নর্মদার তীরে তীরে (পাচমারি অধ্যায়)
আনুমানিক পঠন সময় : ৭ মিনিট

লেখক : সনৎকুমার পুরকাইত
দেশ : India , শহর : ডায়মন্ডহারবার

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ৯৭ টি লেখনী ৩৮ টি দেশ ব্যাপী ৩৫১৯৬ জন পড়েছেন।
Sanat Kumar Purkait
   অমরকণ্টকের অম্বিকেশ্বর মহাদেবের মন্দির থেকে বেরিয়ে সোজা পেন্ড্রা রোড স্টেশনে এলাম। এখান থেকে অমরকণ্টক এক্সপ্রেস ধরে সোজা পিপারিয়া স্টেশন। সেখান থেকে স্করপিও করে রাস্তায় যেতে যেতে বাইসন, ময়ূর, বানর ইত্যাদি দেখতে দেখতে পাচমারী শহরের হোটেলে। মধ্যপ্রদেশের পর্যটন মানচিত্রে পাচমারী এক উজ্জ্বল জায়গা। সবুজের চাদরে মোড়া প্রাকৃতিক পরিবেশে ভরপুর মানীনি পাচমারী সাতপুরা পর্বতের রানী বলে মনে করা হয়। অনেকেই একে মধ্যভারতের কাশ্মীর বলে অভিহিত করেছেন। এই পাচমারীতে দুচোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো অনেক স্পট পাবেন। তবে আপনাকে নিম্নে বর্ণিত স্পটগুলিতে যেতে গেলে এন্ট্রি ফিজ জমা দিয়ে সাতপুরা টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে পারমিশন করাতে হবে। 

হান্ডিপয়েন্ট বা হাণ্ডি খোঃ
   পাচমারীর সবথেকে কাছে এই ৩০০ ফুটের বেশী গভীরতা বিশিষ্ট এই সংকীর্ণ গলির ন্যায় গহন জঙ্গলে ঢেকে যাওয়া স্থান গিরিখাতের মতো বিরাজমান।এটি প্রাথমিক পর্যায়ে হ্রদ ছিল বলে শোনা যায়। এই স্থানের পুরান কথিত বর্ণনা পাওয়া যায়। পুরাকালে এখানে এক দৈত্য ক্ষতিকর বিষধর সাপ হয়ে এই হ্রদকে পাহারা দিত। ভগবান শিব সেই সাপকে হত্যা করেন এবং তাঁদের যুদ্ধের প্রাবল্যে হ্রদের জল শুকিয়ে গিয়ে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছায়।এর নিচে সাধারণত স্থানীয় উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষেরা জীবনকে বাজি রেখে জীবিকার তাগিদে মধু সংগ্রহ করতে যায়। 

প্রিয়দর্শিনীঃ
   পাচমারীর প্রধান শহর থেকে প্রায় ৫ কিমি থেকে এই স্থান অপূর্ব মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে ঢাকা ক্যাপ্টেন জে. ফরসিথ এর নামানুসারে ফরসিথ পয়েন্ট নামে জানা থাকলেও স্থানীয় লোকজন একে প্রিয়দর্শিনী নামেই বলে থাকে। এখান থেকেই চৌরাঘর ও মহাদেব পর্বতের উপরে স্থিত মহাদেব মন্দির ও সবুজ উপত্যকা দেখার পাশাপাশি সূর্যাস্তের সময় এখান থেকে ভালো দেখতে পাওয়া যায়। জঙ্গলের মধ্যে এখানে আপনি গলাটা ভিজিয়ে নিতে পারেন স্থানীয় নিম্বু পানি সেন্টারে।

