নর্মদার তীরে তীরে (জব্বলপুর অধ্যায়)
আনুমানিক পঠন সময় : ৭ মিনিট

লেখক : সনৎকুমার পুরকাইত
দেশ : India , শহর : ডায়মন্ডহারবার

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ৯৭ টি লেখনী ৪১ টি দেশ ব্যাপী ৩৮৪৩০ জন পড়েছেন।
Sanat Kumar Purkait
   পরেরদিন সকালে উঠেই আবার পিপারিয়া স্টেশনে ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসের চেয়ারকারে জব্বলপুরে পৌঁছে গেলাম পড়ন্ত বিকালে। এই জব্বলপুরে বেশ কিছু স্পট আছে যা আপনাকে মুগ্ধ করবেই করবে। বিশেষ করে ভেরাঘাটের জলপ্রপাত ও মার্বেল রকস। আজ তো এলাম সবে। আজ একটু রেস্ট নিয়ে পরের দিন সকাল সকাল গাড়ি ছুটিয়ে চলে গেলাম।

রানী দূর্গাবতী ফোর্ট মদনমহল মন্দিরঃ
   আসুন যাওয়া যাক এক এক করে।জব্বলপুরের খুব কাছেই মদন মহল নামক ষ্টেশনের কাছে এই ইতিহাস প্রসিদ্ধ দুর্গের অবস্থান। আপনারা এখানে মন্দিরটাকে বামদিকে রেখে প্রায় ২০০ সিঁড়ি পেরিয়ে এই দুর্গে যেতে পারবেন। এই দুর্গ একাদশ শতাব্দীর ইতিহাসকে তুলে ধরে। গোন্দ দের রানি দুর্গাবতী ও তার ছেলে মদন সিং মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহিদ হয়ে ইতিহাসে জায়গা করে নেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় জব্বলপুর ও তার আশেপাশে অনেক মন্দির নির্মাণ করেন। দুর্গের অধিকাংশ আজ ধ্বংশ হয়ে গেছে। তবুও আপনি যদি জব্বলপুরে যান, তাহলে একবার এই দুর্গাবতী দুর্গ ঘুরে আসতে পারেন। ভালো লাগবে। কারন দুর্গের উপর থেকে জব্বলপুরের শহরের আধুনিক বিকাশের পর্যায় দেখতে পাবেন।

ব্যালান্সড রকঃ 
  রানীদূর্গাবতী ফোর্ট মদনমহল মন্দিরে যাওয়ার পথে দুর্গে প্রবেশের ঠিক আগেই এই ব্যালান্সড রক দেখতে পাওয়া যায়। শিলার এই প্রাকৃতিক অবস্থান আপনাকে অবাক করে দেবে। এমনিতেই মধ্যপ্রদেশ মার্বেল রকস এর জন্য বিখ্যাত। তার সঙ্গে এই ব্যালান্সড রক ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কৌতূহল বাড়িয়েছে। একটা সেলফি তো হতেই পারে ব্যালান্সড রককে পিছনে রেখে।

ভেরাঘাটঃ
   ভেরাঘাট মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরের নর্মদার তীরে অবস্থিত একটি নগর পঞ্চায়েত শহর। জব্বলপুর শহর থেকে প্রায় ২০ কিমি দূরে অবস্থান করলেও এই নগর ধুঁয়াধরজলপ্রপাত, চৌসাটযোগিনীমন্দির, পাঁচমাথামন্দির ও বিখ্যাত মার্বেলরকস এর জন্য প্রসিদ্ধ। এছাড়াও বাঁদর কোদিনিও উল্লেখযোগ্য। তাই আপনার যদি মধ্যপ্রদেশ ভ্রমণ করেন তাহলে অবশ্যই করে ভেরাঘাট এর এই জায়গা গুলি ঘুরে আসবেন। 

