নর্মদার তীরে তীরে (মন্দির ও নদী মাহাত্ম্য)
আনুমানিক পঠন সময় : ৬ মিনিট

লেখক : সনৎকুমার পুরকাইত
দেশ : India , শহর : ডায়মন্ডহারবার

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ৯৭ টি লেখনী ৪০ টি দেশ ব্যাপী ৩৭৩৫৯ জন পড়েছেন।
Sanat Kumar Purkait
ভূমিকাঃ
 ভারতীয় উপমহাদেশে যে সকল নদনদী বর্তমান তার মধ্যে এই নর্মদা হল পঞ্চম দীর্ঘতম নদী এবং কেবলমাত্র ভারতের মধ্যে যে নদীগুলি প্রবাহিত তার মধ্যে তৃতীয় দীর্ঘতম হল এই নর্মদা। অর্থাৎ গোদাবরী ও কৃষ্ণার পরেই নর্মদার স্থান। এই নর্মদাকে তার অসামান্য অবদানের কারনে মধ্যপ্রদেশের জীবন রেখা বলা হয়ে থাকে। মধ্যপ্রেদেশের অনুপপুর জেলার সাতপুরাপর্বতমালারঅমরকণ্টক মালভূমি তথা পর্বতশৃঙ্গ থেকে উৎপত্তি লাভ করে প্রায় ১৩১২ কিমি পথ অতিক্রম করে সাতপুরা ও বিন্ধ্য পর্বতমালার মাঝখান দিয়ে পশ্চিমবাহিনী হয়ে আরব সাগরের খাম্বাত উপসাগরে মিলেছে। এই নদী দক্ষিণ ও উত্তর ভারতকে মাঝ বরাবর পৃথক করে রেখেছে। অমরকণ্টক কে ভারতের পর্যটন মানচিত্রে জায়গা করে দিয়েছে এই নর্মদা নদী ও নদী কেন্দ্রিক সভ্যতা ও সংস্কৃতি। তাই তপোভূমি নর্মদা সম্পর্কে জানতে হলে অমরকণ্টক সম্পর্কে জানা জরুরী। তাই এবারের কাহিনী অমরকণ্টক থেকে শুরু করা হল। হাওড়া থেকে আজাদ হিন্দ এক্সপ্রেসে চড়ে সোজা বিলাসপুর স্টেশন। সেখান থেকে প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত রাস্তা ধরে আমাদের স্করপিও এগিয়ে গেল অমরকণ্টকের পথে। এ পথের আকর্ষণ একেবারে আলাদা। পাহাড়ি পথের দুধারে অজস্র গাছ। গিরিখাত আর গাছগাছালির বিচিত্র বিন্যাস। বাতাসের গুনগুনানি আর মহুয়ার নেশায় মাতাল হওয়ার মতো বুঁদ হয়ে পৌঁছে গেলাম সেখানে, ঠিক যেখানে সাতপুরা, বিন্ধ্য ও মৈকাল পর্বতের সন্ধিস্থল- সতীপীঠ অমরকণ্টক, তপোভূমি  নর্মদার উৎসস্থল। রামায়ন, মহাভারত থেকে শুরু করে মার্কণ্ডেয় পুরান এমনকি মহাকবি কালিদাসের মেঘদুত কাব্য রচনায় জায়গা হয়েছে এই অমরকণ্টকের। নারদ মুনি, বশিষ্ঠ, দুর্বাসা, ভৃগু মুনির ন্যায় ঋষিরা এই অমরকণ্টকে তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেন। এ হেন স্থানে পৌঁছে নর্মদা মাহাত্ম্য অনুভব করে আপনিও মহাভাবে নিমজ্জিত হবেন। আমরা এখন নর্মদার উৎসস্থলে দাঁড়িয়ে। তাই আমরা এই সুযোগে নর্মদাকে চিনে নেব।  

