলে দে বাইরে।
যাইহোক, রাজীব পরের স্টেশনে নেমে যেতে বাধ্য হল। মেয়েটি তখন কোন অপর এক দাদার(?) কৃপায় সিট পেয়ে গেছেন। শুধু, পেল না যেটা, সেটা হল রাজীবের ত্যাগ স্বীকারের মাহাত্ম্য বোঝার মত ক্ষমতা। জটিল পরিস্থিতিতে রাজীব নিজের জায়গায় তাঁকে প্রদান করে নিজের ভাগ্যের বদল ঘটিয়েছিল, সেটা সময়ের ফেরে মেয়েটি ভুলে গেছিল। কি জানি হয়তো সুযোগ সন্ধানী বলেই হয়তো ভুলে যেতে বাধ্য হয়। তাই লোকাল ট্রেনের ভোকাল টনিকের আশায় হয়তো ভিড় ট্রেনে এরা ইচ্ছে করেই মহিলা কামরা বাদ দিয়ে জেনারেল কামরাতে উঠতে পছন্দ করে। আমাদের আর কি, দিনগত পাপক্ষয়, আর অভিজ্ঞতার ডালি ভরা।
রচনাকাল : ১৬/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।