গুপ্তমহাদেবঃ
   পুরাকালে ভস্মাসুর নামে এক প্রচণ্ড শক্তিশালী অসুর তার তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করায় দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে অমরত্ব বর মাগে। কিন্তু মহাদেব সেই বর দিতে নারাজ হলে, অসুর বলেন তাহলে আমাকে এই বর দিন যাতে আমি যার মাথায় হাত দেবো, তৎক্ষণাৎ সে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আপনভোলা মহাদেব তথাস্তু বলে চলে যাচ্ছেন। এমত সময় অসুর ডাক দিল প্রভু দাঁড়াও, তুমি আমায় যে বর দিলে তা ঠিকঠাক কাজ করে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখব তোমার মাথায় হাত রেখে। সেই কথা শোনামাত্র, ভগবান শিব দৌড়াতে দৌড়াতে এসে একটি সংকীর্ণ গুহার মধ্যে লুকান। তাই এই মহাদেবের নাম গুপ্ত মহাদেব। গুহার বেশ কিছুটা অংশ হেঁট হয়ে হেলে এঁকে বেঁকে এগোলে গুহার মধ্যে প্রবেশ করলে তবে গুপ্ত মহাদেবের দর্শন মেলে। একসাথে ৮ জনের বেশী প্রবেশ করা যায় না। যাইহোক গাড়ি থেকে নেমে খানিকটা পথ হেঁটে গুপ্ত মহাদেবে যেতে হয়। এখানে আপনি রামকন্দমুল পেতে পারেন যেটা খেয়ে নাকি ত্রেতাযুগে ভগবান রামচন্দ্র ১৪ বৎসর বনবাসকালে দিন অতিবাহিত করতেন। এর দাম টা একটু বেশি, কারন আদিবাসী লোকজন বনের গভীর থেকে ঝুঁকি নিয়ে তুলে আনেন। স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন। 

বড়মহাদেবঃ
   গুপ্ত মহাদেব থেকে বেরিয়ে বাম দিকে এগিয়ে গেলে দেখতে পাবেন বড় মহাদেবের মন্দির। যখন মহাদেব গুপ্ত হয়ে আছেন তাঁকে প্রকট করার জন্য দেবকুল চিন্তা করেন এবং স্বয়ং নারায়ন এই সমস্যা নিরসনে এগিয়ে আসেন। তিনি অপূর্ব সুন্দরী রমণীর বেশ ধারন করে ভস্মাসুরের সামনে আসলে তার রূপে মোহিত হয়ে অসুর রমণীরূপী নারায়ন কে বিয়ে করতে চান। তখন নৃত্যরতা নারায়ন এই স্থানে এসে তাঁকে বললেন যে আমি যেমনভাবে নৃত্য করবো সেইভাবে তোমাকে নাচতে হবে। অসুর রাজি হয়ে গেল। নারায়ন নাচতে নাচতে নিজের হাত নিজের মাথায় রেখে নাচতে থাকে। তা দেখে অসুর সবকিছু ভুলে রমণীর ন্যায় নিজের হাত নিজের মাথায় রাখার সাথে সাথে ভস্ম হয়ে গেলে গুপ্ত মহাদেব প্রকট হয়ে এইস্থানে অবস্থান করেন। সেই থেকে এখানে মহাদেবের অবস্থান, কিছুটা দূরে পার্বতী দেবীর মন্দিরের অবস্থান। প্রতি বৎসর শিবরাত্রিতে প্রচুর ভক্তসমাগমে ধুমধাম করে শিবপূজা করা হয়। পাচমারীতে গেলে অবশ্যই এখানে ঘুরে আসবেন। সাম্প্রতিককালে একটা ঘটনা সবার নজর কেড়েছে যে, ভারতবর্ষের যে যে রাজনীতিবিদ এখানে পূজা দিতে এসেছে তারা আর নির্বাচনী লড়াইয়ে জয়লাভ করতে পারেন নি। 


জটাশঙ্করঃ 
  পাচমারী ক্যান্টনমেন্ট এর একেবারে পিছনে ভগবান শিবের এই আধ্ম্যাত্মিক ক্ষেত্র বর্তমান। কথিত আছে যে, ভস্মাসুরের ভয়ে শিব এখানেও বেশ কিছুদিন লুকিয়ে ছিলেন। পাললিক শিলাস্তরের মাঝে অর্থাৎ বেলেপাথর ও কংগ্লোমারেট এর মাঝে চুনাপাথরের স্ট্যালাগমাইট এর প্রাকৃতিক শিবলিঙ্গ এখানে দেখতে পাওয়া যায়। এখানকার পাহাড়ের গঠন অনেকটা শতমাথা বিশিষ্ট শেষনাগের ফণার ন্যায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিলারাজি দেখতে অনেকটা শিবের জটার ন্যায় দেখতে। শিবের পাশাপাশি দেবী পার্বতীও ভক্ত কর্তৃক পূজিত হয় এখানে। তাই এই স্থানের নাম জটাশঙ্কর। পাচমারীর এই স্থান পর্যটক টানতে ভালো ভূমিকা গ্রহণ করেছে। 

