প্রিয় পাঠক বন্ধু, আজ থেকে আমাদের ভারতীয় লোকাল ট্রেনের ভিতরে ঘটে চলা নানান ঘটনা অবলম্বনে ছোট ছোট গল্প অবলম্বনে নতুন সংকলন বেশ কয়েকটি পর্ব উপহার দেব 'লোকাল ট্রেনের ভোকাল টনিক' শিরোনামে। সেই গল্প পড়ে আপনারা যারা বিদেশে আছেন, তাঁদের ধারণা বদলে যেতে পারে। কারণ ভারতের সর্বত্র যেমন লোকাল ট্রেন চলে না, তেমন যেখানে চলে সেখানে একেবারে ছাগলঠাসা ভিড়ে ভর্তি হয়ে দৌড়ায় সেই ট্রেনগুলি। গল্প বলতে গিয়ে স্থানীয় কিছু স্টেশনের নাম ব্যবহার করতে হবে। যারা প্রবাসী বাঙালী সেই নামগুলো শুনে আবেগমথিত হয়ে পড়তে পারেন কিংবা স্মৃতির পাতায় নানান ঘটনা ভিড় করতে পারে। তাই চলুন শোনা যাক এক এক করে লোকাল ট্রেনের ভোকাল টনিক।
এই শতকের গোড়ার দিকে কলকাতার খাসতালুকের ডাকসাইটে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাক্রমে গ্র্যাজুয়েশন ও মাষ্টার ডিগ্রি পড়ার সুত্রে প্রায় পাঁচবছর ধরে মফস্বল থেকে রোজ লোকাল ট্রেনের যাত্রী হয়ে গেছিলাম। বয়সে কাঁচা, ছিপছিপে দেহাবয়ব আর চোখে মুখে স্বপ্ন নিয়ে লোকাল ট্রেনে লড়াই চালাতে কখনও প্রত্যাশা বেড়েছে, আবার কখনও হতাশা গ্রাস করেছে নিত্যযাত্রার অভিজ্ঞতায়।
এখনকার মতো মোবাইলের রমরমা হয় নি। যে দুএকজনের কাছে ছিল, তার ব্যাগ পুরো ফাঁকা থাকলেও বেল্টের সাথে সেটিং করে মানুষকে দেখিয়ে বেশ সমীহ কুড়িয়েছেন। তাছাড়া, সে মোবাইলে না ইন্টারনেট ছিল, না তাস বা লুডো খেলার ব্যবস্থা ছিল।
কিন্তু আমবাঙালীর পিছিয়ে থাকলে তো চলে না। তাই নিত্যযাত্রীর গ্রুপে গ্রুপে দেখতাম একসেট তাস আর একটা সাদা তোয়ালে একটা ব্যাগে জায়গা পেত।
কি সুন্দর ব্যবস্থাপনা তাঁদের, তোয়ালের চারটে কোন চারজনের বেল্টে জড়িয়ে সফট্ টেবিল বানিয়ে নিয়ে দিব্যি চুটিয়ে তাস খেলার একটা একঘন্টার আসর সাজাতো এমনভাবে, যাতে ভিতরে কেউ না প্রবেশ করতে পারে। আমি কিছুদিন যাতায়াত করার পরে আমাকে তাঁরা ঢুকতে দিতেন একটা শর্তে। সেটা হল আমি আমার সমগ্র যাত্রাপথে বসার প্রত্যাশা করব না। আমিও ঠেলাঠেলি এড়াতে বসার বাসনা ত্যাগ করে জানালার ধারে গিয়ে একটা নোট বের করে পড়তে পড়তে বালিগঞ্জ চলে আসাতে অভ্যস্ত ছিলাম।
এই অফিসাররা কিন্তু যেদিন তাস খেলার লোক কম পড়তো বা তাঁদের পছন্দের ব্রিজ খেলার লোক পেতেন না, তখন কাজ ছিল অন্য পেশার লোকজনের দোষত্রুটি খুঁজে বের করে তাঁর ষষ্ঠী পূজা করা।
আমাদের সেকশনের একটা অলিখিত নিয়ম ছিল, বারুইপুর এলে সবাই চেঞ্জ করে অন্যকে বসার সুযোগ করে দেওয়া নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু সেই মহারথীদের যখন একজন বারুইপুর এলে নেমে যেতেন, তাস খেলা গুটিয়ে ঘুমে নেতিয়ে যেতেন যাতে আর উঠে কাউকে বসতে না দিতে হয়। দেখলে মনে হত, গত দুই রাত ঘুমানোর সুযোগ হয় নি। আমার গলা কুটকুট করত, জিভ উসখুস করত, কিন্তু বলার উপায় ছিল না, কারন আমাকে আবার উদ্বাস্তু ঘোষনা করে ইচ্ছাকৃত ঠেলাঠেলি করে উচ্ছেদে নামবেন।
মাঝে ১৬ টা বসন্ত পেরিয়ে গেছে। এখন আমি একটি কলেজে পড়াই। সেদিনের সেই গ্রুপের মেম্বারদের দুএকজন অবসর নিয়েছেন। সঙ্গে একটি মেয়ে নিয়ে সেদিনের একটি চেনামুখ হাজির হলেন আমার দপ্তরে।
-'স্যার, আমার মেয়েটা যাতে ভূগোল নিয়ে পড়তে পারে দেখবেন প্লিজ।'
পরিস্থিতির খামখেয়ালীপনা আর সময়ের ফেরে সেদিনের ছোকরা আজ স্যার সম্বোধন পেলেও ষষ্ঠী পূজার প্রসাদস্বরূপ তাঁকে বললাম মেরিট লিস্ট ফলো করতে।
রচনাকাল : ১৬/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।