নর্মদাঃ 
                             গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতী
                        নর্মদে সিন্ধু কাবেরী জলেহস্মিন সন্নিধিং কুরু।।
আমরা জানি পূজা অর্চনা তর্পণাদিতে আচমন ও আসন শুদ্ধির পর জলশুদ্ধির উপরোক্ত মন্ত্র পাঠ করতে হয়। কারণ গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, সরস্বতী, নর্মদা, সিন্ধু ও কাবেরী- এই সাত নদীকে ভারতবর্ষের সবচেয়ে পবিত্রতম নদী বলে মানা হয়। আর নর্মদা এই সমস্ত নদীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। গঙ্গা উপাসনার নদী, সরস্বতী জ্ঞানের নদী আর নর্মদা হল তপস্যার নদী। স্কন্দপুরান অনুযায়ী সরস্বতীর জলে তিন দিন, যমুনার জলে সাত দিন আর গঙ্গার জলে একদিন স্নান করলে পবিত্র হয়। কিন্তু নর্মদার জল কেবলমাত্র দর্শন করলেই পবিত্রতা আসে। শুধু তাই নয়, নর্মদার তট হল তপস্যার উত্তম ভূমি। নর্মদা তটে তপস্যা করলে অন্য যে কোন তপস্যার থেকে অধিক এবং দ্রুততর ফল লাভ হয়। তাই প্রাচীন কাল থেকে সমস্ত মুনি ঋষিরা তাঁদের সাধনক্ষেত্র হিসাবে নর্মদা তটকেই বেছে নিয়েছেন। এই ধরিত্রির উপর দিব্য ব্রহ্মনদী ও বিষ্ণুনদী বিদ্যমান। কিন্তু একমাত্র রুদ্র নদী ‘নর্মদা’। নর্মদা নদীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা। রুদ্রের তেজ থেকে উৎপন্ন এই নদী স্থাবর জঙ্গম সবকিছু তিনি ত্রান করে সর্ব সিদ্ধি প্রদান করেন। আর এই নর্মদার উৎসস্থল হিসাবে ভারতের তীর্থভূমির মধ্যে অমরকণ্টক একটি অন্যতম পবিত্র তীর্থ। যা সনাতন ঋষি, মুনি, সাধু, সন্তু, মহাত্মা তীর্থ অভিযাত্রীদের যুগ যুগ ধরে আহ্বান করে চলেছে। 

মহাভারত, স্কন্দপুরান সহ বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে এই নর্মদার মাহাত্ম্য উল্লেখ থাকলেও এখানে আমরা বিশদ আলোচনায় যাচ্ছি না। শুধুমাত্র এটুকুই জেনে রাখা দরকার যে নর্মদা ভারতের অধ্যাত্মজগতের এক বিরাট অধ্যায়। এমনকি সপ্ত কল্পের অবসানকালেও নর্মদা অক্ষত ছিল। তিনি লাস্যময়ী রুদ্রজা, চন্দ্রনিভাননা, পদ্মপলাশলোচনা, শীলাবতী, সুশোভনা লাবণ্যময়ী এক অপরূপা কুমারী যার প্রেমে পাগলপারা। তিনি পিতা শিব শঙ্করের কাছে প্রার্থনা করেন, ‘আমি যেন ঠিক এইভাবে চিরকাল আপনার সাথে নিত্যযুক্ত থাকতে পারি। হে প্রভো! প্রলয়কাল উপস্থিত হলে যখন স্থাবর জঙ্গম বিনষ্ট হবে আমি তখন যেন অক্ষয়া হই। সমস্ত পর্বত, নদনদী, সাগর যখন লয়প্রাপ্ত হবে তখনও আমি যেন বিলুপ্ত না হই। হে প্রভো! যে সকল পাতক, উপপাতক ও মহাপাতক ভক্তিযুক্ত হয়ে আমার জলে অবগাহন করবে তারা যেন কলুষ মুক্ত হয়। দেবগণ সর্বদা যেন আমার পূজা করেন। হে পিতা, যারা ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপ করবে তারাও যেন আমার জলে অবগাহনমাত্রই  পাপমুক্ত হতে পারে। সকল যজ্ঞানুষ্ঠানের যে ফল, আমার জলে অবগাহনে যেন মানুষ সেই ফল লাভ করে। দান, উপবাস, তীর্থ ভ্রমণে যে ফল লাভ হয়, আমার জলে স্নান করলে যেন সেই ফল লাভ হয়। আমার তীরে যারা আপনার অর্চনা করবে তারা যেন মৃত্যুর পর আপনার লোকে অর্থাৎ শিবলোকে গমন করে। হে নিখিলদেব আপনি মাতা উমার সাথে আমার তীরে সর্বদা বাস করুন। আপনি যদি আমায় বর দানের যোগ্য বলে মনে করেন, তবে আমি যেন মহাপাতকনাশিনী বলে ত্রিভুবনে খ্যাত হই’।