পান্ডব গুহাঃ
   পাচমারী শহর থেকে কয়েক কিমি গেলেই সেভেন পয়েন্ট ক্রসিং। সেখান থেকে কিছুটা দূরে গেলেই এ স্থানের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র পাণ্ডব গুহা। কথিত আছে যে আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে অর্থাৎ মহাভারতের সময়কালে পাশা খেলায় হারার পরে পাণ্ডবরা পাঁচ ভাই ১২ বছর বনবাসকালে এই স্থানে বেলেপাথরের পাঁচটি গুহা নির্মাণ করে বেশ কিছু বছর বসবাস করেন। স্থানীয় ভাষায় পাচমারী কথার অর্থ পাঁচটি গুহা। পৌরাণিক ব্যাখ্যা যাই হোক, এই স্থান কিন্তু দারুন মনোরম পরিবেশ ও গুহার সামনের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ ফুলের বাগান আলাদা সৌন্দর্য বর্ধন করছে। ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ ও ভূতাত্ত্বিক বিভাগ গবেষণা করে দেখেন যে, গুহা সন্নিহিত শিলা পরীক্ষা করে দেখেন যে এই শিলার বয়স মহাভারতের সমসাময়িক নহে। বরং গুহার আকার বা গুহা মধ্যস্থ চিত্রকলা বৌদ্ধসংস্কৃতিকে তুলে ধরছে। হিন্দু বা বৌদ্ধ সংস্কৃতি যাই হোক না কেন এই গুহা বা গুহার মাথায় উঠলে পাচমারী শহরের একটা অভূতপূর্ব  প্যানোরামিক ভিউ পাবেন। গুহা গুলির দরজা করে বন্ধ রাখা থাকে, কারন পর্যটকরা অনেকেই গুহার দেওয়ালে নিজের নাম খোদাই করে দিয়ে গুহার পুরাতাত্ত্বিক মাধুর্য নষ্ট করছে। ধর্মপ্রাণ মানুষ এখানে এলে কিছুক্ষনের জন্য ভাব জাগে, আবেগপ্রবন হয়ে পড়েন। পাচমারী শহরের নামকরণ যার কারনে সেই স্থানে না ঘুরে এলে পাচমারী ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যেতে পারে। তাই একবার সময় করে ঘুরে আসতে হবে। 

বাইসন লজ মিউজিয়ামঃ
   পাণ্ডব গুহা থেকে বেরিয়ে সোজা বাইসন লজ মিউজিয়ামে চলে যান। সেখানে এই সাতপুরা পর্বতের মহারানী পাচমারীর জীববিচিত্র নিয়ে এক অসাধারন সংগ্রহশালা পেয়ে যাবেন। বোটানি ও জুলজি নিয়ে যারা পড়াশোনা করে তাঁরা এখানে এলে অনেক কিছু জানতে পারবেন। ১৮৬২ সালে যখন ক্যাপ্টেন জে. ফরসিথ পাচমারী আবিস্কার করেন তার ঠিক পরে পরেই এই বাইসন লজ তৈরি করেন। এখানকার আদিবাসীরা বাইসনকে দেবতার মতো পূজা করে থাকে। এই পাচমারীর জঙ্গলে প্রচুর বাইসন রয়েছে। এখানকার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের কারনে মধ্যপ্রদেশের সরকারী বাসভবনসহ রাজধানী ছিল। বর্তমানে আপনি এই চত্বরে রাজভবনও লক্ষ্য করা যায়। শহরের প্রাচীন গির্জার অবস্থানও এখানে।  

প্যারাস্লাইডিং
   বাইসন লজ মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে সেভেন পয়েন্ট ক্রসিং থেকে সোজা পশ্চিম দিকে গেলে ঘন বনভুমির মাঝে অনেকটা জায়গা বন কেটে বিভিন্ন রাইডিং এর ব্যবস্থা আছে। একটু পকেটে টান পরলেও আপনি প্যারাস্যুট, রোপওয়ে, বাইকিং করার এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। পাহাড়ের মাথায় জঙ্গলের মাঝে এ এক অন্যরকম অনুভূতি।   

যমুনাপ্রপাত বা বি-ফলঃ
   পাচমারীর সবুজে মোড়া গ্রীন ভ্যালি ও পাহাড়ে ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে অনাবিল আনন্দে অবিরাম কলকল ধ্বনিতে গুনগুনিয়ে গান শুনিয়ে চলেছে নর্মদার কিছু জলধারা বা জলপ্রপাত।তেমনি আপনি যদি আর একটু জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যান তাহলে দেখতে পাবেন এই জলধারা এবং আরও একটু এগিয়ে গেলে উপর থেকে দেখতে পাওয়া যাবে এই মনোরম জলপ্রপাতের আপাদমস্তক ছবি। যদিও এই ভিউপয়েন্ট সুইসাইড পয়েন্ট এর মতো বিপজ্জনক বটে। ডানদিকে এগিয়ে গেলে প্রায় ৪৩২ টি সিঁড়ি পেরিয়ে নেমে গেলে জনপ্রিয় ৩৮ মিটার উচ্চতার বি-ফলস এর একেবারে পাদদেশে যাওয়া যায়। একটু কষ্টসাপেক্ষ হলেও উপভোগ্য। এখানে পর্যটকরা স্নান করে পুন্য অর্জন করেন। শোনা যায়, এখানে মৌমাছির প্রাধান্য থাকায় এই জলপ্রপাতের এরুপ নামকরণ। পূর্বে এই জলপ্রপাতের নাম ছিল যমুনা প্রপাত। এখান থেকে পাচমারীর বিস্তীর্ণ এলাকার পানীয় জল সরবরাহ করা হয়ে থাকে। যাইহোক, বাঙ্গালীদের কাছে এখানকার মধুর স্বাদ সুন্দরবনের মধু থেকে পৃথক স্বাদ প্রদান করে থাকে। আপনারাও মধু সংগ্রহ করতে ভুলবেন না।   


ধুপগড়ঃ
   চলুন এবার যাওয়া যাক সাতপুরা রেঞ্জের পাচমারী পর্বতের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গে। ধুপগড় সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ১৩৫২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এখান থেকে পুরো পাচমারী শহরসহ জঙ্গল ও পাহাড়সমূহ খুব সুন্দরভাবে দেখতে পাওয়া যায়। কথিত আছে মধ্যভারতের এই স্থানে সবথেকে বেশী সময় ধরে সূর্যালোক (ধূপ) পতিত হয়। এই স্থান (গড়) থেকে খুব সুন্দর পর্যবেক্ষণ করা যায় বলে এর এরূপ নামকরণ। আপনি সাত সকালে বা বিকালের দিকে গাড়ি ছুটিয়ে চলে যান যথাক্রমে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য। একটি পয়েন্ট একেবারে পূর্বদিকে তো সানসেট পয়েন্ট একেবারে পশ্চিমদিকে। এ স্থানে একটি ছোট মিউজিয়াম আছে। পথে যাওয়ার সময় আপনি সাতপুরা রেঞ্জের একটা চোখ জুড়ানো ব্রড ভিউ পাবেন। আপনাকে মনে রাখতে হবে সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথেই গাড়িতে উঠে সোজা স্থান ত্যাগ করতে হবে নিরাপত্তার কারনে। কারন অন্ধকার নামলে বাইসন সহ বিভিন্ন বন্য জানোয়াররা বেরিয়ে পড়ে।   



রচনাকাল : ১৫/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 9  China : 15  France : 1  Germany : 1  India : 139  Ireland : 7  Romania : 1  Russian Federat : 15  Saudi Arabia : 6  Sweden : 11  
Taiwan : 1  Ukraine : 10  United States : 155  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 9  China : 15  France : 1  Germany : 1  
India : 139  Ireland : 7  Romania : 1  Russian Federat : 15  
Saudi Arabia : 6  Sweden : 11  Taiwan : 1  Ukraine : 10  
United States : 155  
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
নর্মদার তীরে তীরে (পাচমারি অধ্যায়) by Sanat Kumar Purkait is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৩৭৭৩৮২
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী