এই তো ২০১৮ সালের কথা। হালকা হালকা শীতের রাতে শিয়ালদহ স্টেশন। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরতে ফিরতে ট্রেন লেট থাকায় হাওড়া থেকে শিয়ালদহ আসতে যথেষ্ট দেরী হল। লোকজন একেবারে কম না হলেও বেশিও বলা যাচ্ছে না। রাত ১১-০৫ এর ডাউন লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল ধরে ফিরব বলে টিকিট করলাম। কিন্তু, প্ল্যাটফর্মে এসে দেখলাম ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে, যাত্রী নেই। একটু ইতস্তত করে আবার ডিসপ্লে বোর্ড দেখে নিশ্চিত হলাম। ততক্ষণে দু একজন করে ট্রেনে উঠতে শুরু করেছে। অনেকে ভেবে দেখলাম, মাঝখানে ওঠার থেকে সামনে অথবা পিছনের দিকে উঠলে একটু বেশি যাত্রী পেতে পারি।
জীবনের প্রথম ফাঁকা ট্রেন না চেয়ে ভর্তি ট্রেন খুঁজছি। যাইহোক, পিছনের দিকের বগিতে উঠে পড়লাম। নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। সোনারপুর-বারুইপুর পর্যন্ত ভিড়টা পাতলা হতে হতে একেবারে হাতে গোনা কয়েকজনে দাঁড়ালো। আগেই বলেছি হালকা শীতের রাত। তার উপর হালকা হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সবাই মোটামুটি একটা চাদরের মতো কিছু না কিছু একটা গায়ে জড়িয়ে বসে, শুয়ে আছে। আজকের লেখক একমাত্র ব্যক্তি, যে চাদর ছাড়া একটা সোয়েটার পরে আছে।
ভালো করে অনুধাবন করে বুঝলাম যে এরা সকলেই হকারি করে ফিরছে। আমি বসে বসে আমার স্মার্টফোনে মুখ গুঁজে ছিলাম।
বারুইপুর থেকে ট্রেন বেরিয়ে যাওয়ার পর নাকে একটা তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ আসতে শুরু করলো। এমনিতেই বিড়ি আর সিগারেটের ধোঁয়ার মাঝে আমি নিজেকে নিবেদন করেছিলাম শুধুমাত্র সঙ্গ পাবার আশায়। কিন্তু, যখন সুরার ঘ্রাণ আমাকে উন্মাদ করার অপেক্ষায়, আমি ধীরে ধীরে উঠে দরজার পাশে এসে দাঁড়াবো বলে ভাবলাম। তারপর একটু তাকাতেই দেখলাম, মোটামুটি অনেকেই ধূমপান বা সুরাপানেই ব্যস্ত।
আমি উঠে এলাম এমনভাবে, যেন আমাকে নামতে হবে সামনের স্টেশনে। কারণ ওদের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে উঠে আসলে জানি না কোন অবাঞ্ছিত ঘটনা জায়গা পেত কিনা। যাইহোক, উঠে এসে দাঁড়াতে উল্টোদিকের কেবিনে দেখলাম, একাধিক বোতল নিয়ে সব গ্রুপে গ্রুপে বসে গেছে। কারোর সামনে চানাচুর তো কারোর মুখে বাদাম। কেউ বা আবার চিকেন কষা নিয়ে আয়েশ করে সুরাপানে বুঁদ হয়ে আছেন।
একজন হকার সে এই সব কাজকর্ম থেকে দূরে ছিল। আমার কাছে আসতেই আমি তাঁরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা সেই সকালে গিয়ে কাজ থেকে এত রাত্রে ফিরছেন?’
- না না, এরা সবাই ঐ বিকাল চারটের দিকে যায়, আর এই ট্রেনে ফেরে। মদ, বিড়ি, গাজা টেনে রাত দুপুরে বাড়িতে যায়।
আমাকে ইশারা করে বললেন, এবিষয়ে কথা না বলতে। আমিও একেবারে নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে নামমাত্র মোবাইলের ক্যান্ডি ক্রাশে মন দিলাম।
মনে মনে চাইছি কখন যে, জয়নগর স্টেশন আসবে। আর আমি ভিজতে ভিজতে হলেও দৌড় লাগাবো। যথারীতি ট্রেন রাত ১২ টা ২৯ মিনিটে স্টেশনে প্রবেশ করলে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কারণ, আমার একটাই কথা পাগল করে দিচ্ছিল, তাঁদের চেহারা আর নিজেদের মধ্যে গালাগালি দিয়ে বীরত্ব প্রকাশের মধ্যে দিয়ে যে, নেশা হয়ে গেলে ডাকাতি করতে না শুরু করে।
পরে বুঝেছিলাম, মানুষ দারিদ্রের যন্ত্রনা কতরকম উপায়ে ভুলতে চায়। তার একটা নমুনা কেবলমাত্র এই লোকাল ট্রেনের ভোকাল টনিকে খুঁজে পাওয়া গেল।
রচনাকাল : ১৬/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।