নর্মদা বিভিন্ন নামে বিভিন্ন সময়ে অভিহিত হয়েছেন। স্কন্দপুরান মতে নর্মদার অপর নাম রেবা। রেবা নামের পিছনে অবশ্য দুটি পৃথক কাহিনী বর্তমান। তা অন্য সময় ব্যাখ্যা করা যাবে। তিনি সকল পাপনাশিনী বলে তাঁর নাম বিপাপা।  আবার মানুষের দুঃখ মোচন করেন বলে তিনি বিপাশা। নর্মদার জল নির্মল, বিমল। প্রলয়ের সময় জগত তমোময় হলেও নর্মদা মহাপ্রভাময়ী ছিলেন তাই পণ্ডিতগণ ‘বিমলা’ নামেও ডাকেন। নর্মদা ক্ষরিত হয়ে প্রবাহিত হলে বিশ্ব মুদিত হয় তাই লোকে ‘করভা’ বলে। নর্মদা দর্শন মাত্রই ত্রিলোক রঞ্জিত হয়, এই লোকরঞ্জনের জন্য নর্মদার অপর নাম ‘রঞ্জনা’।

‘নর্মদারাং তপঃ কুর্যাৎ শরণং জাহ্নবী তটে’ – অর্থাৎ গঙ্গাতীরে মৃত্যু হলে জীবের উচ্চগতি হয় কিন্তু তপস্যায় সিদ্ধি লাভ করতে হলে একমাত্র নর্মদার তটই শ্রেষ্ঠ। তাই নর্মদার তটকে তপভূমি বলে। এই তটে তপস্যা করলে অন্য স্থানের থেকে দ্রুত এবং শতগুণ বেশী ফল পাওয়া যায়।
                   গঙ্গা কনখলে পুণ্যা কুরুক্ষেত্রে সরস্বতী।
                   গ্রামে বা যদিবারণ্যে পুণ্যা সর্বত্র নর্মদা।।
গঙ্গার পুণ্য মহিমা হরিদ্বারের কনখলে বেশি কারণ সেখানে প্রজাপতি দক্ষ যজ্ঞ করেছিলেন। সরস্বতী নদীর নানাস্থানে বৈদিক ঋষিরা বেদপাঠ যজ্ঞাদি করলেও কুরুক্ষেত্রেই সরস্বতীর মহিমা সর্বাধিক। কারণ কুরুক্ষেত্রেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বিশ্বরূপ দর্শন করান। কিন্তু নর্মদার জল উদ্গম থেকে মোহনা পর্যন্ত সব জায়গাতেই সমান মহিমাপূর্ণ। নর্মদার সংগমে কোনও স্থানে যেখানে অন্য কোনও নদী এসে মিলিত হয়েছে সেই স্থানে যদি জপ, তপ, স্নান, দান, হোম, বেদপাঠ, পিতৃ পূজন, দেবতার আরাধনা, মন্ত্রোপদেশ, সন্ন্যাস এবং দেহত্যাগ হয় তাহলে সেই কর্মের ফল তৎক্ষণাৎ প্রাপ্ত হয়। নর্মদার তীরে প্রায় ৬৪,০০০ তীর্থ রয়েছে। তীর্থযাত্রীদের নিকট নর্মদা পরিক্রমা একটি মহাপুন্যের কাজ। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে নর্মদার উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত পদব্রজে পরিক্রমা করে ফেরত আসতে মোট সময় লাগে ৩ বছর ৩ মাস ১৩ দিন। এই নর্মদার উপর বাঁধ নির্মাণ নিয়ে পরিবেশবিদদের নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন সাম্প্রতিক অতীতে ভারতীয় রাজনীতির শিরোনামে চলে আসে। এবারে একটু মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করা যাক। 
রচনাকাল : ১৫/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 7  Cambodia : 1  Canada : 57  China : 12  France : 1  Germany : 5  Hungary : 3  Iceland : 6  India : 532  Ireland : 7  
Japan : 2  Russian Federat : 17  Sweden : 10  Ukraine : 9  United States : 443  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 7  Cambodia : 1  Canada : 57  China : 12  
France : 1  Germany : 5  Hungary : 3  Iceland : 6  
India : 532  Ireland : 7  Japan : 2  Russian Federat : 17  
Sweden : 10  Ukraine : 9  United States : 443  
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
নর্মদার তীরে তীরে (মন্দির ও নদী মাহাত্ম্য) by Sanat Kumar Purkait is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৪৮৪১৯৬
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী