২০১৩ সালের জানুয়ারী মাসের শীতের ভোর। সেবার ভোর চারটে দশের ট্রেনে শিয়ালদহ যাব বলে একেবারে ফাঁকা ট্রেনে উঠে বসলাম। চারিদিক অন্ধকার কাটে নি তখন। বিশ্বভারতী যাব, তাই ভোরের ট্রেন না ধরলে ওদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ধরা দেবে না। অগত্যা, ঘুম ছেড়ে শীতকে আলিঙ্গনপূর্বক ট্রেন ধরা। যাইহোক, ফাঁকা ট্রেনের উইন্ডো সাইড সিট পেয়ে ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে চোখ মুদেছি। ট্রেনটা এক বিশেষ স্টেশনে ঢোকার পরে আমার কম্পার্টমেন্টে খুব বেশী হলে জনা দশেক যাত্রী যোগ হল। প্রায় সব সিট ফাঁকা। একজন ষণ্ডামার্কা পাবলিক এসে আমাকে উঠে যেতে বলে। আমি কারণ জানতে চাইলাম।
- 'আমি এখানে রোজ বসি, তুমি অন্য জায়গায় বসো।' একদম ভারতীয় রেলকে পৈতৃক সম্পত্তি বানিয়ে ফেলার নামান্তর।
আমি সহজে না সরে দু এক কথা চলতে থাকলো।
পাশের দুএকজন নিত্যযাত্রী আমাকে ইশারা করে সরে বসতে বললেন। আমি অবাক হলেও পরে সামলে নিলাম। উঠে গেটে চলে এলাম।
মনে মনে ভাবলাম, যে বগিতে এত ভোরবেলায় মানুষরূপী এক জানোয়ারের প্রবেশ ঘটেছে, সেই বগিতে আর না থাকায় শ্রেয়।
আমি যাবো অনেকদূর। ইন্টারভিউ দিতে, চাকরীর সন্ধানে। সঙ্গে গাদাগুচ্ছ সার্টিফিকেট আর মার্কশীট। তাই, মেজাজ হারানোোর পূর্বে পরের স্টেশন আসতেই নেমে দৌড়ে চলে গেলাম পাশের বগিতে।
শান্তিতে বাকি রাস্তা পেরিয়ে গেলেও, মনের মধ্যে সেই যে অশান্তি ঢুকে গেল তা আজও বয়ে বেড়াচ্ছি। মনের মাঝে একটা প্রশান্তি যে, সে যে আমাকে তুমি বলেছিল, এটাই মনে হয় আমার চোদ্দ পুরুষের ভাগ্য।
লোকাল ট্রেনের অনেক তিক্ত মধুর অভিজ্ঞতা রয়েছে, কিন্তু এটা একেবারে বিষাক্ত অভিজ্ঞতা। ভুলি নাই, ভুলবো না।
আজও মনে মনে কেন একটা জাতি সময়ের সাথে সাথে পিছিয়ে পড়ে। কেউ মনের ব্যাথা বুকের মাঝে লুকিয়ে সহনশীলতায় ভর করে এগিয়ে যায়, প্রতিষ্ঠা পায় উচ্চ মার্গে, আর কেউ দুদিন দাপাদাপি করে শেষে সিঁড়ির নিচে পানবিড়ির দোকান খুলে বসে থাকে। প্রসঙ্গত দুটি দেশ একসাথে স্বাধীন হলেও এত বছরের প্রচেষ্টায় একজন মঙ্গলগ্রহ, চাঁদসহ মহাকাশে পাড়ি দিয়ে দিল, আর অন্যজন সারাজীবন লড়াই করে কাশ্মীরে প্রবেশাধিকার খুঁজল। এই হল মানসিকতা। জাতির উন্নয়নের প্রথম ও প্রধান শর্ত হল তাঁর উন্নত মানসিকতা ও সার্বিক চেতনা। তাই এসকল টিকিটহীন লুঙ্গি পরিহিত যাত্রীদের কারণে ভারতীয় রেল অনেক সময় আতঙ্কের হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাবধানে থাকুন, বিতর্ক এড়িয়ে এগিয়ে চলুন। লোকাল ট্রেনের ভোকাল টনিক সময়ের সাথেসাথে ওদের ঠিক একদিন জুটে যাবে।
রচনাকাল : ১৬/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।