২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ। চারিদিকে কেমন একটা পিকনিক পিকনিক ভাব। আমি সে বছর স্কুল ছেড়ে কলেজে পড়ানোর চাকরীতে প্রবেশ করেছি। ঢুকেই কিছু বুঝে ওঠার আগে জানতে পারলাম আমাকে ট্যুরে যেতে হবে। তাই ট্যুর হয়ে গেল। আমাদের ছেলেমেয়েরা সে বছর কন্যাকুমারি থেকে ঘুরে এসে বারে বারে আব্দার করেই চলেছে যে আর একটা ছোটখাটো আউটিং এর ব্যবস্থা করা হোক। কি আর করা যায়, আমাদের এক কলিগের দায়িত্বে একটা আনফিসিয়াল পিকনিকের আয়োজন করা হল সুদূর মাইথন ড্যামের কাছে। ওখান থেকে ঘুরে ফেরার সময় একটু তারাপীঠ ঘুরে আসা যাবে। সেই মত বেরিয়ে পড়া একদল হুজুগে চিল্লার পার্টির সাথে।
সারাদিনের হইহুল্লোড় আর পিকনিকের আনন্দ কাটিয়ে তারাপীঠ যাওয়ার তাড়া। সেখানে মন্দির ঘুরে রাত্রে ফেরার সময় হল বিরাট বিপর্যয়। বাস চলছে দুরন্ত গতিতে। রাত তখন ২ টা। রাত্রি গভীর হলেও, জ্যোৎস্না রাত ছিল। শীতের রাতে সারাদিনের ক্লান্তি দেহে মনে নিয়ে সকল যাত্রী যখন ঘুমে অচেতন, ঠিক তখন কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম এক কোমর ঠাণ্ডা জলে দাঁড়িয়ে। চোখের সামনে দেখতে থাকলাম পায়ের ফাঁক দিয়ে কেউ কেউ জলের তলায় চলে যাচ্ছে নিদ্রামগ্ন যাত্রীরা। বাসের কাঁচ ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে টুকরো আসতে শুরু করলো আমাদের দিকে। একটু পরেই চিৎকার, চেঁচামেচি। সম্বিৎ ফিরলে বুঝলাম আমাদের বাস দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে এবং সেটা গিয়ে একটা জলাশয়ে পড়েছে। মারাত্মক এক মৃত্যুর হাত থেকে আমরা বেঁচে গেলাম শুধুমাত্র চালকের তৎপরতায়। নইলে পাথর ভর্তি দুরন্ত গতিতে আগত ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে আমরা সবাই ছিটকে চলে যেতাম ভাগাড়ে। কারণ, বাসের পিছনে ছিল গ্যাসভর্তি সিলিন্ডার। বাঁচলাম আরও যে পুকুরে গাড়ি নামিয়ে দিয়েছিল সে পুকুরে জল কম ছিল। নিকটে পুলিশ টহল দিচ্ছিল। পুলিশ এলেন, আহতদের পুলিশ গাড়িতে করে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। জীবনের প্রথম পুলিশ ভ্যানে চড়া হয়ে গেল আমার। প্রাথমিক চিকিৎসার পরে সবাইকে ছেড়ে দিলে আমরা এলাম ট্রেনে বাড়িতে ফিরব বলে।
শুরু হয়ে গেল আবার একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা। মানে লোকাল ট্রেনের ভোকাল টনিক সেবনের পালা। একেবারে টার্মিনাল স্টেশন থেকে আমরা উঠব, যা লোকজন আছে তাতে সবার জায়গা হয়ে যাবে। রানাঘাট স্টেশন থেকে শিয়ালদহ লোকাল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে কিছু লোক যারা নিত্যযাত্রী, ট্রেনে উঠেই একটা তাসের যে ৫২ টা কার্ডের একটা করে নিয়ে এক একটা সিটে রাখতে শুরু করে দিলেন আর বললেন সব লোক আছে। রীতিমতো জুলুমবাজি করতে থাকলো। আমাদের ছেলেমেয়েদের কোন কথা তো শুনলই না, উল্টে নিজেদের মধ্যে বাজে ভাষায় কথা বলতে থাকলো।
মোদ্দা কথা হল, কোত্থেকে যে আসে এইসব উদ্বাস্তু পাবলিক তা কে জানে!!! আমি অবাক হয়ে গেলেও ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষা করতে থাকলাম, কারণ জানি যে এতগুলো যাত্রী ট্রেনে তো নেই, সুতরাং আমাদের জায়গা পেতে অসুবিধা হবে না নিশ্চিত। যথা সময়ে ট্রেন ছাড়লে দেখলাম অধিকাংশ সিট খালি পড়ে। আমি বললাম দাদা, আপনাদের লোক কোথায়? ট্রেন তো ছেড়ে দিল।
-লোক আসবে। কেউ ঠাকুরনগর থেকে, আবার কেউ বা হাবড়া বা পরের কোন স্টেশন থেকে উঠবে বলে ঘোষণা করে দিলেন।
আমি বললাম দাদা, আমাদের ছেলেমেয়েরা একটা বাস দুর্ঘটনায় পড়েছিল। সারা রাত ঘুম নেই। ঠাণ্ডায় ভিজে কাপড়ে সবাই অসুস্থ, ক্লান্ত। ওদেরকে একটু বসতে দিন। ওরা তো রোজ আসবে না।
- কুড়ি টাকা করে দিলে একটা করে সিট পাবেন।
আমি শুনে অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, এদের গায়ের জলকাদা এখনও শুকায় নি। এদের ব্যাগ, টাকা পয়সা যা ছিল তা সেই পরিত্যক্ত বাসের মধ্যে পড়ে। কোনরকমে জীবন বাঁচিয়ে বাড়িতে ফেরা। আর আপনারা এমন করে বলেন কি করে?
কয়েকজন ভদ্রলোক কিনা জানি না, হটাত এসে তাসের কার্ডগুলো ফেলে দিয়ে বসতে বললেন। আমাদের ছেলেমেয়েরা যখন হুড়মুড় করে বসতে তৎপর, তখন সেই নায়ক দুজন ভিজে মুরগির মতো বলছেন আমরা তো ওদের বসাব বলেই জায়গা ধরে রেখেছি। আমরা কি এত অমানবিক? সেদিন বুঝেছিলাম, তেতো ওষুধে রোগ তাড়াতাড়ি সারে।
রচনাকাল : ১৬/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।