ধুঁয়াধর জলপ্রপাতঃ 
   প্রিয় পাঠক, আপনি হয়তো শিবসমুদ্রম জলপ্রপাতের গর্জন শুনেছেন,  তার অপরূপ রূপ দেখে পাগলের মতো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছেন। আবার কখনও বা মুসৌরির কেম্পটি ফলস্ এর সামনে দাঁড়িয়ে ইচ্ছেমতো সেলফি তুলেছেন। কিংবা উত্তরপূর্ব ভারতের মেঘালয়ের জলপ্রপাত এর রূপকথায় আশ্চর্য হয়েছেন। কিন্তু মধ্যপ্রদেশের নর্মদার উপরস্থিত ধুঁয়াধর জলপ্রপাত আপনাকে দেবে এক মানসিক প্রশান্তি। তার কলকল ধ্বনি আপনাকে এনে দেবে নতুন বার্তা। ভাবছেন হয়তো কিভাবে?  সে জানতে গেলে আপনাকে অবশ্যই নিজের চোখে দেখতে হবে এই জলপ্রপাত। নর্মদা এখানে তার কেশরাজি এলিয়ে দিয়ে ভুগোলের ভাষায় সমনতি গঠনযুক্ত অঞ্চলের উপরে যেন বিশ্রামে রত। আর নদীবক্ষের প্রস্তররাজি যেন অতিথি আপ্যায়নের জন্য সদাতৎপর। তার সরলতা, কোমলতা,  পেলবতা উপেক্ষা করার সাধ্যি কার বা থাকতে পারে। অবশ্য যারা আরামপ্রিয় ভ্রমনার্থী অর্থাৎ যারা মূল রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ীতে বসে এর দর্শন করবে তারা হতাশ হবে। তাকে অনুভব করতে গেলে তার নিকটে যেতে হবে,  তারিয়ে তারিয়ে তার আকুলতায় ডুবতে হবে। তিনি মোহময়ী লাস্যময়ী মা নর্মদার সদা সহাস্যমুখ। ধুয়াধর জল্প্রপাত দেখতে। নর্মদা এখানে পাগলি মেয়ের মত হঠাৎ শূন্য থেকে ঝাপ দিয়ে পড়েছে। নীচ থেকে ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে জলকণা। কাছে গিয়ে দেখবেন তো বটেই। রোপওয়ের মজাটাও ছাড়বেন না। পাখির চোখ নিয়ে উপর থেকে দেখুন ধুয়াধরের তাণ্ডব। তবে সাবধান ভেজা মার্বেলে পা হড়কে না যায়।

চৌসাট যোগিনী মন্দিরঃ
   ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মন্দিরগুলির মধ্যে এই মন্দির অন্যতম। দশম শতকে কালচুরি রাজাদের আমলে অনেকটাই খাজুরাহ মন্দিরের শিল্পকলার আদলে তৈরি এই মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবী দুর্গার অবস্থান হলেও গোলাকার এই মন্দিরের চারদিকে ৬৪ জন নারী যোগিনীর মূর্তি বিদ্যমান। স্থানীয় লোকজনের মতে এই মন্দির খুব জাগ্রত। নর্মদার তীরে অবস্থিত এই পুরাতাত্ত্বিক স্থাপত্য সারা ভারতের এক অভূতপূর্ব নিদর্শন। প্রায় ১৬৮ টি সিঁড়ি পেরিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। ভেরাঘাটের বিখ্যাত মার্বেল রক পাহাড়ের অদুরেই এর অবস্থান। যদিও বেশ কিছু অংশ ধীরে ধীরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে চলেছে, তবুও মন্দিরের আদলে এটুকু আপনারা বুঝতে পারবেন যে জব্বলপুরেও প্রাচীন সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের আধিপত্যে এই মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল বলে ইতিহাসে কথিত আছে। তবে মন্দিরটির অধিকাংশ আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তার কারন ইহা একটি পাহাড়ের মাথায় অবস্থান করছে যা সহজে নিচের রাস্তা থেকে দেখা যায় না।  গোলাকার এই মন্দিরের চারদিকে ৬৪ জন নারী যোগিনীর মূর্তি ছাড়াও মাঝখানে এক প্রধান যোগিনীর নিকট দেবী পার্বতী ও দেবাদিদেব মহাদেব নন্দীর উপর অবস্থান করছে।সূর্যের আলো অথবা চন্দ্রালোকে এই মন্দিরের শোভা অনেকাংশেই বৃদ্ধি হয়ে থাকে।  

পাঁচমাথা মন্দিরঃ
    ভেরাঘাট এর মার্বেল রকস এর জন্য নৌকা বিহারের আগে এই বিখ্যাত পাঁচমাথা মন্দির দেখতে পাবেন। শোনা যায় এই মন্দিরটির প্রাচীনত্ব দশম থেকে দ্বাদশ শতকের কালচুরি মহারাজদের আমলের। আবার অনেকের মতে এই মন্দির পঞ্চদশ থেকে ষষ্ঠদশ শতকের। মন্দিরের ভাস্কর্য দেখলে বোঝা যাবে তৎকালীন সময়ের শিল্পনৈপুণ্য ও রুচি। মন্দিরের ভিতরে দেবাদিদেব উমেশ্বর ছাড়াও দেবী পার্বতী ও গণেশ এবং হনুমান ও সূর্য দেবের বিগ্রহ বর্তমান। 

মার্বেল রকঃ 
    এবার আমরা এগিয়ে চলেছি মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরের সবথেকে আশ্চর্যজনক জায়গা ভেরাঘাট – মার্বেল রক। মধ্যপ্রদেশ ঘুরতে গেছেন অথচ মার্বেল রকস এ যাবেন না, তা কি মেনে নেওয়া যায়? আপনারা অনেকেই হয়তো ইতিপূর্বেই মার্বেলে মোড়া বিশ্বের আশ্চর্য স্থাপত্য তাজমহল দেখেছেন নিশ্চয়ই। আর যারা যারা সেটি পূর্ণিমা রাতে দেখেছেন, তাঁরা তার মনোরম রূপ দুচোখ ভরে দেখেছেন। কিন্তু পূর্ণিমা রাতে জব্বলপুরে মার্বেল রক দেখেছেন কি?  তাজমহল হল মানুষের হাতে তৈরি শ্বেতপাথরের স্থাপত্য। আর মার্বেল রক হল প্রকৃতির নিজের হাতে তৈরি শ্বেতপাথরের স্থাপত্য। আর এদের শোভাবর্ধনের জন্য একদিকে যেমন যমুনা আছে, অপরদিকে রয়েছে মানিনী নর্মদা। তাজমহলের পিছনে আছে যমুনা। আর মার্বেলরক নর্মদার বুকে অর্ধনিমজ্জিত। পূর্ণিমারাতে সেই জলে যদি নৌকাবিহার করেন, তাহলে অনুভব করবেন তার আসল রূপ ও প্রেমের ভাষা। নিরাপত্তার কথা ভেবে রাতে নৌকা চালানোর অনুমতি না দেওয়া হলেও কেবল পূর্ণিমার রাতে অনুমতি দেওয়া হয়। তাতে স্থানীয় মানুষের হাতে যেমন পয়সা আসে, তেমনি আমাদের মতো ভ্রমণপিপাসু মানুষদের চোখের স্বাদ মেটে। তবে যদি কোন কারনে পূর্ণিমার রাতে না পৌঁছাতে না পারেন তাহলে কি রাতের মার্বেলরক দেখতে পাবেন না? নিশ্চয়ই পাবেন। তবে সেটা দূর থেকে। মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের মোটেল (মোবাইল হোটেল) মার্বেলরকস থেকে নর্মদার বুকে শ্বেতপাথরের পাহাড় স্পষ্ট দেখা যায়। যেদৃশ্য দেখা যায় না আর কোনও হোটেল থেকে।

     জব্বলপুর শহর হিসাবে বেশ ব্যস্ত। অনেকটা আমাদের বড়বাজারের মতো। তাই মুল শহরে না থেকে ভেরাঘাটের কাছে মোটেল মার্বেলরকসে থাকলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি,  শহরের হট্টগোলকেও এড়ানো যায়। সকালে উঠেই একদফা নৌকাবিহার করে নিন নর্মদার জলে। নামেই শ্বেতপাথর। কিন্তু সেই পাথরের রং যে এতরকমের হতে পারে তা জানা ছিল না। হলদে, গোলাপি, নীলচে, বাদামি, সবুজাভ।নর্মদার বুকে নিমজ্জিত মার্বেলের পাহাড়ের উপর শিবলিঙ্গ স্থাপন করে নর্মদার পবিত্রতা তুলে ধরা হয়েছে। এখানকার মানুষেরা নর্মদাকে খুব শ্রদ্ধা করেন, সেই সাথে শিবলিঙ্গকে ভক্তি ভরে পূজা করে। যাইহোক, ডুবো পাহাড়ের গা ঘেঁষে অলিগলির মতো এঁকেবেঁকে চলেছে নদী। পাহাড় দেখে কখনও মনে হয় দুর্গের দেওয়াল, কখনও মনে হয় উলটে পড়া গাড়ি। কোথাওবা দুটি দুষ্টু ছেলে মারামারি করছে, আবার কোথাও ধ্যানরত বাবা লোকনাথের অবয়ব ইত্যাদি ইত্যাদি। মাঝি আর গাইড ভাইয়েরা খুব সুন্দর সুন্দর ছড়ার আকারে সমস্ত যাত্রাপথের একটি রূপক ও মনোরম বর্ণনা তুলে ধরেন। তাঁদের কথায় ধরা পড়ে কুমিরের বেডরুম, করিনা কাপুরের মেকাপ রুম ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানকার নৈসর্গিক শোভাকে কেন্দ্র করে চলচিত্র নির্মাতারা এই স্পটকে কেন্দ্র করে সিনেমা বানিয়েছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুভি হল অশোকা ও মহেঞ্জদারো। এই পাথরের ফাঁকে ফাঁকে নীল ডানার সোয়ালো পাখিরা বাসা বাঁধে। আর পাথরের উপরে বসে থাকে কিশোরের দল। সামান্য টাকার বিনিময়ে তারা নর্মদার জলে লাফ দিয়ে কেরামতি দেখায়। নৌকাবিহার শেষে সন্ধ্যায় ভেরাঘাটে বসে কিছুক্ষন নর্মদার আরতি দেখুন। আর তারপর জ্যোৎস্নার আলোয় স্নান করে...... না আর বলবো না। এবার আপনার ঘুরতে চলে যান। গিয়ে যা মনে হয় সেটাই করুন।

     পরিশেষে বলি, শুধু নর্মদা ও তার পার্শ্ববর্তী প্রাকৃতিক শোভা এবং আধ্ম্যাত্মিক পটভূমিকে কেন্দ্র করে যে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানো যায়, তা অনেকাংশেই বঞ্চিত হয়েছে। এক্ষেত্রে রাজ্য সরকার আরো পরিকল্পনা করে কিছু পরিকাঠামোগত সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে এই অঞ্চলের পর্যটন বিকাশ সাধন সম্ভব বলে মনে করি। তবে, আবার এটাও মনে হয়, আমাদের মতো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষেরা সুবিধার সৎ ব্যবহার করতে গিয়ে পরিবেশ বান্ধব পর্যটনকে না নষ্ট করে ফেলি। আমরা বিশ্বাস করি আর না করি এই নর্মদা বা এই স্থানের নিশ্চিত একটি আধ্ম্যাত্মিক যোগসূত্র বিদ্যমান। তা মানতে হয়তো আমাদের আরও একটু সময় লাগবে। পুনশ্চঃ এই লেখা লিখতে যে সকল মানুষের লেখা, অভিজ্ঞতা, সহযোগিতা পেয়েছি তাঁদের সবাইয়ের কাছে নতমস্তকে ঋণ স্বীকার করছি। আবার দেখা হবে অন্য দিন অন্য কোথাও। ভালো থাকবেন।

রচনাকাল : ১৫/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 18  China : 7  France : 1  Germany : 2  India : 319  Ireland : 7  Romania : 3  Russian Federat : 11  Sweden : 11  Ukraine : 9  
United States : 299  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 18  China : 7  France : 1  Germany : 2  
India : 319  Ireland : 7  Romania : 3  Russian Federat : 11  
Sweden : 11  Ukraine : 9  United States : 299  
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
নর্মদার তীরে তীরে (জব্বলপুর অধ্যায়) by Sanat Kumar Purkait is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪০৬৭২
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী